প্রকাশিত, নতুন বই, 'নিঃসঙ্গ সম্রাট ও অন্যান্য নাটক'।
১৯৯৫ সালে বহরমপুর যুগাগ্নি নাট্যদলের জন্য ব্রেশটের নাটকের আত্তীকরণ করে কৌশিক লেখেন 'মা অভয়া' এবং ১৯৯৭ সালে কলকাতায় মঞ্চস্থ হয় কৌশিকের লেখা আর একটি নাটক 'নগরকীর্তন'। সদর মফস্বলে দুটি নাটকই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। নাটক রচয়িতা হিসেবে কৌশিক পরিচিতি লাভ করেন।
মৌলিক, অনুবাদ এবং আত্তীকৃত মিলিয়ে প্রায় ২৫টি নাটক লিখেছেন কৌশিক। তার মধ্যে অনেকগুলি নাট্যকোলাজ।
'ব্রেশটের খোঁজে' একটি নাট্যকোলাজ। গ্রথিত হয়েছিল ব্রেশটের শতবর্ষ উপলক্ষে ১৯৯৮ সালে। এটি আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হয়, মঞ্চস্থ হয় নান্দীকারের প্রযোজনায় এবং প্রকাশিত হয় নন্দন পত্রিকার বিশেষ ব্রেশট সংখ্যায়।
ব্রেশটের খোঁজে
প্রথম প্রবাহ
" যুদ্ধ! যুদ্ধ! যুদ্ধ! প্রতিবছর লাফিয়ে বাড়ছে প্রতিরক্ষার বাজেট। অস্ত্র সম্ভারে সারা দুনিয়ার মধ্যে আমরা এখন চার নম্বরে! ওদিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের আলোচনা ভেস্তে যেতে বসেছে। ওয়াশিংটনের সবকটা কাগজ চিৎকার করছেঃ সাদ্দামের মুণ্ডু চাই! বোমা বর্ষণ ক'র ওর প্রাসাদে। ইয়েলেৎসিন বলছেন, তৃতীয় মহাযুদ্ধের আর দেরী নেই!
এই আগুনের মধ্যে বসে আমরা এমন একজনের কথা বলতে চাই, যিনি পথ হেঁটে ছিলেন দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে।মন্ত্রের মতো জপ করেছিলেনঃ গ্লোটস নিখশট জো রোমান্টিস! যুদ্ধকে ভুলেও যেন রঙীন চশমা দিয়ে দেখ না। তার নাম বের্টোল্ট ব্রেশট।বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নাট্য ব্যক্তিত্ব।
- “ আমি বের্টোল্ট ব্রেশট। কৃষ্ণ অরণ্যের মানুষ।
আমি যখন মায়ের পেটে , তিনি আমায় বয়ে এনেছিলেন
এই শহরে। আর আমি বয়ে চলি
সেই অরণ্যের হিম উত্তরাধিকার
বয়ে চলব, যতদিন মৃত্যু না হয়।”
তাঁর সময়ে সভ্যতা ছিল জঙ্গলের চেয়েও হিংস্র। তাঁরই দেশ জার্মানিতে জন্ম নিয়েছিলেন হের ফুয়েরার অ্যাডলফ হিটলার, জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন লাইব্রেরি। জার্মান পার্লামেন্ট আর মাত্র ষাটলক্ষ ইহুদীর লাশ!
বের্টোল্ট ব্রেশট। যাঁকে ফ্যাসিস্ত জার্মানি থেকে পালাতে হয়েছে রাতের অন্ধকারে। আক্রান্ত হতে হয়েছে ডেমোক্রাটিক আমেরিকায়। কম্যুনিস্ট রাশিয়ায় যাঁর ঠাঁই মেলে নি। স্যোসালিস্ট বার্লিনে শেষ নিশ্বাস ফেলার সময়ও যিনি খাক হয়েছেন স্বপ্নভঙ্গের গ্লানিতে।
ব্রেশটকে বাঁচতে হয়েছিল রক্তে পিছল দড়ির ওপর দিয়ে ব্যালান্স করতে করতে । নিজের ভাঙতে- গড়তে - আবার নতুন করে ভাঙতে হয়েছিল বারবার । কিন্তু তিনি মানুষের জন্য স্বপ্ন দেখার অভ্যাস হারান নি।
কিন্তু এমন কেন হবে ? বের্টোল্ট ব্রেশট পৃথিবীরদ্দ শ্রেষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্বের মধ্যে একজন, কেন কোনও শহরই হয়ে উঠবে না তাঁর আশ্রয় ? কেন নিজের দেশ থেকে তাঁকে পালাতে হবে রাতের অন্ধকারে, আর সেই গ্লানি বয়ে চলতে হবে সারা জীবন ? চেকোশ্লাভিয়া- ডেনমার্ক-সুইডেন-ফিনল্যান্ড- সেখান থেকে আমেরিকা। হলিউডের কারখানায় ‘রঙিন মিথ্যে’ সরবরাহ করার কাজ নিতে হবে তাঁকে । স্রেফ পেটের ধান্ধায় ! গ্লানি বাড়বে আরও। কেন তাঁকে তাড়া করবে মৃত্যুর আশঙ্কা! শত্রুর বেয়নেট ! এমনকি যাদের বন্ধু বলে ভাবছেন তাদের হাতেও উঠে আসবে ধারালো গুপ্তি ! শেষ জীবনে। প্রিয় বার্লিনে ফিরে আসার পরেও, কেন শান্তি মিলবে না তাঁর ? টিকে থাকার লড়াই চালাতে চালাতে প্রাণপণে জপ করবেনঃ আমাদের স্বপ্নগুলো যেন না মরে !
-“ জানি এই সময়ের হাতে আমরা যন্ত্র।
জানি শেষ ধ্বংসের পর আর কিছুই থাকবে না।
তবু, যেদিন আসবে, সেদিন আমি যেন শান্তিতে
শেষ টান মারতে পারি চুরুটে।
হাসতে হাসতেই ঝেড়ে ফেলতে পারি শেষ ছাইটুকু।
আমি বের্টোল্ট ব্রেশট, যে অরণ্যকে বুকের মধ্যে
বয়ে নিয়ে চলেছি, আজীবন।”
-‘সভ্য’ শহরে বাস করেও তিনি ভুলতে পারছেন না জঙ্গলকে। কারণ তাঁর সময়ে ‘সভ্যতা’ হয়ে উঠেছিল জঙ্গলের চেয়েও আদিম ! জন্তুর চেয়েও হিংস্র। তাঁর জন্মের একশ বছর পর, আজও কি আমরা এমন শহর বানাতে পেরেছি, যেখানে বসে তিনি বলতে পারতেন-
-“এসো, আমরা বর্ম আর শিরস্ত্রাণ খুলে বসি।
এসো দোস্ত, গেলাসে গেলাস ঠেকিয়ে কথা বলি জীবন বিষয়ে,
নিশ্চিন্তে। কারণ, মানুষের সৃষ্টিকে ধ্বংস হতে দেব না-
এই কথাটা, দুনিয়ার কোনো প্রান্তেই
আজ আর ঠাট্টার মত শোনায় না।”
- না। তেমন দিন আজও আসেনি। তাই ব্রেশটের অভিজ্ঞতা আজও প্রাসঙ্গিক।
দ্বিতীয় প্রবাহ
১৯১৮- ১৯৩৩
-" আমি জন্মেছিলাম আউগস্ বুর্গে "......
- জার্মানির আউগস্ বুর্গ। বাভারিয়া অঞ্চলে । ১৮৯৮ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি।
-" আমি জন্মেছিলাম আউগস্ বুর্গে ।
বড় হচ্ছিলাম , যাকে বলে বেশ শাঁসেজলে।
বাপ মা আদর করে গলায় বেঁধে দিয়েছিলেন সাদা কলার ।
আমি শিখেছিলাম কেমন করে হাঁক পাড়তে হয় চাকরকে
কেমন করে আদায় করতে হয় তার সেবা।”
- সেই শিক্ষা কিন্তু কাজে লাগেনি। ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। রাজার হুকুমে যত জোয়ান ছেলে ঘর সংসার ছেড়ে যুদ্ধে চলে। যুদ্ধে যেতে হবে ব্রেশটকেও। প্রভাবশালী বাবা ওপর মহলে কলকাঠি নাড়ায় তরুণ ব্রেশট ফ্রন্টে যাওয়া থেকে ছাড় পেলেন। তাঁর ঠাঁই হল মিলিটারি হাসপাতালে অর্ডারলি হিসেবে।
যুদ্ধ ফেরত জিন্দা লাশদের শুশ্রূষা করতে করতে তিনি টের পাচ্ছিলেন, সেনা কাপড় রক্তে মাখা। সেই জন্যই তো রাজপতাকার রঙে তাকে রঙ করেছে। ঝলমলিয়ে সং চলেছে। লাশ চলেছে।
- ১৯১৮ সাল এই চিরপরাজিত 'শহীদ'দের জন্য ব্রেশট লিখছেন : 'মরা সৈনিকের গান'।
যুদ্ধ চলেছে যুদ্ধ
পাঁচ বসন্ত পার।
শান্তির দেখা নেই দিগন্তে কোথাও
সৈনিক করবে কি আর?
বীরের মতন মরে যাওয়া তার কাজ
তাই সে মরে যায় ।
বসন্ত আসে , বসন্ত হায়! যুদ্ধ চলছে যুদ্ধ !
রাজা বলেন “ খুব জানি,
তোদের এসব শয়তানি।
সময় হবে, মরবি তবে। কামচোরদের বিচার হবে”
রাজা ভীষণ ক্রুদ্ধ! যুদ্ধ চলেছে যুদ্ধ। …………
-যুদ্ধ তো এখনও চলছে। ঠাণ্ডা কিংবা গরম।
- অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ইরাকের সঙ্গে নাকি চুক্তি করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। কিন্তু আমেরিকার বানিয়ারা তা মানতে রাজি নয়।২৪শে ফেব্রুয়ারি’৯৮ ওয়াশিংটনের সবকটা বড় কাগজ হুংকার দিয়েছেঃ ইরাকি সরকার ফেলে দাও! সাদ্দাম হোসেনের মুন্ডু চাই ! বোমাবর্ষণ করো প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে।
গ্রীষ্ম আসে গ্রীষ্ম যায়, সেনার গোরে ঘাস গজায়
জুতোয় পিষে গোরের ঘাস, আসছে কারা ? উরিব্বাস !
আসছে রাজার মেডিকেল টিম
তদন্ত করতে সরজামিন।
তদন্ত হবে তাই খোঁড় কবর, মন্ত্র প’ড়ে বেলচা ধর।
মুর্দাটাকে তুলে নে খাড়া ক’রে দে লাইনে ।
বদ্যিরা সব দিলেন রায়, রাজার কাছে খবর যায়
জোয়ান সেনার তাগদ খুব
কিন্তু ভয়ে এ ডরপুক চল ব্যাটা
গোরে শুয়ে কাটায় কাল! যুদ্ধে, কদমতাল্।
ঘাস বিচালি ঘাস
যুদ্ধে চলে জিন্দালাশ।
ঘাস বিচালি ঘাস।
যুদ্ধ চলেছে, যুদ্ধ !......
- যুদ্ধ তো সেই ইরাকে।এখানে তো নয়।
- কেন? ইয়েলেতসিন কি বলেছে শোনেন নি? ইরাক ইস্যুতে গোটা বিশ্বের মেরুকরণ হয়ে গেছে। যদি লড়াই বাঁধে , সেটা হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
মধ্যরাতের তারারা আকাশে দেয় পাহারা
দেখে সেনার বৌটাকে।
বৌয়ের পেটে দানা নেই, পরনে তার ত্যানা নেই,
আনছে টেনে বৌটাকে।
কান্দে কুকুর ইন্দুরে, হাড়মাস সব হলে পাচার
পেট ভরাবে কি ক’রে ?
কিন্তু রাজার খিদে নিশ্চয়ই কুত্তার চাইতে বড়
এই মিছিলে ঝান্ডা তুলে সবাই লেগে পড়ো।
বুড়ো হাবড়া পঙ্গু খোঁড়া ছেলে ছোকরা শুদ্ধ।
যুদ্ধ চলেছে যুদ্ধ !
গোরের কাপড় রক্ত মাখা, সেজন্যই তো রাজপতাকার-
রঙে তাকে রং করেছে।
ঝলমলিয়ে সং চলেছে।
লাশ চলেছে- লাশ চলেছে।
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম যায়
ঝাঁঝর কর্তাল ঢোল বাজায়
ভপর পোঁ ভপর পোঁ পম্ পম্ পম্ ..........
- বেশ, না হয় বিশ্বযুদ্ধই বাঁধলো। আমরা তো তাতে যোগ দিচ্ছি না।
- অস্ত্র-শক্তিতে , সারা দুনিয়ায় ভারতের অবস্থান জানেন? চার নম্বরে। তার আগে মাত্র তিনটে দেশ। এত অস্ত্র জমা হচ্ছে কার পয়সায় ?
