ভাষা আর চিন্তায় - বাক্সবন্দিকরণ

ঈশ্বরচন্দ্রের কাহীনি অবলম্বনে বানানো "ভ্রান্তি বিলাস" সিনেমার একটা বিখ্যাত দৃশ্য। শেকস্পিয়ারের "কমেডি অফ এররস"-এর মতো, এই বইটাও, সমহিমায় আর নাম চয়নের গুণে, একটা পুরো ঘরানারই নাম বা পরিচয়বাহক হয়ে গেছে। অর্থাত ভুল বোঝাবুঝির থেকে ক্রমশ বাড়তে থাকা বিভ্রান্তিকেই এই ভ্রান্তি-বিলাস নামেই ডাকা যায়।

ভ্রান্তি-বিলাস ঘরানার সব কাহীনিরই কৌতুক উৎপন্ন হয় ভুল বোঝাবুঝি থেকে। দুই পক্ষই শুরুতে একটা পরিস্থিতিকে আলাদা আলাদা ভাবে সাজিয়ে রাখে মনে মনে। কাহীনি যতো গড়ায়, নানান ঘটনার মাধ্যমে তাদের এই খাপ-না-খাওয়া ধারণাগুলি একই সাথে আরো বদ্ধমূল হয়, আবার বিভ্রান্তিও তৈরি করে চলে। এই দুই লেখকের মতো নিটোল ভাবে কাহীনি নির্মাণ করলে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্যতাও পায় - প্রত্যেক পক্ষ প্রাথমিক ঘটনা আর আবেক্ষণগুলিকে তাদের বোধের মধ্যে আনতে কিছু কিছু "বর্গ" / "খাপ" / "বাক্স" অথবা মৌলিক ধারণায় ভাগ করে সাজায়। তাদের বোধের অসঙ্গতির ফলে এই খাপ অথবা বর্গগুলির মধ্যেও শুরু থেকেই অমিল থাকে। নতুন নতুন ঘটনাগুলিকে, দুই পক্ষ সেই আগে থেকে তৈরি ধারণা বা খাপেই খাপ খাওয়াতে থাকে। এর থেকেই ভুল বোঝাবুঝি বেড়ে চলে।

এই পর্বে আলোচনা মূলত এইসব "খাপ" নিয়ে। মানুষের বোধ, ভাষা, সংজ্ঞা আসলে এরকম স্বনির্বাচিত খাপে খাপে ভাগ করা থাকে। এদের মিল-অমিল থেকেই জন্ম নেয় যতো বিবাদ, ঐক্য, এমনকি তাদের আগামী মানসিক ক্রমপরিণতি। নানান দৈনন্দিনের উদাহরণের মাধ্যমে এই গুঢ় বিষয়গুলি উল্টে পাল্টে দেখবো।

ইংরাজি উপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষ সুন্দরবনের পটভূমিতে "হাংরি টাইড" লিখেছিলেন। সেখানে আমেরিকা-নিবাসি এক গবেষক "লোয়ার গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন" নামের এক বিরল প্রজাতির ডলফিনের সন্ধানে সুন্দরবনে আসে। গল্পের মাঝখানে গবেষক সেই ডলফিনের হদিস পেতে স্থানীয় জেলেদের সেই ডলফিনের ছবি দেখায়, জেলেরা মাথা নেড়ে জানায় যে প্রাণিটাকে তারা চেনে আর দেখেছে, প্রাণিটা শুশুক। এ শুনে গবেষক একটু হতাশ হন, শুশুক প্রকৃতপক্ষে অন্য এক প্রজাতির নাম, জেলেরা একই গোত্রের দুই প্রজাতির মধ্যে বিবেধ-জ্ঞানের অভাবে গুলিয়ে ফেলেছে।

