ভাষা আর গণিতের আখড়া


মানুষের মনে ভাষা কি ভাবে জন্ম নেয় ? নাকি মানুষ জন্ম নেয় ভাষার মধ্যে [১] ? ভাষা দিয়ে চিন্তার গঠন [২], নাকি চিন্তা থেকেই ভাষার উৎপত্তি [৩]। বিদ্যমান বাস্তব কে বোধের মধ্যে আনতে ব্যাকরণ আর শব্দাবলী তৈরি, নাকি ব্যাকরণ আর শব্দালী থেকেই নিরাকার বাস্তবজগতকে আমরা নিজেদের মতো আকার দিই ?

ঠিক একই প্রশ্নগুলি গণিত নিয়েও করা যায়। গণিত চিন্তা আমাদের সহজাত, নাকি অর্জিত, শিখে নেওয়া একটা গুণ ? গাণিতিক চিন্তা, বিমূর্ততা আসলে কি ? এর কতোটা মানুষের চিন্তার সাথে লীন, আর কতোটা কৃত্রিমতা ?


এই সব সুপ্রাচীন প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচারা করার জন্য এই
ইন্টার্নেট আখরা

গণিত আর ভাষাকে মেলাবার চেষ্টা কেন? আমাদের পরিচিত জগতের দুইটা অভিজ্ঞতার কথা ধরা যাক। একটা হলো, বৈষ্ণব সভায় বা দরগায় কীর্তন বা জিকির। অন্যটা হলো, স্কুল জীবনের উচু ক্লাসে উঠে ক্যালকুলাস নিয়ে আমাদের কালঘাম ছড়ানো। এতো আলাদা দুইটা অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা সমসত্ত্বতা হলো, দুইটাই সঠিক ভাবে গ্রহণ করতে হলে, কিছু কিছু নির্দেশ মেনে আমাদের মাথায় এইগুলিকে ভেঙে আবার গড়তে হয়।

কীর্তন বা জিকির দুই-ই হলো ভাববাদী ঘরানার সঙ্গিত। এতে কথা বা শব্দের ভূমিকা গৌণ। এই গানের টান মানুষে মানুষে মাত্রাগত ভাবে খুব আলাদা, আর ইতিহাসের বিভিন্ন সময়েও ছিল আলাদা। মাত্র কয়েক লাইনের বহর হওয়া সত্তেও ভাববাদী গানের আবেদন মানুষ, স্থান, আর সময়ের সাথে এতো বদলায় কেন, সেটা বুঝতে হলে একমাত্র রাস্তা হলো অর্থবিজ্ঞান বা নিরুক্তজ্ঞান (ইং-semantics)। অন্য জায়গায় খতিয়ে দেখানো হবে যে- যে কোনো লিখন বা উচ্চারণ, যখন আমাদের সামনে হাজির হয় প্রচুর "মানে"-এর বোঝা সমেত আসে, বা মোড়ক সমেত। পাঠক বা শ্রোতার কাজ হলো নিজের মতো করে সেই মোড়ক খোলা। এই পুরো প্রক্রিয়াটা নিয়ে প্রাচীন ভারতের পানিনি আর যাস্ক ঘরানা থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপের স্যসুর, রোমান ইয়াকভসন, লেভি-স্ট্রৌসেরা নানান তরিকা দিয়েছেন, সব কিছুর মূলে একটা গাণিতিক অধিকাঠামো (ইং superstructure) -এর হদিস পাওয়া গেছে।

এবার আসা যাক ১১-১২ ক্লাসের ক্যালকুলাসের ক্লাসের প্রসঙ্গে। প্রায় সবারই বিরক্তির কারণ ছিল কারণ পুরো ব্যাপারটাই দাড়াতো সমাকলন আর অনুকলন এর নিয়ম দিয়ে চলরাশিদের মারপাচ, ছাত্রদের পক্ষে উদ্দেশ্য খুজে পাওয়াই ছিল মুষ্কিল। পেশাদারী ভাবে গণিত করে বুঝেছি যে গণিতবিদ-রা সর্বসম্মতিক্রমে ক্যালকুলাসকেই সবচেয়ে কঠিন মনে করে সঠিক ভাবে পড়ানোয়র জন্য। মজার ব্যাপার হলো, "ক্যালকুলাস"-এর একটা মানে হলো " নির্গত" ভাষা। প্রকৃতপক্ষে, ভাষাতত্ত্বের সাম্প্রতিকতম গাণিতিক বিবরণিতে ভাষাকে "ক্যালকুলাস" হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। আমরা দেখবো যে ক্যালকুলাস (বা অংক) পারা বা না-পারার সাথে, অন্যের কথার মানে বোঝা বা না-বোঝার সাথে অভিন্নতা আছে। অংক না পারা শুধ ব্যাক্তি-বিশেষের খামতি নয়, কতটা অর্থপূর্ণ ভাবে তার কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেটাই মুখ্য।