-আমার।আমাদের।
- কিন্তু কেন ?
জ্ঞানীজনে লিখে গেছেন পাতার পরে পাতা
দেশের ডাকে শহিদ হওয়া নয়কো সহজ কথা।
কেতাবে যা আছে লেখা মেনে চলা চাই,
দেশ বাঁচাতে লাশের সাথে
হাঁটতে হবে তাই।
তারারা নেই আকাশে
ভোরের আলো ফ্যাকাশে
সূয্যি মামা তুলছে হাই
বীরের মরণ মরতে যাই-
ভ্যাপর পোঁ ভ্যাপর পোঁ পম্ পম্ পম্।
-প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ । নায়ক হতে গিয়ে খলনায়ক বনে গেল জার্মানি। দেশ জুড়ে নেমে এলো অকালসন্ধ্যা। শেয়ার বাজার ধ্বসে পড়েছে। উৎপাদনের হার দ্রুত কমে গেছে প্রায় চল্লিশ শতাংশ। ছোট-মাঝারি কলকারখানাগুলো দেউলিয়া। তেতাল্লিশ শতাংশ শ্রমিক বেকার। আর তখনই- শিল্পসংস্কৃতির মহানরসিক অ্যাডলফ হিটলার, গান ছবির জগৎ থেকে পায়চারি শুরু করলেন রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে।
- প্রায় বিশ বছর পরে, ১৯৪১ সালে, হিটলারের এই উত্থানকে ব্রেশট ফিরে দেখতে চেয়েছিলেন একটি রূপক নাটকঃ রেজিসটেবল রাইজ অফ আরতুরো উই । আরতুরো উই-এর উত্থান, যা প্রতিরোধ করা যেত।
-“ আমাদের নায়ক আরতুরো উইকে আপনাদের চেনা লাগতে পারে ।কারণ ওকে গড়া হয়েছে শিকাগোর বিখ্যাত মাফিয়া আলকাপোনের আদলে। আমার নাটকের কিছুই বানানো নয় ।শিকাগোর ব্যবসায়ীরা বাজারের সংকট মেটানোর জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল। সেই ষড়যন্ত্রকে আড়াল ক’রে যাতে লুঠমারি চালু রাখা যায়, তাই ভাড়া করেছিল আলকাপোনেকে। সেই সুযোগে মানুষকে প্রোটেকশন দেওয়ার নামে সে নিজের রাজত্ব বিস্তার শুরু করে । কুকর্মের সাক্ষীরা খুন হয়ে যায়। সাংবাদিকরা নিখোঁজ হয়ে যায় ।বেকসুর লোকেরা জেলে যায়। কারা যেন আগুন লাগিয়ে দেয় শিকাগোর সবজি বাজারে। ব্যবসা বাঁচানোর জন্য সবাই যখন মাফিয়া সর্দারের কাছে নতজানু, আলকাপোনে নিজের ভবিষ্যৎ ছকে ফেলেছে।”
- কিন্তু এর সঙ্গে তো হিটলারের আশ্চর্য মিল।
- “হ্যাঁ,আপনার মনে পড়তেই পারে জার্মান পুঁজিবাদের সংকটের কথা, সেই সুযোগে ফুয়েরারের আত্মপ্রকাশ, রাইখস্ট্যাগের অগ্নিকাণ্ড ! কিন্তু আমি সেজন্য দায়ী নই। ইতিহাস নিজেই এই রসিকতা করেছে।”
- এখন প্রশ্ন হল, ডাকাতের ইতিহাস যদি ফুয়েরারের ইতিহাসের সঙ্গে মিলে যায়, সেই চমকপ্রদ সত্যিটাকে চোখের উপর দেখতে দেখতে, আমরা কি হেসে উঠব ? আতঙ্কে হিম হয়ে যাব? নাকি ভাববো প্রতিরোধের কথা ?
১৯২০ সালে প্রথম বার্লিন বেড়াতে গেলেন ব্রেশট, শহরের মারদাঙ্গা দেখে ভড়কে গিয়ে পালিয়ে গেলেন ঘরে। এই তাঁর পালানোর শুরু। সারা জীবন ধরে জুতোর পাটির চেয়ে বেশিবার দেশ পাল্টাতে হবে তাঁকে। শেষ বার ঘরে ফিরেও থাকবেন নিজগৃহে পরবাসী।
ব্রেশট এর মধ্যে নাটক লেখা শুরু করেছেন- বাআল, ড্রামস ইন দ্য নাইট, সিটি অব মেহগনি। জার্মানিতে তখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ভাঙচুর। এমনকী চিন্তার জগতেও সংকট। শহর শাসন করছে মাফিয়া, দালাল, বেশ্যা, মুনাফাবাজ পুঁজিপতিরা। এই নৈরাজ্যের মদকে ব্রেশট পুরে দিলেন একসপ্রেশনিসমের পুরনো বোতলে।কিন্তু সমকালের আয়নায় আর সমকালকে চেনা যাচ্ছে না। দরকার দূরে যাওয়া। যাকে বলা হয়েছে ভেয়ারফ্রেমডুংস এফেক্ট, অর্থাৎ সেই বিখ্যাত এলিয়েনেশান এফেক্ট। যা নিয়ে সারা পৃথিবীর সমালোচকেরা চুলচেরা বিচার করতে করতে নিজেদের বুদ্ধির ধার এবং থিয়েটার রসের ভাঁড় দুইই খুইয়ে ফেলেছেন। ১৯২৮ -এ তিনি পিছিয়ে গেলেন একেবারে দুশো বছর। ইংল্যান্ড থেকে টেনে আনলেন 'বেগার্স অপেরা'। যার নায়ক এক বুর্জোয়া হাঙর। তার দাঁত চমকায় কিন্তু দেখা যায় না, দেখতে পেলে পরিণতি কিন্তু ভয়ঙ্কর !
গানটি নেওয়া হয়েছে 'তিন পয়সার পালা' নাটক থেকে।
নাটক : তিন পয়সার পালা
গায়ক।। চেষ্টা করলে হাঙ্গরেরও দাঁত দেখতে পাবে ,
কিন্তু যখন মহীনবাবুর ছুরিটা চমকাবে
তখন দেখতে পাবে না , পাবে না ।
হাঙ্গরেরা ধরলে শিকার কড়মড়িয়ে খায়
মহীনবাবুর কারবারটার শব্দ কি কেউ পায়-
কেউ শুনতে পাবে না, পাবে না ।
দিনেদুপুরে পথে ঘাটে পড়ে মানুষের লাশ
খুনীর নাম কেই বা করে, বাসরে, ওরেবাস !
কেউ নাম তো করে না, করে না ।
(বিশ্বাস করুন ,আমিও জানি না )
বদ্যিপাড়ার মতিবাবু চিৎপাত ফুটপাথে,
বুকে সমূল ছুরি বিঁধে আছে যে তার সাথে ,
ছুরি কার তা জানেন না, জানেন না ।
- গানটি নেওয়া হয়েছে 'তিন পয়সার পালা' নাটক থেকে। ব্রেষটের 'থ্রি পেনি অপেরা'। প্রথম প্রযোজনা ১৯২৮এর ৩১ শে আগস্ট, বার্লিনে । আমাদের মহীনবাবু হলেন 'থ্রি পেনি'র ম্যাকহিথ । ব্রেষটের আরো একজন ডাকাত নায়ক। বুর্জোয়ারা হলো ডাকাত। ডাকাতই বুর্জোয়া । তারা মাস্তানির সাহায্যে স্থিতাবস্থা রক্ষা করতে চায় ।মানবিক , অমানবিক সব জিনিসকে পণ্য করে তোলে। পুলিশ রক্ষা করে এই ব্যবস্থাটাকেই, যারা এর শিকার তাদেরকে নয় ।
- দস্যু ম্যাকহিথ মেয়েদের ব্যবহার করে নিজের পৌরুষ জাহির করার জন্য। আর মেয়েরা তাকে ভালোবাসুক আর নাই বাসুক তার জন্য দাঁত-নখ বার করে লড়ে যায়। কারণ ম্যাকহিথ হলো পড়শীর ঈর্ষা, আমাদের গর্ব । নগর কোটাল তার জিগরি দোস্ত হলেও ঘটনাচক্রে ম্যাকহিথ এখন পুলিশ হাজতে। তার মুক্তির কথা ভাবার বদলে, থানায় দাঁড়িয়ে তার দখল নিয়ে ঝগড়া করছে দুই প্রেয়সী পলি আর লতু। ব্যবসাদারের মেয়ে পলি পিচাম। আর জেনি, যার বাবা স্বয়ং নগর কোটাল।
(ঈর্ষার গান )
পলু।। মুখপুড়ী লো হতচ্ছাড়ী ঘুঁটে কুড়নী ঝি,
উঁচকপালী চিরুণ দাঁতী বলবো তোকে কি ?
বুঝলে গো, একে কিছু বলবো না, বলবো না।
লতু।। বলবি তো বল্ না গো
বলবি তো বল্ না গো
পলু।। বলতে গেলে গা গুলোয় মা,
বলবো না বলবো না।
লতু।। বলবি তো বল্ না গো
বলবি তো বল্ না গো।
পলু।। ভদ্দরঘরের মেয়ে আমি
বলবো না, বলবো না।
লতু।। বলবি তো বল্ না গো
বলবি তো বল্ না গো।
পলু।। (তুই) বিয়ের জন্যে হন্যে ছুঁড়ি
বলবো না, বলবো না।
লতু।। বলবি তো বল্ না গো
বলবি তো বল্ না গো।
পলু।। পরের সোয়ামি কাড়তে আসিস
বলবো না, বলবো না।
লতু।। বলবি তো বল্ না গো
বলবি তো বল্ না গো।
পলু ও লতু।। আমার সঙ্গে পিরীত তাহার
আর কারে সে তো জানে না,
পলু/লতু বলে তার প্রাণপাখি কাঁদে
আর কারে সে তো জানে না,
অন্যের সাথে দেখিলে আমারে
কেঁদে মরে সে যে যাবে গো
আমি ছাড়বো না ছাড়বো না।
ও যে আমার প্রাণের প্রিয়
ছাড়বো না ছাড়বো না।
ও যে আমার প্রাণের সখা
ছাড়বো না ছাড়বো না।
ও যে আমার পুণ্যিমে চাঁদ
ছাড়বো না ছাড়বো না।
ও যে আমার আর জনমের
ছাড়বো না ছাড়বো না।
ছাড়বো না ছাড়বো না।………
-পলির বাপ জোনাথান পিচাম একটা কোম্পানি খুলেছেন- ‘ বেগার্স ফ্রেন্ডস কোম্পানি লিমিটেড’। কোন ভিখারি, কোন অঞ্চলে, কি পদ্ধতিতে ভিক্ষা করবে, তিনিই ঠিক করে দেন। বদলে নেন যৎসামান্য কমিশন। সোজা কথায় এ হল কষ্ট বিককিরির দোকান।
যতীন্দ্রনাথ।। (দর্শকের প্রতি) একটা নতুন কিছু দরকার, বুইলেন ?এই, মানুষের মনের কথা বলছি। ধরুন , মানুষের মন তো দিন দিন কঠিন হইয়ে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে ধরুন, আমাদের সম্মিলিত সংগ্রামের প্রয়োজন। তা ধরুন, যদি এই সম্মিলিত সংগ্রাম না হয়, তবে, যাকে বলে, একক সংগ্রাম কইরতে হবে। এই যে- কারণে ধরুন আমার কেন্দ্রটি। আশ্রম।বড় কঠিন আশ্রম। কঠিন মানে নরম আর কি। হেঁ হেঁ, কিন্তু মানুষের মন বড়ই কঠিন। তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম কইরবার জন্য যে কেন্দ্র, সে কেন্দ্রের কঠিন না হইয়ে উপায় কী। আমার এই কেন্দ্রের উদ্দেশ্য হল্য মানুষের মনের অন্তঃস্থল থেকে দুঃখকে টেনে উথলে বের করে আনা। মানে যারে বলে কড়াইয়ে ফুটন্ত দুধ যেমন উথলে ওঠে , তেমনি করে মানুষের মনোরূপ কড়াইয়ে দুঃখরূপ দুধকে বক্তৃতারূপ আগুনে জ্বাল দিয়ে উথলে দিতে হবে। হেঁ হেঁ, কিন্তু মানুষের মতো হারামজাদা দুনিয়ায় নেই। একদিন যে জিনিস দেখে মানুষের দুঃখ হয় ,দিন কয়েক দেখতে দেখতে মানুষের হ্যাবিটে প্যাকটিশ হয়ে যায়। তখন আর দুঃখু হয় না। কখন যে তখন মানুষের মনোরূপ হাঁড়ির দুঃখুরূপ ফুটোতে প্যাকটিশের সিমিট গুঁজে দিচ্ছি তার ঠিক নেই। যেমন ধরুন, এই যে ‘অর্থই অনর্থ’ কিংবা ধরুন ‘সংসার মায়া’ এই ভালো ভালো কথার ক্ষেত্রেও তাই। জন্মে ইস্তক সবাই শুনছে, সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা কথা বলিও না, চুরি করা মহাপাপ, মা-বাবাকে ভক্তি করিবে, জননী জন্মভূমিশ্চ, পিতা স্বর্গ এই সব ভালো ভালো কথা শুনতে শুনতে, ঐ যে বললুম, হ্যাবিটে প্যাকটিশ হয়ে গেছে। মানে ব্যাপারটা হচ্ছে, ক্রমাগত ব্যবহারে ব্যবহারে যেমন ওষুধের গুণ নষ্ট হয়ে যায় তেমনি ক্রমাগত শুনতে শুনতে এসব ভালো কথার গুণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
এদান্তি বড়জোর ঐ দু-একটা ভালো কথার কিছু দ্রব্যগুণ আছে। বুইঝলেন, তা এমন নয় এই এখনই কিছু ভালো কথার মড়ক লেগেছে। এ ধরুন চিরকালের ব্যাপার। অবস্থা বিশেষে কখনও কখনও দু-একটা ভালো কথার খুব চল হয়। যেমন ধরুন, এই কিছু দিন আগে একটা কথার বড় চল হয়েছিল, 'দেশের জন্য প্রাণ দাও’, আর একটা হয়েছিল ‘গুজব ছড়াবেন না’। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে একটা ভালো কথা বেশিদিন চলে না। কিছুদিন পরেই আর কেউ দেশের জন্য প্রাণ দেয় না। কিছুদিন পরে সবাই গুজব ছড়াতে লেগে যায়। তারপর যেই বললেন দেশের জন্য প্রাণ দাও, অমনি সবাই দাঁত বের করে হাসে। এই তখন আর একটা নতুন ভালো কথা খুঁজতে হয়। বুইলেন। এই হচ্ছে যাকে বলে, ‘সফলতার মূলধন’। কে ?
