সময় -
অনুভূতিতে, বয়ানে, বিজ্ঞানে, গণিতে, আর জীবনানন্দে

মুখবন্ধ - সময় বা মহাকাল নিয়ে আচ্ছন্ন ছিলেন আমাদের জীবনানন্দ। সময় আমাদের সবচেয়ে রহস্যময় নিত্যসঙ্গি। সময় মানে কি ? সময় আমাদের জীবনে কি ভাবে অনুভূত হয় ? সময় একই সাথে একটা বোধ, সময়কে আমরা আমাদের চিন্তায় আর বয়ানে, ইতিহাস বইয়ের পাতায় নানান ইশারা আর নির্দেশ মেনে পুনর্নিমাণ করি সময় নিয়ে আমাদের বোধে, কাছের আর দূরের অনুভূতি কি ভাবে জন্ম নেয় ? সমায় কি আদেও কোন বোধ বা অনুভূতি, নাকি পদার্থবিদ-দের পারা অনড়, অমোঘ বস্তুজাগতিক নিয়মের অঙ্গ ? এই দুইয়ের মধ্যে কোন সঙ্গতি আছে কি ? গণিতের হাত ধরে সময়ের কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কি ? এই নিবন্ধে মনোজাগতিক অনুভূতি, পদার্থবিজ্ঞান, রাজনীতি আর জীবনানন্দ - এদের সবার বক্তব্য শুনে নিয়ে , গণিতের আশ্রয়ে একটা উত্তরে পৌছানো আমাদের উদ্দেশ্য।

হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:

চারিদিকে পিরামিড— কাফনের ঘ্রাণ;

বালির উপরে জ্যোৎস্না— খেজুর-ছায়ারা ইতস্তত

বিচূর্ণ থামের মতো: এশিরীয়— দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান।

গায়ে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের— ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;

‘মনে আছে?’ সুধালো সে— সুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন'


-- জীবনানন্দ দাশ
হাজার বছর শুধু খেলা করে

উপক্রমণিকা - সময় আমাদের জীবনের প্রতি কাজের আর চিন্তার ছায়াসঙ্গি। সময়ের ধারণা অন্য প্রাণিজগত থেকে আমাদের আলাদা করে রাখে, একমাত্র আমরাই আমাদের চারিপাশের নানা ঘটনার হট্টগোলের মধ্যে, ঘটনাগুলিকে পূর্বাপরে সাজাতে পারি, ঘটনাসমূহ থেকে ঘটনামালা গাঁথতে পারি, নিজেদের বর্তমান দশাকে এক বা একাধিক ধারা-বিবৃতির অংশ হিসেবে দেখতে পারি। অতীতের বোঝা মানুষের মতো আর কোনো প্রাণিকে বয়ে বেড়াতে হয় না। অন্য কোনো প্রাণি, অদেখা ভবিষ্যত নিয়ে মানুষের মতো চিন্তিত, উদ্বিগ্ন অথবা উন্মুখ হয়ে থাকতে পারে না। আমাদের প্রায় প্রত্যেক সিদ্ধান্তের সাথে একটা সময়ের হিসাব জড়িয়ে আছে [১১]। প্রত্নতত্ত্বে এমন প্রস্তাবনাও আছে, যে মানুষের প্রথম শিল্পকর্মের অভিব্যাক্তি আসলে সময়-জ্ঞানেরই প্রথম পরিচয় ছিল [১২]। আমরা এও আলোচনা করে দেখবো যে আমাদের ভালো-মন্দ, বা পছন্দ-অপছন্দের বিচারেও সময়ের ধারণা ক্রীড়নকের ভূমিকায় আছে।

মহর্ষি আইন্সটাইন সম্ভবত প্রথম নির্ভুল গণিত আর গাণিতিক প্রাক-অনুমান (ইং - axiom ) সাহাজ্যে দেখিয়েছিলেন যে সময় অথবা সময়ের অতিবাহনের বোধটাও একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। আইন্সটাইনের এই তত্ত্ব বা ওনার স্থান-কালের গাণিতিক আদল বোঝা, এই নিবন্ধের পরিসরে সম্ভব না। আইন্সটাইনের দেওয়া আদলে আমরা হাল্কা চোখ বোলাবো, কিন্তু তার আগে সময় জিনিসটার নানামুখি চেহারাটার আরো অনেক পরিচয় নেব, আর সময়ের নানান রঙ্গ দেখে নেব।

আমার এই নিবন্ধের মূলত তিনটা প্রধাণ অনুপ্রেরণার উৎস আছে। প্রথমটা হলো জনপ্রিয় বিজ্ঞান সংগঠক মাইকেল স্টিভেন্সের দেওয়া একটা উপস্থাপনা [৩], যেখানে সময় নিয়ে নানান রঙ্গের সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলাম। এর আগে সময়ের সাথে মনঃস্তত্ত্বের এই গভীর সংযোগগুলির কথা জানা ছিল না। আরেকটা উৎস হচ্ছে শাহাদুজ্জামানের জীবনানন্দ বিশ্লেষণ [৫], যেখানে জীবনানন্দের সময়-চেতনার কথা উনি বারেবারে তুলে ধরেছেন। জীবনানন্দ নিয়ে আচ্ছন্ন থাকা শুরু হয়েছে আমার ইস্কুল জীবন থেকে। ওনার সময়ের চেতনা নিয়ে আগেও কিছু চিন্তাভাবনা ছিল, যা শাহাদুজ্জামানের লেখার সাথে সুন্দর মিশেছে। আরেকটা উৎস হচ্ছে আমার নিজের গবেষণা ক্ষেত্র - 'বদলায়মান জগত', আর থেকে পাওয়া কিছু উপলব্ধি। আমার গবেষণার চেষ্টার পথে আমার কখনও একবার মনে হয়েছিল যে সময়ের একটা সমতুল্য সংজ্ঞায়নের হদিস পাওয়া যায়। এই তিনটা চিন্তাসূত্র মিলিয়ে এই লেখা।

আমি শুরু করব সময়ের অনুভূতি-জগত নিয়ে। আমাদের আধুনিক কালের মানুষদের জন্য সময়ের হিসাব রাখা খুবই জলভাত একটা ব্যাপার হলেও, আমরা নিজেরাই সময় নিয়ে নানান ধাঁধায় জড়িয়ে পরি। সেটারই নানান নমুনা দেখতে দেখতে পৌছাবো বর্ষপুঞ্জির প্রসঙ্গে। এটাও শ্বাস্বত কোনো ধারণা নয়, আমরা দেখবো এটারও উৎপত্তি হয়েছিল বৃহত্তর সমাজকে একটা নৈর্ব্যাক্তিক, সবার জন্য সমান একটা অভিজ্ঞতার সাথে বেধে রাখার একটা প্রচেষ্টায়। সবার শেষে, আমরা দেখবো যে আমাদের নানান বয়ানে, যেমন ইতিহাস লিখনে, বিবৃতিতে, সেখানেও সময়ের একটা বোধ নেপথ্যে থাকে। তার অদৃশ্য হাত এই বয়ানগুলিতেও থাকে এবং এর ফলে ইতিহাস-বিবৃতির মতো একটা নৈর্ব্যাক্তিক কাজেও, ব্যাক্তি-স্বার্থ এসে মিশ খায়।

এই নিবন্ধে আমার প্রধাণ লক্ষ্য হচ্ছে সময়ের একটা স্বতন্ত্র গাণিতিক সজ্ঞায়নে পৌছানো। গাণিতিক গড়ন (ইং - mathematical model ) সাধাণত যেমন হয়, এটাও হবে খুবই অল্প-কথার আর সরল। গাণিতিক গড়নের আসল শক্তিমত্তা থাকে তাদের বিমূর্ততায়, আর তাদের নিরাকারগুণে। গণিতের স্বভাবই হলো একটা সহজ-সরল ছাঁচার সন্ধান দেওয়া, যেই ছাঁচার আদলে আবেক্ষমান জগতের অনেক ঘটনার গড়ন খুজে পাওয়া যাবে। অর্থাত বাস্তবজনিত হলেও, সেই ঘটনা-প্রপঞ্চের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত হয়ে এসে তার ভিতরকার যেই যুক্তিগত কাঠামো পাওয়া যায় সেটাই হলো তার গাণিতিক গড়ন। তাই এক অর্থে গাণিতিক গড়ন এক ধরণের সরলীকরণ, দৃশ্যত খুব আলাদা দুই জগতের মধ্যেও তাদের আরো অন্তরবর্তী কাঠামোয় মিল থাকতে পারে।

মূল নিবন্ধে নামার আগে শেষ কথা বলে নি, যে এই লেখার পিছনে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য আছে । এই লেখাটা একটা আরো বড় প্রকল্পের অংশ - গণিতের আলোচনা করার জন্য বাংলা ভাষাকে আরো পোক্ত বানানোর [১৯, ২০]। বাংলায় গাণিতিক পরিভাষা বানানো নিয়ে খেলো না করে কিছু ভাষাত্তত্ব-আশ্রয়ী নীতি মেনে করাটাই শ্রেয়। এ নিয়ে অন্য নিবন্ধে [২১] লেখা আমার কিছু সিদ্ধান্ত আর নিয়ম-নীতির নির্দেশে এই নিবন্ধের জন্য গাণিতিক ভাষা তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, বদলায়মান জগত বা dynamical system-বিষয় নিয়ে, আর তার সংশ্লিষ্ট শব্দাবলীর বাংলা প্রতিশব্দ প্রথমবার এই নিবন্ধেই তৈরি হয়েছে।

