ভাষাবিদ-দের মতে, একটা ভাষাকে সজীব আর বর্ধিষ্ণু রাখতে সাহিত্যচর্চার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলো অন্য দুইটা পথে চলা - এক ভাষাটাকে নিত্য ব্যাবহারের আর সর্বস্থানের ব্যাবহার যোগ্য করা। আর দুই, ভাষাটাকে বুদ্ধিচর্চা আর জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে পোক্ত করে তোলা । বাংলায় গত ৩০০ বছরে জ্ঞানচর্চা হয়েছে কম - অর্থাত দর্শন, সমাজতত্ত্বের মতো বিষয় নিয়ে কম মৌলিক লেখালেখি হয়েছি। উচ্চতর বিজ্ঞানের চর্চা আর ভাবনাও কম হয়েছে। ভাষার একমাত্র যেই উৎকৃষ্ট প্রয়োগটা হয়েছে সেইটা হলো সাহিত্য। এই সাহিত্যচর্চার আড়ালে, আর আমাদের উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে বাকি দুইটা খুব সহজেই উপেক্ষিত হয়েছে। এইখানে আমি বেশ কয়েকটা নতুন প্রসঙ্গ তুলে ফেললাম - ১) ভাষার সজীবতা বলতে কি বোঝায়; ২) ভাষার সজীবতার সাথে অসাহিত্যিক অনুষঙ্গের কি সম্পর্ক; ৩) অ-সাহিত্যিক ব্যাবহার কোন মাপকাঠিতে পিছিয়ে আছে, আর পিছিয়ে থাকলে কেনই বা পিছিয়ে আছে; আর ৪) উত্তর-উপনিবেশিকতা কি। এই চারটা বিষয়ে অন্য কোনো পর্বে আলাপ করব। এখন আসা যাক আমার মূল প্রসঙ্গে - (সেটা হলো) বাংলা ভাষাকে সাহিত্যের কল্পলোক থেকে দৈনন্দিন জীবনের আরো ক্রীয়াত্মক প্রয়োজনগুলি মেটানোতে মনোযোগ দেওয়া।
এটাও কোন সামান্য বিষয় নয়, এর সাথে ভাষাতত্ত্ব, আঞ্চলিক ভাষার শব্দভান্ডার, আর ব্যাকারণগত নানান প্রশ্ন জড়িয়ে আছে, তেমনি জড়িয়ে আছে নানান সামাজিক বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করা - যেমন প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম, শ্রেণিগত বৈষম্য, আর কর্মস্থলে রাষ্ট্রীয় ভাষার পরিসর। এইগুলি নিয়ে বিশেষজ্ঞ আর অবিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই তর্কে জড়িয়ে আছে, আমি এইগুলি নিয়ে কালক্ষেপ না করে আরো সামান্য, সহজবোধ্য একটা মামলা সামনে আনতে চাই। মামলাটা কোনো তাত্ত্বিক বা দার্শনিক সমস্যা নয়, মামলাটা হলো প্রযুক্তিগত। আরো বিশেষ ভাবে বলতে গেলে দুইটা প্রযুক্তির অপর্যাপ্ততা নিয়ে। অন্যান্য নীতিগত বিষয় নিয়ে প্রশাসন বা সরকারের যাই সিদ্ধান্ত নিক, এই প্রযুক্তিগত বাধাটা না পেড়োলে সব পরিকল্পনাই বর্তমানের পৃথিবীতে অকেজো রয়ে যাবে। দুইটা প্রযুক্তির চিন্তা আছে আমার - ১) “অপটিক্যাল ক্যারাকটার রেকগনিশান”, অর্থাৎ একটা ছবি থেকে অক্ষর চিনতে পারা; আর ২) “স্পীচ রেকগনিশান” - অর্থাত কোন উচ্চারিত বুলি থেকে শব্দগুলি আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারা। বলা বাহুল্যে, এইগুলি আয়ত্ত করতে হবে সফটওয়ের আর গণিতের মাধ্যমে।
এই দুইটার প্রয়োজন আছে নানান খাতে - সাহিত্য, প্রশাসনিক কাজে, আইনি কাজে, ইতিহাস পাঠে এবং অবশ্যই ভাষা গবেষণায়। কি ভাবে ? অনেক রকম প্রয়োজনে বই, দলিল, নথিপত্র বা পুরানো খবরের কাগজ ঘেটে তথ্য বের করতে হয়। এই কাজগুলি অধ্যয়ণের জন্য তো লাগেই, এ ছাড়া নানান তদন্তে, আইনি কাজে, জরিপের কাজে লাগে। এই তত্ত্ব তালাশ করার কাজটা এখনো হয়, কিন্তু প্রচুর মানুষের শ্রম খরচ করে করতে হয়।
