"... ভগবান প্রজাপতি মনের আনন্দে সৃষ্টি করে চলেছেন, সৃষ্টির পর সৃষ্টি! বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর। তখন পৃথিবীতে শুধু সৃষ্টিই আছে, ক্ষয় বা মৃত্যু নেই। এমন সময় তার কানে এলো ক্ষীন কাতর কন্ঠঃস্বর। নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল যেন অস্বাচ্ছন্দ্যের কোনো গন্ধ... তার সৃষ্টির একটা বৃহৎ অংশ জীর্ণ মলিন স্থবির র্কশ হয়ে গিয়েছে... ওই গন্ধের সৃষ্টি করেহে জীর্ণ সৃষ্টির জরাগ্রস্ত দেহ।
...সঙ্গে সঙ্গে তার অঙ্গ থেকে ছায়ার মত কিছু যেন বেরিয়ে এলো, ক্রমে সে ছায়া কায়া গ্রহণ করল - একটি নারীমূর্তি দাড়ালো তার সামনে কৃতাঞ্জলি হয়ে। পিঙ্গলকেশী, পিঙ্গলনেত্রী, পিঙ্গলবর্ণা, গলদেশে মনিবন্দ্ধ্ধে পদ্মবীজের ভূষণ, অঙ্গে গৈরিক কাষায়; ... প্রজাপতি বললেন - তুমি আমার কন্যা। তুমি মৃত্যু। সৃষ্টিতে সংঙ্ঘার কর্মে জন্য্ তোমার সৃৃৃৃষ্টি হয়েছে।
চমকে উঠলেন মৃত্যয - অর্থাৎ সেই নারীমূর্তি আর্তস্বরে বললেন - এ কি নারীর কর্ম ? আমার নারীর হৃদয় ... দেখতে দেখতে সেই অশ্রুবিন্দুগুলি হতে এক এক কুটিল মূর্তির আবির্ভাব হলো। ভগবান বললেন - এরা হল রোগ; এরা তোমারই সৃষ্টি; এরাই তোমার সহচর। ... সব পাপ পুণ্যের ঊর্ধে তুমি । পাপ তোমাকে স্পর্শ করবে না।... তুমি অন্ধ হলে, দেখতে তোমাকে হবে না... তুমি বধির হলে। কোন ধ্বনি তোমার কানে যাবে না ...
জগদবন্ধু মশায় বলেছিলেন - মৃত্যু অন্ধ, মৃত্যু বধির। রোগই তার সন্তানের মত নিয়ত তার হাত ধরে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে - নিয়ম - কাল। যার কাল পূর্ণ হয়, তাকে যেতে হয়। আমাদের যে পঞ্চম বেদ আয়ুর্বেদ - তার শক্তি হল কাল যেখানে সহায়ক রোগের, সেখানে রোগকে প্রতিহত করা..."
-- তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, আরোগ্য নিকেতন , পরিচ্ছদ ৮,
মানুষ প্রায়সই কোনো বিরাট, জটিল কর্মকান্ডকে কোন বৃহত্তর কাহীনি বা আবহমান ঘটনার অংশ বানানোর চেষ্টা করে এসেছে। অর্থাত কগুলি বিশ্বাস, অনুমান আর ইতিহাস বিবৃতির ঘেড় তৈরি করে রাখে যা তার সেই কর্মকান্ডের পিছনে চেতনায় রেবিরাজ করে, ব্যখ্যা জুগিয়েযায়, আগামীর আস্বাস বা নির্দেশনা যোগায়। এই "সর্বোপরি সত্য" বলে যেটাকে প্রতিষ্টা করা হয় সেটারই আরেক নাম - তত্ত্ববিশ্ব।
ফলিত গণিতেও আমরা এরকমটাই করে থাকি, সেই ক্ষেত্রে আরো সাদা মাটা ভাবে আমরা সেটাকে ছাঁচ বলব (ইং model )। মানুষের বিশ্ব-কৌতুহল মেটানোর একটা ধারালো অস্ত্র হলো এই গাণিতি ছাঁচ বানিয়ে তাতে কোনো আবেক্ষমান ঘটনাকে আটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। গণিতের ছাঁচ বানানোর নানান তরিকা, কাহীনি আর বাধা সম্বন্ধে আমরা এই পর্বে জেনে নেবো।
তারাশংকরের আরোগ্যনিকেতন এমনই দুই বিপরীত মুখী তত্ত্ব-বিশ্বের সংঘর্ষ। কবিরাজির যুগ শেষ হয়ে আধুনিক চিকিতসার যুগে বদলে যাওয়ার সন্ধিক্ষণের বর্ণনা। দুই তত্ত্ব-বিশ্বের সংঘর্ষ, দুই প্রজন্মের আর বিশ্ববীক্ষণের সংঘর্ষ নিয়ে তারাশংকর এক মহা উপাখ্যান বানিয়েছেন। কবিরাজির সীমাবদ্ধতার সামনাসামনি হয়েও কবিরাজ জীবন ডাক্তার এই ভেবে আশ্বাস পান যে ওনার কবিরাজির তত্ত্ববিশ্বে উনি আজীবন নিষ্ঠার সাথেই কাটিয়েছেন। সেই তত্ত্ববিশ্ব আধুনিক জনমানসে বা চাহিদায় গ্রহণ হোক বা না হোক। ওপরের উদ্ধৃতিটা ওনার বাবার বচন, জন্ম-মৃত্যু, বৈদিক বিশ্বাসরীতি, চিকিৎসকের ভূমিকা আর দায়িত্ব, সব কিছু সমন্বিত করে একটা তত্ত্ব-কাঠামোর হদিস দিয়েছিলেন তার শিক্ষানবিশী পুত্রকে।
