বিমূর্ত চিন্তাশক্তি মানুষের একটা অবাক করা ক্ষমতা। প্রাণি জগতের সবার থেকে এটা মানুষকে আলাদা করে। গণিতের ভাষা সঠিক ভাবে বুঝতে হলে সবার আগে প্রয়োজন বিমূর্ত চিন্তা কি সেটা সম্বন্ধে ধারণা তৈরি করা। আমরা শুরু করব একটা উপমান দিয়ে, গঠন শিল্প আর সেতু নির্মাণের। এই উপমানের সাহাজ্যে বিমূর্ত-চিন্তা আর বিমূর্তকরণ - এই দুই প্রসঙ্গে নামাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। সেখান থেকে আমরা গণিতের কারখানার কারবার গুলি বোঝার চেষ্টা করব, আর পেশাদারি বা স্কুলের গণিতের বাইরে, দৈনন্দিন জীবনে আর অন্যান্য বিদ্যাতয়নিক ক্ষেত্রে, এই একই কর্মকান্ড অন্য নামে বা রূপে আবিস্কার করব।
সদ্য নির্মিত পদ্মা সেতু, জানুয়ারি ০১, ২০২১
নির্মাণের মাঝপথে সেতুর এক অংশ, প্রকৌশলীগত জ্ঞানের অভাবে এটাকে আমি নাম দিয়েছি মাচা।
গণিতের পুরো কর্মকান্ডের সাথে দারুণ সাদৃশ্য রাখে সেতু নির্মাণের শিল্প আর তার সংলগ্ন যাবতীয় উৎপাদন ব্যাবস্থা আর কারখানা। ছবিতে দেখানো হয়েছে পদ্মা সেতুর ইষ্পাতের কাঠামোটা। মোটা দাগে এর বিবরণ দেওয়া যায় এই বলে যে এটা দাড়িয়ে আছে কতগুলি থামের ওপর, ওপরে বিরাট বিরাট মাঁচা বসানো আছে, এক-একটা থামের ওপর দুইটা মাঁচা আগায়-আগায় জোড়া আছে। এই মাচাগুলি আবার এক রাশ লোহার পাত, বাঁক, জোড়, পাটাতন, কব্জা এইসব দিয়ে। লোহার পাতগুলি নানান ভাবে কাটাকুটি করে মাঁচাগুলির বেড়া তৈরি করেছে। সেতুর এই অংশগুলি তাদের নিজ-নিজ উপাদানে বিভাজিত করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমরা গুটি কয়েক মৌলিক উপাদানে এসে ঠেকবো - নাট, বল্টু, একশিলা পাত আর পাটাতন, এইসব।
এইবার মনে মনে গঠনগত ভাবে ভাঙা এই উপাদানগুলিকে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে গেলে চারটা খুব প্রণিধানযোগ্য ব্যাপার নজরে পরবে।
প্রথমত - সেতুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির ব্যাবহারযোগ্যতা শুধু এই সেতুটার নির্মানেই সীমাবদ্ধ নয়। এক-একটা পাটাতন, জোড়, কব্জা আলাদা আলাদা করে বানানো হয় আলাদা কারখানায়। তৈরি হওয়ার সময় কোনো নিরদিষ্ট ফরমাশ মেনে এদের বানানো হয় না। বরং প্রকৌশলী বিদ্যা থেকে অর্জন করা জ্ঞান থেকে মানুষ এই অঙ্গগুলির ভূমিকা আরো ব্যাপ্ত পরিসরে দেখতে শিখেছে। এই ব্যাপ্ত পরিসরটাই হলো বিমূর্ততা - এই অংশগুলি কোনো বিশেষ বস্তু না জিনিসের সাথে বাধা নয়। এদের প্রয়োগক্ষমতার সঠিক বিবরণ দিতে হলে গঠনশাস্ত্রের নানান প্রণালিতে ফেলে এইগুলির ভূমিকা নির্ধারণণ করতে হবে। যেমন সেতু জিনিসটাকে একটা মহাসড়কের অংশ হিসেবেও দেখা যায়, আবার আরো বিমূর্ত ভাবে দুইটা জায়গার যোগসূত্র হিসেবেও দেখা যায়।
