"বারবেলাতে দুপুরে... "


কবিতার মানে জগত

মুখবন্ধ -

আমরা

এত

" পোনা মাছে লাফ মেরেছে পুকুরে
শনিবারের বার বেলাতে দুপুরে
তাই ঢেউয়ের পরে ঢেউ উঠিল জলে
মনের পাখি বনে পালায় কি কৌশলে ... "

আমার মতে একটা মনোজাগতিক অভিজ্ঞতা, যার সাধারণ ভাষায় বিবরণ দুঃসাধ্য,সেটাকে এখানে অসামান্য ভাবে ভাষার বাগে এনেছেন লালন। আমার বুঝ অনুযায়ী, এইখানে দুইটা খুব ভারি দ্যোতনা কবিতার সাধারণ দৈনন্দিন শব্দগুলির মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে আছে। লালন রূপকে রূপকে জোড়া লাগিয়ে কি অদ্ভুত অর্থময়তার সৃষ্টি করেছেন সেটাই দেখাতে চাই। রূপক দুটি হলো "দুপুর" আর "পুকুর", এই দুইটা শব্দের সাথেত প্রচুর অতিরিক্ত দ্যোতনা যুক্ত আছে। একে একে এদের আরেকটু খতিয়ে দেখা যাক।

দুপুর শব্দটা আক্ষরিক ভাবে মধ্যাহ্ন হলেও বাঙালি জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে আরো নানান দ্যোতনা বহন করে। শহর হোক বা গ্রামে, দুপুর মানেই কর্ম-ব্যাস্ততা থিতিয়ে আসা, মনে একটা অলস, নিশ্চিন্তির ভাব, আর একটা গা-এলিয়ে আনা আমেজ। দুপুরের এই মুহূর্তগুলিতে প্রায়সই, ব্যাস্ততার অভাবে আর চারিপাশে ঘটনা-জগত জুড়িয়ে এলে, আমরা আমাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার মুখোমুখি হই। এই সুন্দর অলস জাগরণের মূহুর্তগুলি অনেকেই বিবৃত করেছেন নিজস্ব কায়দায়। যেমন বরিশালের জীবনানন্দ লিখেছিলেন -

"" ছেলেদের পড়াতে পড়াতে হঠাত জানালার ভিতর দিয়ে তাকিয় দেখি একটা বিস্তীর্ণ সুপুরিগাছে ... এসে বসেছে একটা কাঠঠোকরা। দুপুরের ছাতিফাটা রোদে তার খটখট খটখট শব্দ; আদি নেই, শেষ নেই। এ গান নয়, সুর নয়, তবুও আবিভূত হয়ে শুনি, কেমন আমেজ বোধ হয়। অন্য কোনো এক পাড়াগাঁ-র কবেকার কোনো বিলুপ্ত রৌদ্রফাটা দুপুরের কথা মনে পরে যায়। হৃদয় কেমন গুমড়ে ওঠে। ঝুঁটিওয়ালা সুন্দর পাখিটা কোনো এক ফাঁকে ডানা মেলে বাতাসের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই বিশ বছর বাইশ বছর আগেকার পৃথিবীটার দিকে বোধ করি ? সে পৃথিবীটাকে আজও সে চেনে নিশ্চই ..."

-জীবনানন্দ দাশ
ক্ষমা-অক্ষমার অতীত

আবার আধুনা কোলকাতা শহরের পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া যায় -

" সেই মায়ের গানে ঘুমের পরী
আজো থেমে আছে সময়ের ঘড়ি
সেই ঝিম ধরা দুপুর বেলা
ঘুমে জাগরণে হারানো খেলা
ছেলেবেলা ছেলেবেলা ... "


-- নচিকেতা,
একা একা পথচলা

" সেদিনও ছিলো দুপুর এমন
ঝকঝকে রোদ, অস্থির মন
আর ঘড়ির কাটায় তখন
প্রশ্রয়;
সেদিনের মতো কলেজের ক্লাস
শেষ হয়ে গেছে, অবকাশ
পাওয়া গেছে ফের দেখার আকাশ
নীলচে সময়... "


-- রূপম ইসলাম,
নীল রং ছিলো ভীষন প্রিয়

"পুকুর" কথাটা বাউল তত্ত্বে খুবই গভীর আর পূজিত একটা শব্দ। সম্ভবত বাউল ঘরানার আরো কয়েকশ বছর পূর্বে বাংলার তন্ত্র আর দেহাত্ম চিন্তাধারায় [১৩] এর উদ্ভব। "পুকুর" বলতে দেহ-মন-চেতনার কোন অজ্ঞাত স্তরের কথা বোঝায়। দৃষ্টির অগোচরে, আর নিয়ন্ত্রণ, নিরীক্ষণের বাইরের কোন জগত, কিন্তু শরীর মনের মধ্যেই বিরাজমান। লালনের ভাষায়, খাচার পাখির মতো মাঝে মাঝে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। সহজীয়াদের ভাষায়, "সহজ" বা অন্তর্লীন একটা মানবের বিচরণ সেখানে। এই পুকুরে ডুব দিলে আর ভেসে ওঠা যায় না, ডুব দিতে পারাটাই সাধনার অংশ। বাউলরা আত্ম-বিদ্রুপ করে বলে

"ডুব দিতে শিখলি না বাবার পুকুরে !"