(ছেঁড়া ফরসা কাচা জামা, সাবানে কাচা ধুতি, খালি পা, চুল উস্কোখুস্কো, অল্প দাড়ি, পকেটে টাকা। অবস্থা বিপর্যস্ত একটি যুবক সামনে এসে দাঁড়ায় । তার নাম গোপাল)
গোপাল।। নমস্কার কর্তা মশাই।
যতীন্দ্র।। হুঁ।
গোপাল।। আজ্ঞে , আপনিই তো পাল মশাই ?
যতীন্দ্র।। হুঁ, কী চাই ?
গোপাল।। তা’হলে আপনিই এই আশ্রমের পালকপিতা পালমহাশয় ? তারপর যেন কী? (বিড়বিড় করে মনে করার চেষ্টা করে) মহানুভব মতো…… না , না, আপনার মতো মহানুভাব-
যতীন্দ্র।। ভব।
গোপাল।। আজ্ঞে হাঁ।
যতীন্দ্র।। নাম ?
গোপাল।। আজ্ঞে আমার ?
যতীন্দ্র।। (ঘাড় নেড়ে গম্ভীর হয়ে ) হ্যাঁ।
গোপাল।। (কাঁদো কাঁদো হয়ে) আজ্ঞে ছোটবেলায় আমার বাবা মারা যায়। মা ঝিগিরি করে আমাদের দু’ভাই বোনকে মানুষ করেচে। আজ ছমাস যাবৎ তার বিসূচিকা।
যতীন্দ্র।। ভগ্নীটিও মরণাপন্ন ?
গোপাল।। (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে) আজ্ঞে হ্যাঁ, মরণাপন্ন।
যতীন্দ্র।। সন্তান সম্ভবা ? তার স্বামী……
গোপাল।। দুই বৎসর যাবৎ বেকার বসে আছে।
যতীন্দ্র।। আগে ডুমতলায় দোলগোবিন্দবাবু’র গদিতে মুহুরি ছিল…… কদ্দিন এই লাইন ধরেচো ?
গোপাল।। আজ্ঞে ?
যতীন্দ্র।। এই পুরো বুলিটা মুখস্ত করে কদ্দিনব্যাপী বাজারে ছাড়চো ?
গোপাল।। আজ্ঞে তা ধরুন বছরদুয়েক হবে। তা গতকাল চাঁদনী চকের মোড়ে একবাবুর ফেটিঙের সামনে ডাঁড়িয়ে এই কতা বলে বাবুরে যখন প্রায় পটিয়ে এনেচি, এমন সময় আপনার এই পালনকেন্দ্রের…
যতীন্দ্র।। চাঁদনীচক, গতকাল, বেলা এগারোটা বেজে পোয়া ঘণ্টা? ও তুমি? তোমারি সঙ্গে আমার আশ্রমের হরে আর নটুর তক্কবেতক্ক হয়েছে ? তুমি ওদের বুঝিয়েচ যে… হারামজাদা শূয়র, এর পর কোনোদিন ঐ এলাকায় ভিক্ষে করতে দেখলে মেরে যদি তোমার পিঠের ছাল খুলে না নিই তো আমার নাম যতীন পাল না। চাঁদনীচকে ভিক্ষে করো, শূয়র। ওকি তোমার বাপের এলাকা ?
গোপাল।। আপনি আমার বাপ হন পালমশাই । আমারে বাঁচান, আমি জানি চাঁদনীচকে আপনার লাইসেন্স ছাড়া ভিক্ষে করা বেআইনী।
যতীন্দ্র।। জেনেশুনে করেছিলে কেন, শুনি ?
গোপাল।। আজ্ঞে আগে চাঁদপাল ঘাট এলাকায় ছিলুম, সেখানে বড়ো হাঙ্গামা হতে নাগলো, রেগেমেগে ভাবলুম……
যতীন্দ্র।। বইস।
গোপাল।। আইজ্ঞে ?
যতীন্দ্র।। এহানে থাপ্পা দিয়ে বইসে পড়। এই হল মহারানীর কলিকাতা শহর, একত্রিশটি থানায় বিভক্ত। আমার হল নয় নম্বর থেকে একুশ নম্বর পর্যন্ত। চীনাবাজার, চাঁদনীচক , তুলবাজার, গোমোপুকুর, চুকডাঙ্গা , শিমলেবাজার, লালঞ্চবাজার, মুলঙ্গাপুতুল ডাঙ্গা, কোবর ডিঙা, বৈঠকখানা, শ্যামপুকুর, শ্যামবাজার, পদ্মপুকুর এই এলাকার মধ্যে যে ভিক্ষে করতে চাইবে- সে যদি রাণীর বেটা যোবরাজও হয় তো তাকে এই যতীন পালের পালনকেন্দ্র থেকে লাইসেন নিতে হবে। (এগোতে এগোতে) নইলে ঐ ‘আপনাদের মতো মহানুভব’ বললে লাথি মেরে তাড়াব (দর্শকদের) দেখছেন লাইসেন ছাড়াই এর বাপ মেরেচে, মা ঝিগিরি করেচে, মার বিসূচিকা হচ্চে, ভগিনীর সন্তান হচ্চে, মগের মুল্লুক।
গোপাল।। লাইসেন ফি কত দিতে হবে ?
যতীন্দ্র।। অডিনারি না পেশাল ?
গোপাল।। পেশালে কত আর অডিনারি কত?
যতীন্দ্র।। পেশাল তিনটাকা, অডিনারি একটাকা।
গোপাল।। বাবা, এক টাকা … তিন সিকে হয় না ?
যতীন্দ্র।। তিনসিকে ছিল, ছিল। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে না এদান্তি। আমার গলায় আর ছুরি বসিও না বাবা।
গোপাল।। তিনসিকেই নেন পালমশাই।
যতীন্দ্র।। হুঁ।
গোপাল।। আর একটা দু’য়ানি। আর কিছু নেই, মাইরি বলচি।
যতীন্দ্র।। (পকেট সার্চ করে হতাশ হয়ে) ঠিক আছে, পত্তেক হপ্তায় য আপাবি তার অর্ধেক জমা দিবি।
গোপাল।। কী সাজব ?
যতীন্দ্র।। সে বিধি এই পালনকেন্দ্র ঠিক করে দেবে ।
গোপাল।। আমি কোন এলাকায় বেরোব ?
যতীন্দ্র।। চুকডাঙ্গা, চুকডাঙ্গা। পুলের ওপারে ভিড় কম, আদায় বেশী। ডোলও কম, এক সিকি।
গোপাল।। বেশ।
যতীন্দ্র।। নাম ?
গোপাল।। শ্রী পটলবিহারী দাস।
যতীন্দ্র।। ওগো শুনচ ? শ্রীপটলবিহারী দাস, চুকডাঙ্গা পুলের ওপারে , বয়েস বাইশ, পূর্বপেশা ভিক্ষা… তিন নম্বর, তুমি তিন নম্বর অডারে যাবে।
গোপাল।। তিন নম্বর অডার কী?
যতীন্দ্র।। এই হ’ল মানুষের মন গলাবার জন্য চারটি বিধিব্যবস্থা। এসব পেশালিস্টদের দিয়ে গবেষণা করে বের করা হয়েছে। এর যে কোনো একটি দেখলে মানুষের মনে এমন একটা ক্ষণকালীন অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হবে, যে তাকে কিছু না কিছু পয়সা ‘বাপ বাপ’ বলে ছাড়তে হবে। যেমন ধরো দুনম্বর বিধি- জন্মপঙ্গু। জন্ম থেকে অন্ধ- বিকলাঙ্গ- নুলো-হাবা। এ জিনিসটা করা শক্ত, তবে করতে পারলে মার নেই। এসব ভিখিরি কলেজের গ্র্যাজুয়েট ছাড়া টপ করে পারবে না। এই দ্যাখ, এই দ্যাখ এই রকম ---
( যতীন পাল গোপালের দিকে এগিয়ে দেখান। হাবার মতো করে কথা বলতেই গোপাল ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। যতীন পাল সঙ্গে সঙ্গে থেমে যান, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন গোপালের দিকে, তারপর হঠাৎ চিৎকার ক’রে)
মায়া হচ্ছে, মায়া হচ্ছে শূয়র। মায়া করলে জন্মে কোনোদিন ভিখিরি হতে পারবি না। আজন্ম ভিখিরিকে পয়সা দিয়ে জীবন শেষ হবে।
- ইতিমধ্যে ব্রেশট প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন থিয়েটারের রীতিনীতি, বিষয়বস্তু সব কিছু নিয়ে। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে এপিক থিয়েটার নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ।
তিনি বলতে চাইছেন, চলতি সমাজটা যেমন গোলমেলে , চলতি থিয়েটারটাও তাই। এর কাজ হল সমাজটাকে টিকিয়ে রাখা। কিন্তু জীবন বদলায়। মানুষ বদলায়। এই পরিবর্তনকে চিনতে শেখানো, তাকে বিচার করা, পরিবর্তন ত্বরান্বিত করা- এটাই কি থিয়েটারের কাজ হওয়া উচিত নয় ?
স্বভাবতই প্রচলিত নাট্যদর্শনের সঙ্গে বিরোধ বাঁধছে তাঁর। সেই বিরোধের কারণ এবং তাঁর নিজের ভূমিকা স্পষ্ট করার জন্য, লিখছেন ‘মেসিংকাউফ ডায়ালোগ’। একজন অভিনেতা, এক অভিনেত্রী আর এক ডাকসাইটে নাট্যবোদ্ধার সঙ্গে দার্শনিক ওরফে স্বয়ং ব্রেশটের কথোপকথন।
নাট্যবোদ্ধা।। আরে মশাই আপনার চাহিদাটা কি? কি দেখতে চান ? নদী -নালা- ক্ষেত-খামার- হাট- মাঠ -দালান- কোঠা যা চান দেখিয়ে দেব ।এই মঞ্চে। বাস্তবে যেমনটা দেখেন একেবারে তেমনি । যুদ্ধের বিভীষিকা ,বস্তির দারিদ্র,স্টক এক্সচেঞ্জের ভুলভুলাইয়া,মায় পলিটব্যুরোর টেবিলটক অবধি। আমাদের থিয়েটারে সব পাবেন।সতীর অগ্নিপরীক্ষা , বীরের আত্মত্যাগ , নিহত ভালোবাসা, বিবেকের আর্তনাদ ,দেশমাতৃকার আহ্বান-
দার্শনিক।। বাঃ।
নাট্যবোদ্ধা।। পীর ,মিশকিন , হুরি, পরি, বানিয়া, খুনিয়া ,প্রেমিক, মাতাল, ঘুষখোর চিটিংবাজ - মানে এই মানব সংসারের যেকোনও চিড়িয়া, যে কোনও বিষয় , আমরা দেখিয়ে থাকি। তবে হ্যাঁ , বিষয়টার একটা ' পাওয়ার' থাকা চাই, একটা যাকে বলে 'এফেক্ট ' থাকা চাই ।
দার্শনিক।। তার মানে এই মঞ্চের উপর আপনারা মানুষের জীবনের অনুকরণ করছেন, তাই তো?