গবেষণা, সমীক্ষা বা সরকারি কাজে যখন কোন প্রকল্প তৈরি করা হয়, উদ্ভাবনাটা সীমিত থাকে বিদ্যমান প্রযুক্তির দিয়ে, আর প্রকল্পের জন্য দরকারি রশদ পাওয়ার আয়াস-সাধ্যতার ওপর। উদাহরণ স্বরূপ - জেনিভার সুপার কোলাইডার প্রকল্পটার কথা কেউ ভাবতোও না সুপারকম্পিউটিং এর আগমনের আগে। কম্পিউটারের এলগোরিথম দিয়ে কেনাকাটার বাছাই আর খোজে কম্পিউটার ব্যাবহারও এসেছে সমাজ বিজ্ঞানের সাথে গণিতের কিছু অদ্ভুত সংযোগ আবিস্কারের পর। এই বাস্তবতাটা ভাষা-নির্ভর সব প্রকল্পের জন্যেও সত্যি। যেই যেই কাজে প্রচুর সময় এবং শ্রম লাগবে, সেই শ্রম এবং সময়ের সমমূল্যের পুঁজি না থাকলে সেই কাজে উদ্যোগও নেওয়া যাবে না। অথচ স্বয়ংক্রিয় ভাবে লিখিত আর উচ্চারিত শব্দ চেনার প্রযুক্তি থাকলে তথ্য সংগ্রহের কাজ বহু বছরে না হয়ে মিনিটে সম্পন্ন হবে। এর পরবর্তী ধাপগুলি, অর্থাত তার বিশ্লেষণ, পরিসংখ্যায়ন তৈরি করা আর তার মধ্যে থেকে নানান প্রবণতা বা গতিক আবিস্কার করা, সেটাও নির্ভুল আর ত্বরিতে সম্পন্ন হবে।
একটা উদাহরণ দিই - বাংলাদেশে একটা গবেষণায় চর্যাপদ থেকে শুরু করে ১৯-শ শতক পর্যন্ত লিখিত বাংলায় সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত শব্দের পরিসংখ্যান নেওয়া হয়েছিল। এই দীর্ঘ প্রকল্পটা সম্পন্ন হওয়ার পর ইতিহাসবিদ আর ভাষাবিদ-দের বেশ কিছু প্রস্তাবনা ঠিক বা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। ছাপা অক্ষর চিনতে পারার প্রযুক্তি থাকলে এমন একটা প্রকল্প আর ব্যাপক ভাবে অনুষ্ঠিত করা যেত। প্রযুক্তি এমন একটা জায়গায় পৌছাচ্ছে যেখানে তথ্য ধারণ করে রাখা, তন্ন তন্ন করে খুজে দেখা, প্রক্রিয়াকরণ করা - এইসব কোনো ব্যাপারই নয়। এইগুলি ১০-২০ বছর আগেও বাঁধা সৃষ্টি করত, এইগুলির সীমাবদ্ধতার জন্য আমাদের পরিকল্পনাও সীমিত ছিল। এইটা এখন আর অন্তরায় হওয়ার কথা নয়।
ধরা যাক মোবাইল ফোনে একটা এপের মাধ্যমে কোনো অডিও রেকর্ডিং-এ বহু মানুষের কন্ঠ থাকলেও সেইগুলিকে আলাদা করা যায়, তার শব্দগুলিকে সনাক্ত করা যায়। ধরা যাক এমন একটা এপ চালু রেখে কেউ বাজারে বা চায়ের দোকানে গিয়ে পারিপার্শ্বিক কথাবার্তা তুলে রাখলো ফোনে। ফোনের এই সামান্য রেকর্ডিংটা হয়ে উঠবে মহা তথ্যের ভান্ডার । রেকর্ডিং চলা কালীন উচ্চারিত বিশেষ বিশেষ শব্দ বা শব্দবন্ধগুলি খুজে দেখা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলের পরামর্শদাতা, অথবা সমাজতত্ত্ববিদ, নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী সেটা থেকে জনমানসের একটা ছবি তৈরি করতে পারে। নৃতত্ত্ববিদরা পরিযানের একটা মানচিত্র তৈরি করতে সাহাজ্য পেতে পারে। সম্ভাবনা অফুরন্ত। আর এই সব কিছুই হবে মিনিটের মধ্যে, আর স্বয়ংক্রিয় ভাবে।
এ ছাড়াও আরেকটা সহজগ্রাহ্য উপকারিতা হলো যে তথ্য জিনিসটা কুক্ষিগত থাকবে না, অভূতপূর্ব মাত্রায় এর প্রসার বাড়বে আর লোকের নাগালে আসবে। একটা শহরের সংরক্ষণাগারে রাখা কোনো পুরানো নথি বা দলিল ঘেটে দেখতে আরেকটা শহর থেকে যাত্রা করতে হবে না, ইন্টারনেট খুললেই পাওয়া যাবে। আমার ধারণা এই সব প্রযুক্তি প্রণীত হলে এরকম অনেক কিছুর আমূল বদল হবে, বর্তমানের কিছু কিছু নিত্যকার কাজ ভবিষ্যতে নিষ্প্রয়োজন হয়ে যাবে। একই সাথে মানুষের নতুন নতুন দক্ষতা আর প্রকৌশলীর স্ফূরণের অবকাশ বাড়বে।