বাঙাল কইতে পারমু না ক্যানে ...

আরো গোড়ার একটা ভাষাগত পরিচয় দিয়ে শুরু করি - শুনেছি যে জন্মসূত্রে আমি “খাঁটি ঢাকাই”, অর্থাত আমার চৌদ্দ-গুষ্টি-ই ঢাকাশহরের বসবাসকারী ছিল। ৪৭-এর আগে আর পরে নানান পথ ধরে আমার চার দাদু-দিদারা কোলকাতায় এসে সমবেত হয়। এনাদের দুইজনের কৃচ্ছসাধন আর সংগ্রামের কাহিনী আমার পরিবারে তাদের প্রবাদপ্রতিম জায়গা করে রেখেছে। এনাদের কাহিনীর ছাড়াও যেই নানান অতীত নিয়ে আমার কোনো ঠাকুমা, বর্ষিয়শী পিষি বা মাসিদের গর্ব করতে শুনি, তার কিছু নমুনা হলো - “আমরা হইলাম ঢাকাই, বুঝলা ?”, বা আমাদের বড়ি দিয়ে আড় মাছ, বা অমুকের ঠাকুমার বা বাপের বাড়ির শুটকি রান্নার কাহীনি। আমার প্রয়াত পিষি-ঠাকুমা ওপার থেকে আসার পর সারা জীবন নদীয়া জেলার বাঙাল-অধ্যুষিত গয়েশপুর গ্রামে জীবন কাটিয়েছে, আমরা দেখা করে ফেরত যাওয়ার সময় আমার মা কে বলত “মৌসুমী, অনেকদিন বাইচ্যা থাইক্যো”, মনে হতো এই কথাটা আর কেউ বলেনি।


আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম যে তাদের পরের প্রজন্ম, অর্থাত আমার বাবা-কাকা-মামা-রা, কদাচিত ঢাকাইয়া বলত। বিশেষ করে যারা কোলকাতাবাসী। ঢাকাইয়া বলত ব্যাঙ্গ করার উদ্দ্যেশ্যে, ঢাকাইয়া ছিল অমার্জিত বুলি। দুই প্রজন্মের মধ্যে মুখের ভাষার এতো তফাত আর এতো ভিন্ন মনোভাব খুবই অস্বাভাবিক। নিজের বোধবুদ্ধির মধ্যে একটা অস্বাভাবিকতাকে স্থান দিতে হলো আরো বৃহত্তর একটি প্রক্রিয়া বা ছবির অংশ বিশেষ হিসেবে দেখতে হয়। সেরকম কিছুর হদিস ছিল না, খালি একটা ছোটখাট ক্ষোভ পোষণ করতাম।


এই অসঙ্গতিটা আমি আমার পাড়াতেই দেখতাম। আমি বড় হয়েছি ঢাকুড়িয়ায়, খুব মধ্যবিত্ত বাঙাল পাড়া। ঢাকুড়িয়া আর তার আশেপাশের সেলিমপুর, গর্ফা, হালতু নানান দফায় পূর্ব বঙ্গ থেকে পরিযানের সাক্ষী হয়েছে। এর সর্বাঙ্গে তার ছাপ আছে, নানান কাহিনী আর স্মৃতি চারিদিকে। দোকানীদের, আমাদের দর্জিকে বাঙাল বলতে শুনলে, রাস্তার পাশের অতি জীর্ণ পুরানো মিষ্টির দোকানে সগর্ব “প্রসিদ্ধ ঢাকাই মিষ্টি প্রস্তুতকারক” লেখা, বা ছোট সেলুনের গায়ে “ইস্ট বেঙ্গল হেয়ার কাটার” দেখলে একটা না-দেখা দেশের প্রতি অদ্ভুত একটা টান অনুভব করি, শিকড়ের খোজ পাই। অথচ সিনেমায়, টেনিদার গল্পে সব ক্ষেত্রেই বাঙাল-স্বভাবটা গেয়োঁ আর অমার্জিত রূপে দেখে এসেছি, আর হাসির খোরাক হিসেবে।


ঘটনাটার ব্যাখ্যাটা আমি পেলাম মাত্র কয়েকদিন আগে, জিনিসটার সাথে একটা লম্বা ইতিহাস আর ক্ষমতার রাজনীতি জড়িয়ে আছে। এতো সুদীর্ঘ আর প্রথাগত এই ব্যাপারটা, যে আমরা আজন্ম এই ব্যাঙ্গই দেখতে অভ্যস্ত হয়েছে, অপরিহার্য্য অঙ্গ হিসেবে মেনে নিয়েছে। এর গোড়ায় যাওয়ার আগে কয়েকটা মজার কথা বলি ইতিহাসের পাতা থেকে। এই অভ্যাসটা শুরু হয়েছিল অন্তত ৮০০ বছর আগে! মোটা দাগে বলতে গেলে, পূর্ব বঙ্গের একাধিক ভাষা ছিল পশ্চিম বঙ্গের মানুষদের কাছে হাস্যকর আর “বেঠিক”। পূর্ব আর পশ্চিম বঙ্গ বিভাজনটা কিন্তু কার্জন করে নি। রিচার্ড ঈটন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রি থেকে শুরু করে আরো অনেক ঐতিহাসিকরাই পূর্ববঙ্গের মধ্যে একটা খুব আলাদা, স্বকীয় সাংস্কৃতিক পরিচয় খুজে পেয়েছিল সহশ্রাব্দ আগেও। মূল ভারত ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দুর্গম একটা এলাকা, প্রথাগত ব্রাহ্মণ্য, ইসলাম বা বৌদ্ধ ধর্মের আওতার বেশ বাইরে। ৮০০-১০০০ বছর আগে হঠাত করে পদ্মা নদী বিপুল প্রবাহে যখন পূর্ব বঙ্গে বইতে শুরু করে, বাকি বঙ্গদেশের সাথে এই বিচ্ছিন্ন এলাকাটা প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়, আর শুরু হলো পরিচিতির সংঘাত।