"অনেকদিন আগে, তখন তমিজের বাপ তো তমিজের বাপ, তার বাপেরও জন্ম হয় নি, তার দাদা বাঘাড় মাঝিরই তখনো দুনিয়ায় আসতে ঢের দেরি, বাঘাড় মাঝির দাদার বাপ না-কি দাদারই জন্ম হয়েছে কি হয় নি, হলেও বন-কেটে বসত-করা বাড়ির নতুন মাটি ফেলা ভিটায় কেবল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে, ঐসব দিনের এক বিকালবেলা মজনু শাহের বেশুমার ফকিরের সঙ্গে মহাস্থান কেল্লায় যাবার জন্যে করতোয়ার দিকে ছোটার সময় মুনসি বয়তুল্লা শাহ গোরা সেপাইদের সর্দার টেলরের বন্দুকের গুলিতে মরে পড়ে গিয়েছিলো ঘোড়া থেকে... "


-- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
খোয়াবনামা

ইলিয়াসের মহা-উপাখ্যান 'খোয়াবনামা' শুরু হয় (এবং শেষও হয়) এই অবিস্মরণীয় বর্ণনা দিয়ে। কাহীনিটা একটা আগা-গোড়া রাজনীতির কাহীনি, শুরু হয় একটা অখ্যাত গ্রামের এক জনপ্রবাদ দিয়ে। জনপ্রবাদ যেই ধরণের ইতিহাস চেতনা বা সময়-চেতনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, সেটা ইলিয়াস চমৎকার ধরেছেন তার লেখায়। জনপ্রবাদ সাধারণত হয়ে থাকে অতীতের কোনো এক ঘটনা, মায়া-মোহ দিয়ে অলংকৃত হয়ে, ইতিহাসের অনুসঙ্গ থেকে সরে এসে ক্রমশ প্রবাদ হয়ে ওঠে। এই প্রবাদ বারে বারে বর্ণিত হয়, কখনই সন-তারিখ মেনে তার সময়কাল নির্ধারণ করা হয় না। বরং এর সময়কাল অস্পষ্ট ভাবে সুদূর অতীতেই কোথাও ধরে নেওয়া হয়েছে। বৃত্তান্তে ঘটনার সুদূরবর্তীতা স্থাপন করা হয়, পর পর অনেকগুলির প্রজন্মের নাম করে -
'তখন তমিজের বাপ তো তমিজের বাপ, তার বাপেরও জন্ম হয় নি, তার দাদা বাঘাড় মাঝিরই তখনো দুনিয়ায় আসতে ঢের দেরি''
এই কায়দায় সময়ের হিসাব রাখার চল কমে আসলেও এখনো গ্রামেগঞ্জে বিদ্যমান, এইখানে সময়কে কোনো উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনার সাথে এক করে দেওয়া হয়। সময় সেই ঘটনার আগে অথবা পরে হিসাবে বিখন্ডিত হয় - যেমন দক্ষিণবঙ্গের নানান গ্রামে গুরুতর ঝড়-ঝাপটাকে লোকেরা মনে রাখে সময়ের বিভাজক হিসাবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে, যেমনটা এই গল্পের গ্রামে অথবা বাস্তব ক্ষেত্রে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের নানান দীপে, কোনো এক ঘটনাই হয়ে দাড়ায় সময়ের বা অস্তিত্বের শুরু। 'খোয়াবনামা' নানান কারণে নন্দিত, তার মধ্যে একটা কারণ হলো তার নৃতাত্ত্বিক বিষয়ে সচেতনতা। গ্রামীন অথবা কৌম সমাজে যেখানে জীবনযাত্রায় প্রজন্মের সাথে প্রজন্মের বিশেষ বদল হয় না, সেইখানেই এই ধরণের সময়ের বিবৃতি গড়ে ওঠে।

সময়ের এই ধারণাকে আমরা বলতে পারি ঘটনা-নির্ভর। এটা স্বভাবজ ভাবেই ব্যাক্তিকেন্দ্রিক, অথবা আঞ্চলিক। সময়ের সম্পূর্ণ নৈর্ব্যাক্তিক হিসাব আমরা বেশির ভাগ মানুষই আজ মেনে চলি, যেমন বর্ষপঞ্জি, ঘড়ি ইত্যাদি। বর্ষপঞ্জির উদ্ভবের প্রসঙ্গে আমরা পরে আবার ফিরবো। ঘটনা দিয়ে গড়া সময়ের এই নির্মাণকে কাঁচা মনে করে খারিজ করা উচিত না, কারণ সময়ের অনুভূতি মাত্রই হলো ঘটনাকেন্দ্রিক। দেখা যাক এ নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের কিছু নিরীক্ষণ।

বেড়াতে যাওয়ার ধাঁধা [৩, ৩ঃ০০]।
ধরা যাক আমরা নিজেদের শহর থেকে অন্য কোনো শহরে বেড়াতে যাচ্ছি, মাঝখানে কোনো জংশনে ট্রেনের বদলি। ধরা যাক ট্রেন বদলের জন্য অপেক্ষা করতে হলো ১২ ঘন্টা, তারপর গন্তব্যে পৌছে ৭ দিন বেড়ানো। এই যাত্রাটা যখন ঘটে চলেছে, তখন জংশনে পরের ট্রেনের অপেক্ষাটা অনন্তকালের মতো লাগে, আর গন্তব্যে পৌছানোর পর ঘোরাঘুরির মাঝে ৭ দিন নিমেষেই ফুরিয়ে যায়। পরে ফিরে এসে এই ভ্রমণ স্মরণে আনলে, জংশনের ওই অপেক্ষাটা খুবই স্বল্প মেয়াদের মনে হবে, আর ঘোরাঘুরি দিনগুলি দীর্ঘ ঘটনাবহুল লাগবে।

সময়ের অনুভুতি বলা যেতে পারে দুই রকম ভাবে করি আমরা, পিছু-দর্শন আর আশুদর্শন । এইখানে ঘটনার আগে আর পরে, সময়-দৈর্ঘ্যের ভোল পাল্টানোর কারণ হলো আমরা দুই আলাদা পদ্ধতিতে সময়কে দেখছি বা নিরীখ করছি বলে।

সময় নিয়ে আমাদের অনুভূতি কতো অদ্ভুত রঙ্গ করে তার একটা উদাহরণ হলো - বেড়াতে যাওয়ার ধাঁধা। সময়ের অনুভুতি বলা যেতে পারে দুই রকম ভাবে করি আমরা, যখন অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনায় ফিরে যেতে চাই, তখন সেটাকে বলা হয় পিছু-দর্শন (ইং- retrospective [৩]), আর যখন ঘটমান সময়কে অনুভদ করি, সেটাকে বলা হয় আশুদর্শন (ইং - prospective [৩])। এইখানে ঘটনার আগে আর পরে, সময়-দৈর্ঘ্যের ভোল পাল্টানোর কারণ হয় আমরা দুই আলাদা পদ্ধতিতে সময়কে দেখছি বা নিরীখ করছি বলে। একটা অদ্ভুত গবেষণায়, মাইকেল স্টিভেন্স নামের একজন অনুসন্ধানকারি, নিজেকে একটা ছোটো ঘড়ে বন্দি রেখেছিল ৩ দিন [৪]। এই ৩ দিন তাকে সর্বক্ষণ গবেষকেরা ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণে রেখেছিল, কিন্তু তার সাথে কোনো যোগাযোগের পথ রাখেনি। তিন দিনের মাথায় লোকটির চিন্তা-ভাবনায় পাগলামি আসতে শুরু করে, জড়িয়ে যায়। তবে এই পরীক্ষাটা হয়ে যাওয়ার ১ দিনের মধ্যেই এই বিগত ৩ দিন তার কাছে সময়ের একটা ছোট্ট পর্ব বলে ঠাহর হতে শুরু করে। বেড়াতে যাওয়ার ধাঁধা-র এইটা এক বিকটতর উদাহরণ।

পিছুদর্শন করার সময় একএকটা অধ্যায়কে কত লম্বা বা খাটো বোধ হয়, সেটা নির্ভর করে সেই অধ্যায়টা কতোটা ঘটনাবহুল ছিল তার ওপর। আশুদর্শনের সাথে মূলত জড়িয়ে আছে সময়ের অতিবাহনের অনুভূতি। এ নিয়ে মানুষের বোঝাপড়া এখনো বাকি আছে, তবে একটা একটা মনোগ্রাহী প্রস্তাব হলো অনুপাত-তত্ত্ব [৩]। এর অনুযায়ী, আমাদের পূর্বেকার জমানো অভিজ্ঞতার তুলনায় কতোটা নতুন জিনিস আমরা অভিজ্ঞ করছি, সেই অনুযায়ী সময় ঘীরগতি হবে বা দ্রুত বয়ে যাবে। আবার সেই পর্বটা যখন অতীতে ফেলে দেখবো, তখন বোধও সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে।

তোমায় আমি দেখেছিলাম ঢের

সাদা কালো রঙের সাগরের

কিনারে এক দেশে

রাতের শেষে —দিনের বেলার শেষে



-- জীবনানন্দ দাশ
তোমায় আমি দেখেছিলাম

জীবনানন্দ আর সময়ের নানান রূপ - রূপ না বলে হাতও বলা যেতে পারে। আমরা জীবনানন্দের এরকম আরো বেশ কিছু উদাহরণ দেখব যেখানে সময় আর তার অদৃশ্য হাতকে (ইং-agency) নানান রূপকে দেখিয়েছেন, কখনো ইঁদুর-পেচাদের আনাগোণায়, কখনো ফসল তোলার পর ফাটল পরি জমি দিয়ে, আর এখানে সাদা-কালো রঙের সাগর দিয়ে। তার কবিতায় নিয়ন্তা বলে যদি কেউ থাকে, সেটা প্রেম বা নারি নয়, গ্রাম-বাংলা বা প্রকৃতি নয়, সেটা হলো শুধুমাত্র সময়। এখানে গুটিকয়েক লাইনের মধ্যেই সময়ের হাত নিয়ে তার দুইটা গভীর বিষন্ন চিন্তা ফুটে ওঠে, সময়ের আর মানুষের জীবনের পুনরাবৃত্তিকর গড়ন, আর একই সাথে নশ্বরতার ফলে বারেবারে হাড়িয়ে ফেলার দুঃখ।