দ্বিতীয়ত, উপাদান থেকে উপকরণ, উপকরণ থেকে আরো কারিগরি দেওয়া যুগ্ম-উপকরণ, এই ভাবে জোড়া লাগানোর প্রক্রিয়াটার একটা পরিস্কার স্তর বিন্যাস আছে। মানুষের বিমূর্ত ভাবনাও এমনই বহুস্তরীয়, একটা স্তর অর্জন করে আরো জটিল ভাবনার রশদ যোগায় তৈরি হয়ে থাকা বিমূর্ত ভাবনাগুলি।
তৃতীয়ত, এক-একটা উপকরণ যদি ধরা হয়, এর আকার-আয়তন তার লাগোয়া অন্যান্য অংশগুলির সাথে মানানসই হতে হবে। কিন্তু এই শর্ত ছাড়া, এই উপকরণ গুলি একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র ভাবেই তৈরি হয়। বাকি অংশগুলি কি নিয়মে তৈরি হচ্ছে, বা কোন বৃহত্তর অংশের অঙ্গীভূত হতে চলেছে, সেটা ধর্তব্যের মধ্যে থাকে না। এক-একটা অংশকে এক-একটা ধারণা মনে করলে, সেই ধারণাগুলির রচনা আর বাধুনি হয় একক ভাবে, তার ক্রীয়াত্মক সংজ্ঞা মেনে। ক্ষেত্রবিশেষে, চাহিদা মতো এর আয়তন আর অনুপাত ঠিক করা হয়।
চতুর্থত, লক্ষণীয় যে মৌলিক গাঁথনি [২]-গুলি মাত্র গুটিকয়েক ধরণের, এর যেয়ে যৌগিক গাঁথনিগুলির প্রকারভেদ অনেক বেশি। এর কারণ বুঝতে অবলম্বন করতে হবে উপকরণগুলির ক্রীয়াত্মক সংজ্ঞাকেই। একএকটা যৌগিক উপকরণে, যেমনা ছবিতে দেখানো বেড়া-বাধা মাঁচাটায়, তার মৌলিক উপকরণগুলির ক্রিয়া বা ভূমিকা একক ভাবে না। এদের ক্রিয়া সমষ্টিগত ভাবে। অন্যভাবে বলতে গেলে মাঁচা বা পাটাতনগুলির ক্রিয়াত্মক মূল্য আসে তাদের কাঠামো থেকে, তাদের মৌলিক গাঁথনিগুলি যেই সম্পর্কে আবদ্ধ, তার থেকে।
লোহা লক্কড়ের শিল্প আর কারখানা এই নিয়ম মেনেই চলছে, সেই জন্যেই পড়োয়জন মতো শুধু সেতু-ই তৈরি হচ্ছে না, প্রয়োজন মত একই গাঁথনিগুলি নতুন করে গেঁথে জাহাজ, বিল্ডিং, টাওয়ার তৈরি হচ্ছে। প্রত্যেক কাজের জন্য নতুন করে এই উপকরণগুলির ছক কষতে হচ্ছে না। এটাই হলো প্রকৃতপক্ষে গণিতের কারখানা। কাঁচা মাল হিসেবে ঢুকছে নানান মৌলিক সংজ্ঞা অথবা প্রাক-অনুমান আর বস্তু, যেমন সম্ভার , বিন্দু, রেখা, চলরাশি । এইগুলি দিয়ে খলিফাদের তত্ত্ববধানে [৩] আর পরবর্তীকালে ইউরোপে, কারখানায়, অর্থাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে তৈরি হয়েছে আধুনিক বিজগণিত, জ্যামিতি, কলনবিদ্যা। সেই প্রাথমিক গাণিতিক ধারণাগুলি থেকে গত ১০০-২০০ বছরে অজস্র তত্ত্ব জন্ম নিয়ে চলেছে। গাণিতিক তত্ত্ব বা প্রস্তাবনা সাধারণত আসে উপাদ্য বা প্রস্তাবনা আকারে। এইগুলির বহর ছোট থেকে খুবই বিরাট হতে পারে। যেমন নদীর দুই পারকে জোড়া দেওয়া সেতু, অথবা দুইটা থামের মাঝখানে জোড়া দেওয়া একটা মাঁচা বা বেদি।
বিমূর্ততা - কোন পরিস্থিতি বা বস্তুর আচরণ আর কর্মকান্ডের মধ্যে থেকে কিছু কিছু গতিপ্রকৃতি/ চলন / আচরণ সনাক্ত করে, সেই ক্রীয়াত্মক বা আচরণভাষিক বিবরণ দিয়ে সেই পরিস্থিতি বা বস্তুর চরিত্রায়ন করা।
