Date: April 21, 2023
প্রতিদিনকার মতই চিত্রা সকালের জগিং, হাঁটার উদ্দেশ্যে বের হল। মিন্টু রোডের বাসা থেকে রমনা পার্ক ১০-১৫ মিনিটের হাঁটা রাস্তা। ১ ঘণ্টার এক্স্যারসাইজ সেরেই ভার্সিটির ক্লাসের উদ্দেশ্যে বের হয়। বিকালের ক্লাস শেষে পার্ক এ আসা হয় মাঝেমধ্যে, তবে ফিরতি পথে এখানে আসাটা নিয়মিত না। এই অনিয়মিত আসার মধ্যেই একদিন চিত্রার চোখে ধরা পরে একটা সুন্দর জিনিস। একটা ছেলে প্রায়শই বিকালে পথশিশুদের পড়ায় পার্কের এক গাছের নিচে। ব্যাপারটা চমৎকার। চিত্রা প্রায়শই ভাবে ছেলেটার সাথে কথা বলবে, ওর কাজকর্ম সম্পর্কে জানবে, পরিচয় হবে কিন্ত আর হয়ে উঠে না।
একদিন সকালে পার্কের এক বেঞ্চিতে ছেলেটাকে দেখা গেল। উদাশ ভঙ্গীতে বসে সিগারেট খাচ্ছে আর প্রতিবার সিগারেটের ধোয়া খুব সতর্কতার সাথে ফেলছে যেন চারিদিকে ছড়ায় ছিটায় না যায়। চিত্রা বেঞ্চের এক কোণায় বসে গভীরভাবে ছেলেটালে খেয়াল করতে লাগল। তেমন বিশেষ কিছু নেই ছেলেটার মধ্যে, ৮-১০ টা ছেলের মতই একটা চেক ডিজাইনের ফুলহাতা শার্ট পরে আছে। চোখের নিচে কালির দাগ দেখে বুঝা যায় খুব কম ঘুমায়। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চুলগুলো উসকোখুসকো, দেখেই বুঝা যায় যে চুল দাঁড়ি সাইজ করা হয় না অনেকদিন।
“ এক্সকিউজ মি, আমি চিত্রা। এখানেই রোজ সকালে হাটতে আসি। আপনি?”
শুধু “ওহ” বলে উত্তর দিল। মনে হচ্ছে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে কোন বিষয়ে।
“ আমি মাঝেমধ্যে বিকালেও আসি হাঁটতে। আপনাকে দেখি ঐ গাছটার নিচে কিছু বাচ্চাদের পড়াতে দেখি, আপনি কি কোন পথশিশুদের সংগঠনের সাথে সংযুক্ত?”
এবার ছেলেটা মাথা ঘুরে চিত্রার দিকে তাকালো, একটু যেন অবাক দৃষ্টি, তবে পরক্ষণের অন্যদিকে মাথা ঘুরে সিগারাটের শেষ টুকরাটা ফেলে পকেট থেকে প্যাকেট থেকে বের আরেকটা সিগারেট বের করে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে সিগারেট ধরাল। এরপর হুট করে খুব ঠাণ্ডা ভঙ্গীতে নিজেই কথা বলা শুরু করল, “ আমি তুষার। একটা সংগঠনের সাথে যুক্ত, তারা শুধু পথশিশু আর ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে কাজ করে। আমি সংগঠনের সাথে যুক্ত সূচনালগ্ন থেকে। সেটার অংশ হিসাবেই সপ্তাহে ৩ দিন বিকালে ওদের পড়াই। আজ সকালে এদিকে একটা কাজ ছিল, ভাবলাম পার্ক হয়েই যাই”
এভাবেই তুষারের সাথে চিত্রার পরিচয়, পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। প্রায়ই বিকালে ক্লাস শেষে চিত্রা চলে আসে পার্কে। তুষার এর ক্লাস শেষে হাঁটতে হাঁটতে আড্ডা চলে। তুষার কিছুটা চাপা স্বভাবের। কথা যা বলার চিত্রাই বলে, তুষার একজন ভাল শ্রোতা। মনোযোগ দিয়ে চিত্রার গল্প গুলা শুনে আর একটার পর একটা সিগারেট ধরায়, শেষ করে। এতো কেন সিগারেট খায় ছেলেটা?