সময় আর সময়ের অনুভূতিতে নানান রকমের বিপরীত-মুখী ব্যাপার জড়িয়ে আছে। সময়ের প্রবাহকে এই মুহূর্তে অনুভব করার সাথে সাথে আমাদের স্মৃতিতে রাখা বিচিত্র ঘটনাদের সময়কালের আর সময়পর্বের মাপ ধরে রাখতে হয়। এই কাজে সামাল দিতে আমাদের মন নানান উপায় বেছে নেয়, তার মধ্যের একটাকে বলা যায় সারাংশিক সময়ের আন্দাজ (ইং- conceptual level heuristics [৩])। বিগত কোনো সময়ের পর্বকে আমরা মাঝে মাঝেই খালি গুটিকয়েক অনুষঙ্গের সাথে যুক্ত রাখি, বাকি খুটিনাটি স্মৃতি আবছা করে ফেলি। এই অভ্যাসকে সারাংশিক স্মৃতি (ইং-conceptual time ) নাম দিয়েছি । কিছু উদাহরণ দেখা যাক -

১) আমরা যারা ৯০-র দশকে বড় হয়েছি, তাদের ভেবে একটু অবাক লাগতে পারে যে নচিকেতা-সুমনদের প্রথম এলবাম আমাদের বর্তমান সময় (২০২১ জুলাই)-এর যতো না কাছে, তার চেয়ে কাছে হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে। বছর পার হয়ে যাওয়ার হিসাবে অবশ্যই এই কথাটা মিলবে, কিন্তু আমরা এই দুই ঘটনা আলাদা ভাবে স্মৃতিতে ভরে রাখি। ৬০-৭০ এর যুগ গুণগত ভাবে বর্তমান যুগের চেয়ে বহু আলাদা, এতটাই আলাদা যে ৭১-এর বিজয়ের ঘটনাটা সুদূর অতীতে স্থান দিয়েছি। অন্যদিকে নচিকেতা-সুমনদের গানে যেই মানসিকতা, মনবৃত্তি বা বীক্ষার পরিচয় পেয়েছি, সেইটা আমাদের বর্তমানের সাথে এতোটাই মেলে যে তাদের বহু যুগ আগেরকাল মনে করিনা। এই ক্ষেত্রে এই দুই ঘটনা, নচিকেতা-সুমনের আবির্ভাব, আর ৭১-এর বিজয়, এদের যুগের সালের হিসাব না রেখে, একটা সারাংশিক হিসাবে রেখেছি বলেই এই রঙ্গটা তৈরি হয়।

২) এবার দুইজন ব্যাক্তির কথা ধরা যাক, নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ আর সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। এদের জীবনকাল নানান অর্থ নিয়ে আমাদের জীবনের আর কৃষ্টির সাথে জড়িয়ে রয়েছে। এটা ভেবে অবাক লাগতে পারে যে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনকাল এদের দুইজনেরই জীবনকালের সাথে ঠেকেছিল। এই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় অবাক লাগাটা অস্বাভাবিক নয়, এনারা দুইজন কিছু কিছু প্রতীক আর বস্তুসংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে - ওয়াজিদ আলীর সাথে আমরা যুক্ত করি কবেকার বিস্মৃত কোম্পানির আমল, কোলকাতা শহরের গোড়া পত্তন, কোলকাতার বাবু সংস্কৃতির আদি-পর্ব এইসব। অন্যদিকে নীরেন্দ্রনাথ হচ্ছেন আধুনিক বাংলা কবিতার জয়যাত্রার একজন কান্ডারি। এই ২১শ-শতাব্দীর প্রায় সব কবি আর সাহিত্যিকই তার সান্নিধ্য পেয়েছেন। যেই সমাজে বা মহলে এনাদের যাতায়াত ছিল, যেই বস্তুসংস্কৃতির ঘেড়ে এনাদের নাম-পরিচয় তৈরি হয়েছিল সেই জগতগুলির মধ্যে গোটা দুই শতকের ফারাক আছে। অথচ এনাদের সময়কাল মাত্র একজন মানুষের জীবনকালের ব্যাবধানেই রয়েছে। এনাদের সময়কালকে আমরা খুব দূরে রাখতে অভ্যস্থ, ওনাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ড থেকে তৈরি হওড়া সারাংশিক সময় ধারণা থেকে।

৩) আরেকটা জিনিস ভেবে অবাক লাগতে পারে যে, প্রথম ফেলুদার সিনেমা বেড়িয়েছিল মুজিব-হত্যার ১ বছর আগে, ১৯৭৪ সালে। মুজিব-হত্যা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে একের পর এক এতোগুলি বাঁকবদল ঘটেছে, যে বাংলাদেশের ঘটনাবহুল ইতিহাসের একদম আদি-পর্বের ঘটনা ধরা হয় মুজিব-হত্যা। এই ঘটনাটা সংজ্ঞাগত ভাবেই বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের সূচনা-পর্বেই নোঙড় বেধে আছে। অন্যদিকে ফেলুদা নিয়ে নতুন বেশে, নতুন রঙে সিনেমা যেহেতু হয়েই চলেছে, ফেলুদার লাগোয়া সারাংশিক সময়-বোধ আমাদের নবিন হয়েই রয়েছে। আরো বিষদ ভাবে বলতে গেলে, ফেলুদার ভাবমূর্তি আর স্মৃতি আমরা বারে বারে পুনরনির্মাণ করে চলি, তাই এই স্মৃতি অন্য উপায় সমরক্ষিত থাকে - গাঁথামালার স্মৃতি হিসাবে (ইং - construal memory) । এই নিয়ে পরে আরো আলোচনা হবে।

এই প্রত্যেকটা কুহেলির সাথে "নোঙড়" বাধার একটা ব্যাপার আছে। এইটা সময় নিয়ে আরেকটা কুহেলি, কোনো এক অতীতের পর্ব, ব্যাক্তি, বা পরিবেশের সাথে নোঙড় বেধে ফেলে সময়ের জ্ঞানে স্থানু হয়ে পরি (ইং - chronostasis)। সময়ের চাকা ঘুড়ে যাওয়া ভুলে যায়। সময়ে স্থানু হওয়া, বা সময়ের সারাংশিক স্মৃতি বানানো, এই দুইটা কাজই আমাদের ঝোঁক, আবেগ, আর পারিপার্শ্বিকের নানান ইশারায় পালন করা হয়। যেমন আমরা যারা ৯০-র দশকে বড় হয়েছি, জ্ঞান হওয়ার আমাদের বাবা-মার যা বয়স ছিল, আমরা সেই বয়স অনেকেই পার করে ফেলেছি। এটা ভেবেও অদ্ভুত লাগতে পারে।বাবা-মা-এর সাথে এতই নিবিঢ় আমাদের বন্ধন, যে তাদের সময় বা বয়সের একটা স্বতন্ত্র ধারণা তৈরি হয়ে থাকে, যেটা বড় হয়ে ওঠার সময়ে দেখা বাবা-মা-এর সাথে অনড় ভাবে বাঁধা।

ছবির উৎস - https://twitter.com/dustingrowick/status/1100579021308469248?lang=it

সারাংশিক সময়ের আন্দাজ - এর একটা বহু আলোচিত উদাহরণ হলো, ডাইনোসরদের যুগ নিয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি। ডাইনোসর আকারে, আকৃতিতে মানুষ বা এই সময়ের বিদ্যমান প্রাণিদের থেকে এতটাই আলাদা, যে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই তাদের বিবর্তনের ধারাবাহিকতার একেবারে পিছন দিকে ফেলে দি। অর্থাত তাদের যুগ আর আমাদের বর্তমান যুগের মধ্যেকার দূরত্বটা সাংখ্যিক নয়, ধারণাগত, আর কিছুটা দৃশ্যমান ফারাকের ভিত্তিতে। এর মুষ্কিল হলো যে সিনেমায়, বইয়ে সব ডাইনোসরদেরই একই সাথে চড়ে বেড়াতে দেখানো হয়, যদিও ডাইনোসরদেরও অন্তত তিনটা বিশাল যুগ ছিল, আর জনমানসে প্রিয় দুইটা ডাইনোসর, টিরানোসরাস আর স্টেগোসরাস, এদের মধ্যেকার সময়ের দূরত্ব (সালের হিসাবে) মানুষ আর টিরানোশরাসের চেয়ে বহুগুণ বেশি। অর্থাত জনপ্রিয় বইয়ে, টিরানোসরাস আর মানুষ সমকালীন ছিল বলাটা আরো সঠিক হবে, এই দুই ডাইনোসর সমকালীন ছিল বলার চেয়ে।

সময় আর স্মৃতি জিনিসগুলি তাই দেখা যাচ্ছে খুবই ব্যাক্তিনির্ভর। তবে আমরা একই সাথে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘড়ি, বর্ষপঞ্জির মতো সার্বজনীন, নৈর্ব্যাক্তিক সময়ের হিসাবও রাখি। বর্ষপঞ্জির উদভব হয়েছিল প্রাচীন সুমেরীয় আর মিশরীয় সভ্যতায়, যখন মানুষ প্রথম তার কৌমের বাইরে গিয়ে নগরকেন্দ্রিক সমাজের অংশী হয়ে উঠল। নগরকেন্দ্রগুলি ছিল বিশাল আর বহুজাতিক, তাই হয়তো বাধ্যতা বশত সবার জন্য সমান, সহজে নথিভুক্ত করা যায় এমন এক সময়ের হিসাব রাখার চল শুরু হলো। সেই নতুন ব্যাবস্থাপনাটা হলো বর্ষপঞ্জি, যা দিয়ে খাজনা আদায়, রাজ-পুজা আয়জনের তিথি নির্ধারিত হতে লাগলো। এবং এই বর্ষপঞ্জির অবলম্বন ছিল মহাকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ, সূর্য অথবা চাঁদেদের চলাদেরা। পৃথিবীর বিভিন্ন বিভিন্ন স্থানে লোকেরা খেয়াল করেছিল যে এই আসমান-চারি বস্তুগুলির গতিবিধিতে একটা নিয়মবদ্ধতা আছে, বৃত্তাকার হিসাব আছে। তাই এদের গতিপথের সাথে মানুষের জীবনের সময় সূচি ধরা-বাঁধা হয়ে পরল। এখানে দুইটা জিনিস কাজ করেছে, প্রথমত মানুষদের গণিত আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের মহান কিছু আবিস্কার। আর দ্বিতীয়ত, কৌমগুলি ভেঙে গিয়ে মহানগরির জীবনে মিশে যাওয়ার পর বিশ্বজনীন বা সার্ব্বজনীন কোনো নিয়ামক খোজার আকাঙ্খাও জন্ম নিলে একই সাথে [১৩]। ফলতঃ, মানুষের সাংসারিক আর রাষ্ট্রিয় কর্তব্য হয়ে দাড়ালো, এই বর্ষপঞ্জির হিসাবের নির্দেশে চলতে।