এইটা কে "বিমূর্ততা" বা "বিমূর্তকরণের" একটা কেজো সংজ্ঞা মনে করে এগোনো যাক। সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে আধুনিক শিল্প ব্যাবস্থার মধ্যেই এই বিমূর্তকরণ আছে। গণিতের ক্ষেত্রে আরো সবিশেষে দেখার আগে খেয়াল করা উচিত যে সাধারণ জীবনেও, অসংগঠিত ভাবেও আমরা প্রতিনিয়ত বিমূর্তকরণ করে চলেছি। একটা সহজ উদাহরণ দেখা যাক। ধরা যাকে একজন চাষার ক্ষেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকগুলি ধানের গোলা আছে। তাকে সেইগুলি জরো করতে হবে তার ট্র্যাক্টরে, কিন্তু ট্র্যাকটরের গম্য রাস্তা ধরেই এগোত হবে। সে চেষ্টা করবে সবচেয়ে কম সময় আর শ্রম খরচ করে কাজটা হাসিল করতে। এই বাস্তব উদ্ভুত সমস্যাটার সমাধান খুজতে হলে, এই পরিস্থিতির সাথে যুক্ত অনেক বিষদই পাশে সরিয়ে রাখতে হবে। যেমন মাঠে কিসের ফলন হয়, ট্র্যাক্টরের গতিবেগ কতো, গোলাগুলি দেখতে কেমন এইসব। এইসব বিষদের পর্দার আড়াল থেকে এই সমস্যাটার গাণিতিক সারবস্তু টা বের করে নিতে হবে। ক্ষেতটার সব বৈশিষ্ট্য ভুলে গিয়ে তাকে একটা সমতল অথবা কাগজের পৃষ্টা মনে করা যাক। ট্রাক্টর-পথগুলির সব বাহ্যিক বিবরণ ভুলে সেইগুলিকে এই কাগজের ওপর আঁকা কতগুলি রেখা ধরা যাক, আর ধানের গুলিকে দুইটা রেখার সংযোগস্থলের কয়েকটা বিন্দু। তাহলে প্রশ্নটা দাড়ালো সেটা হলো, একটা কাগজে কয়েটা বিন্দু আছে, আর তাদের কারুর মধ্যে রেখা টানা আছে। কোন যাত্রা পথ এই গুলির সাহাজ্যে আঁকলে প্রত্যেকটা বিন্দুকে ছুয়ে আবার ফেরত আসা যেতে পারে, সবচেয়ে কম দূরত্ব গিয়ে ?
প্রশিক্ষণ থাকুক বা না থাকুক, চাষা মাথায় বা কাগজে কলমে এই ভাবেই সমাধান খোজার চেষ্টা করবে। এটাই বিমূর্তকরণ। লক্ষণীয় যে, গোড়া থেকেই শুধু রেখা আর বিন্দু - এইগুলির মাধ্যমেই প্রশ্নটা তোলা যেত, চাষা আর ধানের গোলার উদাহরণ না দিয়ে। রেখা-বিন্দুর সমস্যাটার সমাধান খুজে ফেলে, সেই কাগজে আঁকা ছক যদি কেউ এই ধানের ক্ষেতে আবিস্কার করে, তাহলে চাষার সমস্যারও সমাধান হয়। এই একই ছক ধানক্ষেতে না হয়ে যদি শহরে হতো, ধানের গোলার বদলে ডাকবাক্স, আর চাষার জায়গায় থাকতো ডাকপিওন, তাহলে প্রকৃতিগত ভাবে সমস্যাটা একই থাকতো। অর্থাত এই সামান্য বিমূর্তিকরণ থেকে আরো বহুত মাত্রায় ব্যাপ্ত একটা সমস্যার বা নকশার নাগাল পাওয়া গেল, যার একটা উদাহরণ বিশেষ, বা মূর্ত-রূপ হিসেবে গোড়ার সমস্যাটাকে নতুন করে দেখা যায়।
এই সামান্য বিমূর্ততা খাটিয়েই একটা বড় কর্মকান্ডের হদিস পাওয়া যায়। সেটাকে তিন ভাগে ভাগ করা যাক।
ক) প্রাথমিক বিমূর্তিকরণ
খ) অংক কষা
গ) বিমূর্ততর স্তরে পৌছানো
এই তিনটা বিষয় আরো সবিশেষে খতিয়ে দেখা যাক। মুখ্যত গণিতকেন্দ্রিক আলোচনা হলেও বারে বারে স্মরণ করা হবে যে এই প্রক্রিয়াগুলি গণিতির বাইরে মানুষের অন্য যে কোনো বিমূর্তিকরণ প্রকল্পতেও বিদ্যমান।
ক) প্রাথমিক বিমূর্তিকরণ - - অর্থাত মাঠ পর্য্যায়ে উদ্ভুত কোন প্রশ্ন বা কর্তব্য খতিয়ে দেখে, তার থেকে তার গাণিতিক রূপরেখাটা ছেঁকে বের করে নিয়ে, গণিতের যাবতীয় শব্দাবলী দিয়ে পরিস্থিতি আর প্রশ্নের বর্ণনা। এই ক্ষেত্রে ডান দিকে দেখানো ছবিটা থেকে বাম দিকের রেখা চিত্রে রূপান্তর এই কাজটাই করে।
এই কাজটি সকলেই করে থাকে নানান মাত্রায়। এর একটা প্রাচীনতম উদাহরণ হলো জ্যোতির্বিদ্যা [৪]। আসমানী ঘটনা আর প্রপঞ্চের মধ্যে নিয়মনীতি খুজে বের করার অভিপ্রায় থেকে মানুষ গতিপথ, গতিবেগ, বৃত্ত - এই ধরণের নানান বিমূর্ত ধারণার অবলম্বন নিতে শিখেছে। ১৬০০-র শতাব্দীতে নিউটন আর কপারনিকাসের আবিস্কার এই প্রকল্পগুলিকে পূর্ণতা দিয়েছিল, এর তাদপর্য নিয়ে এখানে আগে লিখেছি ।
খ) অংক কষা - আরেক কথায়, বিমূর্ত বা গাণিতিক শব্দমালা নিয়ে নাড়াচারা করা। এই পর্য্যায়ে কাজ হলো যে কোনো একটা স্থির গাণিতিক পরিধির বা বিবরণির মধ্যে থেকে, গাণিতিক নিয়ম কানুন মেনে নতুন নিয়ম, সমীকরণ অথবা সম্পর্ক আবিস্কার করা। আলোচ্য উদাহরণে সেইটা দাড়াবে বা দিকের আকা রেখাচিত্রটায় সুসংহত ভাবে নানান আঁকিবুঁকি কেটে, নানান উপায় বিচার বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সমাধান গুলি ভের করে আনা।
গণিতের পদ্ধতি, উদ্দেশ্য আর গঠন - এই সব নিয়ে এই পর্ব থেকে পাওয়া ধারণা আর মীমাংসাগুলি ভাষার ব্যাপারেও সমান ভাবে প্রযোজ্য...
গ) বিমূর্ততর স্তরে পৌছানো - ওপরে প্রশ্নটা যা দাড়ায় সেটা Travelling salesman problem [২] নামে আখ্যায়িত হয়েছে। বিন্দু থেকে বিন্দু রেখা বরাবর যাওয়ার প্রক্রিয়াটাকে আরো বিমূর্ততর বৈশিষ্ট্যের সাহাজ্যে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে আরো গভীর মীমাংসা সম্ভব হয়েছে। এই প্রশ্নের সমাধান গাণিতিক অর্থে জটিলতম () প্রমাণিত হয়েছে। আবার রেখা আর বিন্দুদের তৈরি এই জাল কোনো বিশেষ ছকের অনুসারী হলে আবার এও প্রমাণ হয়েছে যে সমাধান কম জটিল এবং গণনা-সাপেক্ষ। এই সব মীমাংসা সম্ভব হয়েছে কারণ বিমূর্ত ভাবনাগুলি শুধু রেখা আর বিন্দুতে সীমিত থাকে নি, সেইগুলি দিয়ে আরো বিমূর্ত চরিত্র তৈরি করা হয়েছে। যেমন - তাদের জালের মধ্যে কোনো বিশেষ প্রকারের উপজাল -এর প্রাদুর্ভাব আছে কিনা। অথবা, এই জালটা যেই অফুরন্ত কায়দায় ছড়িয়ে থাকতে পারে, সেই 'অফুরন্ত'-এর চরিত্রায়নের মাধ্যমে (enumeration, randomness, canonical form)।
লাগোয়া ...
১) ঘের-এর সঙ্গায়ন এখানে করা হয়েছে।
২) https://en.wikipedia.org/wiki/Travelling_salesman_problem
৩) ইসলামী স্বর্ণযুগ -
https://www.youtube.com/watch?v=RI0kwcr83R0
৪) Solving the Babylonian problem of quasiperiodic rotation rates