১৪০০-র শতাব্দীতে প্রথম মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের আবির্ভাব হয়, মঙ্গলকাব্য আকারে। পাঁচালি আকারে লেখা এই কাহিনীগুলোতে নানান সুখ দুখ বিপর্যয়ের মধ্যে কমিক রিলিফ দেওয়ার একটা বহুল-ব্যাবহৃত উপাদান ছিল পূর্ববঙ্গীয় মাঝিদের আহাজারি [১]। এ ছাড়া সিলহেট, চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে মজা করেও কবিতা আছে। শ্রী চৈতন্য নিজেও সিলহেট থেকে এসেও এই কৌতুকটি করেছেন। ১৮০০-র শতাব্দীতে ঢাকা আর কোলকাতার অনেক পত্রিকা পূর্ববাংলার ভাষাগুলিকে বেঠিক বাংলা বলে দাবি করতে শুরু করে।


এই ব্যাঙ্গটা কিন্তু শুধু হাস্য-কৌতুকে সীমিত ছিল না কোনদিনই। এর সাথে ক্ষমতার একটা নিবিঢ় আতাত আছে। প্রকৃতপক্ষে, দোষি হচ্ছে - “প্রমিত বাংলা” নামের একটি বস্তু। এর অন্য কিছু নাম আছে যার থেকে একে চিনতে আরো সহজ হবে - “সরকারি বাংলা”, “স্ট্যান্ডারডাইজড বাংলা”, বা “মান-ভাষা”। লক্ষণীয় যে আমাদের ইতিহাসের সিংহভাগ সময় ধরেই শাসনের কেন্দ্র ছিল পশ্চিম বাংলায়। পাল, গৌড়, সেন, আর সুলতানি আমলের রাজাদের রাজধানি ছিল গৌড় বা মালদায়, মোগল আমলে ঢাকা প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রথম , বারের মতো পদ্মার পূর্ব পারে কিছু ক্ষমতা চালান হয়, আবার নবাবী আমলে সেটা চলে যায় মুর্শিদাবাদে। সুলতানি আমল থেকেই সাহিত্যের মূল পৃষ্টপোষক ছিল পশ্চিম বঙ্গের রাজা আর তাদের অধঃস্তন রাজারা। তাই তাদের অঞ্চলের কথ্য ভাষাই হয়ে উঠলো সঠিক বাংলা।


তবুও, ব্রিটিশরা আসার আগে অবধি কেন্দ্রীয় শাসনের প্রভাব এতই স্বল্প ছিল যে কথ্য ভাষাগুলি খুবই স্বতন্ত্র ভাবে টিকে ছিল। সুনীতি চ্যাটার্জি আর সুকুমার সেন [৩,৪] ধ্বনিসমূহ, শব্দকোষ আর উচ্চারণের ভিত্তিতে ৮টি মূল উপভাষা চিহ্নিত করেছিলেন। এইগুলি পরস্পরের থেকে এতই ভিন্ন যে উভয়ত বোধগোম্য না। আর এই বিভাজনটা তৈরি হয়েছিল বঙ্গদেশের প্রধাণ নদী গুলি দিয়ে। ব্রিটিশ ভাষাবিদ গ্রিয়ারসান তার আকরগ্রন্থে [২] এই নানান এলাকার নিজস্ব বাংলার নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের পত্তনের পরেই অভূতপূর্ব দুইটি ঘটনা ঘটল। এর থেকে আমাদের ভাষা আর ভাষা সম্পর্কৃত চেতনা আমুল বদলে গেল। প্রথমটি ছিল ছাপাখানা স্থাপন আর ৭-টি প্রচলিত বাংলা হরফের মধ্যে থেকে ১-টিকে অক্ষরমালা বলে মনোনীত করা।


দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশরা দ্রুত বাংলা শেখার জন্য, দফায় দফায় ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের সাহাজ্য নিয়ে একটা ব্যাকারণ বিধি আর ভাষা তৈরি করে ফেলল। প্রথমবারের মতো বাংলা প্রমিতকরণ হলো, অর্থাত স্ট্যান্ডার্ডাইজেশান হলো। এদের এই প্রকল্পটা শুরু হয়েছিল ফোর্ট উয়িলিয়াম কলেজের পত্তন থেকে, এবং প্রায় ১০০ বছর ধরে সরাসরি ইংরেজ সরকারের অর্থ অনুদানে।