বর্ষপঞ্জি অবশ্যই জনপ্রবাদ-নির্ভর অথবা স্মৃতি-নির্ভর সময়ের হিসাবের থেকে আরো নির্ভুল আর নির্ভরযোগ্য। ব্যাক্তিগত সময়-ধারণ মানেই মনোজাগতিক দশা আর বাহিরজগতের দশার একটা মিশেল। অন্যদিকে বর্ষপঞ্জি ছিল নক্ষত্র, সূর্য বা চাঁদের অবস্থার ভিত্তিতে, অর্থাত মহাকাশের দশার ভিত্তিতে। এখন থেকে আমাদের এই "দশা" শব্দটা মাথায় রেখে চলতে হবে।

সময়ের গাণিতিক সংজ্ঞা -
গণিতের একধরণের আদল আছে যাকে বলা হয়
বদলায়মান জগত। এই ছবিতে আমার মূল প্রস্তাবনা আনা হয়েছে - সময় আর সময়ের বোধকে আসলে কোনো এক বদলায়মান জগত, আর তার দশা। এই দুই গাণিতিক ধারণার সাথে পরিচয় করিয়া দেওয়া হবে। এর পরে সময় নিয়ে আমাদের হয়ে যাওয়া আলোচনা এই নতুন আলোকে দেখব।

গণিতে অথবা বিজ্ঞানে, প্রায়সই "জগত" (ইং-system) নামে একটা সমষ্টিকে চিহ্নিত করা হয়, এবং এই চিহ্নায়নটাই হয়ে দাড়ায় অনুসন্ধানের এক পাটাতন। জগত মানে হলো যে কোনো ঘটনা আর বস্তুর সমূহ, যাদের গতিপ্রকৃতি, চলাফেরা, আর নিয়মনীতিকে, একটা বিচ্ছিন্ন ঘেড় (ইং - span)-এর মধ্যে এনে তাতে সীমিত রাখা যেতে পারে। এর উদাহরণ সর্বত্রেই - আদ্যিকাল থেকে মানুষ যখন জ্যোতির্বিজ্ঞান করে আসছে, আসমানী গ্রহ-তারাদের গতিবিধি বোঝার সুবিধার জন্য তাদের নিজস্ব একটা জগতে আলাদা করে রাখতে শিখেছে - যেইগুলিকে অজ অমরা সৌরযগত, নক্ষত্রপুঞ্জ, এরকম নানান নামে চিনি। এই জগত পৃথিবী বা মানুষের কাজে-কর্মে প্রভাবিত হয় না। আমাদের সৌরজগতে, চাঁদ-সূর্য-পৃথিবী মিলে একটা ঘের বা জগত তৈরি করে, যার নাম তিন-গ্রহ জগত (ইং - three body problem )। সৌর জগতের বাকি গ্রহ বা উপগ্রহদের প্রভাব বিশেষ নেই এই তিনজনের ওপর, এই তিনজনেই স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা জগত, একে অপরেরর গতি, গতিপথ আর ত্বরণ নির্ণয় করে চলেছে সর্বক্ষণ [৬]। আমাদের পৃথিবী নানান আকার-প্রকারের প্রাণে ছেয়ে আছে, তাদের মধ্যে কোনো একটা বিশেষ, ছোটতর পরিসরের প্রাণিজগতকে বেছে নিয়ে জীববিজ্ঞানীরা গবেষণা করে, যেমন সমুদ্রে মাছ আর জলজ উদ্ভিদ, অথবা কোনো জঙ্গলে বাঘ আর হরিণ। এরা প্রত্যেকেই এক-একটা ক্ষুদ্র জগত, একএকটা জীব-মন্ডল। রসায়নবিদ-রা শরীরের অসংখ্য রসায়নের মধ্যে হয়তো গুটিকয়েক রসায়ন অথবা প্রোটিন্দের বেছে নিয়ে তাদের মধ্যেকার ক্রীয়া-বিক্রীয়ার খবর পেতে একটা জগত বানিয়ে ফেলে।

আমার প্রধাণ গবেষণার বিষয় হলো গণিতের একধরণের আদল - যার নাম বদলায়মান জগত (ইং - dynamical system)। গণিতের এই শাখাটা সরাসরি উদ্ভুত হয়েছে বস্তুজগতের গবেষণা থেকে। নাম থেকেই এর পরিচয় পাওয়া যায় - এ এমন কোনো জগৎ যা নিজস্ব কোনো নিয়মে, স্বতন্ত্র ভাবে বদলে চলেছে, সেটাকেই বদলায়মান জগত বলে। তিন-গ্রহ জগত, বাঘ-হরিণ ভারসাম্য, আবহাওয়া-মন্ডলি, এই সব কিছুই বদলায়মান জগতের বিভিন্ন রূপ, বিভিন্ন আয়তন আর মাত্রিকতার। তবে গণিতের তদন্ত কোনো একটা বিশেষ বাস্তবঘটিত জগতে আবদ্ধ নয়, গণিতে সব কিছু শুরু হয় বিমূর্ত কিছ প্রাক-অনুমান, রাশি, আর ছাপাই থেকেই। প্রথম কাজ হলো, জগতটার প্রতীকায়ন - Ω। এইখানে Ω কিছু গুণবিশিষ্ট গাণিতিক কোনো একটা সম্ভার / সমূহ (ইং - set , দেখুন [৭] ), Ω-র প্রত্যেক সদস্য হলো, সংশ্লিষ্ট জগতটার কোনো না কোন দশা (ইং - state )। এবং জগতটার প্রত্যেক দশার সাথে Ω-র সদস্যেদের মধ্যে একটা একে-একে-মিলন্তি (ইং - one-to-one correspondence , দেখুন [৭] ) আছে। অর্থাত Ω -কে, জগতটার একটা নাম অথবা লেবেল মনে করা যেতে পারে। তবে Ω=র মাধ্যমে আরো কিছু হাসিল হয়, Ω যেহেতু নানান গাণিতিক ধর্মের সমষ্টি, এর ফলে Ω-র আড়ালে যেই জগত আছে, সেই জগতের প্রত্যেক দশার একটা অনন্য গাণিতিক প্রতিনিধি পাওয়া যায়। বস্তুত, কোনো জগতকে তার নানান দশার সমষ্টি হিসেবে দেখার কায়দাটা মানুষের প্রগতির একটা বড় ধাপ ছিল। Ω আমরা বলব ক্রীয়াভূমি অথবা শুধুমাত্র ভূমি (ইং - phase space, state space )।

কোনো জগতকে তার নানান দশার সমষ্টি হিসেবে দেখার কায়দাটা মানুষের প্রগতির একটা বড় ধাপ ছিল। ইউরোপীয়ারা ১৫০০-র শতাব্দীতে খেয়াল করেছিল যে বস্তুর গতিবিধির হদিস রাখতে তার স্থানাংকগুলিই যথেষ্ট। নিউটনীয় গতিবিজ্ঞান দুইটা প্রাক-অনুমানের ওপর দাড়িয়ে আছে - বস্তুর স্থানাংক দিয়ে প্রতিনিধিত্ব, আর সময়ের একরৈখিক, সমানগতির চরিত্র। ভিনগ্রহে পাঠানো সব আকশযানের গতিপথ আর নিয়ন্ত্রণের হিসাব কষা হয়েছে নিউটনের দেওয়া অধিকাঠামোয়। একএক্টা সফল অভিযান নিউটনের তত্ত্বের এক-এক্টা চূড়ান্ত বিজয়। এর মূলে আছে আবেক্ষমান জগতের "দশা" চিনতে পারা। প্ররতিবী, বা প্লুটো, এদের নানান বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন ভর, অবস্থান, বায়ুমন্ডল, তাপমাত্রা ইত্যাদী। কিন্তু এদের মধ্যে গুটিকয়েক বৈশিষ্ঠ্য শুধুমাত্র এই জগতের জন্য প্রাসঙ্গিক। এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে ছেকে তুলে, সংখ্যায়ন বা অন্য গাণিতিক উপায়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেই সৌরজগতের দশা-গুলিকে সঠিক চিনতে পারতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানিরা। এই ক্ষেত্রে, Ω-ভূমিটা হলো কোনো ইউক্লিডীয় ক্ষেত্র Rn

বদলায়মান জগতের প্রথম উপাদান হলো তার ভূমি Ω, দ্বিতীয় উপাদান হলো তার বদলানোর নিয়ম, যেইটা লেখা হয় এই আকারে