উপন্যাসটার নানান গুণের মধ্যে একটা হলো বাস্তব-লিপ্ততা। জেলেদের আর গবেষকের মধ্যেকার কথপোকথনেও এরকম একটা নিত্যকার বাস্তব চিত্র ধরা পরে যাচ্ছে। আধুনিক পশ্চিমা বিজ্ঞানের অগ্রগতির একটা আনুষঙ্গিক প্রপঞ্চ হলো জ্ঞানের বিভক্তিকরণ, আর সুক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ধ্যান-ধারণা, বৈশিষ্ট্য সনাক্ত করে সেইগুলির চিহ্নায়ন বা পৃথক নামকরণ। এই জ্ঞানের সাথে আমাদের মতো দেশের লোকায়ত জ্ঞান কুল পায় না - প্রায়সই এই জ্ঞানের খামতি দেখা যায়, এই জ্ঞানজগতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণাগুলি সঠিক আটিয়ে নেওয়াও যায় না।, যদি না কিছুটা প্রথাগত বিদ্যা অর্জন তাদের হয়ে থাকে।

এই পুরো গরমিলটার মূলে কিন্তু অজ্ঞতা বা পান্ডিত্য কোনোটাই নেই। মূলে আছে ভাষা - আরো স্পষ্ট ভাবে, ভাষায় ব্যাবহৃত সংজ্ঞা-মালা। সংজ্ঞার অনেক নাম আছে - বিশেষ্য, আখ্যা, নাম, চৈতন্য, বোধ ইত্যাদি। "গাছ" "আকাশ" যেমন এক-একটা সংজ্ঞা, ঠিক তেমন গণিতে শেখা "রেখা", "বৃত্ত"-ও একএকটা সংজ্ঞা। এই চারটা সংজ্ঞা - গাছ, আকাশ, রেখা, বৃত্ত - এরা কোনোটাই শুধুমাত্র জিনিস নয়, অথবা শুধুমাত্র নিরাকার ধারণাও নয় । এরা প্রত্যেকেই দুইটাই। অন্যভাবে বলতে গেলে, এরা একই সাথে ধরা-ছোঁয়া জিনিসকেও বোঝাতে পারে, আবার খুব নিরাকার কোনো ধর্ম-সমষ্টিকেও বোঝাতে পারে। যেমন "গাছ" একটা ঘোরতর বস্তুজগতের জিনিস, ধরা-ছোঁয়া গেলেও শব্দটার মধ্যে প্রচুর বিমূর্ততা নিহিত আছে, গাছ বলতে কোনো একটা বিশেষ গাছকে না বুঝিয়ে গাছের বৈশিষ্ট্য সংবলিত যে কোনো উদ্ভিদকেও বোঝানো যায়। আবার সাধারণ কিছু শব্দে, যেমন "বংশ-লতিকা", ভূতত্ত্বে ব্যাবহৃত "গাছ-সদৃশ নকশা" (ইং dendritic pattern) -এ গাছ শব্দ থেকে আসল গাছের শাখা-প্রশাখায়িত হতে থাকার স্বভাবটাকে ব্যাবহার করে "গাছ"-কে চমৎকার প্রতিকী অর্থ প্রদাণ করেছে। একই ভাবে, কাগজে টানা সোজা দাগ-কে আমরা "রেখা " বলে চিনতে পারি, আবার বাস-স্টপে মানুষের সারি দেখে সেই একই প্রণালিবদ্ধতার স্বভাব দেখেও তাকে লাইন বা রেখা বলে চিনতে পারি।