এই সব ইতিহাসের সাথে আমাদের বাঙালদের সমপর্ক কি ? উপরোক্ত ঘটনাটাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “সাহেব-ব্রাহ্মণ পাপ”। ক্রিশ্চিয়নদের “আদি-পাপ” নামের একটি তত্ত্ব আছে, যেটা অনুযায়ী সব পাপকর্ম কে বলা হয় সৃষ্টির শুরুতে্রর একটি অনিচ্ছাকৃত পাপকর্মের অনিবার্য পরিণাম হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ আক্ষরিক অর্থে “original sin” শব্দবন্ধটি ব্যাবহার করেছিলেন ব্রিটিশদের এই কৃত্রিম, মন-গড়া “ভাষা আর ব্যাকরণ”-এর জন্য। জার্মান ছাড়া বাংলার মতো আর কোন ভাষাতে এতো বৈচিত্র্য নেই। কিন্তু আর কোন ভাষাতেই, প্রমিত রূপের সাথে কথ্য ভাষার এতো তফাত ছিল না। ব্রিটিশ সান্নিধ্য আর ব্রাহ্মণ-টোল থেকে সৃষ্ট ভাষাটি রবীন্দ্রনাথ, হরপ্রসাদ এবং রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখেরা পরবর্তীকালে নানান দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করে সর্বমতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারা বলেছিলেন যে (সেই সময়কার) প্রমিত বাংলা অতি কৃত্রিম এবং অচেনা, কথ্য ভাষার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই ভাষাই সরকারি ভবনগুলি থেকে ক্রমশ স্বতন্ত্র পত্রিকাগুলিতে ছড়িয়ে পরল, এর নানান কুফলের মধ্যে ছিল-


১) বিরাজমান বাংলা ভাষাগুলিকে “আঞ্চলিক” বলে অভিহিত করা, আর তাদে সম্মানহানি

২) ব্রিটিশদের চাকরিরত বাবু সমাজকে এই প্রমিতকরণ মাধ্যমে শ্রেণিগত উত্থান ঘটানো,

৩) শিক্ষাব্যাবস্থা যাদের সামর্থের বাইরে, তাদের নিজস্ব শতাব্দী পুরানো ভাষাই হয়ে দাড়ালো তাদের অশিক্ষার আর নিম্নশ্রেণি হওয়ার পরিচয়

৪) সংস্কৃত ভাষার অনুপ্রবেশ, এবং পরবর্তীকালে সেটা ভিত্তি করে প্রথমবারের মতো সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা।


এই পর্বটার নানান বিচিত্র সরকারি ষড়যন্ত্র, সংশোধনি প্রচেষ্টা আর উথাল পাথালের আর বিষদ দেব না, এ নিয়ে গবেষকরা বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে গেছেন [৫,৬]।


১৯৪৭-এর পর প্রথমার, প্রমথনাথ বীশির আর অন্যান্যদের উদ্যোগে এর সংশোধন হয়ে আজকের বর্তমান প্রমিতরূপ পেল। সরকারি ভাষা প্রথমবারের মতো একটি বিস্তীর্ণ আঞ্চলিক ভাষার সন্নিকটস্থ হলো, কুষ্টিয়া - রাজশাহী-যশোর- নদীয়া-শান্তিপুর, হাওড়া-হুগলি জেলার ভাষার সাথে অনেক সাদৃশ্য পেল। কিন্তু এই সঠিক বেঠিকের ধারণাটা রয়ে গেল। স্কুলের পাঠ্যক্রমে প্রমিতরূপ শেখানোর হয়তো বিকল্প নেই, কিন্তু একাডেমির বিধি-নির্দিষ্ট ভাষারুপ যাতে, (আমার প্রিয় চিন্তক মোহাম্মদ আজমের ভাষায়) “যতটা সম্ভব কম নিপীড়ক হতে পারে”, তার কোন প্রয়াস ছিল না। আমাদের বৈচিত্র্য সম্পদ হিসেবে ব্যাবহৃত না হয়ে প্রতিহত করা হলো। এর কুফল আমি চাক্ষুশ দেখেছি অসংখ্যবার, যেমন নিজের ঢাকাই পরিবারে ঢাকাইয়ার প্রতি অবজ্ঞা, আর হোস্টেলে পড়তে আসা বাঁকুড়া বিরভূম জেলার ছাত্রদের রাঢ় ভাষার টান নিয়ে মজা করা।


তথ্যসূত্র


[১] আশুতোষ ভট্টাযার্য্য – বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস

[২] Linguistic Survey of India, Vol. 5, Pt. 1 Indo-Aryan Family. Eastern Group. Specimens of the Bengali and Assamese Languages, George Grierson.

[৩] বাংলা ভাষা ও উপভাষা, সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স

[৪] "Indian Journal of Linguistics". 20. Bhasa Vidya Parishad. 2001: 79

[৫] বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার মোহাম্মদ আজম

[৬] উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য - দেবেশ রায়