F : Ω ----> Ω

এই খানে F একটা ছাপাই (ইং - function)। F ছাপাইটা Ω-র প্রত্যেক দশাকে Ω-রই নতুন কোনো দশাতে নিয়ে যায়। F-এর কাজ হলো Ω-র দশাগুলির মধ্যে রূপান্তর আনা, একে অপরের মধ্যে।
১) F-এর কাজ হলো
Ω-কে নতুন করে Ω-র মধ্যেই ছেপে দেওয়া। (এর থেকেই ছাপাই নাম-সংজ্ঞাটা বাছা, দেখুন [৮, ধারা-৬] )
২)
Ω- র যে কোনো একটা বিন্দু ω- র ছাপ হলো F(ω)।
৩) এই F(ω)-কেই ω- র পরবর্তি দশা বা বদলে যাওয়া দশা মনে করা যেতে পারে।

এই এক দশা থেকে আরেক দশাতে বদলটা বদলায়মান জগতের উথাল-পাতালের জন্ম দেয়। বদলায়মান-জগত শাস্ত্রের কাজ হলো, এই F : Ω -> Ω ছাপাইটার ওপর বাড়তি নানান গাণিতিক অনুমান বা গুণাবলি চাপিয়ে, তার থেকে অন্যান্য গাণিতিক ধর্মের সন্ধান পাওয়া। F : Ω -> Ω এর স্বভাব নানান ভাবে বর্ণনা করা যায়, তার মধ্যে কয়েকটা শব্দাবলী হলো বৃত্তাকার (ইং-periodic), বহুবৃত্তাকার(ইং-quasiperiodic), আর ওলটাই-পাল্টাই(ইং-chaotic)। এদের মধ্যে তৃতীয়টার সাথে আমরা সাধারণ জ্ঞানে বোধগম্য নানান ধর্ম দেখি, যেমন অস্থিতীশীলতা, বিশৃঙ্খলতা ইত্যাদী। এই সবেরই নিটোল গাণিতিক সংজ্ঞা আছে, এবং তাদের সংজ্ঞার অন্তরগত অনুমান ধরে ধরে গণিত তাদের স্বভাব-উন্মোচনে বহু দূর এগিয়ে গেছে। এ নিয়ে আরো বিস্তারিত আলাপ অন্যত্রে।

বদলায়মান জগত নিয়ে গাণিতিক তদন্ত হয় সম্পূর্ণ ভাবে কোনো আসল বদলায়মান জগত থেকে বিযুক্ত থেকে, এর রশদ হচ্ছে শুধুমাত্র গাণিতিক নানান প্রাক-অনুমান, আর এর ফলাফলও হয় নিরাকার গাণিতিক কিছু ধর্ম। নিরাকার হওয়া দরুণ, এর প্রয়োগশীলতা অফুরন্ত। আজকাল বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখাতেই ফলিত বদলায়মান-জগত-তত্ত্ব-এর জায়গা খুজে পাওয়া গেছে।

বদলায়মান-জগত-তত্ত্বের সাথে সময়ের সম্পর্কটা কি বোঝাবার আগে বদলায়মান-জগত সম্পর্কে আরেকটা জিনিস জেনে নেওয়া বাকি আছে, সেটা হলো সেই জগতের একটা আবেক্ষক বা মাপক থাকে (ইং - observor / measurement), যেইটা আমরা লিখতে পারি

m : Ω --> M

আকারে। এইখানে M কোনো এক সম্ভার, এটাকে আমরা আবেক্ষণ-ভূমি বলব (ইং-observation space)। এই আদল অনুযায়ী, একটা আবেক্ষক বা আবেক্ষণ আসলে একটা ছাপাই, যেটা ক্রীয়াভূমি Ω-র একটা ছাপ ফেলে আবেক্ষণ-ভূমি M-এতে। এই ছাপাইকে আবেক্ষণ বল্র কারণ, এর ছাপের মধ্যেই বদলের ক্রীয়াভূমির সম্বধে কিছু খবর/তথ্য গ্রথিত হয়ে যায় ভিন্ন ভূমিতে, ভিন্ন আকারে। পদার্থবিজ্ঞানে, অথবা গণিত শাস্ত্রে, প্রায় সব ঘটনা-প্রপঞ্চকেই কোনো অন্তরালে ঘটে যায়া গাণিতিক প্রক্রিয়ার বাহ্য রূপ, অর্থাত আবেক্ষণ মনে করা হয়। এই অন্তরলের প্রক্রিয়া বা দুনিয়াটা সরসাসরি বাস্তব-সম্পর্কিত হতে পারে, আবার মনগড়াও হতে পারে। মনগড়া হলে এর অস্তিত্ব দাড়িয়ে থাকে শুধু তার বিশেষ গাণিতিক অধিকাঠামোয়।

ডবল পেন্ডুলাম, আর তার ওলট-পালটের জগত - একটা পেন্ডুলামের নীচে আরেকটা পেন্ডুলাম ঝুলিয়ে দিলে যেই খেলনাটা তৈরি হয়, তার গতিবিধি হলো আমাদের আলোচিত ওলটাই-পালটাই জগতের একটা সহজ, হাতেনাতে-গড়া উদাহরণ। পাশের চলচ্ছবিটায় টোকা দিলে এই যুগ্ম পেন্ডুলামটার দোলন দেখা যাবে। পেন্ডুলামের সবচেয়ে নীচের গোলকটার গতিপথ (সাদা রেখা) দেখলেই এর ওলট-পালট খাওয়ার চরিত্রটা বোঝা যাবে। এই সরঞ্জামটায়, শুধ্য সাদা রেখাটার ওপর চোখ রাখলে এই বদলায়মান-জগতটার জটিলতাটা আড়ালে চলে যাবে। এই সরঞ্জামটা নিউটনীয় ছাঁচে ৬ টা স্থাংক আর তাদের মধ্যেকার সমীকরণ দিয়ে বর্ণনা দেওয়া যাবে। আমাদের শব্দাবলীতে, ডবল-পেন্ডুলামের দোলনটা একটা ঘটনা / প্রপঞ্চ, তার নিউটনীয় ছাঁচের গড়নটা হলো তার তলবর্তী বদলায়মান-জগত, আর নীচের গোলকটার আঁকা, কাটাকুটি করা সাদা রেখাটা হলো এই জগতটার একটা আবেক্ষণ / আবেক্ষক

এই পর্য্যায়ে আমরা সময়ের গাণিতিক সংজ্ঞায়ন করতে প্রস্তুত। এই সংজ্ঞার একটা ছবি আগে দেখানো হয়েছে। এর মোট বক্তন্য খুবই সংক্ষিপ্ত -
১) আমাদের যে কোনো রকমেরই
সময় নির্মানে, আসলে কোনো এক আবছায়া বদলায়মান জগত তৈরি করি,
২) আর সেই সাথে সেই জগতকে নানান আবেক্ষণ-মাধ্যম দিয়ে সচারচর মেপে চলেছি বা অনুভব করে চলেছি, সেই অনুভূত দশাই হয়ে দাড়ায় আমাদের সময়-জ্ঞান।

এমনটা লাগতে পারে যে যেই ঘটনা-প্রপঞ্চের ব্যাখ্যার সন্ধানে এই গাণিতিক ছাঁচগুলি তৈরি হচ্ছে, তাদের জটিলতা আর বৈচিত্র্যের প্রতি এই সরলতর গাণিতিক ছাঁচগুলি সুবিচার করে না। তবে গাণিতিক গড়ন তৈরির এটাই একটা বৈশিষ্ট্য, জটিলতাটা নির্মিত ছাচেও থাকে, আর থাকে সেই ছাচটার প্রয়োগ-কৌশলীতে। যেমন এই নিবন্ধে আমাদের আলোচ্য প্রপঞ্চ হলো 'সময়'। আমরা এখন দেখে নেব যে আমার দেওয়া সরল দুই সমীকরণেরই বারংবার প্রয়োগে নানান সময়-ঘটিত ধারণা, আবেক্ষণ আরঙ্গের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে

শুরু করা যাক বর্ষপঞ্জিতে রাখা সময়ের হিসাবে। এখানে গোড়া থেকেই, সংজ্ঞাগত ভাবেই এই হিসাবটা আসলে একটা দশার, দিনাংক হলো সূর্য্যের দশা বা অবস্থান তার নিজস্ব ঘূর্ণনপথে, আর ঘন্টা বা মুহূর্তের হিসাব হলো সূর্যের সেই দশাকে স্থির ধরে নিয়ে তার স্বাপেক্ষে পৃথিবীর দশা, তার নিজস্ব অক্ষে পাঁক খাওয়ার পথে। তেমনই, ঘড়িতে রাখা সময়ও একটা দশা। ঘড়ির ক্ষেত্রে বদলায়মান জগতটা হলো হয় কোনো ইলেক্ট্রিক সারকিট, নয়তো কোনো স্ফটিকের কম্পন-নিয়ম। ঘড়িতে রাখা সময়ের হিসাব হলো এই জগতগুলির দশা। যদিও এই চার রকমের জগতগুলির পাঁক-সময় (ইং - time period) অথবা কম্পাংক আলাদা আলাদা, এইগুলি প্রত্যেকটাই একটা বৃত্তপথিক বদলায়মান জগত (ইং-simple harmonic motion) আর পরস্পরের সাথে একধরণের সমতুল্যতা বজায় রাখে, যাকে গণিতের ভাষায় বলে রূপান্তরিত (ইং-conjugate)। সেই জন্যে এই বিভিন্ন হিসাবের মধ্যে ভাষান্তর করতে আমাদের অসুবিধা হয়না।

এবার ধরা যাক ইলিয়াসের গল্পে তমিজের রাখা সময়ের হিসাব, অথবা আন্দামান নিকোবার বাসীদের রাখা তাদের নিজস্ব, অনুরূপ সময়ের হিসাব। এখানে এই গ্রামে অথবা বিচ্ছিন্ন দীপপুঞ্জে, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে দশা বদলায়নি, অর্থাত জীবনযাত্রায়, প্রযুক্তিতে, বিশ্বদর্শনে, বস্তু-সংস্কৃতিতে কোনো হেরফের হয়নি। এই দশার অভাবের জন্যেই, সব সুদূর অতীতকে অনির্দ্দিষ্ট সংখ্যক কিছু পূর্বপুরুষদের আগে একটা সময়ে ফেলা হয়।