অংক করতে পারা, আর ভাষা থেকে মানে সঞ্চয় করা, দুইটাই নির্ভর করে বাহ্যিক "ব্যাকরণ"-এর ওপর [৪, ৫], আর খুবই সুপ্ত স্তরের মানসিক প্রস্তুতির ওপর [৬]।

যেই জিনিসই ভাষার পিঠে চড়ে আমাদের কাছে আসে, যেমন খবর, সাহিত্য, কথোপকথন, সেই সবেরই দ্বিস্তরীয় ব্যাখ্যান তৈরি করি এই বাহ্যিক আর অভ্যন্তরীন নিয়ম-নীতি দিয়ে। ভাষা তত্ত্বে গণিতের সাহাজ্যে খুবই চমৎকার ভাবে তা বাগে আনা হয়েছে, এ নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু কাজ আমি এই পাতায় আলোচনা করে দেখবো।

অন্যদিকে শিল্পকলা, যেমন সঙ্গিত, ছবি, সিনেমা - সেইগুলির এই দ্বিস্তরীয় গঠন চিনতে পারলেও এর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যান বা বিবরণি হতে এখনো দেরি আছে। এ নিয়ে আমি নিজে কিছু বিশেষ ক্ষেত্র পরীক্ষণ করেছি, এইখানে তার একটা নমুনা।

প্রথমে তোলা প্রত্যেকটা প্রশ্নের মধ্যে একটা দ্বৈত্য-ভাব আছে। মানুষের কর্মের আর চিন্তার প্রায় সব ক্ষেত্রেই, এই দ্বৈত্যের যৌগিক উপস্থিতি স্বীকৃত হয়েছে। লেভি স্ট্রসের নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়ণে আদলপন্থা / কাঠামোবাদ (ইং structuralism), প্রাচীন সংস্কৃত ব্যাকারণবিদ-দের থেকে শুরু করে ফার্দিনান্দ দি স্যসুরের ভাষাতাত্ত্বিক কাঠামোবাদ, আধুনিক গণিত থেকে উতপন্ন "ক্যাটেগরি থিওরি"-র শব্দাবলী দিয়ে ভাষা আর অর্থজ্ঞান-এর সমন্বয়, এই সব কিছুতেই মানুষ আর তার ভাষা, চিন্তা, সমাজ - সব কিছুই অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠছে।

ভাষা তাত্ত্বিক অধ্যয়ণ থেকে সরে এসে মানুষের আর সমাজের চিন্তার বিবর্তন আর ক্রমধারাগুলিতেও দেখা যাবে একই দ্বৈত্যভাব বিদ্যমান। আমাদের ব্যাক্তিগত আর গোষ্টিবদ্ধ চিন্তা, আকাঙ্খা, হতাশা, আরাধনার পাত্র - এই সব কিছুই নানান মাধ্যমে অভিব্যাক্ত হয়, আমাদের গণমাধ্যমে, আমাদের জনপ্রিয় সিনেমা বা বইয়ের চরিত্র নির্মাণে, আমাদের নেতাদের প্রচারণায় আর তাদের হার-জিতে, আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ের ইতিহাস লিখনে, আমাদের প্রতিদিনের বাসে ট্রামের আলাপ-আলোচনায়। এর থেকে জন্ম নিচ্ছে রাজনীতি, ক্ষমতার লড়াই, ভাষার লড়াই, আমাদের সাম্প্রদায়িকতা অথবা সম্প্রীতি।

" ...গাঙ্গজোড়া মীন রয়েছে
সংক্ষেপে নেও রে বুঝে
লালন বলে জল শুকাইলে
সেদিন মীন যাবে হাওয়া
য় ..."


মানুষের নানান কর্মকান্ডের ধারাগুলিকে, যদি এক-একটা সুতা মনে করা হয়, তাহলে ব্যাক্তি-মানুষ আর তার সমাজ বা গোষ্ঠি, সকলকেই এক-একটা জট মনে করা যেতে পারে। অজস্র সুতা এসে ঢুকছে, মিশ খাচ্ছে, জট বাধছে, নতুন অজস্র সুতা হয়ে বেড়োচ্ছে। ভিতরে আসা সুতাগুলি ধরা যেতে পারে আমাদের অতীত আর পারিপার্শ্বিকের বোঝা - আমাদের ইতিহাস চেতনা, উত্তরাধিকারবোধ, আমাদের রাজনৈতিক অথবা ক্ষমতায়নের চাহিদা, আমাদের মনভূমিতে তৈরি হয়ে থাকা ভালো-বাজে, মূল্যবান-গৌণ বিভাজন বোধ। জটথেকে বেড়োনো সুতাগুলি আমাদের নতুন চিন্তা আর চাহিদা, আমাদের নতুন নতুন ফেরেশ্তা অথবা শয়তান।