নাট্যবোদ্ধা।। নিশ্চয়ই । শুধু একটা নতুন আইডিয়া দিন। আমরা জমিয়ে দেব।ওসব নীতি নিয়ম গুলি মারুন। নাটক পাঁচ অ্যাক্টের হতে পারে , আবার পঞ্চাশও। ট্র্যাজিক হতে পারে। কিংবা কমিক। আজকাল আবার দুরকম শেষ দেখিয়ে বলা হচ্ছে, আপনারাই বলুন কোন এন্ডিংটা পছন্দ- হ্যাপি না আনহ্যাপি ? তারপর ধরুন দেখতে এলেন মিউজিক্যাল কমেডি, আচমকা আপনার বুক ভেসে যাবে কান্নায় কিংবা কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ হেসে উঠবেন। আর এই যে সব অ্যাকটার- আহা ! এই অমিত্রাক্ষর আওড়াচ্ছে তো এই খিস্তি। সকালে করছে স্টাইলাইজড অভিনয়। বিকেলে ন্যাচারাল। সবগুলোই ফাটাফাটি। তেমনি মঞ্চ। এক নাটকে হয়তো দেখলেন যে কয়েকটা রংচঙে খুঁটি ছাড়া কিস্যু নেই। আবার পরেরটাতেই দালানবাড়ি। বেডরুম-পায়খানা-হেঁসেল মায় স্টোভ খুঁচোনোর পিনটা অবধি সাজিয়ে দেব।
দার্শনিক।। বাঃ।
অভিনেতা।। কি বাঃ বাঃ করছেন? জানেন এসবের জন্য কতটা খাটনি লাগে, কত শৃঙ্খলা লাগে! এই কম্পিটিশনের বাজারে অ্যাকটার হওয়া মুখের কথা নয়। ফিলীং বোঝেন ফিলীং ?
দার্শনিক।। হ্যাঁ ভাই বুঝি । জীবনের অনুকরণ করতে গেলে অনুভব তো জাগবেই। কিন্তু ভয় হয় একটা ঘটনা থেকে একটাই বিশেষ অনুভবকে ছেঁকে তোলার যে চেষ্টা তোমরা করে যাচ্ছ তাতে অনুকরণ ব্যাপারটাই না পন্ড হয়ে যায় । আসল কথা হল, কী উদ্দেশ্যে তুমি অনুকরণ করবে ?
অভিনেতা।। বলে যান, শুনছি।
দার্শনিক।। এই যে বিচিত্র মানবসংসার- মানুষ একে অন্যের সঙ্গে থাকছে, ঝগড়া করছে , বন্ধুত্ব করছে , বিয়ে করছে, ছেলে বিয়োচ্ছে, মাটি খুঁড়ে আলু তুলছে , সবজি বিক্রি করছে , জালনোটের কারবার করছে- এইসবের প্রতি অসম্ভব কৌতূহল আমার। কেমন করে মানুষ ষড়যন্ত্র করে , শোষণ করে , আড্ডা মারে সম্মান করে, শেখে , শেখায়, অন্যকে সাহায্য করে , বানিয়ে তোলে সমাজ- এই সব, সব-কিছুর মধ্যে আমি কয়েকটা সাধারণ সূত্র খুঁজতে চাই । যাতে জীবনের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারি। আমি নিজেকে শুধোই, এই যে মানুষটা- ওর মত অবস্থায় পড়লে এখন আমি কি করতাম ? কেমন করে সবচেয়ে ভালো থাকতে পারতাম? আমার ভালো থাকা কিন্তু নির্ভর করবে অন্যে আমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছে তার উপরে । কাজেই আমাকে চেষ্টা করতে হবে, কীভাবে তাদের কাজকর্ম, ব্যবহারকে ঠিক দিকে নিয়ে যাব, তার ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পারব !
নাট্যবোদ্ধা।। তার মানে আমাদের থিয়েটার থেকে স্রেফ অনুকরণ ব্যাপারটা আপনার দরকার। আর কিছু নয়। যেন কাঁচামালটা কিনতে এসেছেন।
দার্শনিক।। ঠিক।
অভিনেতা।। তার মানে ? আচ্ছা, আপনি আমাদের লোক তো? নাকি বাইরের লোক ?
দার্শনিক।। বোধহয় বাইরের। রবাহুতও বলতে পারো ঐ যে, তোমাদের সমালোচক মশাই বললেন, আমি কাঁচামালের ব্যাপারী। ধরো, আমি কাঁসা-পিতল কিনে বেড়াই। তোমাদের দরজায় এসে হাত পাড়ছি, আছে নাকি পুরনো পিতল ? ঐ তো- ওটা কি ! একটা ট্রাম্পেট ! বাঃ , বেশ খানিকটা ধাতু মিলবে এটা থেকে। হ্যাঁ, আমি শুনেছি এটা একটা চমৎকার বাজনা। তবে সত্যি বলতে কি, এটা বাজনা না গামলা তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমি চাই মেটিরিয়াল, ওর মালমশলাটা। তোমাদের কাছে ট্রাম্পেটটা আছে। তোমরা সেটা বাজিয়ে যাচ্ছো বহুদিন ধরে। কিন্তু আমি এসেছি বাজনা শুনতে নয়, ওতে কতটা খাঁটি ধাতু আছে তা খতিয়ে দেখতে। তোমাদের থিয়েটার কতটা ঐতিহ্যবান, কতটা জমকালো, কত সুন্দর- এসব ধর্তব্যের বিষয়ই নয়। আসল কথা হল, বাস্তব জীবনের কষ্টিপাথরে যাচাই করে, ওর ভেতরের খাঁটি মালটাকে বার করে নেওয়া।”
নাটক: ব্যতিক্রম
- সমাগত সুধীজনে....
- দৌড় দৌড় ! মরুভূমির উপর দিয়ে ছুটছে এক সওদাগর , তার গাইড আর কুলি । যেতে হবে উরগা শহর । তেলের খনির খোঁজে । সওদাগর জানে, সঙ্গের ভাড়াটে লোকগুলো মোটেই তার বন্ধু নয়। ওদের শ্রেণি আলাদা।ওরা পরস্পরকে সাহায্য করবে । আর সুযোগ পেলেই ছুরি মারবে মালিককে । পেছনে ছুটে আসছে আরও সব প্রতিদ্বন্দ্বী। সওদাগর তাড়া লাগায়। গাইডকে বাধ্য করে কুলির পিঠে চাবুক কষাতে।
পেছন থেকে দ্বিতীয় সওদাগরের চিৎকার শোনা যায়......
“ এই...... এইটা কি ওরা যাওয়ার পথ? এই...... আমরা দোস্ত, দুশমন না। এই......... আমাদের জন্য অপেক্ষা করো।
সওদাগ।। ( উত্তর দেয় না এমনকি ফিরেও তাকায় না) জাহান্নামে যাও ! আগে বাড়ো ! তিনদিন আমার লোকদের ঘোড়দৌড় করাবো। প্রথম দুদিন খালি খিস্তি, তৃতীয় দিন ক্রমাগত আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি। তারপর সে সব উরগা শহরে পৌঁছে দেখা যাবে । আমার প্রতিযোগীরা প্রায় ধরে ফেলেছে আমাকে। কিন্তু কাল সারারাত আমি ছুটবো এবং তৃতীয় দিনে আমি হাণ স্টেশনে পৌঁছবো- অর্থাৎ আর সবার চেয়ে একদিন আগে -আগে বাড়ো।
(সওদাগরের গান )
হা হা হা এগিয়ে আছি
হা হা হা এগিয়ে আছি
রাত্রি জেগে ছুটছি বেগে কেউ ফেলো না হাঁচি
আমায় নাকি টপকে যাবে পুঁচকে মশা মাছি
হা হা হা এগিয়ে আছি
দু'চক্ষে দেখতে পারি না কুঁড়ে লোকের মরণ
চালাও চাবুক সপাং সপ, পাল্টে যাবে ধরণ
সে রকম গেলেই বাঁচি।
হা হা হা এগিয়ে আছি।
-যদি সফল হতে চাও, সবাইকে সন্দেহ করো ।এই হল সওদাগরের দর্শন। তার সন্দেহ, কুলিটি ইচ্ছা করে দেরি করিয়ে দিচ্ছে আর গাইড তাকে দয়া দেখাতে ব্যস্ত। সেই অপরাধে দুর্গম পথের মধ্যিখানে গাইড ছাঁটাই হয়ে যায়।
(সওদাগরের গান)
আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আমাকে লড়তে হবে।
(পিস্তল বার করে, সাফ করতে করতে গান গায়)
শক্ত মানুষ লড়ে
আর দুবলা মানুষ মরে
কোথাও কি আর ঝর্ণা থেকে পেট্রোলিয়াম ঝরে ?
মাটি কেন বুক ফাটিয়ে সোনালী তেল দেবে
কুলি বেটা কেন আমার বোঝা ঘাড়ে নেবে !
তেল চাইলেই লড়াই,
এই মাটির সাথে, কুলির সাথে
সবার সাথে লড়াই!
এই লড়াইয়ের নিয়মটা ভাই জলের মতো সরল
শক্ত মানুষ টিকে থাকে দুবলা তোলা পটল।
-সন্দেহপ্রবণ সওদাগর ছুটছে টাকার পিছনে। আর কুলি ছুটছে- যাতে তাড়াতাড়ি পৌঁছে, যাওয়া যায় ঘরে, বউ ছেলে-মেয়ের কাছে, তাদের মুখে দুটো অন্ন তুলে দেওয়া যায়। সন্দেহ মানুষকে অমানুষ করে দেয় আর ভালোবাসা তাকে আরো বড় করে তোলে । মির নদীর ধারে ওরা জিরোচ্ছে। কুলিটি ক্লান্ত । তবু তার মুখে গান-
(কুলির গান) যাচ্ছি আমি উরগা শহরে
যাচ্ছি আমি উরগা শহরে।
পথে যদি ডাকাত পড়ে
মরুভূমির ধুলোঝড়ে দুচোখ ঢেকে যায়
তবু যাব আমি উরগা শহরে…
সওদাগর।। কুলিটা কেমন নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ- চারপাশে ডাকাতের ভয়, স্টেশনের ধারে কাছে যত চোর জোচ্চর ছেনতাইয়ের ভিড়- আর ও নিশ্চিন্তে গান গাইছে। (কুলিকে) শুরু থেকেই ঐ গাইডটাকে আমার গোলমেলে লাগছিলো। এই অসভ্য ব্যবহার করছে , পরের মুহূর্তে খয়ের খাঁর মতো হেঁহেঁ হেঁহেঁ করছে ।এইসব লোকের কোনো মেরুদণ্ড নেই। কোনো আত্মসম্মান বোধ নেই ।
কুলি।। হ্যাঁ মালিক (গান গাইতে থাকে)
উরগা গেলে মাইনে পাব
মাইনে পেলে খাবার খাব, খাব পেট ভরে
যাব আমি উরগা শহরে।
সারাটা পথ কষ্ট, শরীর হল নষ্ট
আরো কত দূর-
সেই উরগাপুর......
সওদাগর।। আচ্ছা দোস্ত, তুমি এত মেজাজে গান গাইছো কি করে ? চারপাশে ডাকাত- ভয় করছে না তোমার? হুঁ আসলে ভাবছো তোমার আর কি ক্ষতি- যদি কিছু লুটপাট হয় সে তো আমার যাবে।
কুলি।। ( গান গাইতে থাকে)
যত খুশি হোক দূর
সেই খানেতে রোদ্দুর সোনার ছুটি ভরা
মাইনে পাব মাইনে পাব উরগা গেলে ত্বরা
আর পাব বৌ তোমাকে
ছোট্ট খোকন সোনাকে
যাচ্ছি গো তাই উরগা শহরে
সওদাগর।। (বাধা দিয়ে) এই... তোমার ঐ গান-ফান আমার ভাল্লাগছে না। গান গাওয়ার কি হয়েছে। গান গাওয়ার মতো তো কিছু হয়নি। তাছাড়া তোমার এই চিৎকার এতো উরগা শহর পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে । এ যেন ডাকাতের নোটিশ দেওয়া -ও গো আমরা এইখানে আছি, দয়া করে আমাদের একটু লুটপাট করে যাও। কাল গান করো -প্রাণের খুশিতে যত ইচ্ছে গান গেয়ো কাল।
কুলি।। ঠিক আছে মালিক।
- মাথার ওপর গনগনে সূর্য । পায়ের নিচে গরম বালি। গলা শুকিয়ে কাঠ ।পরিশ্রমে, উত্তেজনায় সওদাগর মরতে বসেছে। কুলিটি তার দিকে এগিয়ে দেয় নিজের জলের পাত্র । কারণ তৃষ্ণার্ত মানুষকে জল না দেওয়া, সে তো অপরাধ। কিন্তু সওদাগর ভাবে, কুলি বোধহয় পাথর ছুঁড়ে মারতে আসছে তাকে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালায়।
- নিহত কুলির বউ নালিশ করছে সওদাগরের নামে। শুরু হচ্ছে ক্ষতিপূরণের মোকদ্দমা !!