ভাষা-তত্ত্বের একটা প্রস্তাবনা নানান উথাল-পাথালের মধ্যেও টিকে আছে, সেটার নাম হলো প্রতীকায়ন তত্ত্ব (ইং sign theory)। এর মূল প্রস্তাবনা হচ্ছে যে ভাষা আর শব্দ মাত্রই প্রতীকী। এক-একটা শব্দ বা সংজ্ঞা হলো আসলে একএকটা ধারণা। এর সামনে রয়েছে তার প্রকাশ্য রূপ - অর্থাত এর উচ্চারণ বা শব্দ। আর আড়ালে রয়েছে এর সাথে সংযুক্ত অনেকগুলি ধারণা। সেই ধারণাগুলি কিছুটা অস্পষ্ট হয়, আর হয় ক্রীয়াভিত্তিক (ক্রীয়াভিত্তি-র প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে)। আমাদের বোধ বা সংজ্ঞাগুলির এই দুইটা উপাদানকে বলা হয় - "দ্যোতক", আর "দ্যোতনা" (ইং signifier-signified) [১]। মানে আমরা কোনো একটা জিনিস বা ধারণা, যাকে "দ্যোতনা" বলা হয়, সেটাকে নির্দেশ করার চেষ্টা করি শব্দ, ছবি, অক্ষর এইসবের মাধ্যমে, এই দৃশ্যমান প্রতীকগুলিকে বলে "দ্যোতক"।

এইখানে তিনটা জিনিসের উত্থাপন হয়েছে। প্রথমত হলো "বোধ" বা "সংজ্ঞা"। মানুষ সব সময় একটা বিরাট প্রকল্পে লিপ্ত থাকে - আমরা আমাদের জ্ঞানজগতকে নানান "সংজ্ঞা" বা "বোধ"-এ বিভক্ত করতে থাকি, আর আগে থেকে নির্মিত সংজ্ঞাগুলিতে নতুন অভিজ্ঞতা আঁটানোর চেষ্টা করতে থাকি। এই প্রক্রিয়াটা অনেকটা বাক্সবন্দি করার মতো। আমাদের যাবতীয় সামগ্রি কয়েকটা পূর্ব-নির্দিষ্ট বাক্স-পেট্রার মধ্যে আটক করার চেষ্টা। কিভাবে বন্টন করছি সেটার সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছে, আমাদের জিনিসপত্রগুলির কোন কোন বৈশিষ্ট্যগুলিকে ব্যাবহার করে তাদের প্রকারভেদ করছি, তাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করছি।

এর একটা মানে হলো যে ভাষা আসলে হলো আমাদের অভিজ্ঞতা আর বোধগুলিকে গুছিয়ে রাখার চেষ্টা। আগের উপমানটা ধরে আরো বলা যেতে পারে যে জিনিসের বৈশিষ্ট্য থেকে তাদের বাক্স-বন্দিত্ব নির্ধারিত হয়, আবার কোনবাক্স বা খাপে ফেলা হচ্ছে, সেটা থেকে তাদের ব্যাবহারিক দিকগুলি কম বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নতুন পরস্পর নির্ভরতাও জেগে ওঠে, যেমন একই বাক্সে রাখা দুইটা আলাদা জিনিসকে একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্য বা অপরিহার্য্য মনে হওয়া শুরু করে।

এর থেকে একটা পুরানো প্রশ্ন উঠে আসে - ভাষা থেকে বোধ না বোধ থেকে ভাষা। এইটা একটা বহু পুরানো বাহাস, সংস্কৃত ভাষাতাত্ত্বিকদের দিয়ে শুরু করে আধুনিক আদলপন্থি ভাষাতত্ত্বেও চলছে। মোটামুটি এটা স্বীকৃত হয়েছে যে ভাষা আর বোধ - এই দুইজনেই দুইজনকে প্রভাবিত করে। এ নিয়ে মনোগ্রাহী কিছু বাহাস আর আলাপ পাবেন এখানে - [২], [৪]।

সংজ্ঞা বা বোধের আরেকটা যথার্থ প্রতিশব্দ হলো "বর্গ" (ইং category )। আমরা একটু পরে দেখব যে নিশ্ছিদ্র, অগণনীয় বস্তুজগতকে আমরা সীমিত কয়েকটা শব্দমালার মধ্যে ধারণ করতে যেই ভাবে তাকে ভাগ-ভাগ করে রাখি, তার সাথে একখন্ড আবাদিজমির বর্গে বর্গে ভাগ করার সাথে দারুণ সাদৃশ্য রাখে।

