Date: May 01, 2023
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
ফ্লাইট ছাড়তে আর কিছুক্ষণ বাকি। এই অল্প সময়টাকেও যেন অনন্তকাল মনে হচ্ছে নীলার কাছে।
আজ প্রায় ৬ বছর পর বাংলাদেশে ব্যাক করছে নীলা। এই ছয়টা বছর পরিচিত সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন একটা একাকী জীবনযাপন করেছে নীলা। চেয়েছে অতীত ভুলে একটু শান্তি খুজে পেতে। প্লেন ছেড়ে দিয়েছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে নীলা ফিরে গেলে আজ থেকে ১৪ বছর আগে।
তখন নীলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। ফাইনাল ইয়ারের ক্লাস ল্যাব থিসিস সব মিলিয়ে ক্যাম্পাস থেকে
৫.২০ এর সময় বাসেফেরা হয়। এরই মাঝে নীলার খেয়াল হল একটা ছেলে রোজ গেটে দাঁড়িয়ে তাকে আর চোখে দেখে। প্রতিদিনই ছেলে ৫.২০এর বাসেই যায়। চোখে বড় গোল চশমা, চেক চেক শার্ট পড়া, চুলগুলো উসকোখুশকো এলোমেলো, মুখে খোচাখোচা দাড়ি। চেহারায় আহামরি কোন বিশেষত্ব নেই, ৮-১০ টা সাধারণ ছেলের মতই। উপরে না যেয়ে গেটেই দাঁড়িয়ে থাকে। এতোদিন বাসে কখনো দেখা যায় নি, এই সপ্তাহখানেক হল। চোখে চোখ রাখলেই নামিয়ে ফেলে। যেন কিছু বলতে চায়।
এভাবেই সপ্তাহদুয়েক চলল। একদিন গোপীবাগের স্টপেজে নীলার সাথেই নামল ছেলেটা। বাস ছেড়ে দিতেই নীলা জিজ্ঞেস করে বসল, "আপনি রোজ আমাকে ফলো করেন। কিছু বলতে চান? "
হুট করে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তার জন্য মনে হয় ছেলেটা প্রস্তুত ছিল না। প্রচন্ড ঘামাতে শুরু করল। এম্নেতেও সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে বলল, " আসলে কি বলব বুঝতে পারছি না। আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না "
নীলা একটু ভালো করেই লক্ষ করল ছেলেটা৷ ফুলহাতা একটা কালো চেক কালারের শার্ট পড়া, হাতা গুটানো। খুবই লাজুক আর প্রস্তুত ভংগিতে দাঁড়িয়ে আছে। না, কোন বাজে ছেলে না, কোন প্রকারের খারাপ উদ্দেশ্যও নেই বুঝায় যাচ্ছে। ছেলেটা কি আমাকে পছন্দ করে? করতেই পারে, দোষের তো কিছু না।
" চলুন ঐ কফিশপ টায় বসে কথা বলি, সময় হবে আপনার? " ছেলেটা এবার একটু সাহস পেল। পাশাপাশি হাটা শুরু করল।
এভাবেই রাহাতের সাথে পরিচয় নীলার। এরপর প্রায় ৩ বছর চলল প্রেম ওদের দুজনের৷ এর মধ্যে রাহাত ও এমবিবিএস শেষ করে এক জায়গায় চেম্বার দিয়ে বসা শুরু করল আর নীলাও মাস্টার্সের থিসিস টা জমা দিয়ে একদম ফ্রি হয়ে গেল।
এরপর প্রেম থেকে প্রণয়।
৫ বছরের ছোট্ট সংসারে কখনোই অশান্তি ছিল না আমাদের। বিয়ের পর আমিও একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে লেকচারার হিসাবে জয়েন করি। বাসাতে যথেষ্ট সময় দিতে পারতাম। রাহাত ও চেম্বারের পাশাপাশি এফসিপিএস টা দিতে থাকে। সব কিছু ভালোই চলছিল। সংসারে অভাব ছিল না কিছুর, শুধু ছিল একটা বাচ্চার অভাব।
সমস্যাটা কার? আমার না রাহাতের? এটা কেউই জানতাম না আমরা। একদিন সিদ্ধান্ত নেই টেস্ট করানোর। টেস্টের রেসাল্ট রাহাত ই দেখে। ও জানায় সমস্যা কারোরই না । প্রথম প্রথম কিছু না বললেও একসময় সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে৷ রাহাত ইগনোর করতে থাকে আমাকে। একটা সময় রাহাত আর তার পরিবার বাচ্চা না হবার জন্য আমাকেই দোষারোপ করতে থাকে।