সময়কে দশার আদলে ফেলে বাস্তবঘটিত ঘটনার গাণিতিক গড়ন পাওয়া যায়। এই চারটা ছবিতে আমেরিকার এক প্রদেশের বিরাট সড়কব্যাবস্থার যান-চলাচলের চারটি পরিমাপ নিয়ে তার ছাপ আঁকা হয়েছে সময়ের সাপেক্ষে নীল রেখায়। আমরা [৯] যান-চলাচলের এই এবড়োখেবড়ো গতিকে, তাদের পরিমাপ-ক্ষণ থেকে আলদা করে এনে, তাদের নেপথ্যের কোনো এক বিমূর্ত, মনগড়া বদলায়মান জগত F : Ω -> Ω-এর সাথে বেধেঁ ফেলেছি। ফলতঃ, সেই স্বতন্ত্র বদলায়মান-জগতের ঘূর্ণন বা বদলের হিসাব রাখতে গিয়ে আমরা দেখলাম যে প্রাথমিক উপাত্তগুলির চমৎকার পুনরুৎপাদন হচ্ছে, (কমলা রেখায়)।

মহাকাল - সময়ের ধারণা বা নির্মাণকে একটা বদলায়মান জগত মনে করলে, এও কল্পনা করা যেতে পারে যে সেই জগতের কক্ষপথের সদৃশ্‌ কোনো পথে সময়ও এগোচ্ছে। ঘড়ি বা বর্ষপঞ্জির মতো, বেদান্তে মহাকালকে বৃত্তাকার বলে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মগুলিতে মহাকাল একটা সীমাযুক্ত সময়-ব্যাবধি, এর একটা শুরু (সৃষ্টি) আছে, আর শেষ আছে (কেয়ামত)। আমার পূর্বপুরুষেরা যারা ইন্দোচিন আর দ্রাবিঢ় থেকে আসা জনজাতিদের মিশেল থেকে পূর্ব বঙ্গে তৈরি হয়েছিল, তাদের কৌম সমাজে সম্ভবত এরকম কোন এলাহী মহাকাল চিন্তাই ছিল না। তাদের বন-জঙ্গল আর কাদাজলে ঘেড়া জীবন বাকি ভারতীয় ভূখন্ডের রাজনীতি আর কৃষ্টির ছোঁয়াচ থেকে বেচে বেচে চলেছিল বহু শহস্রাব্দ, তাদের মহাকাল চিন্তা সম্ভবত ছিল এলিয়াসের বর্ণনার সদৃশ, এর শুরু আর শেষ অস্পষ্টবর্তমানকে ঘিড়ে একটা ছোট সময়ের খুপড়িতে সময় সেখানে চলে সমান, মন্থর গতিতে।

অর্থাত সময়ের বদলায়মান জগতের সাথে সাথে সময়ের একটা দৃশ্যপটও তৈরি হয়ে যায়। এই দৃশ্যপট কে আমরা ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে নানান নামে ডাকবো - সময়ের নির্মাণ, সময়ের রূপরেখা, অথবা আরেকটু গণিত ঘেষা হয়ে সময়ের ধাঁচা। জীবনানন্দ সময়ের এই নানান রূপরেখার আভাস পেয়েছিলেন, তাদের নানান খেলা আর জটিলতাও অনুভব করেছিলেন তার গোটা সাহিত্য জীবনে।

"আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন— এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে
"

-- জীবনানন্দ দাশ
ঘোড়া

জীবনানন্দের গড়া বদলায়মান-জগত - জীবনানন্দকে সময় বা মহাকালের চিন্তা তাড়িত করে গেছে প্রায় তার গোটা কর্মজীবন ধরে। উপমহাদেশের নানান বিশ্বদর্শনের মতো, জীবনানন্দের সময়ের গড়নও ছিল বৃত্তাকার। অসীম অনন্ত মহাকাল অসংখ্য বৃত্তাকার পথ দিয়ে তৈরি, তার মধ্যে মানুষের জীবন ওলট পালট খায়, আবার কিছু কিছু স্মৃতি বা স্থানু চরিত্র নিয়েও ফিরে আসে। মহীনের ঘোড়াগুলি সেই অনাদিকালের সময়ের দশার প্রতীক। প্রসন্নকর ব্যাপার হচ্ছে যে জীবনানন্দ এই ঘোড়াদের একটা বিরাট ডাইনামোর ওপর আঢ়ুর বলে বর্ণনা করেছেন। আমাদের ভাষায় যেইটাকে আমরা "তলবর্তী বদলায়মান-জগত" বলি, তার সাথে ধারণাগত আশ্চর্য মিল আছে।এখানে পৃথিবী অর্থাত মহাবিশ্ব নিয়ন্তার ভূমিকায় আছে, পুরানো স্মৃতি, ঘটনা আর মানুষদের ওলট পালট খাওয়াচ্ছে, আবার ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনছে। আমাদের প্রস্তাবিত সময়ের ওলট-পালট-জগতের সাথে সুন্দর মিল আছে।

আমাদের প্রত্যেকেরই মনে বা চিন্তায় আমরা একাধিক সময়-জগত অর্থাত সময়ের ধাঁচা বহন করে চলি। আমরা কেউই শুধু একটা কোনো সময়ের রূপরেখা মাথায় রাখি না। আমাদের খুব দার্শনিক মনষ্ক যারা, আর সবচেয়ে ঘোড়তর বাস্তুবাদি যারা, প্রত্যেকেরই একটা মহাকাল চিন্তা আছে, যার মধ্যে আমরা জীবনের একটা মানে আর জায়গা তৈরি করি, আর মৃত্যু চিন্তাকে সামাল দিই [২২]। আমাদের কোনো চিন্তা বা সিদ্ধান্তই আমাদের অতীতের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। একই সাথে আগামী সম্বন্ধে কোনো না কোনো প্রত্যাশা বা আশংকা থেকেও এরা জন্ম নেয়। অর্থাত মোট কথা হচ্ছে যে মহাকাল-ধাঁচা আমাদের চিন্তার কোনো না কোনো স্তরেই আছেই সারাক্ষণ।

অন্যদিক আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে মহাকাল চিন্তা সরাসরি থাকে না, তখন হয়তো দিন-রাতের চক্র, ঋতুচক্রগুলি আরো সচেতন ভাবে আমাদের মাথায় ঘোরে। দৈনিক অথবা ঋতুর চক্রের সাথে সাথে নিয়মবদ্ধ ভাবে বদলাতে থাকে আমাদের কর্মজীবন বা সংসার জীবনের দায়-দায়িত্ব। সব কাজ সারাতেই একটা সময়ের হিসাব থাকে। সব অর্থনিবেষে, পরিকল্পনায়, একটা সময়ের লগ্নিও ঘটে। তাই প্রাত্যহিক ভিত্তিতে আমরা এক বা একাধিক সময় ধাঁচার আশ্রয় নি।

আর এ ছাড়াও আছে আমাদের স্মৃতিতে ধরে থাকা নানান সময় ধাঁচা, একএকটা গাঁথামালার মতো। আমরা এর আগে এই বিভিন্ন গাঁথামালা ধারণ করা বিভিন্ন, বেহিসাবী সময়-হিসাবেরই পরিচয় পেয়েছিলাম। সময়ের এই প্রত্যেকটা ধাঁচাই একরৈখি, পিছনের দিক থেকে শুধু সামনের দিকেই এগোয়। কিন্তু আমরা যেহেতু এরকম অনেকগুলি ধাঁচার অবলম্বন নিই আমাদের দৈনন্দিন যাপনে, সময়ের অনুভূতি আর স্মৃতি হয়ে থাকে বহুরৈখিক।

"ঢের সম্রাটের রাজ্যে বাস ক’রে জীব
অবশেষে একদিন দেখেছে দু-তিন ধনু দূরে
কোথাও সম্রাট নেই, তবুও বিপ্লব নেই, চাষা
বলদের নিঃশব্দতা খেতের দুপুরে।
বাংলার প্রান্তরের অপরাহ্ণ এসে
নদীর খাড়িতে মিশে ধীরে
বেবিলন লণ্ডনের জন্ম, মৃত্যু হ’লে—
তবুও রয়েছে পিছু ফিরে।
বিকেল এমন ব’লে একটি কামিন এইখানে
দেখা দিতে এলো তার কামিনীর কাছে;
মানবের মরণের পরে তার মমির গহ্বর
এক মাইল রৌদ্রে প’ড়ে আছে।
"

-- জীবনানন্দ দাশ
খেতে প্রান্তরে

অতীত-দর্শনের মতো, আমাদের সময়-বদল-জগত আমাদের আগামীর-চিন্তাকেও আদল দেয়। উন্নতি, প্রগতি এই ধারণাগুলি ২০০ বছর আগেও তেমন চাউর ছিল না, মানুষ তার বদলায়মান বস্তু-সংস্কৃতি থেকে নিজের সময়-বদল-জগতকেও বদলে ফেলেছে [১৭]। এর আগে গ্রামীণ সমাজ, কৌম সমাজেরা একই স্থিতাবস্থায় শতকের পর শতক পার করেছে, একটা ঐতিহাসিক দশা থেকে একটা উন্নতর দশার কল্পনা আর তার দিকে আগুয়ান হওয়ার অভিপ্রায়টা নেই। গ্রামবাংলার সমাজ এর ফলে রাজনীতি, শিল্পায়ন, সমাজ-বদল, হানাহানি - উন্নতির এই সহচরদের থেকেও তারা দূরেই থেকেছে। জীবনানন্দ গ্রামবাংলার এই স্থীরচিত্রেই বারে বারে ফেরত আসতেন নিশ্চিন্তির খোঁজে।