ভাষার (বা চিন্তার !) মৌলগুলি হচ্ছে এইসব দ্যোতক-দ্যোতনা যুগল, যেইগুলি কে "সংজ্ঞা" বলা হচ্ছে। এই সংকেতগুলির একক ভাবে কোনো "মানে" নেই, আমরা একটা একটা শব্দ বা ধারণা, যেমন "নীল", "কম্পিউটার" ইত্যাদী-র সাথে যখনই কোনো "মানে" যুক্ত করি, সেটা আসলে একটা আপেক্ষিক অবস্থান। আদল-পন্থি ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে "অর্থ"-র হদিস করতে গেলে শেষ পর্যন্ত নাকি এরকম নানান বিপ্রতীপ সম্পর্ক জুড়ে জুড়েই তৈরি হয়। এর একটা বড় পরিনাম হলো যে "ব্যাকারণ" কারুর লেখার অপেক্ষা রাখে না। সব চেয়ে "পিছিয়ে পড়া" বা অস্বাক্ষর জনজাতিদেরও নিজস্ব ব্যাকারণ আছে, ব্যাকারণ ছাড়া একে অপরের কথা বুঝতে পারবে না। অপর দিক থেকেও একই পারস্পরিকতা - ভাষা মানেই হলো কতগুলি শব্দ বা ধারণার আন্তঃসম্পর্ক, যেটা ব্যাকারণ বই আর কিছু না। এই নিয়ে অন্যত্রে আরো বিস্তারিত আলোচনা হবে।

দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয়টা হলো দ্যোতক, অর্থাত সরল ভাবে বলতে গেলে নামকরণ। নামকরণ আর নামকরণের জিনিস নির্বাচন ভাষার খেয়াল খুশির ওপর চলে [৬]। জিনিসটার কোন বস্তুনির্ভর ( ইং objective) ভিত্তি নেই। সভ্যতা বা সমাজে এরকম ভাবে নিজের খেয়াল খুশির মতো কিছু কিছু নাম বা সংজ্ঞা-নাম তৈরি করে রেখেছে। দ্যোতক-দ্যোতনার জুটি হয়ে থাকা আমাদের বোধগুলির দ্যোতক বা ভাষিকরূপই হচ্ছে আমাদের "ভাষা"। এই সংজ্ঞাগুলির আন্তঃসম্পর্ক থেকে তৈরি হয় সেই ভাষার ব্যাকারণ, অর্থজ্ঞান ( ইং semantics), আর নতুন নতুন বাক্য বা অভিব্যাক্তি উৎপাদন করার ক্ষমতা, যাকে চমস্কি আখ্যায়িত করেছেন রূপন্তরি সঞ্জননি ব্যাকারণ [৭] ( ইং transformative generative grammar)। মানুষের ভাষা বা বুলির এই শক্তিমত্তা তাকে অন্য সব প্রাণি থেকে আলাদা করে রাখে। এ নিয়ে অন্যত্রে আরো বিস্তারিত আলাপ হবে।

এই আলোচনার নিরিখে, ভাষা আর বোধজগতের আঁটুনিটাকে বাক্সবন্দিকরণ নাম দিয়েছি । ইংরাজিতে এর সমার্থক "compartment-alization" একই অর্থে অন্য জায়গায় ব্যাবহৃত হয়ে থাকে। আর "সাইন-থিওরি"-র একটা সার্থক প্রতিশব্দ হলো "সংজ্ঞায়ন তত্ত্ব", আমাদের তৎসম শব্দ "সংজ্ঞা"তে আসলে এই পুরো কর্মকান্ডটাই ধরা পরে। সংজ্ঞাতত্ত্বের জনক ফার্দিনান্দ দ্যি সস্যুর কে বলা হলেও, এর ঢের আগে সংস্কৃত-আশ্রয়ী ভাষা তাত্ত্বিক পানিনি আর যাস্করা এই একই সিদ্ধান্তগুলি নিয়েছিলেন, নিয়ে নব্য সংস্কৃত রচনাও করেছিলেন [৭]। সুতরাং "সংজ্ঞা" দ্যোতকটার সাথে সংযুক্ত দ্যোতনা যে এই কর্মকান্ডের সাথে এতো মিলে যাবে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

