Date: July 27, 2025
তখন আমি যেন এক ছন্নছাড়া, উদ্দেশ্যহীন, উদ্ভ্রান্ত বেকার যুবক। সবেমাত্র অনার্স শেষ করে হন্যে হয়ে বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানিতে সিভি ড্রপ করে বেড়াচ্ছি। সারাদিন টিউশন, সিভি ড্রপ শেষে রিডিং রুমে বিসিএস-এর পড়া শেষ করে যখন হলের ছোট্ট ঘুপচি রুমটায় মাথা গুঁজতে আসি, তখন ঘড়িতে বেজে যায় প্রায় রাত ২টা। বিশাল এই কর্মচঞ্চল ঢাকায় নিজেকে বড্ড অচেনা আর একা লাগে তখন।
জীবনের এমন অনিশ্চিত সময়টাতেই আমার সাথে পরিচয় হয় তিথীর। তিথী তখন ফিজিক্সের অনার্স ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রী। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ; অনার্স শেষেই বাইরে পিএইচডি করতে যাবার ইচ্ছে। আর আমি, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে কোনোমতে টেনে-হিঁচড়ে পাশ করে বের হওয়া এক ভবঘুরে ছেলে। বিসিএস আর সরকারি চাকরির জন্য জোর প্রিপারেশন নিচ্ছি। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
দু’জন দুই মেরুর মানুষ, লক্ষ্যও ভিন্ন। এরপরও তিথীর ছিল আমার জন্য প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসা। বৃষ্টি হলেই ফোন দিয়ে বলত, “মুহিব, এক্ষুণি আমার বাসার কাছে পার্কটায় আসো, একসাথে ভিজব।”
আমিও হিমুর মতোই ‘আসব’ বলে কখনোই যেতাম না। তিথীর তাতে অভিমান হত কিনা তা কোনোদিন জানা হয়নি। পরে যখন দেখা হত, অভিমান করতে দেখিনি কখনো। নাকি এটা আমার অভ্যাস, তা তিথীর বোঝা হয়ে গিয়েছিল!
আজকেও অফিস থেকে ফেরার পথে ঐদিনের মতো ঝুম বৃষ্টি নামল। সাথে ছাতা নেই, তাই এক দোকানের নিচে আটকে গেলাম। ছাতা নিয়ে বের হলেই হারিয়ে ফেলি, তাই ছোটবেলা থেকেই ছাতা ব্যবহার করি না। এটা নিয়েও তিথীর ছিল অনেক অভিযোগ। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর আসলেই আমার জন্য তেহারি রান্না করে আনত। তেহারি আমার পছন্দের। রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে খাইয়ে দিত, দেখে আমি হো হো করে হাসতাম, আর তিথী বলত, “এমন বিশ্রী করে হাসতে আমি আর কাউকে দেখি নি তোমার মতো।”
এক ঘণ্টা আটকে থাকার পরও বৃষ্টি না থামায় অগত্যা বৃষ্টির মধ্যেই রওনা দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই মনে পড়ল; শেষবার এভাবে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম বছর তিনেক আগে। হ্যাঁ, মনে আছে একদম স্পষ্ট, তারিখটা ছিল জানুয়ারির ১২ তারিখ। সেদিনও সন্ধ্যায় এমন ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল, তিথী সেবার না বললেও আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু জানলাম, গত মাসেই তিথীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তিথী এখন হানিমুনে।
সবসময় যাকে এড়িয়ে গিয়েছি, যার ভালোবাসাকে মূল্য দেইনি; সে এবার সত্যিই অভিমান করে অনেক দূরে চলে গেছে। বিস্মিত হইনি, রাগও না। শুধু এক চিলতে একাকী অনুভব হয়েছিল। সেবার পুরো এক মাস বিসিএসের জন্য ওর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।
হাঁটতে হাঁটতে বাসার কাছে চলে এসেছি প্রায়। এসেই দেখি কোমরসমান পানি। এই এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই পানি উঠে যায়; যাচ্ছেতাই অবস্থা। এত রাতে আর রান্না করে খাওয়ার তেল হবে না। যাই টঙে এক কাপ চা খেয়ে খিদেটা আজকের মতো চাপা দেই। বাসায় গিয়েই এক ঘুম দেব।
মামাকে কড়া করে এক কাপ চা দিতে বলে আবারও তিথীকে নিয়ে ভাবতে বসে গেলাম। তিথীর কথা আজ কেন যেন খুব মনে পড়ছে। ওকে নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগছে। শেষবার তিথীর সাথে যখন দেখা হয়েছিল, তখন ওর পরনে ছিল কালো রঙের সালোয়ার-কামিজ। অসম্ভব মায়াবী আর মিষ্টি লাগছিল ওকে।
“তোমার পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন হচ্ছে?”
“হ্যাঁ, ভালোই।”
এতোটুকুই কথা। অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে অনেক কম কথা বলেছিল তিথী।
শেষমেষ বিসিএসটা আর আমার হলো না। দুইবার ভাইভা পর্যন্ত গিয়েও ফিরে আসতে হল। তবে একটা ভালো প্রাইভেট কোম্পানিতে জবটা হয়ে গেল। প্রথম দিকে কম স্যালারি আর কাজের চাপের কথা ভেবে জয়েন করব না ভাবলেও এখন খারাপ লাগছে না। এক বছর পর থেকে ইনক্রিমেন্টও আসা শুরু করল। একটা সমস্যা, কাজের চাপ একটু বেশি; প্রায়ই রাত হয়ে যায়। তবে এটা আমার জন্য তেমন সমস্যা না, একদিক থেকে ভালোই সময় কেটে যায়।
বৃষ্টিটা থেমে গেছে। বৃষ্টি শেষে চারিদিকে একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ আর মাতাল হাওয়া বয়ে যায়। ভালো লাগে তখন।
চায়ের বিলটা দিয়ে রওনা হলাম বাড়ির দিকে।