( আদালতের গান)
মাথার উপর খাড়ার ঘাঁ
কোর্ট কাছারি জজেরা
যে মরেছে তার দোষ
কেউ কোরোনা আফশোষ।
হাকিম সাহেব দিচ্ছে রায়
ছুরির ফলা ঝকমকায়
ছুরিতেই তো ধার ছিল
তবু পরেছে পরচুলো ?
শকুন উড়ছে আকাশে
ক্ষিদেয় দুচোখ ফ্যাকাশে
আয়রে শকুন কাছে
অনেক খাবার আছে।
আদালতের ভাগাড়ে
খেয়ে যা এক নাগাড়ে
লুঠের মালের নতুন নাম
লাভের কড়ি- রাধেশ্যাম।
- বিচারক রায় দিলেন, সওদাগরের কোন দোষ নেই। দোষ কুলিরই। একথা কে না জানে যে কুলি সর্বদাই নিজেকে শোষিত মনে করে ! ঘৃণা করে শোষকদের ! তাহলে সে কেন খামোকা শোষকের তৃষ্ণা মেটাতে যাবে? এটা অযৌক্তিক দয়া। এটা ব্যতিক্রম ! ঐ অবস্থায় কুলির মারতে আসাই স্বাভাবিক ছিল। কাজেই সওদাগর জলের পাত্রকে পাথর ভেবে ভুল করতেই পারে । কুলির বউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না ।
-একেই বলে স্থিতাবস্থা। কুলিটি মরবেই। গুলি চালালেও, না চালালেও। আর আমরা বিচারশালার এই অমানবিক সীমাবদ্ধতা দেখে তিতো হাসি হাসবো। এতদিন আমাদের সব ট্র্যাজেডি শেষ হয়েছে মৃত্যুতে আর সব কমেডির শেষে বেজেছে বিয়ের সানাই। কিন্তু মৃত্যু মানেই কি দুঃখের ? বিয়ে মানেই কি সুখ ? হ্যাঁ, এটাই প্রচলিত ধারণা ।এটাই স্বাভাবিক। এমন ঘটলে, স্থিতাবস্থা বজায় থাকে । তাই দেখে স্বস্তির হাসি ফোটে আমাদের মুখে । কিন্তু সেই স্থিতাবস্থা নিয়ে যদি ঠাট্টা করা হয় ? তখন আমরা হাসি তবে সেই হাসির চরিত্র আলাদা। তা আমাদের দাঁড় করায় একটা প্রশ্নের সামনেঃ এই ব্যবস্থাটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেব কেন ?
১৯৩২ এ গোর্কির মা অবলম্বনে লিখলেন, ‘ডিমুটার’।
অভিনীত হওয়া মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়লো শকুনের পাল।
বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিক্রিয়াঃ
- শহরের বুকে থিয়েটারের নামে গৃহযুদ্ধে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। খোলাখুলি ষড়যন্ত্র চলছে ।পুলিশের অতন্দ্র পাহারা সত্ত্বেও যুব অভিনেতৃদলের ‘ডিমুটার’ যুবগণমঞ্চে প্রযোজিত হয় কেমন করে ? এই নাশকতা বন্ধ হোক!
- শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা বিলুপ্ত ।এই নাটক অবিলম্বে বেআইনি না হলে, সর্বনাশ !
- পুলিশ কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখুন, মা নাটকটি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে আপনাদেরই। শহরের বুকে এই শান্তিভঙ্গ, এই উপদ্রব, এই তাণ্ডবলীলা- আর কতদিন চলতে দেবেন?
- সেদিন মুভিট হলে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ভাণ্ডারের সাহায্যার্থে অভিনীত হচ্ছিল মা। পুলিশ আর নাজি গুণ্ডারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। তছনছ হয়ে গেল। আহত হলেন শিল্পীর। ব্রেশট বেরিয়ে এলেন একা । বিষণ্ণ। বিস্তৃত বুলেভার্ড জুড়ে ছড়িয়ে আছে নাটকের জিনিসপত্র, পোশাক, রং, তুলি । আর একটু দূরে টায়ার জ্বালিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করছে কমরেডরা । বিয়ারপাবগুলোয় চলছে কমিউনিস্ট আর নাজি গুন্ডাদের খণ্ডযুদ্ধ। পথে গড়াচ্ছে রক্ত । দুপা হাঁটলেই গ্যালারির সামনে , তিনি জানেন, এতক্ষণে জড়ো করা হয়েছে অনেক বই। ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে আগুনে। গ্যয়টে, শিলার এমনকি শেক্সপিয়র।তাঁর চোখ দুটো আগুনের আভায় চকচক করে ওঠে। হ্যাঁ তিনিও আছেন খতম তালিকায়। পুড়ছেন তিনিও। ভাগ্যিস!
- “ওরা আমাকে ছেড়ে দেবে কি করে ?
আমি তো আমার কবিতায়
সত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছি বারবার
সাবাস মহামহিমেরা ! পুড়িয়ে দিল আমার বইগুলোও।”
- ব্রেশট হেঁটে চলেছেন একা, হয়তো শেষবারের মতো।তিনি জানেন, প্রিয় বার্লিন ছেড়ে চলে যেতে হবে তাঁকে।শিগগিরই।
-২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩। রাইখস্টাগ, অর্থাৎ জার্মান পার্লামেন্ট জ্বালিয়ে দিলো হিটলারের গুন্ডাবাহিনী। গোয়েবলসীয় কায়দায় নাশকতার দায় চাপানো হলো কমিউনিস্টদের ওপর। পরদিন সকালেই ব্রেশটের দেশত্যাগ।
-“ আমাকে দেশান্তরী ভেবে ভুল করবেন না আপনারা। এতো মনপসন্দ সফর নয়।
অন্য দেশে যাওয়া, থিতু হওয়া, তাও নয়।
আমরা পালাচ্ছি, বিতাড়িত হচ্ছি, বহিষ্কৃত হচ্ছি।”
- ১৯৩৩-এ গিয়েছিলেন ডেনমার্ক। সেখান থেকে সুইডেন। তারপর ফিনল্যান্ড, ১৯৪১-এ ক্যালিফোর্নিয়ায়।
-“ যে দেশে গিয়ে উঠছি
তা আমার ঘরদোর নয়, নির্বাচন।
উচাটন হয়ে বসে থাকি সীমান্তে।
চোখ ক্ষয়ে যায় আমার দেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে।
নতুন কেউ যখন আসে
সাগ্রহে শুধই, কি ভাই, দিন কি বদলাচ্ছে?
বলো সব খুঁটিনাটি খবর ।
আমার কানের ভেতর ঢুকে যায় জন্তুর শীৎকার !
কাঁটাতারের ওপার থেকে ভেসে আসে
বিবরণ।
এপারে ছেঁড়া জুতো পরে ভিড়ের মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি।
তুলে ধরি শরীরের দাগগুলো। লজ্জার দাগ। কিন্তু একথাও বলতে চাই যে,
আমরা কেউ এখানে থাকবো না।
কিছুতেই না। শেষ কথা বলা এখন বাকি আছে।”
তৃতীয় প্রবাহ
১৯৩৪ – ১৯৪৮
- নানা দেশ ঘুরে ব্রেশট শেষ পর্যন্ত থানা গাড়লেন হলিউডে। যে জায়গাকে তিনি নিজেই বলেছেন মজাদার নরক।
- যারা মিথ্যে বানায় যারা স্বপ্ন বানায় আর স্বপ্ন বিক্রি করে ডলার কামায় তারা কোথায় থাকে? হলিউড হলিউড এই নরকে।
জমকালো বাড়িগুলো, নাম ‘হ্যাপিহোম’ বাগানে ফুলের মেলা ছবির মতোন। নরকের বাড়িঘর দেখে দিলখুশ, হাসছে সবাই কত রঙিন মানুষ!
আমিও তো তাই, কত মিথ্যে বানাই রোজ করে মাথা হেঁট, শুধু ভরাতে এ পেট মিথ্যের হাটে গিয়ে লাইন লাগাই । বেচারা নাট্যকার কোথায় থাকে? -হলিউড হলিউড এই নরকে।।
-প্রশ্ন উঠতে পারে, এর গ্লানি সহ্য করা সত্ত্বেও কেন তিনি রাশিয়া যাননি? তাঁর স্বপ্নের দেশ! সমাজতন্ত্রের পিতৃভূমি। কে জানে, হয়তো ভেবেছিলেন, রাশিয়াও নিরাপদ নয় তাঁর পক্ষে।
তখন তাঁর বিরুদ্ধে কলম শানাচ্ছে কম্যুনিস্ট লুকাচ। ব্রেশটকে তুলনা করা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিকতার পদ্মবনে ঢুকে পড়া মত্ত হস্তির সঙ্গে। কিছুদিন আগেই কজন রুশ বন্ধুর সঙ্গে তিনি স্থাপন করেছিলেন দিদেরো সোসাইটি। সেইসব যুক্তিবাদী বন্ধুদের কণ্ঠ খুব তাড়াতাড়ি থেমে গেল। আইজেনস্টাইনের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হল। অখ্ লোপকভের থিয়েটার কেড়ে নেওয়া হল। গুলি করে মারা হল ত্রেতিয়াকোভকে। জেলে পাঠানো হল অভিনেত্রী করোলা নেহারকে। রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে গেলেন মায়ারহোল্ড। আর তাঁর স্ত্রীর লাশ খুঁজে পাওয়া গেল ভোরবেলা, শরীরে অসংখ্য ছুরির ক্ষত।
-তিনের দশকের মাঝখান থেকেই অন্ধকারের একটা নয়, সহস্র মুখ দেখতে পাচ্ছেন বিষণ্ণ ব্রেশট। সেইজন্য কি ১৯৩৭ থেকেই বন্ধ করে দিচ্ছেন নিছক মার্কসবাদী কিম্বা নিছক ফ্যাসিবিরোধী গান কবিতা লেখা? তখন তিনি প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন মানুষের হৃদয়ে নিহিত আলোকে। যুক্তির আলো। যা আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় সমস্ত রকম কর্তৃত্ব পরায়ণতার বিরুদ্ধে।
-১৯৩৮ সালে লিখলেন গ্যালিলিওর জীবন। গ্যালিলিওর কথা আপনারা সবাই জানেন। তার আগে মানুষ বিশ্বাস করত পৃথিবী স্থির। সূর্য আর সব গ্রহ উপগ্রহ সমেত তাকে ঘিরে পাক খাচ্ছে। চার্চও তাই প্রচার করত। কোপারনিকাস বলেছিলেন পৃথিবী ঘুরছে। কিন্তু তার প্রমাণ করতে পারেন নি। গ্যালিলিও দূরবীণ তাক করলেন আকাশে। অঙ্ক কষে প্রমাণ করলেন কোপারনিকাসের কথা। আর, স্বাভাবিকভাবেই পড়লেন চার্চের বিষ নজরে । কিন্তু গ্যালিলিওর কৃ্তিত্ব শুধু এটুকু নয়। ব্রেশট দেখিয়েছেন, তিনি ধরে ফেলতে পেরেছিলেন বিজ্ঞান কেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের বন্ধু, চার্চের আসল স্বার্থটাই বা কী!
গ্যালিলিও তখন রোমে।
ফ্লোরেন্স রাষ্ট্রদূতের প্রাসাদে রাজভোগ খাচ্ছেন। তবু তার মন ভার।
তরুণ এক যাজক এল তার সঙ্গে কথা বলতে।
নাটকঃ গ্যালিলিওর জীবন
ছোট মঙ্ক।। সিনর গ্যালিলেই,কাম্পানিয়ার এক চাষীর ঘরে আমার জন্ম। ওরা সহজ সরল মানুষ। ওরা খুবই গরিব। ওরা এই জেনে নিশ্চিন্ত আছে যে ওরা স্থির পৃথিবীর ওপর দাঁড়িয়ে আর ঈশ্বর ওপর থেকে তাদের সব সময় দেখছেন।
সব কিছুরই স্থিরতা আছে – সেই ভরসাতেই ওরা কাজ করে, সন্তানের জন্ম দেয়, দুবেলা খাবার জোগাড় করে। সিনর গ্যালিলেই, এখন আমার চাষি বাবা-মাকে গিয়ে যদি বলি যে আমাদের এই পৃথিবীটা স্থির নয়, মহাশূন্যে আর পাঁচটা তারার মতোই ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহলে ওদের সমস্ত বিশ্বাস কিরকম ওলট-পালট হয়ে যাবে। যে পবিত্র বাইবেল এতদিন ধরে ওদের সহ্যশক্তি, ক্ষুধা, ক্লান্তির প্রয়োজনটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছে, সে সবই যদি ভুল মনে হয় তাহলে ওরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! তখন তো ওরা বলবে, আমাদের মাথার ওপর কেউ রইল না। আমাদের এই ভাঙাচোরা জীবনটার ভার আমাদের নিজেদেরই বইতে হবে। আমরা যে কষ্ট পাচ্ছি তার কোনো মানে নেই? বোঝা বয়ে বয়ে নুয়ে পড়াটাই কি উদ্যম? এর মধ্যে কোনো পরমার্থিক মহিমা নেই? তাহলে বুঝতে পারছেন পবিত্র চার্চের বাণীর মধ্যে আমি কেন মায়ের মমতা এবং আত্মার মহান রূপ খুঁজে পেয়েছিলাম?