তৃতীয় আলোচ্য বিষয় হলো দ্যোতনা। যেই অর্থ-ভূমিতে এক-একটা শব্দ দাড়িয়ে আছে, শক্তি সঞ্চয় করছে, নতুন শব্দ-অর্থ জুটির সাথে মিশে আরো নতুন সংজ্ঞা তৈরি করছে, সেটাই হলো তার দ্যোতনা জগত। দ্যোতনার সঠিক আর পদ্ধতিগত অনুসন্ধান কে বলা হয়ে নিরুক্তজ্ঞান বা অর্থজ্ঞান (ইং )। ভাষাতত্ত্বের এই বিস্তারিত ক্ষেত্রটা এখনো গাণিতিক হিসাব নিকাশের আওতায় আসে নি ঠিক মতো। এর নানান দিক আছে, এর কিছু কিছু নিয়ে এখানে আর এখানে আলাপ করেছি।

সংজ্ঞায়ন তত্ত্ব বা বাক্সবন্দিকরণ তত্ত্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার একটা উতকৃষ্ট উদাহরণ হলো বর্ণালির নামকরণ। বর্ণালি অর্থাত রংরাজি আমাদের দৈনিক অভিজ্ঞতার একটা অপরিহার্য্য অংশ। এর বৈজ্ঞানিক বিবরণ খুব সহজ - রংরাজি একটা একটানা জিনিস (ইং linear continuum)। রংএ -রংএ ছেদ নেই, একটানা বদলাতে থাকে। এদেরকে তাদের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য অনুযায়ী সরল রেখায় সাজানো যায়। এই একটানা হওয়ার দরুণ সংখ্যায় এর অগুণতি (ইং uncountable)। কিন্তু ভাষায় ব্যাক্ত রং-এর ধারণা আর বিবরণ একদম আলাদা।

সব প্রাকৃত মানুষই তাদের ভাষায়, রং-এর বৈজ্ঞানিক তরঙ্গ-ধর্মী বিবরণ না দিয়ে, তাদের নিত্যকার জীবনে মূর্তরূপ দিয়েই বিবরণ করেছে। এক-একটা সমাজ আর ভাষায় রং-এর চিহ্নায়ন আর নামকরণ একদম আলাদা। এই একই একমাত্রিক রংরাজিকে প্রত্যেক সমাজের নিজস্ব কায়দায় কয়েকটা নামে ভাগ ভাগ করে রেখেছে। একই অভিন্ন বর্ণালির জন্য আলাদা রকমের বাক্স তৈরি করে রেখেছে। যেমন আমাদের লাল-নীল সাদার সব কিছুর প্রতিশব্দ ইংরাজিতে নেই। জাপানি ভাষায় নীল আর সবুজের পৃথকীকরণ নেই, দুইকে একসাথে সমুদ্র-রং বলা হয়। অর্থাত "সমুদ্র-রং" নামাঙ্কিত বাক্সে দুই আলাদা শেড। আবার সাইবেরিয়ার আদিবাসিদের আছে আমাদের নীল রং-এর বিভিন্ন পোচের জন্য আলাদা আলাদা নাম। তাদের কাছে আকাশী নীল আর সমুদ্রের নীল একদম আলাদা দুইটা জিনিস, এক করে দেখার কোনো অবকাশই নেই। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে জানা গেছে যে নিজ ভাষার রংনামকরণ থেকে রং-এর চোখ আরো তীক্ষ্ণ অথবা ভোঁতা হয়ে ওঠে। অর্থাত বাক্স নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আমাদের মতিষ্কের চলনকেও প্রভাবিত করতে পারে।