ফিরে আসা যাক আমাদের মূল সমীকরণটায়

সময় = দশা

এই সমীকরণটা বসানোর ফলে, এর দুই দিকেই যাওয়া সম্ভব হয় আর একটা দ্বিমুখী সম্পর্ক তৈরি হয়।

১) দশা --> সময় - কোনো একটা ঘটনাক্রমের দশাগুলি থেকে একটা সময়-সংজ্ঞা বা রূপরেখা তৈরি করা যায়। বেড়াতে যাওয়ার ধাঁধায়, পিছুদর্শনের অভিজ্ঞতাটা আসলে এই নিয়মেরই প্রয়োগ। ডাইনোসরদের সাথে বর্তমান জগতের ফারাকের ফলে ডাইনোসরদের একই সময় পর্বে ফেলে দিয়ে যেই কালের অসঙ্গতি তৈরি হয়, সেটাও এই নিয়মের প্রয়োগ।

) সময় --> দশা - অন্যদিকে, সময়ের কোনো ধাঁচা তৈরি হয়ে থাকলে, আমরা আমাদের স্মৃতি বা অভিজ্ঞতাকে তার মধ্যে আঁটানোড় চেষ্টা করি, সময়ের এক-এক দাগের সাথে এক-এক দশার সাযুয্য রাখতে। বেড়াতে যাওয়ার ধাঁধায়, আশুদর্শনের অভিজ্ঞতাটা এই নিয়মেরই প্রয়োগ। আমরা পরে দেখবো যে আমাদের তিহাস চর্চায়, উপনিবেশিত ইতিহাসের রূপরেখায়, ইতিহাস বিকৃতি হয়ে যায়। অথবা "আধুনিকতা" নামক যাত্রাটাও একটা সময়ের রূপরেখা, তার মধ্যেও নিজেদের অতীত আর বর্তমান আঁটাতে গিয়ে ইতিহাসের বিবৃতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পরে।

শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপর মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে;
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার- চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,
তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,
দেহের স্বাদের কথা কয়;
বিকালের আলো এসে ( হয়তো বা ) নষ্ট ক’রে দেবে তার সাধের সময়।



-- জীবনানন্দ দাশ
অবসরের গান, ‎ধূসর পাণ্ডুলিপি‎

জীবনানন্দের একটা যুগ-সূচনাকারি কবিতা, ভাষা রীতিতে, আর রূপকের ব্যাবহারে। তার মুনসিয়ানায় সময়ের হিসাব আর প্রকৃতির দশা মিশে একাকার হয়ে গেছে। সময় বাস্তবিক প্রকৃতির মতো বিরাম নেওয়ার অনুভূতি তৈরি হয়েছে।


সময়ের জ্ঞানে স্থানু হয়ে পরাটাও আসলে এই দ্বিতীয় নিয়মের প্রয়োগ। নিজের জীবনকালের সাপেক্ষে সময়ের হিসাব, অতীতের কোনো নোঙড়-কালের স্বাপেক্ষে তৈরি সময়ের হিসাবের সাথে মিশে যায়, আবার অমিলও তৈরি করে।

এখন আমি একই স্বপ্ন দেখি রোজ
আশৈশব সম্পর্ক নেই যার সঙ্গে- সেই বাড়ির।
দেখতে পাই
নাটমন্দিরের দুপাশে জুঁই ফুটেছে
এখন বর্ষা।
দেখি, দিঘির ঘাট থেকে উঠে আসছে কেউ
আমার মায়ের মত।
দেখি আসগর আলির
সুপুরি গাছে উঠে-যাওয়া লম্বা লম্বা পা,
আর দিগন্ত জোড়া পাটখেত।
ওরা এখন শরণার্থী, ষাট লক্ষ।
ওরা সারাদিন সদরে ঘন্টা বাজায়
আমি অসাড়,
শুধু রাত্রে স্বপ্ন আসে নাটমন্দির,
পাটখেতে ঢেউ, আসগর আলির পা।



-- বিজয়া মুখোপাধ্যায়
আসগর আলির পা

অতীতচারী কবিতায় সময়-জ্ঞানের নানান রূপ - কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু শক্তিশালী কবিতা লিখে গেছেন, যেখানে অল্প, সহজ কথায় গভীর কোনো ক্ষত অথবা ধাক্কা বহন করে। ওনার কিছু কিছু কবিতা আছে ওনার দেশ ভাগের স্মৃতি নিয়ে। এই কবিতাটা বাছাই করার কারণ, এর কবিত্ব ভর করে আছে সময়ের কিছু কিছু অদ্ভুত চলন আর রঙ্গ-এর ওপরের। আমরা আলোচনা করেছিলাম যে বিগত কোনো সময়ের পর্বকে আমরা মাঝে মাঝেই গুটিকয়েক অনুষঙ্গের সাথে খালি যুক্ত রাখি, বাকি খুটিনাটি স্মৃতি আবছা করে ফেলি। এই অভ্যাসকে সারাংশিক স্মৃতি (ইং-conceptual time ) নাম দিয়েছি আমরা। সময় নিয়ে আরেকটা কুহেলিতে আমরা জড়িয়ে পরি, কোনো এক অতীতের পর্ব, ব্যাক্তি, বা পরিবেশের সাথে নোঙড় বেধে ফেলে সময়ের জ্ঞানে স্থানু হয়ে পরি (ইং - chronostasis)। সময়ের চাকা ঘুড়ে যাওয়া ভুলে যায়। সময়ে স্থানু হওয়া, বা সময়ের সারাংশিক স্মৃতি বানানো, এই দুইটা কাজই আমাদের ঝোঁক, আবেগ, আর পারিপার্শ্বিকের নানান ইশারায় পালন করা হয়। এই কবিতায় দেশ ভাগের ক্ষত থেকে তৈরি হওয়া এক অদ্ভুত স্থির ছবি - আসগর আলির পা - র কথা বলা হয়েছে। এই অদ্ভুত ছবিটার মধ্যেই এই দুই রকমের সময়-বোধের স্বাক্ষর পাওয়া যায়।

সময়-দশা সমীকরণের আরো একটা প্রয়োগ আমরা দেখবো, যেখানে সমীকরণটা দুইবার চালানো হয় -

) সময় --> দশা --> সময় - উদাহরণ হিসাবে, ভেবে দেখুন যে কোলকাতার মৃণাল সেন জন্মেছিলেন ওলন্দাজ তরুণি এনি ফ্র্যাঙ্কেরও আগে। এনাদের জন্মসাল দেখলে এইটা সহজেই পরখ করে নেওয়া যাবে, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু এই তুলনাটা, প্রথম নজরে খটকা জাগাতে পারে। এই সময়-রঙ্গটার পিছনেও, সময়-ধাঁচার একটা ভূমিকা আছে। এই ব্যাক্তিত্বদের আমরা তাদের জন্মসাল দিয়ে চিনি না, চিনি তাদের কর্ম দিয়ে বা জীবন থেকে। মৃণাল সেন ১৯২৩ সালে ফরিদপুরে জন্মালেও, আমরা তাকে বলি "কোলকাতার ৬০-৭০ দশকের লোক"। অর্থাত ওনার গোটা ব্যাক্তিত্ব আর জীবনকে একটা দশা মনে করলে, সেটা আমরা আমাদের জীবনের সময়কালের একটা পর্বে রেখে দিয়েছি। অন্যদিকে, এনি ফ্র্যাঙ্ক বলতেই আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বুঝি, প্রায় ৮০ বছর আগে ওনার বহু চর্চিত হত্যা হয়েছিল। এইখানেও, ওনার জীবনের একটা দশা বেছে নিয়ে, আমাদের সময় চেতনার প্রেক্ষাপটে একটা বিশেষ স্থানে তাকে রেখেছি। এর ফলেই, মৃণাল সেন এনি ফ্র্যাঙ্কের "আগের লোক" শুনলে প্রথমে খটকা জাগতেই পারে।

এক-একজন ব্যাক্তিত্ব বা ঘটনাকে আমরা কিভাবে আমাদের আমাদের স্মৃতিতে ঠাঁই দেব, সেটা নির্ভর করে তার কোন বৈশিষ্ট্য বা দশা আমরা বেছে নিয়েছি। মনবিজ্ঞানে এই প্রক্রিয়াকে দুই ধরণে ফেলে - conceptual level heuristics construal level heuristics [৩, ১১:০০] । বস্তুত, আমাদের স্মৃতি সারাক্ষণ এই খেলাটা করে, ভুলে যাওয়া আর মনে রাখার একটা আপস চলতে থাকে একই সাথে সচেতন আর অবচেতন স্তরে। আমরা অনেক পিছনে ফেলে আসা কোনো অতীতকে আমরা গুটিকয়েক শব্দে অনেকটা সংজ্ঞার মতো মনে রাখি, যেমন - 'অমুক কোম্পানিতে চাকরী করার সময়টা', অথবা 'কলেজে পড়ার সময়'। এটাকে মনোবিজ্ঞানীরা বলে সারাংশিক স্মৃতি (ইং -conceptual memory). একজন কর্মি যে নানান কোম্পানিতে মোটামুটি একই রকমের কাজ করেছে, সে দশার অভাবে, এই ভাবে সারাংশ বানিয়ে একটা নতুন দশার মারফত এই পর্বটাকে নিজের অতীতে গচ্ছিত রাখে। সারাংশিক স্মৃত মানেই হলো, খুটিনাটি ভুলে গিয়ে, কোন ধারণাগত বিবরণ বা আখ্যার মাধ্যমে একটা সময়ের ব্যাবধিকে মনে রাখা। সারাংশিক স্মৃতির সাথে যুক্ত ঘটনাবলী এই বিষদের অভাবে আমাদের স্মৃতিতে, দূরতর বলে অনুভূত হয়।