গ্যালিলেও।।এসব কথা আমাকে বলো না। তার চেয়ে তোমার বাবা মাকে দুবেলা খাবার উপায় করে দাও না। দেখবে তাতে অনেক বেশি আত্মিক মহিমা প্রকাশ পাবে।
ছোট মঙ্ক।।আপনি কি বিশ্বাস করেন না, যে সত্য যদি প্রকৃতই সত্য হয় তাহলে সেটা আমাদের সাহায্য ছাড়া নিজের জোরে জিতে যেতে পারে?
গ্যালিলেও।। না, না, না, সত্য ততটাই জয়ী হবে যতটা আমরা তাকে জয়ী করতে পারব। সত্যের জয় মানে যুক্তিবাদী মানুষের জয়। সবচেয়ে মুশকিল হল যেটাই আমি জানতে পারি সেটাই অন্যকে জানাতে হবে আমাকে। জানাতে হবে পৃথিবী স্থির নয়, তা সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কিন্তু তোমরা পৃথিবীটাকে ব্রহ্মাণ্ডের মাঝখানে রেখেছ, আর ঠিক মাঝখানে রেখেছ সেন্ট পিটারের সিংহাসন, যাতে সবকিছু ওকে কেন্দ্র করে ঘোরে। চার্চের এই স্বার্থটা সবাইকে জানাতে হবে - প্রেমিকের মতো, মাতালের মতো, বেইমানের মতো। জানি এটা রোগ, এই রোগেই মানুষের সর্বনাশ হয়, কিন্তু আর কতদিন আমি এই সর্বনাশা চিৎকার করে যাব?
না। খুব বেশিদিন চিৎকার করেন নি গ্যালিলিও। সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ‘শহিদ’ হবার সুযোগ হেলায় হারিয়ে, ভীতু বিজ্ঞানী বেছে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছা নির্বাসন। ভোগীর জীবন। আর খুব গোপনে চার্চের চোখ এড়িয়ে, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য লিখে রেখে গেছিলেন ‘ডিসকোর্সি’। গ্যালিলিও তো ‘বীর’ নন, তবু নতুন যুগের স্রষ্টা। সেই ‘নতুন যুগ’ আসে অনেক লড়াকু মানুষের ছোট ছোট আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে। যারা ব্যক্তিগত নৈ্তিকতা আর বাঁচার ইচ্ছা – এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয় বারে বারে। কিন্তু কেন এমন হবে? কেন আমরা বাঁচব এমন এক ভুল সমাজে, যেখানে যুক্তিবাদী হতে গেলে ‘বীরের মতো’ মরে যেতে হয়? গ্যালিলিওর ছাত্র আন্দ্রেই বলেছিল – “কী হতভাগ্য সেই দেশ , যেখানে একজনও বীর নেই!” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন – “কী হতভাগ্য সেই দেশ, যেখানে শুধু বীরেরই প্রয়োজন হয়।”
ব্রেশট নিজেও তো বীর হতে চান নি। তিনিও গ্যালিলিওর মতোই, শহীদ হবার বদলে, সমাজের প্রয়োজনে এবং অবশ্যই নিজেরও প্রয়োজনে বেঁচে থাকার দরকার ছিল তার। কিন্তু এ হারেমের দুনিয়ায় বাঁচতে হয় হারামির মতো। যেমন বেঁচেছিলেন মাদার কারেজ!
১৯৩৯ সালে লিখলেন ‘মাদার কারেজ অ্যান্ড হার চিলড্রেন’।মাদআর কারেজের কাজ ছিল যুদ্ধের বাজারে যেনতেন প্রকারেন সৈন্যদের রসদ বেচে কিছু কামিয়ে নেওয়া। যেমন মরা সৈনিকের শিরস্ত্রাণ, কোমর বন্ধনি, অস্ত্রাগার থেকে হাতিয়ে আনা তলোয়ার, শতছিন্ন ঝলমলে পোশাক, মদ, রুটি চাপাটি।
মা মোটেই সাহসী হতে চান নি। বরং নিজের তিন ছেলে মেয়েকে বুঝিয়েছেন, বেশি বীরত্ব সাহস দেখাতে যেও না। বেশি সৎ হতে যেও না, দয়ালু হয়ো না এই সমাজে, এমন সব মানবিক গুণ যার থাকে, সেই মরে। তবু যে মার নামের সঙ্গে কারেজ শব্দটা জুড়ে গিয়েছিল, তার কারণ একবার ঘোর যুদ্ধের মাঝখান দিয়ে বেদম জোরে গাড়ি হাঁকিয়েছিলেন তিনি।
সৈন্যদের রসদ বিক্রি করার ঠেলাগাড়ি। আসলে চাপাটিগুলো পচে যাচ্ছিল কিনা, তাই না দৌড়ে উপায় ছিল না মা-র। লোকে তা বোঝেনি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক বিপদ মাথায় নিয়ে এক যুদ্ধ থেকে আরেক যুদ্ধে রসদের গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে মা গাইছেন জীবন যুদ্ধের গান-
নাটকঃ মা অভয়া
( মা-র গান )
অনেকদিন আগে আমার সবুজ বয়সকালে ভাবতাম কেউকেটা হব, বাঁচব রাজার চালে। ভাতে পড়লে মাছি আমার চাকরবাকরদের- খিস্তি করে ভূত ভাগাতাম স্বপ্ন ছিল ঢের!
ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী আমায় হঠাৎ বলে যায়, “সবুর কর কয়েক বছর পড়বে এসে সেপাই। যেথায় যাবে ফৌজ, তুমি যেও তাদের পথে, কদমতালে পা মিলিয়ে গান গেও একসাথে”।
ইচ্ছে ছিল পাকড়ে ধরে পক্ষী্রাজের ডানা আসমানেতে দেব পাড়ি, স্বপ্ন হল কানা।
যখন আমার গতর ভরা রণস্থলের ধুলো, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর সাথে আবার দেখা হল। বলল “তোমার ফেরার পথে পাঁচিল সারি সারি। মৃতদেহের ওপর দিয়েই ঠেলতে হবে গাড়ি”।
বেশ বুঝেছি, ঘাড় গুঁজেছি, ফৌজি পথে পথে, কদমতালে পা মিলিয়ে গাইছি ওদের সাথে।
শেয়ালের মতো বাঁচতে চেয়েছিলেন মাদার কারেজ। কিন্তু যুদ্ধ তো আরো বড় শেয়াল। সেই শেয়াল খেল মার তিন সন্তানকেই। তবু গাড়ি টেনে চললেন তিনি। একা। নতুন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। আগে আগে চলেছে মরা সৈনিকের কুচকাওয়াজ।
রক্ত মেখে কান্না ঢেকে চল কদমতালে হেই সামালো বিপদ তোমার সঙ্গ ধরে চলে। নিজের ভায়ের রক্ত ঝরাই পাওনা হল কি? যুদ্ধ থেকে বাঁচলে পরে খিদেয় মরেছি।
মাদার কারেজ চান নি সাহসী, সৎ, গুণবতী, দয়াবতী হতে। কিন্তু আর একটি মেয়ে তা চেয়েছিল। চেয়েছিল নিজে ভালো হতে ও অন্যের ভালো করতে। কিন্তু তা কি পারা যায়? না কি বাঁচতে হয় এই সমাজের সাথে টক্কর দিয়ে হিংস্র নেকড়ের মতো?
নাটকঃ গুড পার্সন অফ সেটজুয়ান
রচনাকালঃ ১৯৪১
স্বর্গরাজ্যে হুলস্থুল। এ পৃথিবী নাকি আর ভালো মানুষের বাসযোগ্য নয়। তিন দেবতা এলেন তদন্তে।অনেক কষ্টে খুঁজে পেলেন একজন ভালোমানুষ। নাম শেনতে । ধাম সেটজুয়ান। পেশায় পতিতা। দেবতাদের দেওয়া পয়সায় ছোট্ট একটা তামাকের দোকান দিন শেনতে। প্রেমে পড়ল বেকার পাইলট ইয়াংসুনের। বেকার প্রেমিকের ঘরে রাত কাটিয়ে ফেরার সময় এই নোংরা শহরটা তার চোখে ধরা দিচ্ছে নতুন রূপে।
নাটকঃ শংখপুরের সুকন্যা
জানকী।। এই শহরটাকে এত ভোরে আমি কোনওদিন দেখিনি। আগে তো এই সময় নোংরা চাদরে মুখ ঢেকে শুয়ে থাকতাম। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা খবরের কাগজ ফেরি করছে, শক্ত পোক্ত লোকেরা রাস্তা ধুচ্ছে, মোষের গাড়িতে করে গাঁ থেকে তাজা শাকসব্জী শহরে আসছে। হর্ষর বাড়ি থেকে এখানটা আনেক দূর, তবু যত হাঁটছিলাম ত্ত ভালো লাগছিল। সব সময় শুনেছি, ভালোবাসলে নাকি লোকে হাওয়ায় ভাসে। না, মাটিতে, এই পৃথিবীর শক্ত মাটিতেই হাঁটে। এই ভোরবেলায় বাড়িগুলো সব মনে হয় বিশাল জলের স্তুপ, ভিতরে ছোট ছোট টুনি জ্বলছে। আর আকাশটা, গোলাপি, স্বচ্ছ্ব, একটুও ধুলো নেই। ভোরবেলায় শহরটার ঘুম ভাঙছে, যেন বয়স্ক সৎ, অভিজ্ঞ কারিগর আড়ামোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠে তার যন্ত্রপাতিগুলো আদর করে হাতে তুলে দিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখতে না পেলে একটা মানুষের জীবন বৃথা।
কিন্তু শিগগিরই বাধল ঝামেলা। ভালোমানুষের কাছে সকলের দাবির অন্ত নেই। বাড়িউলির আগাম চাই, প্রেমিকের যৌতুক চাই, পুলিশের ঘুষ চাই, পাওনাদারদের টাকা চাই, আশ্রয় দেওয়া চাই যত হাঘরে স্বজনকে। দোকানটা বুঝি আর টেকে না। দিশাহারা শেনতে বাধ্য হয় ছদ্মবেশ ধরতে। হাহির হয় মাসতুতো দাদা সুইতা। একশো ভাগ ব্যবসায়ী। গলায় বাঘের ডাক। মগজে শেয়ালের ধূর্তামি। এতদিন একই চরিত্রের নানামুখ দেখিয়েছিলেন ব্রেশট। এই নাটকের মুখদুটো পরিষ্কার আলাদা করে দিলেন। দেখালেন, বুর্জোয়া সমাজে ব্যাবসা আর নৈতিকতার সহাবস্থান অসম্ভব। মানুষ শুধু তখনই ভালো হতে পারে, যখন সে খারাপ। অথচ কোনও কোনও বেচারা ভাবে, এই অবস্থাটা পালটে যাবে। কোনও চেষ্টা ছাড়াই পালটে যাবে। শেনতের বিয়ের আসরে তার হবু বর বেকার পাইলট, পনেরো টাকা না পেয়ে বিয়ে ভেঙে দেয়। স্বপ্নভঙ্গের জ্বালায় অলীক স্বপ্নকে নিয়ে তিক্ত ব্যঙ্গে গেয়ে ওঠে-
(গোবিন্দের গান/ ভালোমানুষ)
একদিন আসবে, একদিন আসবে কেউ কেউ ভাবে একদিন আসবে যেদিন সবাই উঁছু গলায় জয়ধ্বনি দেব আমরাও জয় রাজা- জয় রাজা- জয় রাজা।
ফুটপাথ থেকে এসে ভিখিরির ছেলেটা মখমল মোড়া এক বেদির ওপর সিংহাসনে বসবে যার যা ইচ্ছে নিয়ে যাও নয়ে যাও বলে হো হো হাসবে, সেই স্বপ্নের দিনও, গল্পের দিনও, অদ্ভুত দিনও আসবে।
দুনিয়ায় শুধু ভালো থাকবে মন্দ কিছু থাকবে না জ্ঞানীগুনীর কদর হবে টাকাওলার হবে না। ভাতের অভাব, অভাব শুনে লোকে হো হো হাসবে সেই স্বপ্নের দিনও, গল্পের দিনও, অদ্ভুত দিনও আসবে।
সেই সুদিনও আসে নি। তাই পাইলট ভুলতে চেষ্টা করে তার আকাশে ওড়ার স্বপ্ন। খারাপ মানুষ সুইতার কারখানার কাজ নেয় সে। ইয়াংসুন বুদ্ধিমান। তাই অন্যসব হাঘরের চাইতে তার মাইনে বেশি। শ্রমিকদের তদারক করা তার কাজ, অর্থাৎ খোঁচড়গিরি।
( অষ্টম হাতের গান ) আটটা হাতি ছিল সাহেব খানের সাতটা মুখ বুজে খাটে সাতটা বেয়াদব বাকিটা পোষমানা বুদ্ধি গাঁটে গাঁটে খোঁচড়গিরি তার আসল কাজ সবার পিছু পিছু হাঁটে। চলতে রহো ভাই খানের জঙ্গল জলদি সাফ করো তবেই মঙ্গল। মূর্খ সাত হাতি নিজেরা কাটে বন বাকিরা গায়ে দেয় হাওয়া কাজটা ঠিকঠাক করানো তার কাজ খানকে নিজ পিঠে বওয়া। জোরসে কাট গাছ খানের জঙ্গল জলদি সাফ করো তবেই মঙ্গল। নাগাড়ে গাছ কেটে ক্লান্ত সাত হাতি ঝিমিয়ে পড়ে এক ফাঁকে। সাহেব রেগে লাল, ইনাম দিল তবু, চুকলিখোর হাতিটাকে। সাতটা হাতি ধোঁকে, মগজে ঘিলু নেই আটের মাথা আছে খাঁটি বুদ্ধির ঝলকে বাকিরা কুপোকাত সাহেব হেসে কুটোপাটি। কাটরে কাট গাছ খানের জঙ্গল জলদি সাফ করো তবেই মঙ্গল।
- শহরে রটে যায় গুণ্ডা সুইতা খুন করেছে তার ভালোমানুষ বোনকে। সে গ্রেপ্তার হয়। ক্ষুব্ধ দেবতারা বিচারে বসেন। তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে, সুইতার পোশাক ছেড়ে বেরিয়ে আসে শেনতে। জিজ্ঞেস করে এই সমাজটা যিদি না পালটায়, কেমন করে ভালো থাকবো আমি? দেবতারা উত্তর দিতে পারেন না। কিছু গোঁজামিল দিয়ে, কিছু ফাঁপা সদুপদেশ দিয়ে, হাত নাড়তে নাড়তে মিলিয়ে যান শূন্যে।
কিন্তু আমরা, যারা এই নাটক দেখছি, তারা দুনিয়া ছেড়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারব না, তারাও কি চেষ্টা করব না, এই ধরিত্রীকে ভালোমানুষের বাসযোগ্য করে তোলার?
ব্রেশট যখন যেখানে গেছেন, প্রাতিষ্ঠানিকরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তার ওপর স্টাচ্যু অফ লিবার্টির দেশ আমেরিকাও তাকে দেখতে শুরু করল সন্দেহের চোখে। নির্বাসিত জীবনের একেবারে শেষ পর্বে আন আমেরিকান অ্যাক্টিভিটির জন্য হাউস কমিটির জেরার সামনে পড়তে হল তাঁকে। ব্রেশট তো বীর নন তাই নানা ছলচাতুরি করে অস্বীকার করেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযোগ, আবার জেরায় জেরবার হতে হতেও জানিয়ে দিচ্ছিলেন নিজের বিশ্বাসের কথাটাও।
স্ট্রিপলিং।।সত্যি কথা বলুন। আপনি কখনও কোনও দেশে কম্যুনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলেন কি না? ব্রেশট।। মিঃ চেয়ারম্যান, আমি যতদূর শুনেছি, আমাকে সরাসরি এ জাতীয় প্রশ্ন করা কিংবা তার জবাব দিতে বাধ্য করা, এটা বেআইনি। তবু আমি যেহেতু আমেরিকার অতিথি, আর আইন নিয়ে কোনো কূটকচালির মধ্যে ঢুকতেও চাই না, তাই মিঃ স্ট্রিপলিং এর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। না, আমি আজ কিম্বা কোনওদিন কোনও কম্যুনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলাম না। স্ট্রিপলিং।। সে কি? জার্মান কম্যুনিস্ট পার্টি? ব্রেশট।।না। স্ট্রিপলিং।।এই পত্রিকাটা দেখুন। এতে আপনার একটা লেখা বেরিয়েছে। সম্পাদকের নাম আলফ্রেড কানত্রোভিচ। এর সঙ্গে আপনার পরিচয় নেই বলতে চান? ব্রেশট।।আজ্ঞে না। পরিচয় আছে। স্ট্রিপলিং।।আপনি জানেন না উনি কম্যুনিস্ট? ব্রেশট।।কী করে জানব? জার্মানিতে যখন আলাপ হয়েছিল, উনি উইলস্টেইন প্রেসের সাংবাদিক। ওর ঘরে কম্যুনিস্ট পার্টির কোনও কাগজপত্রও চোখে পড়েনি। স্ট্রিপলিং।।আচ্ছা। কিন্তু হানস্ আইসলারকে চেনেন তো? আপনার বন্ধু।আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কম্যুনিস্ট নেতা। ব্রেশট।।চিনি। স্ট্রিপলিং।।আপনারা দুজনে মিলে ‘ডি মাসানহামে’ বলে একটা নাটক লিখেছিলেন? ব্রেশট।।লিখেছিলাম। স্ট্রিপলিং।।সেটা কী বিষয়ে লেখা? ব্রেশট।।ওটা একটা জাপানি নো নাটকের রূপান্তর। একটা প্রাচীন গল্প। মৃত্যু পর্যন্ত কোনও আদর্শে অবিচল থাকা যায় কিনা, তাই নিয়ে লেখা। স্ট্রিপলিং।।কোন আদর্শ? ব্রেশট।।পুরোনো গল্পটা অনুযায়ী আধ্যাত্মিক আদর্শ বলতে পারেন। স্ট্রিপলিং।।কম্যু্নিস্ট পার্টির সঙ্গে এই নাটকের কোনও সম্পর্ক নেই বলতে চান? আমরা জানি নাটকটায় আপনি পার্টির আদর্শ, তার আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিয়ে কথা বলেছেন! ব্রেশট।।হ্যাঁ, তা হয়ত বলেছি কিন্তু- স্ট্রিপলিং।।সোজা কথায় বলুন নাটকটা কম্যুনিস্টপন্থী না তার বিরোধী? ব্রেশট।। দেখুন, সমসাময়িক কোনও দর্শনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সাহিত্যের অধিকার। এই নাটকটা – যদিও আমি অন্তত খান বিশেক নাটক লিখেছি, তবু এটার কথাই যদি বলেন, এ হল হিটলারের বিরুদ্ধে লড়ছে জার্মানির সেইসব শ্রমিকদের অনুভূতির নাটক। স্ট্রিপলিং।।মিঃ ব্রেশট আপনার লেখালিখির সিংহভাগই কি মার্কস- লেনিনের দর্শনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে নি? ব্রেশট।। না।একেবারেই নয়। তবে ওদের দর্শন আমি পড়েছি।ঐতিহাসিকনাটক লিখতে গেলে না পড়ে উপায় নেই। লেখাপড়া নাট্যকার হওয়া যায় না। আর আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে যার প্রভাব সবচেয়ে গভীর তার নাম কার্ল মার্কস।
- মার্কসবাদ শুধু পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেনি। তাকে বদলে দিতে চেয়েছিল। বদলানোর অন্যতম উপায় হল, যে শ্রম করে, শ্রমের ফল সেই ভোগ করুক। যে জমি চাষ করে, জমি হোক তার। যে যন্ত্র চালায়, কারখানা হোক তার। তারা দাবি করুক আরও বড় জিনিস – গোটা রাষ্ট্রটাকেই।
- এই নীতিটা প্রকাশ করার জন্য ১৯৮৫ সালে লিখেছিলেন ‘ককেশিযান চক সার্কেল’। তখন যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে। চারদিকে ধ্বংসের ভয়াবহ ছবি। অনেক পরিণত হয়েছেন ব্রেশট। তখন কেবল রূঢ় বাস্তব নয়, সেই বাস্তবকে বোঝার জন্য অনায়াসে পাড়ি দিতে পারেন কল্পলোকে।
- নাটকের গোড়ায় একটা মুখবন্ধ আছে। বিপ্লবের পর, সোভিয়েত রাশিয়ার দুইগ্রামের কৃ্ষকদের মধ্যে কাজিয়া বেঁধেছে। এর আঙুর খেতের দখল নিয়ে। কারা পাবে খেত? যারা উত্তরাধিকারসূত্রে মালিক, নাকি যারা ওই খেতে ফসল ফলিয়েছে? এই সমস্যার সমাধানের জন্য নাট্যকার আমাদের নিয়ে যান এক কল্পজগতে।
নাটকঃ খড়ির গণ্ডি
গায়ক।। সে অনেক বছর আগের কথা বল না হে ঠিক মনে নাই – তা হবে চার পাঁচশ সাল তা হবে হবে এই বাংলাদেশের আকাশ জুড়ে সিঁদুরে মেঘ লাল। সারা দেশের মালিক তখন জাফর খাঁ সুলতান আর ছোট বড় নবাবেরা পরগনা চালান। দৌলতপুর পরগনাতেও এক যে ছিলেন নবাব মন্দ তাঁকে বলত তারা কারা হে? কারা? যাদের নিন্দে করা স্বভাব।ছি ছি ছি তাদের মুখে যুগে পড়ুক চুন আর কালি তাদের মুখে যুগে যুগে পড়ুক চুন আর কালি দৌলতপুরের রাজ্য চালান নবাব আব্বাস আলি নবাব আব্বাস আলি। ধনরত্নে সিন্দুক বোঝাই বেগম জ্যান্ত পরী ফুটফুটে তার ছেলের মুখে চাঁদের গড়াগড়ি। চাঁদের গড়াগড়ি (কোরাস)। অন্য কোন জায়গীরদার গৌড় পাণ্ডুতে পাল্লা দিয়ে পারবেন না তাঁর তিন সীমানা ছুঁতে আস্তাবলে হাজার ঘোড়া রাস্তাতে ভিখারি লোকলস্কর, লেঠেল, পাইক,কামান-বন্দুকধারী। হায় হায় কামান-বন্দুকধারী। দরবারে তাঁর আর্জি হাতে উমেদারের সারি দৌলতপুরের রাজ্য চালান নবাব আব্বাস আলি নবাব আব্বাস আলি। কেমন বর্ণিব আমি তাঁহার গুণগান কেমন বর্ণিব আমি তাঁহার গুণগান (কোরাস)। - ঠেকায় কেডা? সাধ আহ্লাদ পূর্ণ সবই, পূর্ণ ধনমান। - তারপর তারপর? এমতকালে একদিন ইদের মোনাজাতে নবাব এলেন মসজিদে, বেগম এলেন সাথে। নবাব এলেন, বেগম এলেন সাথে।
- যুদ্ধ! যুদ্ধ! রাজারা বিদ্রোহ করেছেন সুলতানের বিরুদ্ধে। সুলতান পালিয়েছেন। নবাব কচুকাটা। নবাব আব্বাস আলির বেগম নাদিরা পালাচ্ছেন। সেই ডামাডোলের মধ্যে নাদিরা বেগমের দাসী লুৎফার সঙ্গে দেখা হল তার প্রেমিক সিপাই মনসুরের।
মনসুর।। লুৎফা, লুৎফা, লুৎফা…… ওঃ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেলাম! তুমি কী করবে এখন? লুৎফা।। কী আবার করব? নসীপুর গাঁয়ে আমার এক দাদা আছে, অবস্থা খুব খারাপ হলে তার কাছে চলে যাবো। তুমি কী করবে? মনসুর।।আমার ওপর হুকুম নাদিরা বেগমের পাহারাদার হয়ে যেতে হবে। লুৎফা।। সেকি? মঞ্জিলের সিপাহীরা বিদ্রোহ করেনি? মনসুর।।(গম্ভীরভাবে) হ্যাঁ, তা করেছে। লুৎফা।।তাহলে ওই মেয়েলোকটার জন্য তোমার অত মাথাব্যথা কীসের? মনসুর।।ওই মেয়েলোকটার জন্য আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু হুকুম হয়েছে, আমাকে যেতে হবে। লুৎফা।।সিপাহীর মাথায় গোবর। কোনো কারণ নেই- কিছু না- শুধু শুধু সিপাহী আগুনে হাত বাড়াচ্ছে।(প্রাসাদ থেকে থানা বরদার লুৎফাকে ডাকে) আমাকে যেতে হবে। তাড়া আছে। মনসুর।।লুৎফা বিবি, তাড়াহুড়োর সময় ঝগড়া করা ঠিক নয়। ভালো করে ঝগড়া করতে সময় লাগে! একটা কথা, বিবিজানের মা-বাপ আছেন? লুৎফা।।দুনিয়ায় কেউ নেই, এক ভাই ছাড়া। মনসুর।।সময় খুব কম- বিবিজানের শরীর-স্বাস্থ্য কী রকম? জলের মধ্যে মাছের মতো? লুৎফা।।কখনো কখনো ডান কাঁধে একটা ব্যথা ওঠে। এছাড়া সব সময় সব কাজ পারি।আজ অবধি কেউ কখনো নিন্দে করে নি। মনসুর।।সে কথা সবাই জানে। ঈদের দিনেও যদি সাত সকালে নদীর ধার থেকে হাঁস নিয়ে আসার দরকার হয় তো লুৎফা বিবি একপায়ে খাড়া। আর একটা কথা, বিবি কি সবুর করতে জানেন নাকি শীতকালেই আম খাওয়ার বায়না ধরেন? লুৎফা।।সবুর ঠিকই করতে জানেন; কিন্তু যদি একটা মানুষ খেয়ালখুশি মতো যুদ্ধে যায় আর কোনো খবর না পাঠায়, তাহলে তো খুবই খারাপ! মনসুর।।কবর ঠিকই আসে।( আবার খানাবরদার ভিতর থেকে লুৎফাকে ডাকে) এবার শেষ আর সবচেয়ে জরুরি কথা…… লুৎফা।।মনসুর মিঞা, বুঝতেই পারছ আমাকে অন্দরে যেতে হবে- খুব তাড়া, কাজেই আমার জবাব, হ্যাঁ।