গাণিতক ছাঁচেরও সীমাবদ্ধ থাকে, তার জন্ম, বেড়ে ওঠা আর মৃত্যু হয়, সমন্বয় অথবা ক্ষুদ্রকরণও হয়।
" তখন টুনিকে বোঝাতে লেগে গেলো আমেনা - ওলা বিবি, বসন্ত বিবি। আর যক্ষ্মা বিবি - ওরা ছিল তিন বোন। তিন বোন একপ্রাণ... একদিন যখন খুব সুন্দর করে সেজেগুজে ওরা রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলো তখন হঠাত হজরত আলীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল... আর তহনি এক কাইন্ড কইরা বসলেন তিনি। খপ কইরা না ওলা বিবির একখান পা ধইরা দিলেন জোরে এক আছাড়। আছাড় খাইয়া একখানা পা ভাইঙ্গা গেলো ওলা বিবির। আহা সব খোদার কুদরত।...
মকবুল সঙ্গে সঙে বলে উঠলো - একখান পা দিয়া দুনিয়াডারে জ্বালাইয়া খাইতাছে বেটি। দুই পা থাকলে তো দুনিয়াডাঅরে একদিন শেষ কইরা ফালাইতো..
ওর কথা শেষ হতেই ফাতেমা জানালো - গত রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে... একটা খোড়া কুকুর খুড়িয়ে খুড়িয়ে ওদের গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। "
-- জহির রায়হান, হাজার বছর ধরে, পরিচ্ছদ ৯
ছাঁচ বানিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে তার মধ্যে আঁটানো শুধু গণিতকারদের কাজ নয়। মানুষ অনাদিকাল থেকে সেটাই করে এসেছে তার পরিপার্শ্বকে বুঝতে। পরকাল চিন্তা, ঈশ্বর-অদৃষ্ট চিন্তা, সবই এক-একটা ব্যখ্যান বা ছাঁচ। আমাদের বাংলা অঞ্চলে যেহেতু জনমিতির অভাব, আর লৌকিক রীতিনীতি ঠিক ভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি, কথা-সাহিত্য থেকেই অনেক সময় নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। প্রাক-৪৭-এর পূর্ব বঙ্গের গ্রামীন, বিশেষ করে মুসলমান গ্রামীন মানুষদের জীবনচর্যা আর ধর্মাচরণ সম্বন্ধে একটা দারুণ সচেতনতা আর বিবরণ পাওয়া যায় জহির রায়হানের "হাজার বছর ধরে"-তে। পুরোপুরি শাস্ত্রীয় অনুশাসন না মানা, আর প্রাচীন টোটেম পুজা আরো অন্যান্য সংস্কৃতি বিশ্বাস রীতি ধরে রাখা এই বর্গের মানুষদের একটা ছাঁচ নির্মাণের উদাহরণ পাওয়া যায় ওপরের উদ্ধৃতিটায়। ওলাওঠা বা কলেরার নিয়ে যেই সীমাহীন আতংক ছিল, সেটাকে নানান কল্পকাহীনির মধ্যে বেধে শুধু নিজেদের জীবনে মেনে নেন নি, খাপ খাইয়েছেন কিছুটা তাদের শাস্ত্রীয় নির্দেশ মতে, কিছুটা বিধবা-বৈরীতার প্রাচীন সামাজিক রীতির সাথে, কিছুটা তাদের পরিচিত জগৎ-এর মানুষ আর তাদের বেশ-ভূষার সাথে। নিজেদের চেনা জানা কর্মজগত, বাস-জগত আর জিজ্ঞাসা-জগত - এই তিনের পরিধির মধ্যে এই কাহীনি বা ছাঁচ সম্পূর্ণ দ্বন্দবিহীন ব্যাখ্যান দেয়, রোগের বাস্তবতা একটা আবহমানতা দেয়। গণিতের ছাঁচ ঠিক এই কাজটাই করে। একটা নির্দিষ্ট ঘের[১]-এর মধ্যে গাণিতিক ছাঁচ সম্পূর্ণ বিবরণি দেয়, ব্যাখ্যান ক্ষমতা রাখে।
লাগোয়া ...
১) ঘের-এর সঙ্গায়ন এখানে করা হয়েছে।