প্রকাশিত, নতুন বই, 'নিঃসঙ্গ সম্রাট ও অন্যান্য নাটক'।
সপ্তর্ষি প্রকাশন, জুন ২০২২
কৌশিক রায় চৌধুরীর বেশিরভাগ কবিতাই এতদিন অপ্রকাশিত ছিল। খুশিতে, বেদনায়, ব্যক্তিগত অনুষঙ্গে রচিত সেসব। খুুঁজে পাওয়া প্রায় শতাধিক কবিতার মাত্র কয়েকটিই ছাপা হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকায়। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কৌশিকের কবিতাসমগ্র ।
এক ছিল মন্ত্রী মশাই
পরত সে ধুতি মেরজাই
বামুন বাড়ি নেমতন্ন হলে।
থ্রি পিসেও আপত্তি নেই
হ্যাট-কোট দিব্যি মানায়
সারতে ডিনার সাহেব বাড়ি গেলে।
দুচোখে সুর্মা আঁকায়
ফেজ আর লুঙ্গি চাপায়
ইফতারেতে দাওয়াত টাওয়াত পেলে।
পোশাকের ভড়ং ছেড়ে
সেক্যুলার ন্যাংটো গোঁসাই
রেন্ডিখানায় ব্র্যান্ডি খেতে চলে।।
অপ্রকাশিত কবিতা। বইমেলা ২০০৪।
ঝাঁপ দিয়েছ মনের ডুব জলে
পথ হারাল গহন বনে বনে
স্বপ্ন এল এক সাগর নীলে
পাশে হাঁটলে বৃষ্টি ভেজা দিনে।
উড়িয়ে নিল মরুভূমির ঝড়ে
সেজে উঠল বাসন্তী পর্বত
এ সব কিছু তোমারই তরিবৎ
বোঝা যাচ্ছে তুমি এসেছ ফিরে।
ঝাঁপ দিয়েছ মনের মধ্যে তাই
ঢেউ গোলক ওঠে শরীর জুড়ে
তোমার হাতে মাথা রাখতে চাই
বাঁচতে চাই তোমার মধ্যে ম'রে।
আছিল বাকি যতেক ভালোবাসা,
যতেক চুমা পায়নি ঠোঁট খুঁজে
সেসব আজ নেবেই চিনে দিশা
দাঁড়াও যদি সামনে চোখ বুজে।
[ জন ডেনভারের ' You fill up my senses' গানের অনুসরণে ]
প্রতিটি দিন রাতের দিকে যায়
তেমনি করে সহজ প্রতীক্ষায়
আজ শুধোই কটা পড়ল লাশ
বন্ধু বলে, তিনটে, উরিব্বাস!
একটা হল আমার বাড়িওয়ালা
শুনেছি নাকি সুদখোর সে ছিল,
কে মেরেছে? তপন দাড়িওয়ালা,
এই সেদিন দুধ ছাড়া চা খেলো!
দ্বিতীয়জন পাড়ার ফেরিওয়ালা
দশ নয়ায় দিত হরেকমাল
তৃতীয় জন নিরীহ হোমগার্ড
না ছিল ঢাল, না ছিল তরোয়াল!
আমার বাড়ির দুধ বা চিনি ছাড়া
চা খেয়ে যায় হাজার শত জনা
সিপিআই করে কাকা এবং এস এফ
করেন দাদা, আমার কত চেনা
জেঠুরা করে কংগ্রেস আর বাবা
পালিয়ে ফেরে গ্রামের থেকে গ্রামে
সিপিএমের জরুরি ব্যস্ততা
কখন কোথায় খড়্গ এসে নামে!
কখন কোথায় ইন্দিরাজির কোপ
লাঠিয়ে দেখো যে কোনো ঝাড় ঝোপ
সিআইএ'র এজেন্ট আছে সুপ্ত
গৌরকিশোর, বরুণ সেনগুপ্ত?
সত্তর আর পঁচাত্তরের ফারাক
নিয়ে লিখুক বিবেক দেবরায়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিশোরবেলা
সাঁঝ ঢললে পশ্চিমেতে চায়।।
*২০০৯ সালে লিখিত, অপ্রকাশিত, শিরোনামহীন কবিতা*
প্রতিটি দিন রাতের দিকে যায়,
তেমনি করেই সহজ প্রতীক্ষায়
কাগজ খুঁঁজি, লাশ পড়ল কটা !
একটা নাকি চারটে পাঁচটা ছটা ?
আজকে গেল পাড়ার ফেরিওয়ালা
দশ নয়ায় দিত হরেক মাল,
কাল গিয়েছে আমার বাড়িওয়ালা
না ছিল ঢাল , না ছিল তরোয়াল।
দাদা বলেন, ও ছিল সুদখোর
কে মেরেছে? শুনেছি বিশুকেই
ধরেছে থানা, বিশুদা মানে তোর
অতসীদিদি ভালোবাসতো যাকে।
অতসী দিদি জেগে কাটায় রাত
রক্তমাখা জামা লুকিয়ে রাখে
দিনে বানায় ঠোঙা যে দুটি হাত
সে দুটি হাত আগলে রাখবে কাকে?
গুলি চলল জেলের মধ্যে যেদিন,
আলকাৎরা মাখা বিশটা চোখ
ভাবছিল কি স্বপ্নে দেখা মে দিন
অতসীদির সিঁদুরে রাঙা হোক?