নানান কারণে বর্ণালির নামকরণ সমীক্ষা আমাদের জিজ্ঞাসাকে প্রচুর রসদ যোগায়। ভাষা-আর-মস্তিষ্কের সম্পর্ক নিয়ে কৌতুহল জাগায়। নৃতাত্ত্বিক নানান প্রশ্ন তোলে। এই আলোচনায় এর তাদপর্য হলো যে এর থেকেই এটাই সামনে আসে যে দুইটা ভাষার মধ্যে সরাসরি তুলনা খুব কঠিন। রঙ্গের প্রকারভেদ বা বিভাজন রেখাগুলি এক-এক ভাষায় আলাদা বলে কোনটা বেশি সূক্ষ্ম, কোনটা বেশি স্থুল - সেই তুলনাটাই অচল হয়ে পরে। বাক্সের দেওয়ালগুলি, অর্থাত রঙ্গের বিভাজন-রেখাগুলি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছে এক-এক ভাষার খেয়ালখুশিতে। তাই আমার বাক্সের সাথে আরেকজনের বাক্স খাপ না খেতেও পারে। বাংলায় "নীল" নামের তৈরি করা সংজ্ঞা বা বর্গের সাথে জাপানির "সমুদ্র-রং" বর্গের মিল থাকলেও থাকবে আংশিক।

একটা সমাজে কোন কোন রঙ্গের বর্গ তৈরি হয়েছে, সেটার অনুধাবন একটা গুঢ় নৃতাত্ত্বিক আর ভাষাতাত্ত্বিক বিষয়। আদলপন্থি ঘরানার (ইং structuralist) চিন্তকরা বলে, রঙ্গের নাম হোক বা অন্য কোনো সংজ্ঞা, এরা তৈরি হয় শুধুমাত্র একটাই নিয়ম মেনে - "বিপ্রতীপ সম্পর্ক" বা "জোড়-বিপরীত" সম্পর্ক (ইং binary opposition) [১] । একটা সমাজে যখন রং সনাক্ত করা শুরু হয়েছিল, বৈপরীত্য-র ভিত্তিতে এক একটা রঙসমষ্টি চিহ্নতি হয়েছিল। এই রংগুলির বৈপরীত্য তাদের পারিপার্শ্বিক জগতে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখেছিল বলেই আলাদা তক্‌মা বা নাম লাগিয়েছে [৩]। পরে জীবিকা বা জীবনযাপনের প্রয়োজন অনুযায়ী এক-একটা বর্গ আরো বিভাজিত হতে থেকেছে, নতুন নতুন রঙ্গের নাম তৈরি হয়েছে [৫]।

আদলপন্থিদের প্রস্থাবনা যে মানুষের মননের সব ক্ষেত্রেই এই জোড়-বৈপরীত্যের নিয়মটা ক্রীয়াশীল। পারিপার্শ্বিকের দাবিতে বা আয়জনে যেই যেই জোড়-বিপরীত গুলি হাজির হয়েছে, তার হাত ধরেই সে নতুন নতুন সূক্ষতর চিন্তা আর প্রকারভেদে অবতীর্ণ হয়েছে। নতুন নতুন আর আরো বিশেষায়িত সংজ্ঞা তৈরি করেছে, তাদের মধ্যেকার সম্পর্কগুলি স্থাপন করেছে। আগের তৈরি আয়ত বর্গগুলি থেকে নতুন নতুন ক্ষুদ্রায়িত বর্গ জন্ম নিয়েছে।