লালনের কথায় পুকুর বা ডুব দেওয়ার এরকম অনেক নমুনা আছে, অতি সহজ ভাষা, অতিশয় গভীর মানে, যেমন -

" গেড়ে গাঙ্গের ও ক্ষ্যাপা
তুই হাপুর হুপুর ডুব পাড়িলি
এবার মজা যাবে বোঝা
কার্তিকের উলানির কালে... "

"দুপুর" আর "পুকুর" এর এই ভারি ব্যাঞ্জনাগুলি মাথায় রেখে একটা ছবি কল্পনা করা যাক -

একটা অলস, নিরিবিলি, নিস্তরঙ্গ দুপুরে হঠাত নিস্তব্ধতাটা খানিক ভেঙে একটা (পোনা)-মাছ হঠাত ঘাই মারল। মাছটা টুপ করে লাফ মেরেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন নিথর পুকুরের গভীর তলদেশের আবছা জানান দিয়ে গেল। মাছটা মিলিয়ে যাওয়ার পরেই শুরু হলো স্থির পুকুরের গায়ে মৃদু মৃদু ঢেউয়ের রোল।

এখন পড়ে মনে হবে যে লালন একটা অদ্ভুত মানসিক জাগরণের কথা বর্ণনা দিচ্ছেন। "বাউল" বা "বাউলা" কথাটার মানে হলো "যাকে ভর করেছে", বা যার গায়ে "বদ-হাওয়ার ছোয়া" লেগেছে। এমনই একটা মনের গভীরে পোকা নড়ে ওঠার খবর এখানে হাজির হয়, এই শব্দ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে।

রুশ দেশের এক কিংবদন্তি সাহিত্যতাত্ত্বিক ছিলেন মিখাইল বাখতিন। উনি কবিতা আর উপন্যাসের বিমূর্ত সঙ্গায়নে লিপ্ত ছিলেন। উনি কবিতা আর উপন্যাসের মধ্যে ফারাক বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন যে উপন্যাসে ভাষার বা শব্দের ব্যাবহার তার পরিচিত অনুষঙ্গের মধ্যেই বাধ্যতামূলক ভাবে করতে হবে। অন্যদিকে কবিতার কাজই হলো, কোনো শব্দ বা দ্যোতক-কে, তার অনুষঙ্গ থেকে বিযুক্ত করে, সম্পূর্ণ অন্য কোনো পরিপ্রেক্ষিতে এনে হাজির করা [১৪] । শিল্পকলার ক্ষেত্রে কোনো সঙ্গায়ন বা বর্গিকরণই চূড়ান্ত নয়, কিন্তু বাখতিনের এই প্রস্তাবটা এই ক্ষেত্রে খুব চমৎকার খাটে। "দুপুর" আর "পুকুর"-কে একসাথে এনে আক্ষরিক অর্থের বাড়ন্ত অনেক অর্থময়তা অর্জন করতে পেরেছেন লালন।

তথ্যসূত্র

[১] The growth of language - Universal Grammar, experience, and principles of computation - N Chomsky et. al.

[২] চিন্তার আদল আবিষ্কারঃ ভাষা কিম্বা মানুষের মনের গড়ন - বখতিয়ার আহমেদ

[৩] Semiotics for Beginners - D Chandler

[৪] Bare grammar - E. Keenan, E Stabler. Center for the Study of Language and Information, 2004.

[৫] Lambek grammars based on pregroups - S Buszkowski

[৬] Grammar as mathematics - J Lambek, Canadian math. bull., 32.3, 1989

[৭] The mathematics of sentence structure - J Lambek

[৮] Sentence entailment in compositional distributional semantics

[৯] Mathematical Foundations for a Compositional Distributional Model of Meaning - B Coecke, M Sadrzadeh, S Clark

[১০] Free compact 2-categories - A Preller, J Lambek

[১১] Semantic Vector Models and Functional Models for Pregroup Grammars - A Preller,· M Sadrzadeh, J. Logic, Language and Information, 20.4, 2011

[১২] The syntax-semantics interface and the origins of philosophy - J Lambek, The Mental Lexicon, 4.1, 2009.

[১৩] বাংলার দর্শন চর্চা - অতীশ দীপঙ্কর - রায়হান রাইন

[১৪] মিখাইল বাখতিন - যাপিত জীবন, ভাষা ও উপন্যাস - মোহাম্মদ আজম