[ অপ্রকাশিত শিরোনামহীন কবিতাটির সম্ভাব্য রচনাকাল ২০১০ ]
ছড়ানো ছিটোন ঘর সংসার
সেই মায়াবী সন্ধ্যায়
হাঁটতে হাঁটতে
আমরা মৌলালী পার হয়ে গেলাম।
পা বাড়ালাম
আমাদের নির্জন হৃদয়ের দিকে।
ধীরে ধীরে ডানা ছড়িয়ে দিল সম্পূর্ণ কলকাতা
আকাশ ঝলসে উঠল মাঘীপূর্ণিমার তীব্র চাঁদে
আর কথার জোয়ার এল নিঃঝুম মনের ভিতর।
শিয়ালদার উড়ালপুলে
হৈ হৈ করে খেলে বেড়াচ্ছে শহর -
খেলুক!
নাচছে কলকাতা -
নাচুক না! এসো,
আমরা পৌঁছুই
গম্ভীর পাতার
সারি সারি দেওদার গাছে ঘেরা
প্রশান্ত মনের অতলান্ত অনুভূতিতে।
ঠাসবুনোট দোকান পশারের মাঝে
গমগমে নিয়ন আলোর জমকালো বিজ্ঞাপন
আর শূন্যে টলমল জ্যোৎস্নার ভিতর
চতুর্দিকে ধ্বংসনগরীকে তুচ্ছ করে
আমাদের হৃদয় মাতাল
মাতাল হোক, ভাঙ্গুক
ভাঙ্গুক বাঁধ,
পথ চলতে চলতে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে,
এসো, আমরা সন্ধি করি।
-- চাঁদ
-- আমাদের একান্ত দেওদার বন
এসো , তোমরা সাক্ষী থাকো
-- সানাই তোমার ভালো লাগে?
-- মরশুমী ফুল?
তাহলে বাজুক না সানাই,
তোমার ইচ্ছে হয়ে ফুটুক না ফুল
লাখে লাখে, হাওয়ায় দুলুক
ঝলমলে রোদে
হেসে খেলে, থেমে
তাল দিক সানাইয়ের সমে।
কিন্তু কথা শোন,
কাজ নেই ফুলের মেলায় গিয়ে।
কথা শোন, মেতো না উৎসবে।
চলো,
ঐ ঘাসের রিক্ততায়
টালমাটাল পায়ে
আমরা হাঁটি।
আমি জানি,
কাঁটা ফুটে ঘটতে পারে অনেক দুর্ভোগ
তা হোক্।
আপাতত হেঁটে যাবো
ব্রাত্য ঘাসের পিঠ দিয়ে।
চলো,
দিগন্তকে আড়াল করি,
আমাদের দৃষ্টি
শুধু আমাদেরই বিদ্ধ করুক।
বসন্তের সমূহ চক্রান্ত
পদানত করে
আমরা পাবই পাব
রক্ত মাংসের ফুল।
আমরা বুকে টেনে আনি আকাশ,
শরীরে ধাক্কায় ভাঙ্গি ঝোড়ো হাওয়া,
উত্তাল কবিতায় ভরিয়ে দিই মাঠ,
চিড়িয়াখানার প্রাচীর ঘেঁষে
আমরা দৌড়ই লোকালয়ের দিকে।
আমাদের সন্ধিতেই তো এই জয়যাত্রার শুরু।
চলো, এই তীব্র দৌড়ের প্রান্তসীমায়
পৌঁছতে পৌঁছতে
আমরা আমাদের জয়যাত্রার পতাকা উড়াই
আকাশে আকাশে,
অশ্রু, ঘাম আর রক্তে ভেজা কবিতার দুর্জয় লাইন
ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিই
মানুষের নিশ্বাস প্রশ্বাসে।
এসো, এসো
তোমরাও এসো,
এসো চৈত্র বসন্তের দিন
এসো ফুলের শোভা, সানাইয়ের তার
এসো কোকিল দোয়েল, লক্ষ্মীর পা, উঠোনের আলপনা
তুমিও এসো আমাদের বুক জোড়া মামনি,
দেখো, দেখো তোমরা
আমাদের সকলের ঘরে এলো
আমাদের ভালোবাসার
প্রার্থিত, আনন্দিত দিন।
[ কবিতাটি শুভ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত 'রৌরব' পত্রিকায় ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ]
বুকের ভিতর
যদিও দীর্ঘ বল্লম হাতে নিয়ে
আগুনের মধ্যিখানে বসে আছি,
আসলে আমাদেরও ঘুমের ভেতর
একটা নরম স্বপ্ন নদী আছে,
গোলাপ বাগানে,
ওগো
সোনার চুলে জাফরানী রুমাল বাঁধা মেয়ে,
আসলে আমাদেরও
অন্দরের আনাচ কানাচে
বৃষ্টিভেজা ঝাউবন আছে।
এই জ্বলে ওঠা খটখটে দিনে
পাহাড় পর্বতে, প্রতিটি পদক্ষেপে
ঝরাপাতার পাহাড় ভাঙ্গি, দ্যাখো --
বুক পকেটে মৃত্যু নিয়ে, পায়ে পায়ে
দুর্ঘটনার শঙ্কার মধ্যে
এই যানজটের পাগলাগারদেও
বুকের ভেতর
আমরা জাগিয়ে রাখি পরম যত্নে
ভীষণ নরম স্বপ্ন নদী
খুন খারাবী রাঙা দেহের
প্রস্ফুটিত গোলাপ বাগ।
[ কবিতাটি শুভ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত 'রৌরব' পত্রিকায় ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ]