Date: May 01, 2023
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
খট খট করে শব্দ আসতে লাগল রান্নাঘর থেকে।
শফিক দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে বাজে রাত ৩ টা। একই সাথে চোখে প্রচন্ড ঘুম এবং বিরক্তি। একদম ইচ্ছা করছে না বিছানা থেকে উঠতে।
প্রচন্ড রকমের বিরক্তি নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেই বুঝল এটা ইদুরের কাজ। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে নিয়ে আবার রুমে ফেরত আসলো। গ্লাসে ঢেলে পুরাটা শেষ করল এক টানে। আবার ঘড়িতে তাকাল। বাজে প্রায় সোয়া ৩ টা। আর ঘুম হবে না সারারাত।
শফিকের এই ইনসমনিয়ার সমস্যা টা বেশিদিনের নয়। এই মাস দুয়েক হল। মূলত নীলা যাবার পর থেকেই এই সমস্যা। আগে দিব্যি ঘুমাত রাত্রে। বরংচ নীলাই রাত বিরাতে চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠত আর শফিকের ঘুম ভাংগিয়ে পাশে নিয়ে বসে থাকত।
এখন নীলা থাকলে মন্দ হত না। বাকিটা রাত গল্প করে ভালোই কেটে যেত।
একদমই ঘুম আসছে না দেখে বারান্দায় এসে বসল শফিক। আজকে শাবান মাসের ১৫ তারিখ। ভরা পূর্ণিমা। আকাশ টাও পরিষ্কার৷ বারান্দা থেকে অসাধারণ জোছনা দেখা যাচ্ছে। নীলা থাকলে এখন কি করত? অবশ্যই অনেক আগ্রহ নিয়ে চাঁদ দেখত।
শেষবার কুরবান ঈদের চাঁদ দেখাই ছিল ওর সাথে দেখা শেষ চাঁদ দেখা। বেচারি খুব করে চাইত ভরা পুর্ণিমায় রাস্তায় হাত ধরে হাটতে। শফিকের এসব আদিখ্যেতা একদম ভাল্লাগে না। কোনদিনই রাতে হাটতে বের হওয়া হয় নি পূর্ণিমা রাত্রে।
শফিকের সাথে নীলার বিয়েটা পারিবারিকভাবে৷ শফিক ইউএসএ থেকে প্রায় ৬ বছর পরে পিএইচডি শেষে ফিরে। প্রবাসী শফিক দেশে ছুটিতে এসে ঠিক করল বিয়ে করবে। পারিবারিকভাবে সম্বন্ধ আসল নীলাদের থেকে। মেয়ে বয়সে একটু ছোট, অনার্স ফোর্থ ইয়ারে। মেয়ে দেখতে গিয়েই শফিকের অনেক ভালো লেগে গেল নীলাকে। নীলার মায়াবী চোখ এ যেন কি খুজে পেল। নীলার মা-বাবা ছোট বয়সেই মারা গেসে বাস অ্যাক্সিডেন্টে। নীলা সৌভাগ্যক্রমে বেচে যায়। এরপর থেকেই মামার বাসায় মানুষ। এগুলা শুনে শফিকের মায়া হয়। ছোটবেলা থেকে মায়া ভালোবাসা ছাড়া মেয়েটাকে নিজের কাছে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে এমনটাই ভেবেছিল হয়ত। বিয়ের আগে নীলার নামে কিছু খারাপ কথাবার্তা শুনলেও খুব আমলে নিল না শফিক। সুন্দর মেয়েদের নামে মফস্বল শহরে একটু আধটু দুর্নাম রটেই।
বিয়ের পর ৩ মাস পর নীলার ফাইনাল পরীক্ষা শেষে নীলাকে সাথে করেই নিয়ে ওয়াশিংটন এ আসলো শফিক। নীলার অস্বাভাবিকতা গুলো এই ৩ মাসে যে একদম ই শফিকের চোখে ধরা পরে নি তা না। মাঝেমধ্যেই রাত্রে নীলা একটু কেমন হিংস্র হয়ে উঠত। এটা বেশি হত শারীরিক সম্পর্কের সময়। কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করত নীলা। আবার মাঝেমধ্যেই মাঝরাত্রে অদ্ভুত আচরন করত।
এক রাত্রের কথা। শফিক তখন অনেক ঘুমে। একটু পর ঘুম থেকে উঠে দেখে পাশে নীলা নেই। ভাবল হয়ত ওয়াশরুমে গেছে হয়ত । একটু পর মনে হল কথার হাল্কা আওয়াজ পাচ্ছে। ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে নীলা সোফায় বসে কেমন যেন করছে। চোখগুলো স্বাভাবিক না ওর। ডাক দিতেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল শফিককে।
"কি হয়েছে? ভয় পেয়েছ?"