এবার যদি সুন্দরবনের কাহীনিটায় ফিরে আসি, তাহলে দেখবো যে ভুলটা কিন্তু করছেন বৈজ্ঞানিক মহিলাটি নিজে, জেলেরা নয়। "শুশুক" কোন একটা বিশেষ প্রজাতি নয়, শুশুক একটা "বর্গ"। এই বর্গের মধ্যে ডলফিন আর ডলফিন সদৃশ অন্য কিছু প্রাণিও পরে। এই বর্গ আঁকুনিতে ঠিক-ভুলের প্রশ্নই ওঠে না, এটা জন্মসূত্রেই "সঠিক"। এবার বৈজ্ঞানিক মহিলাটি সুন্দরবনের মানুষদের বর্গ বা বাক্সগুলির সাথে পশ্চিমা জীবতাত্ত্বিক বর্গগুলির এক-এক সম্পর্ক খুজতে গেছেন বলেই হইয়েছে বিপত্তি। জীবতত্ত্বের "সামুদ্রিক ডলফিন", "পরপয়েজ" আর "গাঙ্গেও ডলফিন" কোনো বর্গই পুরোপুরি "শুশুক" বর্গের মধ্যে আঁটে না, বা শুশুক বর্গকে পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত করে না। এইগুলির সাথে "শুশুক" বর্গটার কম-বেশি মিল-অমিল আছে।

ভাষিক বর্গের এরকম অনেক পরিচিত উদাহ=রণ আছে যা আপাত দৃষ্টিতে বাঙ্গা আর ইংরাজির মধ্যেকার অসামঞ্জস্যতা মনে হলেও আসলে এইগুলি আলাদা-আলাদা বস্তু-সংস্কৃতির আলাদা-আলাদা বর্গ। যেমন ধরা যাক -
বিস্কুটের টিন, আর চায়ের গেলাস
ইংরাজিতে টিন আর গ্লাস দুই রকমের পদার্থের নাম। এ দিয়ে পাত্র বা কৌটা তৈরি হয়। কিন্তু বাংলায় এই দুইটা পদার্থগত পরিচয় বহন করে না, এক-এক ধরণের পাত্রের লেবেল হিসেবে কাজ করে। গৃহস্থলিতে গেলাস আর কৌটার ব্যাবহার বাড়ার সাথে সাথে এই বর্গগুলি টৈরি হয়েছে। ইংরাজি নামগুলিরস সাথে মিল হওয়্র একমাত্র কারণ এই বাংলা নামগুলির উতপত্তি হয়েছে একদা শুধু মাত্র টিন বা কাঁচ থেকে টৈরি কৌটা আর গ্রেলাসের প্রাধাণ্য ছিল।
একই রকম ভাবে
চকোলেট বলতে সব রকমেরই লজেন্স বোঝানো হতো।

মানুষে মানুষে ভুল-বোঝাবুঝি, তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা এর অনেক কিছুর মূলেই আছে এই বর্গের অমিল। এইখানে আলাপটা ছিল শুধু নামকরণের বিষয়ে। এই বর্গের অমিল থেকে সঞ্জাত দ্বন্দ নিয়ে আরো কিছু আলাপ রয়েছে - যেমন
১) রাজনীতির ক্ষেত্রে
হিন্দু, বাঙ্গালিয়ানা, আর ভারত আখ্যাগুলিতে;
২) অথবা দলিয়ে রাজনীতির
মেরুকরণ-এ;
৩) আর ইংরাজি থেকে বাংলায়
আমাদের অনুবাদ প্রচেষ্টায় ।

তথ্যসূত্র

১) চিন্তার আদল আবিষ্কারঃ ভাষা কিম্বা মানুষের মনের গড়ন - বখতিয়ার আহমেদ

২) Economist debate - the language we speak shapes our thought

৩) Colour categories and category acquisition in Himba and English

৪) Language, thought, and color - Whorf was half right - T Regier, P Kay

৫) )On the origin of the hierarchy of color names -

৬) On the Arbitrary Nature of Linguistic Sign - M Duan

৭) পরমাভাষার বোধন-উদবোধন - ভাষাতত্ত্বের ক্রীয়াভিত্তিক রি-ইঞ্জিনিয়ারিং- কলিম খান