এর ঠিক উল্টোটা হচ্ছে গাঁথামালা-স্মৃতি (ইং- construal memory)। ওই কোম্পানিতে কাজ করা কালীনই হয়তো এমন কোনো ঘটনা ঘটবে যা নতুন, যা আজও প্রাসঙ্গিক, আর যার বিষদগুলি এখনো বারে বারে আমাদের মনে আবার গেঁথেগেঁথে পুনরনির্মাণ করি। সেই ঘটনাটা মানুষ আরো পরিস্কার আর বিষদ ভাবে মনে রাখে, এর অনুভূত দূরত্বও সব সময় কম থাকে। যেমন কোনো একটা একঘেয়ে চাকরীজীবনের মাঝখানে কারুর সাথে প্রণয় হয়ে তার থেকে বিয়ে। জীবন-সঙ্গিরা মাঝে মধ্যেই তাদের প্রথম দেখার দিন কত আগে ঘটে গেছে ভেবে অবাক হয়। এরকম ভাবে, গাঁথামালা-স্মৃতিতে রাখা ঘটনা অম্লান থাকে, যদিও তাদের সমসাময়িক অনেক ঘটনা বা দশাই, সারাংশিক স্মৃতির অন্তরালে চলে গেছে।

"...তারপর- একদিন
আবার হলদে তৃণ
ভ'রে আছে মাঠে,
পাতায়, শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দিকে-দিকে, চড়ুইর ভাঙা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে- পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা, ঠাণ্ডা- কড়্‌ কড়্‌;
শসাফুল- দু-একটা নষ্ট শাদা শসা,
মাকড়ের ছেঁড়া জাল- শুক্‌নো মাকড়সা
লতায়- পাতায়
ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে পথ চেনা যায়;
দেখা যায় কয়েকটা তারা
হিম আকাশের গায়- ইঁদুর-পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে-মাঠে, খুদ খেয়ে তাদের পিপাসা আজো মেটে
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!
"

-- জীবনানন্দ দাশ
পঁচিশ বছর পরে

জীবনানন্দের সব কবিতার মধ্যে এটাতেই সম্ভবত সময়ের অবিরাম বয়ে চলার সেরা বর্ণনা আছে। সময়ের ক্রীড়নক হিসেবে উনি এনেছেন মাঠের ইঁদুর পেঁচাদের, মাঠে মাঠে বাড়ে বাড়ে ফসল ফলে উঠে আবার খালি পরে থাকার চলন্ত দৃশ্য দিয়ে। এই লাইনগুলিতে ফসল কাটবার পরের একটা মাঠের বর্ণনা আছে, আসলে সেটা সময়ের বহু ধাপ পেরিয়ে আসারই বর্ণনা। সময়ের হাতে আমরা অনেক কিছু পাই আর খুয়েও ফেলি, সেটাই বেদনার মতো হাল্কা ফুটে উঠেছে কবিতার শেষ লাইনে।

আমাদের সময়ের আদল আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ আর নির্ণায়ক কিছু ভূমিকা পালনা করে, শেষ করবো তারই একটা পর্যালোচনা করে। আমার প্রস্তাবনা অনুযায়ী, সময় আসলে হচ্ছে আমাদের নিজস্ব-নির্মিত কোনো বদলায়মান জগতের দশা। অনেক সময় এই সম্পর্ক উল্টেও যায়, অর্থাত, অন্য কারুর সময়-জগতের প্রভাবে আমরা নিজেদের দশাকে ঠাহর করি। এর একটা প্রকট উদাহরণ হলো, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস চর্চায়। এ নিয়ে [১,২]-তে বিস্তর আলাপ আছে, আমি তার ২-৩ টার উল্লেখ করব।

১) প্রথমত, ইউরোপীয় ইতিহাশের বিবৃতি অনুযায়ী, আমরাও আমাদের অতীতকে তিনটা ভাগে ভাগ করেছি - প্রাচীন, মধ্য-, আর আধুনিক যুগ। অথচ আমাদের উপমহাদেশের বিচিত্র দুনিয়ায়, সময়ের এই তিন-ভাজন / তৃভাজন ইউরোপীয় আদলে কোনো মতেই খাটে না, খাটলেও, উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়কালে এইগুলি ঘটেছে। একটা যুগের থেকে আরেকটা যুগে যুগান্তর হয় যখন দ্রুত কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কোনো বিরাট বদল ঘটে মানবজীবনে আর সংস্কৃতিতে (ইং-continuity within change)। ইউরোপীয় অনুকরণে তাই আমাদের মধ্যযুগ, প্রাচীন যুগ বা আধুনিক যুগের সীমারেখাগুলি অর্থহীন।

২) ইতিহাসবিদ, বিশেষ করে উত্তর-উপনিবেশবাদ নিয়ে যারা চর্চা করে, তাদের মতে এই অনুকরণের মূলে আছে আধুনিকতার একটা চিন্তা, 'আধুনিকতা' কোনো এক দশা নয়, আধুনিকতা একটা ক্রম-পরিবর্তন আর যাত্রা, আমাদের ভাষায়, একটা একরৈখিক বদলায়মান জগত। আমাদের ইতিহাস বয়ানে ইউরোপীয় ইতিহাসের বর্গগুলি চাপানোড় কারণ, আমরা মনে মনে ইউরোপীয় এই যাত্রার অনুসারী হতে চাই।

৩) এইরকমই নানান প্রবণতা থেকে আমরা আমাদের ইতিহাসের নানান পর্বের ওপর কিছু কিছু লেবেল লাগাই, যেইটা খুবই মোটা দাগের অথবা আংশিক সত্য হলেও, সেই লেবেলের বর্গের মধ্যেই গোটা ইতিহাসপর্বটাকে ফেলে দিই। অর্থাত বদলায়মান জগতের দশা থেকে সময়কাল নির্ধারণ হচ্ছে না, সময়কালের সাথে জোড় করে কোনো দশাকে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। যেমন আমরা এক-এক যুগ বা শাসনকালকে হিন্দু, বৌদ্ধ, অথবা মুসলমান শাসন-আমল বলি। ধর্মের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক, ভারতে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, খুবই জটিল আর স্বতন্ত্র নিয়মে টিকে থাকতো।

৪) তেমনই বর্তমানে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে, সাম্প্রদায়িক মৈত্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে, অথবা আরো ঘেটে ফেলতে, আমরা এক-একটা যুগ অথবা শাসককে ধর্মীয় সম্প্রীতি অথবা ধর্মীয় নিপীড়নের যুগ - এই লেবেলগুলির তলায় ঢেকে দিই। প্রত্নতাত্ত্বিক স্বাধীন সেন নানান প্রত্ন-উপাত্ত থেকেই এই ধরণের সরলীকরণের ভুল প্রমাণ খুজে পেয়েছেন [২]।

আমরা বর্তমানে কোথায় আছি, আমাদের ভালো মন্দ কি, সেটার বিচার হয় আমাদের নিজস্ব অতীতের প্রেক্ষাপটে, আর অন্যের ইতিহাসের বিবৃতি দিয়েও। আমাদের বিচারে, আকাঙ্খায়, এই দুইটার একটা জগাখিচুরি হয়ে থাকে।

বাংলার ইতিহাস-আশ্রিত তিনটা বই - পাল আমলে থেকে সুলতানি আমলের শুরু অবধি, বাংলার ইতিহাস অন্ধকারে ঢাকা। সেই সময়কার শাসকুল কেমন ছিল, সম্প্রীতি কতোটা ছিল, ধর্ম জিনিসটারই বা কি মানে ছিল, এ নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। এই তিনটা বই বহু আলোচিত এবং পঠিত, এদের কাহীনির সময়কাল এই ৯০০-১৪০০-র মাঝের। কিন্তু এই বইগুলি থেকে সেই পর্ব সম্বন্ধে যতো না জানা যায়, আরো বেশি জানায় যায় লেখকদের সমসাময়িক রাজনীতি আর ইতিহাস-গড়ার আকাংখা সম্বন্ধে।

তথ্যসূত্র


১) যুগ-যুগান্ত-যুগান্তর:দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্নতত্ত্ব-ইতিহাসে সময়ের বয়ান - স্বাধীন সেন, রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট

২) প্রাচীনত্ত্ব, সভ্যতা, সম্প্রীতি আর (প্রত্ন)সম্পদের জন্য ব্যাকুল বাসনা - স্বাধীন সেন

৩) Illusions of Time - Michael Stevens, Vsauce

) Isolation - Michael Stevens, Mindfield, 1.1

) একজন কমলালেবু - শাহাদুজ্জামান

৬)Solving the Babylonian Problem of quasiperiodic rotation rates - S Das, Y Saiki, E Sander, J Yorke, Discrete Contin. Dyn. Syst. (2018), 12.8,

৭) সংখ্যা নিয়ে বোঝাপড়া - শুদ্ধসত্ত্ব দাস

৮) নতুন শব্দাবলীর ফর্দ

৯) Data-driven discovery of quasiperiodically driven dynamics - S. Das and S. Mustavee and S. Agarwal and S. Reza
১০)
Taking Time Seriously - A Theory of Socioemotional Selectivity - L, Carstensen, D Isaacowitz, S Charles
১১)
Mental time travel and the evolution of the human mind - T Suddendorf, M Corballis
১২) The roots of civilization: The cognitive beginnings of man's first art, symbol and notation - A Marshack
১৩) Empires of time: Calendars, clocks and cultures -
A Aveni
১৪) Einstein's clocks, Poincare's maps, empires of time
১৫) Time As a Metaphor of History - Early India - R Thapar
১৬) The politics of time - primitives and the writings of history in colonial Bengal - P Banerjee
১৭) Futures Past - On the Semantics of Historical Time - Reinhart Koselleck
১৮) Time and the Other - How Anthropology Makes Its Object - J Fabian

১৯) কেন বাংলায় গণিত

২০) আমাদের অনুবাদ-চর্চা

২১) গাণিতিক পরিভাষা

২২) The Worm at the Core: On the Role of Death in Life - S. Solomon, ‎J. Greenberg, ‎T. Pyszczynski