প্রাসাদ জুড়ে হুলস্থুল।পালানোর আগের মুহূর্তেও নাদিরা বেগম কেবলই এটা নেন , সেটা নেন। শাড়ি, গয়না। আর এই করতে গিয়ে, ভুলে গেলেন নিজের বাচ্চাটাকেই। সেই পরিত্যক্ত শিশুকে কোলে তুলে নেয় লুৎফা। দৌড়, দৌড়। লুৎফা ছুটছে। কোলে বাচ্চা। পিছনে ছুটে আসছে কালোকুর্তা সিপাইএর দল। ওই বাচ্চাকে তাদের চাই। নির্বংশ করা চাই নবাবকে।
হাবিলদার।। মাথামোটার দল, তোদের দিয়ে কোনোদিন কিস্যু হবে না। কেন বল তো? কাজেকম্মে মন নেই।( তারা নীরবে পায়চারি করে)সবসময়- সবসময়- তোমাদের বেয়াদপি- আমার চোখে পড়ে না ভাবছ? এই তো ল্যাংচাচ্ছ। কেন? আরে বারণ করছি না ল্যাংচাতে? কৌশল? খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বোঝনোর চেষ্টা আর এগোবে না? সে গুড়ে বালি- সব জমা রইল। গান কর – গান কর-
২য় সৈন্য।।যুদ্ধে এলাম অকালে ফাগুন মাসের সকালে ঘরে রইল বিবি যদ্দিন না ফিরি তোরা একটু নজর দিবি
১ম সৈন্য।।দেবে দেবে দে -এ বে -এ –এ।
হাবিলদার।। চ্যাংড়ামি হচ্ছে, জোরে গা –
১ম সৈন্য।। যখন শোব কবরে নাম উঠবে খবরে একটি মুঠো মাটি ছড়িয়ে শুধু বলবে বিবি লোকটা ছিল খাঁটি।
হাবিলদার।। এবার চল হাঁটিহাঁটি। এবার চল হাঁটিহাঁটি।। (হাবিলদার চাবুক মারে, সিপাহীরা টলতে টলতে চলে যায়) হায় আল্লা, তোদের মতো বুদ্ধুদের নিয়ে কীভাবে যে আমি নবাবের বেজন্মা ছেলেটাকে কব্জা করবো।
লুৎফা অনেক চেষ্টা করেছিল ছেলেটাকে ওদের হাত থেকে বাঁচাতে। এমনকি প্রেমিকের ভুল বোঝার সম্ভবনা সত্ত্বেও বিয়ে করেছিল বুড়ো ইউসুফকে। তারপর প্রেমিক যখন যুদ্ধ শেষে ফিরে এল, সেদিনই বাচ্চাটাকে খুঁজে পেল সেপাইরা। সুলতানের সেপাই। রাজাদের বিদ্রোহ দমন করে ফের তখৎ এ বসেছেন তিনি। ফিরে এসেছেন নাদিরা বেগম। তিনি ওই বাচ্চার দখল নিতে আদালতে মামলা করেছেন। বাচ্চা কার? যে তার মালিক, না যে তাকে পালন করেছে? এই নিয়ে মোকদ্দমা। বিচারকের নাম মুস্তাক। অরাজকতার মধ্যে ফাঁকতালে বিচারক হয়ে গেছে সে। এক মোহভঙ্গ বুদ্ধিজীবী। মাতাল,লম্পট, ঘুষখোর। কিন্তু মুস্তাক ব্যতিক্রমের বিচারক নয়। লোককথার বিচারক। তাই একটা গণ্ডীতে দাঁড় করানো হয় বাচ্চাটাকে। দু পাশে লুৎফা আর নাদিরা। যে টেনে নিতে পারবে, বাচ্চা তারই। আপনারা সবাই গল্পটা জানেন। বাচ্চার লাগবে তাই লুৎফা দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। আর জিতে যায় লুৎফাই। বিচারক মুস্তাক জিতিয়ে দেয় তাকে। ব্রেশট নাটক শেষ করেন সেই পুরোনো চাওয়া দিয়ে-
গায়ক।। যারা শুনলেন এই খড়ির গণ্ডীর বৃত্তান্ত মনে রাখবেন এই গল্পের সাদাসিধে সিদ্ধান্ত যে কোনও জিনিস হাতে পাবে সেই, যোগ্যতা আছে যার গাড়ী যাবে ভালো চালকের হাতে ছুটবে সে জোরদার শিশুকে দেখবে স্নেহময়ী নারী বড় হয়ে ওঠে যাতে ফসল ফলাবে যারা, খেতমাঠ যাবে সেই চাষীর হাতে।
চতুর্থ প্রবাহ ১৯৪৯-১৯৫৬
- যুদ্ধ শেষ হল।পৃথিবীর মানচিত্রে ঘটে গেল অনেক অদল বদল।পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে উড়ল লাল ফৌজের পতাকা। ব্রেশট ফিরে এলেন তাঁর দেশে। প্রিয় বার্লিনে।
- সমাজতন্ত্রী সরকার সাদরে বরণ করে নিয়েছিল তাঁকে। পেয়েছিলেন নিজস্ব থিয়েটার বার্লিন আঁসম্বল। সামনে উড়ছে পিকাসোর আঁকা শ্বেত পারাবত। বইছে স্প্রে নদী। রয়েছে নাটক নিয়ে এতদিনের সব ভাবনার প্রকাশ ঘটানোর, তাই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার স্বাধীনতা! আর কীই বা চাওয়ার থাকতে পারে মানুষের?
- তবু চাওয়ার ছিল । সত্যিকারের শান্তি বোধহয় কোনও দিনই পান নি। বরং ভুল সময়ে ভুল উপায়ে, ভুল মানুষদের হাতে তৈরি সমাজতন্ত্রের মধ্যেও ভুল খুঁজে পাচ্ছিলেন।
- “স্বপ্ন দেখি আমি এক রাজমিস্ত্রি। লোহার কর্নিক হাতে দাঁড়িয়ে আছি অট্টালিকার উপরে। গাঁথতে চাইছি স্বপ্নের ইমারত। কিন্তু মশলার কড়াইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়া মাত্র, নামল আঘাত। লোহার কর্নিক খসে গেল আমার হাত থেকে।”
- ১৯৫৩র ফুড রায়টের সময় পূর্ব জার্মানির শ্রমিকরা দাবী জানাচ্ছিলেন এই শাসকমণ্ডলী বাতিল কর। অন্য শাসকদের আমরাই নির্বাচিত করব। ব্রেশট একটা ছোট্ট কবিতায় লিখেছিলেন,-
- “ এঁদের বাতিল করার দরকার কী? তার চেয়ে বরং এই জনগণকেই বাতিল করে দেওয়া যাক। সেটাই হবে সহজ।”
তখন লুকিয়ে রেখেছিলেন কবিতাটা। ছাপা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর। কতটা মোহভঙ্গ হলে, নিজেকে নিয়ে , নিজের স্বপ্নকে নিয়ে এমন মর্মান্তিক ঠাট্টা করতে পারে মানুষ? মৃত্যুর পর ব্রেশটকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর বাড়ির কাছেই। অনাড়ম্বর কবরের ওপর শুধু একটা আঁকাবাঁকা পাথর। তাতে খোদাই করা তাঁর নাম। “ সত্য বটে, আমি আছি অন্ধকার যুগে। শহরে আমার আসা বিশৃঙ্খলার সময়ে যখন ক্ষুধাই রাজা। মানুষের মধ্যে আমার আসা যে গণ-উত্থানের লগ্নে, আর আমিও বিদ্রোহী। তাই তো ফুরিয়ে গেল আমার সময় মর্ত্যে যেটকু আমার ভাগে ছিল।
আমার খাওয়া সারতে হয়েছে হত্যাকাণ্ডের ফাঁকে ফাঁকে, আমার ঘুমের উপরে পড়েছে খুন খারাবির ছায়া, আমার প্রেমের মধ্যে তাই তো এসেছে ঔদাসীন্য। নিজের স্বভাবে আমি বোধ করেছি অধৈর্য। তাই তো ফুরিয়ে গেল আমার সময় মর্ত্যে যেটকু আমার ভাগে ছিল।
আমাদের কালে পথের শেষ হয় চোরাবালিতে। আমার বাকশক্তিই আমায় ধরিয়ে দিয়েছে কসাইদের হাতে। অল্প আমার ক্ষমতা। কিন্তু আমি না থাকলে শাসকেরা আরো নিশ্চিন্ত হত। এই অন্তত ছিল আমার আশা। তাই তো ফুরিয়ে গেল আমার সময় মর্ত্যে যেটকু আমার ভাগে ছিল।
তোমরা যারা বেরিয়ে আসবে এ বন্যা থেকে যাতে আমরা ডুবছি ভেবে দেখ, যখন তোমরা আমাদের দোষত্রুটি হিসেব করবে, তখন ভেব এই অন্ধকার যুগের কথাও যার জঠরের ব্যথায় এর জন্ম। কারণ আমরা দেশ পালটিয়েছি জুতোর পাটির চেয়ে বেশিবার। বাধ্য হয়ে শ্রেণি সংগ্রামে, মরিয়ে ব্যথায়, যখন অন্যায় ছিল, ছিল না তার প্রতিরোধ। কারণ ভালোই জেনেছিলুম দারিদ্রের প্রতি ঘৃণায় ললাট হয়ে ওঠে নির্মম কঠিন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে রাগ তাতেই কণ্ঠ হয়ে ওঠে কর্কশ। হায়রে! আমরা যারা প্রাণ দিতে গেছি দয়ামায়ার বনিয়াদ গড়বার জন্য আমরা নিজেরা দয়ামায়া রাখতে পারি নি। তবুও, তোমরা, যেদিন শেষটায় সহজ হবে মানুষের পক্ষে সব মানুষকে হাত এগিয়ে দেওয়া, সে দিন তোমরা আমাদের বিচার কোরো না খুব একটা কর্কশতায়।”
ব্রেশটের সমস্ত কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইতিহাসের অলোয় নিজের সময়কে চিনতে শেখা, নিজের ভূমিকা স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়া এবং সেই উপলব্ধির সোচ্চার প্রকাশ ঘটানো। যে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তিনি পথ হেঁটেছেন তা তো আজও পার হওয়া যায় নি। হয়তো যুদ্ধের দামামা এখনও বাজছে না, কিন্তু যুদ্ধের দম বন্ধ করা বুক কাঁপানো প্রস্তুতি কি চোখে পড়ে না আমাদের? যদি তাই হয় তবে ব্রেশটকে চাই। আরো বেশি করে। তাকে আমরা বারবার দেখেছি খণ্ড খণ্ড করে। জাতীয়তাবাদী ব্রেশট, কম্যুনিস্ট ব্রেশট, নৈরাজ্যবাদী ব্রেশট। এই হল ওনার তত্ত্ব। এই হল বিষয়। এইটা টেকনিক। কিন্তু নানা ব্রেশটের একখানা মালা গাঁথা হলেও, তার তো সুতো থাকবে কোনও। সেই অখণ্ড সূত্রটা আজও খুঁজে পাওয়া গেল না। কেন? বহুদিন ধরে বহু পণ্ডিত পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কস তাকে বদলে দিয়ে চেয়েছিলেন। ব্রেশটকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে নানাভাবে। এবার তাঁকে বদলে নেবার সময়।
(গান/ ব্যতিক্রম)
নাটক তো ফুরোলো। নটে গাছটি মুড়োলো। চোখের ওপর দেখতে পেলেন কীসের থেকে কী হল। একটা কথা বলি শেষে বিচার করে নিন রোজ যা ঘটে সত্যি হবে তাই কি চিরদিন? চিরকেলে নিয়ম দেখে রা সরে না মুখে নিয়ম তো নয় মিথ্যে করে সুযোগ নিচ্ছে লোকে মিথ্যে বলে চেনেন যদি, একটা কিছু করুন আপনারা সব মেয়ে পুরুষ বৃদ্ধ এবং তরুণ একটা কিছু করুন সবাই একটা কিছু করুন।।