এ কয়েকদিনে বন্ধুত্বটা গভীর হয় দুজনের। হয়তোবা বন্ধুত্বের চেয়েও হয়তো বেশি কিছু। পহেলা বৈশাখ কিছুদিন পরই। ঐদিন বের হবার কথা বলল চিত্রা। বরাবরের মতই গম্ভীর তুষার শুধু “আচ্ছা” বলেই তার উত্তর দিল। কিন্ত তুষার আর ঐদিন আর আসলো না। ভাবে হয়তো কোন কাজে আটকা পরেছে তাই আসেনি। ঠিক ঐদিন ই রমনা বটমূলে ভয়ংকর বোমা হামলা হল।
কিন্ত একদিন যায়, দুই দিন যায় আর ওর দেখা পায় না চিত্রা।
কোথাও যে খুঁজবে সেই সুযোগ ও তার নেই। ওর সম্পর্কে চিত্রা শুধু এতোটুকুই জানে মাস্টার্স শেষ করে চাকরীর প্রিপারেশন নিচ্ছে, থাকে ফার্মগেটের এক মেসে। পাশাপাশি কিছু টিউশন করে। পরিবার গ্রামে। কিন্ত এটা তুষারের আসল পরিচয় না।
প্রতিদিন ই বিকাল হলে যায় চিত্রা। আগের সেই বাচ্চাগুলাকেও আর দেখা যায় না পার্কে। একধরণের শূন্যতা অনুভব করতে থাকে চিত্রা। এরপরেও প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে পার্কে গিয়ে অপেক্ষা করে । যদি দেখা হয়ে যায় কোন এক পড়ন্ত বিকেলে!!! একসময় চিত্রার মধ্যে যে দ্বিধাটা তৈরী হল-এটা কি শুধুই বন্ধুত্ব? নাকি আরো বেশি কিছু?
এক মাস পর……
প্রতিদিনের মতই আজো সকালে হাঁটার জন্য বের হল চিত্রা, পত্রিকা খুব একটা পড়া হয় না। কি মনে করে আজ একটা পত্রিকা কিনে বেঞ্চে বসল পত্রিকা পড়তে। হঠাৎ চোখে পড়ল বোর্ডে বাচ্চাগুলাকে আবারো পড়াতে দেখা যাচ্ছে একজনকে। পিছন থেকে দেখতে হুবুহু তুষারের মত। মুহুর্তের মধ্যেই ছুটে ছেলেটাকে পিছন থেক কাধে হাত রাখতে মুখের ঘুরে তাকালে। দেখা গেল এ তো তুষার নয়, অন্য কেউ।
" আপনি কি তুষারকে চিনেন? আগে আপনার জায়গাতেই ওদের পড়াত"
" নাহ চিনি না। উনি কাজটা ছেড়ে মাসখানেক আগে চলে গেছেন"
" কোথা গেছেন কোন কন্টাক্ট ঠিকানা, বলতে পারেন? "
"না"
চিত্রা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে হাটা দিল। কেন যেন ছেলেটার সাথে কোথায় একটা মিল পেলে তুষারের৷ কোনভাবেই ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝাড়তে পারছে না।
চিত্রা চোখের আড়াল হতেই ছেলেটার কাছে একটা নাম্বার থেকে কল এলো-
" হ্যালো তুষার, নিউ অপারেশনের জায়গা টা দেখে এসেছ? আপডেট কি? "
" আপডেট কোড ৪৩৮. আরো পেলে জানানো হবে৷ লোকেশন: টিকাটুলি, অভিসার সিনেমা হল "
"ওকে"
এক মূহুর্তের জন্য চিত্রার দিকে ঘুরে তাকাল তুষার। হালকা বাকা হাসি দিয়ে দ্রুত রমনার পিছের গেট টার দিকে পা বাড়াল সে।