"কে যেন আমায় ডাকছিল। তাই এই রুমে আসলাম"
কই, কেউ তো নেই। তুমি বোধহয় ভুল শুনছ। এরপর সারারাত জেগে থাকল আর আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকল। এরকম অডিটরি হ্যালুসিনেশন ওর খুব কমন হত।
ইউএসএ আসার পরেও এসব চলতে থাকল।প্রায়শই তিথী নামে এক কাল্পনিক বান্ধবীর কথা বলত। কিন্ত এখানের বাংগালী কমিউনিটিতে এই নামে কেউ নেই। পরে অবশ্য শফিক বুঝেছিল ব্যাপারটা
প্রথম প্রথম একটু কম হলেও এই সমস্যাগুলো খুব ঘনঘন হওয়া শুরু করল নীলার। হিংস্রতার মাত্রাও বাড়তে থাকল নীলার। একদিন ছুরি দিয়ে আক্রমণ করতে বসেছিল প্রায়। শেষের দিকে প্রায়শই আত্মহত্যার চেষ্টা চালাত নীলা। বেশ কয়েকবার দড়ির নিচ থেকে বেচে ফিরিয়ে আনে শফিক।
একটা পর্যায়ে ব্যাপারগুলো অসহ্যকর হয়ে উঠে শফিকের। কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশে নীলাকে নিয়ে আসে। এইকয়দিনে সিলেটের যেখানে মামার বাসায় নীলা বড় হয়েছে, সেখানে নীলার অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করা শুরু করে শফিকের এক সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধু আলমের পরামর্শে। নীলার অতীত ঘাটতে গিয়ে শফিক যা পেল তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
ছোটবেলার বাবা-মা সহ কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে চোখের সামনে বাবা ও মা কে পিষ্ট হতে দেখে নীলা। এরপর থেকেই ওর এসব অস্বাভাবিকতা আচরণের সূত্রপাত। আর এলাকায় ২-৩ টা ছেলের সাথে শারীরিক সম্পর্কও তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে!!
এতোসব শুনে শফিক এর একইসাথে প্রচন্ড ঘৃণা এবং প্রচন্ড ভালোবাসা কাজ করতে লাগল নীলার প্রতি। যাকে প্রচন্ড ভালোবাসা যায়, তাকেই হয়ত সবচেয়ে বেশ ঘৃণা করা যায়।
সব শুনে বন্ধু আলম বলল, " তোর ওয়াইফ নীলা খুব বিরল একটা মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত; নিম্ফোম্যানিয়াক ডিজ়িজ উইথ সাইকোটিক ডাইমেনশন। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর শরীরে অস্বাভাবিক যৌন চাহিদা তৈরি হয়। রোগীর দ্বৈত সত্তা কাজ করে। মনস্তত্ত্বের এই পর্যায়কে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না।"
শফিক আবার ওয়াশিংটনে ফিরে নীলাকে এক সাইক্রিয়াটিক সেন্টারে ভর্তি করে দেয়। সেন্টারে ভর্তি করে আসার সময় নীলা হয়ত বুঝতে পারে দীর্ঘদিন এর জন্যে আলাদা থাকতে হবে। তাই বলে,
" আবার যেদিন আমি বাসায় ফিরব, পূর্ণিমা রাত্রে হাটতে বের হব দুজনে "
শফিক উত্তরে কিছু বলে না। এই অসুস্থতা এতো সহজে যে ভালো হবে না ডাক্তার বলেছে। সুস্থ না হলে ওর সাথে স্বাভাবিক সংসারজীবন এ ফেরাও হয়ত আর হবে।
আজ প্রায় ৬ মাস হতে চলল। আগের এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে রাত পেরিয়ে ফজরের আজান দিয়ে দিল টেরই পাইনি শফিক।
১ বছর পর:
আজকে নীলাকে রিলিজ দিবে ডাক্তার। গত সপ্তাহে ডাক্তার ফোন দিয়ে জানাল এখন অনেকটাই সুস্থ। বড় ধরণের কোন বিপদের আশংকা নেই এখন। রাত ১২ টায় রিলিজ করে নীলাকে নিয়ে হাটতে হাটতে পার্কে এসে বসল।
আজ ভরা পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় নীলার দিকে ভালো করে তাকাল শফিক। আগের সেই হিংশ্রতা আর ধারালো ভাব টা আর নেই চোখে। চোখের নিচে কালিটাও চলে গেছে। আগের চেয়ে অনেকটা শুকিয়ে গেছে। কিন্ত চেহারায় মায়াবী ভাব টা একটুও কমে নি যে!! চমৎকার মিষ্টি রঙের শাড়িতে ভয়ংকর সুন্দর লাগছে নীলাকে!!
অর্কিড ফুল নীলার অনেক পছন্দ। কিছু ফুল তাই সাথেই এনেছে শফিক। নীলার হাতে ফুলগুলো দিতে দিতে শফিক বলল, " আজকের পূর্ণিমা কেমন লাগছে? "
কোন উত্তর দিল না নীলা। আগের চেয়ে অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে।
দুজনে চুপচাপ বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। একটু পরে নীলা বলল, " চল এবার বাসায় যাই "
যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালো শফিক। তখনি নীলা বলল, " আমার হাত টা কি একটু ধরবে?"
এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেল শফিক। ও কি আসলেই সুস্থ হয়েছে? আগের মতই ঝাপিয়ে পরবে না তো?
নাহ, যাকে ভালোবাসা যায় তার উপর এতোটুকু বিশ্বাস রাখা যায়। হাত ধরে হাটতে লাগল দুজন।