খুব খারাপ লাগে যেদিন রাহাত বলে, " তুমি এই বাসা থেকে চলে যাও " আমি উত্তরে কিছুই বলি নি। সব মেনে নিয়ে বেরিয়ে আসি। দুই মাসের মধ্যেই ডিভোর্স হয়ে যায় "
পিএইচডির জন্য অ্যাপ্লাই করা শুরু করি। সিদ্ধান্ত নেই দেশের বাইরে যাওয়ার। বাবা মা এর মধ্যে চেয়েছে আমি আবার বিয়ে করে স্যাটেল হই। কিন্ত আমার আর মন থেকে সায় দেয় নি৷ কোন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম সব ছেড়ে দেশের বাইরে গিয়ে কাজকর্মে ডুবে যেতে।
এরপর চলে আসি ইউএসএ। গত সপ্তাহে পিএইচডি শেষ করলাম। এর ঠিক এক সপ্তাহ আগেই জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য টা জানি।
এক কফিশপে হুট করে দেখা হয়ে যায় রাহাতের ফ্রেন্ড মাহিনের সাথে। মাহিন এখন ওয়াইফ সহ এখানেই আছে। দেখা হতেই মাহিন বলে উঠল, " ভাবী অনেক দিন পর আপনার সাথে দেখা। কেমন আছেন? এখানে কবে আসলেন? "
অনেক কথা হল। যাওয়ার আগে মাহিন বলল, " ভাবী, আপনাকে আজ একটা কথা বলতে চাই। রাহাত আমাকে মানা করেছিল কিন্ত আমার মনে হয় আপনার সত্যিটা জানা জরুরী।"
"কি?"
" আপনাদের টেস্টের রেসাল্ট নিয়ে রাহাত আমার কাছে আসে। সমস্যাটা ছিল রাহাতের। বাবা হবার অক্ষমতা ওকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। ও চেয়েছিল আপনি ভালো থাকেন। অন্য কোথাও সুখী হন। আপনাকে সত্য টা জানানোর মত সাহস তার ছিল না। কারণ ও জানে আপনি কখনোই ওকে ছেড়ে যাবেন না। কিন্ত ওর জন্য আপনি সারাটা জীবন এভাবে থাকেন তা ও চাই নি। আপনার লাইফ টা আপনি আপনার মত করে গুছিয়ে নেন সুখী হন সেটাই ও চেয়েছিল। তাই আপনাকে ছেড়ে দেয়"
বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫ টায় এসে প্লেন পৌছে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে মতিঝিলের জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করে নীলা। আগের বাসাতেই থাকে রাহাত সে তথ্য মাহিন দিয়েছে ওকে। আগে ত সবসময় সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে ডিউটি শেষ করে বাসাস এসে খেলা দেখতে বসত। ওর সাথে বসে খেলা দেখা লাগত। ও আবার একা একা কথা না বলে খেলা দেখতে পারে না। এখনো কি সেই আগের অভ্যাস টা আছে ওর?
ঢাকার রাস্তায় জ্যাম টা এই কয় বছরে আরো বেড়েছেল মনে হয়। সন্ধ্যা ৭ টা বেজে গেল আসতে।
২ বার কলিংবেল দেয়ার পরেও কোন সাড়া নেই। ও কি এখনো ফেরে নি বাসায়?
একটু পরেই দরজাটা খুলল। অবাক চোখে রাহাত তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ।
" কি এভাবে দাঁড়িয়েই রাখবে? ভেতরে আসতে দিবে না?"
কিছু না বলে দরজা টা খুলে ঢুকার সুযোগ করে দিল।
টিভিতে খেলা চলছে। বাংলাদেশ আয়ারল্যান্ড সিরিজ।
" এখনো খেলা দেখার সেই অভ্যাস টা যায় নি তাই না?"
" কেমন আছো নীলা? ভালো আছে?"
কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। দুজনে চুপ করে বসে রইল।
নীরবতা ভেংগে নীলা বলল, " তোমাকে ছাড়া কি ভালো থাকাটা সম্ভব ছিল আমার? তাই চলে এসেছি বাকিটা জীবন তোমার সাথে থাকতে, রাখবে আমাকে? "