আমরা এক-একজন প্রচুর জটিলতার একএকটা গিট। কিন্তু সবাই-ই পরস্পরের সাথে জটিল জালে আবদ্ধ। এতো বৈচিত্র্য সত্তেও এই জটিল জালের এক-একটা আঙিনায় তৈরি হচ্ছে এক-একটা অভিন্নতা বা ঐক্যমত্য - অদ্ভুত ভাবে যার ঘেড় বেড়েই চলে। এর শ্রেষ্ট উদাহরণ হলো ভাষা, মানুষের যৌথচেতনার সবচেয়ে বিস্ময়কর পরিণাম। রাজনীতির আদর্শ, নেতা, রাষ্ট্র, এই সবকিছুই সমষ্টিগত ঘটনা।

আমাদের ইতিহাস, ঘটমান বাস্তব, আর বাস্তব খতিয়ে দেখতে গেলে তাই শেষ পর্যন্ত এই গিটগুলি ছাড়াতে হবে। কোনো কিছুকে ধ্রুব না মনে করে, নিজগুণে ঠিক-ভুল, সঠিক-বেঠিক, গৌণ-মুখ্য বিবেচনা না করে, মানুষের মনভূমিতে এদের ফলিত রূপ দেখলেই সঠিক ভাবে এর বিচার করা যাবে।

লালন কি এই গভীর নৃতাত্ত্বিক, মনোজাগতিক অন্তর্দৃষ্টি নিয়েই এই কথাগুলি বলেছিলেন ?

"... মানুষ ছাড়া মন রে আমার
দেখবি ভবে সব শূন্যকার
ফকির লালন বলে - মানুষ আকার
ভজলে পাবি..."


আমার এই আখড়াটা বানানোর একটা মুখ্য উদ্দেশ্য হলো বাংলায় উচ্চতর গণিত চর্চা করা। এই সব ব্যাপারে প্রথম বিচার্য্য বিষয় হওয়া উচিত যে এই সবের প্রয়োজনীয়তা কি, দশের জন্য অথবা ভাষার জন্য। তাত্ত্বিক আর ফলিত গণিতের কিছু নমুনা নিয়ে কিছু প্রতিবেদনও আছে। গণিতে পরিভাষা নিয়ে আমার কিছু চিন্তাও রেখেছি, বাংলা ভাষায় এর বিরাট ঘাটতি বোঝার চেষ্টা করেছি। পরিভাষা তৈরির কিছু নিয়ম-নীতিতে পৌছানোর চেষ্টা করেছি। এইধরণের প্রকল্প, যা ভাষার সাথে জড়িত, কখনো একক প্রয়াস হতে পারে না। আপনাদের এ ব্যাপারে মতামত আর উপদেশ খুবই দরকার।

বাংলা ভাষায় গাণিতিক পরিভাষার ঘাটতি বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চা আর যুক্তি-চর্চার করার অভাবেরই একটা ফল। এর সাথে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ
রাজনীতি, এ নিয়েও আমার বেশ কিছু আলোচনার ফর্দ আছে। ভাষা রাজনৈতিক টানাপোরেনের একটা জীবন্ত দলিল, সেটা নিয়ে গভীরে খতিয়ে দেখা হয়েছে এখানে। ভাষা শুধু লিখিত জিনিস নয়, সবচেয়ে মামুলি, নিরীহ কথাবার্তাতেও ব্যাবহৃত শব্দাবলীও নিজস্ব ভাষা-গুণে, মানুষের মন কে নির্দেশনা দিতে থাকে। ইতিহাস লিখন-এর পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যাপারটাও খতিয়ে দেখা জরুরি মনে করেছি।

গণিত আর ভাষার তাত্ত্বিক বিষয়গুলি ছাড়াও, সাহিত্য-বিষয়ক আমার কিছু লেখালেখিও রেখেছি।

বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই লেখাগুলি আমি ওপরে নানান ফর্দে সাজিয়েছি। যেই প্রকল্পগুলিতে হাত দিয়েছে, সেইগুলি কোনোমতেই আমার প্রথম উদ্যোগ নয়। আমার আলোচনা থেকে আর তথ্যসূত্র থেকেই তা পরিস্কার হবে। তবে আমার বিশ্বাস এইগুলি অবহেলিত হয়েই রয়েছে। আমি নিজের মতো করে এই প্রকল্পগুলিকে এই আখড়ায় সমন্বিত করেছি।

পড়ে জানান কেমন লেগেছে।
তার চেয়েও ভালো হবে যদি এই প্রকল্পগুলির অংশী হন।

--শুদ্ধসত্ত্ব দাস
২১শে ফ্রেব্রুয়ারি, ২০২১

তথ্যসূত্র

[১] Language structure: You're born with it

[২] Semiotics for Beginners - D Chandler

[৩] The Language of Thought Hypothesis - publ. Standofrd University

[৪] Mathematical foundations for a compositional distributional model of meaning- Coecke et al 2010

[৫] From Logical to Distributional Models, author- A. Preller

[৬] Pregroups and natural language processing - J Lambek