আহমেদ মূসা : মনীষী আহমদ ছফা আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের উত্তাপ থেকে জন্ম নেওয়া দল বলে উল্লেখ করেছিলেন । বঙ্গবন্ধুর ‘সেন্স অব টাইমিং’ ড. কামাল হোসেনকে প্রধানভাবে আকর্ষণ করেছিল বলে জানিয়ে ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার-আন্দোলনে-সৃষ্ট রাজপথের ভাষা পাঠ করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন; দৃশ্যত ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তার কন্ঠের ক্ষোভ-অভিমান তিনি লুকোবার চেষ্টাও করেননি। সবকিছু নিয়ে একগুঁয়েমি না করার কারণেই আওয়ামী লীগ বার বার ফিরে আসে। একই সঙ্গে অনেকের জন্য এমন ‘রামকুন্ডুলি’ সৃষ্টি করে, যে, তারা আওয়ামী লীগ না করলেও এডহক ভিত্তিতে বা পার্টটাইম সমর্থন দিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ যা করে তা অতি দক্ষতার সঙ্গে করে, এমন কি দমন-লুন্ঠনও।
আমি কোটা সংস্কারের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়ায় কেউ কেউ বিস্মিত হয়েছেন। আমার অবস্থান আমি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করিনি বলে বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় এই ব্যাখ্যার চেষ্টা।
কোটা সংস্কারের নির্দলীয় আন্দোলন নিয়ে আলোচনার সময় অনেকে সরাসরি আন্দোলনের পক্ষে কথা বলেছেন। কেউ কেউ ক্ষীণ ধারায় হলেও বিরোধিতা করেছেন। কোনো কোনো ব্যক্তি আবার আন্দোলনকারী ও তাদের সমর্থকদের ‘রাজাকার’ বলে গালি দিয়ে ‘দেখে নেওয়া’র আষ্ফালন করেছেন। বর্তমানে দরে-বায়ে না বনলে ‘রাজাকার’ ও ‘নাস্তিক’ গালিদ্বয় দৈনন্দিন-বর্ষণে পরিণত হয়। রাজনৈতিক ব্যবসা শুধু ধর্ম নিয়েই নয়, কিছু ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও চলে। কারণ, এই দু’টির তেজারতিতেই তরক্কী প্রচুর। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের লাভতো ষোলো আনা।
লেখক-সাংবাদি-রাজনীতিক-আমলা প্রভৃতির সংমিশ্রনে সম্প্রতি-সৃষ্ট ‘সুশীলদের’ অনেককেও নিরব থাকতে দেখা গেল। কেউ আবার কচ্ছপের মতো মাঝে মাঝে গলা বাড়িয়ে হাল-হকিকত দেখে আবার গুটিয়ে নিচ্ছেন। একদল আবার টিভি চ্যানেলে তাদের ‘মধ্যরাতের বাণী চিরন্তনী’তে এতো বেশি ধানাইপানাই করেন, যে কিছুই বোঝা যায় না। কিছু ব্যতিক্রমও আছেন, যারা আগাগোড়া সাহসের সঙ্গে কথা বলেছেন।
কেউ কেউ বলেন, বঙ্গবন্ধু কোটা করে যাওয়ায় এর পরিবর্তন বঙ্গবন্ধুর অপমান। কিন্তু তারা ভুলে যান যে, উপযোগিতা হারানো বা সমসাময়িক-কালের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে অনেক কিছুরই রদবদল ঘটাতে হয়েছে, এমন কি বাদ দিতে হয়েছে বাকশালও।
কোটা সংস্কার-বিরোধীদের সঙ্গে সমর্থকদের পার্থক্য আকাশ-পাতাল নয়। পার্থক্য দৃষ্টিভঙ্গির। কেউ কেউ মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য কোটা তুলে দেওয়া বা হ্রাস করা মানে তাদের অপমান করা। কথাটি ঠিক নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য বর্তমান হারের কোটা রাখাটাই মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান ও বিতর্কের দিকে ঠেলে দেওয়া এবং জনগণের মূলধারা থেকে ছিঁটকে ফেলার ঝুঁকি নেওয়া । বিশেষ করে এ-নিয়ে যখন কথা উঠে গেছে এবং আন্দোলন ব্যাপকতর হচ্ছে। এই অবস্থায় তাদের কোটা একটি কোটারি শ্রেণীর জন্ম দেবে, মুক্তিযোদ্ধার বংশধরেরা করুণা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হবেন। অনেকে প্রয়োজনীয় উদযোগ গ্রহণে বিরত থেকে একশ্রেণীর পরজীবীতে পরিণত হবেন। এসবের পরিণাম কারো জন্যই ভালো হবে না। আন্দোলনের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধাও বিব্রত বোধ করেছেন। ফেসবুকে মুক্তিযোদ্ধার এক সন্তানকে দেখলাম ‘কোটা চাই না’ বলে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে। সবচেয়ে বড় কথা, মুষ্টিমেয় ও চিহ্নিত রাজাকার-আলবদর-আলশামস প্রভৃতি বিশ্বাসঘাতক ছাড়া দেশের সব মানুষই স্বাধীনতার জন্য নানাভাবে যুদ্ধ করেছেন, যার যার অবস্থানে থেকে। জান-মাল-সম্ভ্রম হারানো মানুষের সংখ্যা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়েছিলেন দেশের সবচেয়ে সাহসী ও অংগীকারবদ্ধরা। তারা যুদ্ধে গেছেন নিজের বা আপন পরিবারের কল্যাণের জন্য নয়, দেশের মুক্তির জন্য। কেউ সরাসরি রণাঙ্গনে ছিলেন, কেউ ভারতসহ অন্যান্য দেশে থেকে কাজ করেছেন। হাজার-হাজার মানুষ যুদ্ধ করতে গিয়েও বয়সের স্বল্পতা বা রোগের জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ পাননি। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ-সুযোগের স্বল্পতার কারণে অনেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি। তারা ইয়ুথ ক্যাম্প থেকেই ফেরত এসেছেন। যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে অনেককেই শুধুমাত্র কয়েকটি গ্রেনেড বা বেয়োনেট ধরিয়ে দিয়ে দেশের ভেতরে পাঠানো হয়েছে। অবশ্য এখানে যুদ্ধ করতে যাওয়াটাই মুখ্য, যুদ্ধ করার সুযোগ পেল কি পেল না সেটা মুখ্য নয়।
বহু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ইচ্ছে করেই সার্টিফিকেট নেননি। কেউ কেউ আবার বিশেষ রাজনৈতিক প্ররোচনায় সার্টিফিকেট পেয়েও ছিঁড়ে ফেলেছেন। হাজার-হাজার মানুষ দেশের ভেতরে থেকেই যুদ্ধ করেছেন বিভিন্ন বাহিনীর হয়ে, যেমন নরসিংদিতে আবদুল মান্নান ভুঁইয়া, মানিকগঞ্জে আবদুল হালিম চৌধুরি, বরিশালে সিরাজ সিকদার ও হেমায়েত বাহিনী প্রভৃতিতে যোগ দিয়ে। তাদের অনেকেই সার্টিফিকেট পাননি বা নেননি। অন্যদিকে বিলি করা হয়েছে হাজার হাজার ভুয়া সনদ। প্রতিদিনই এরা ধরা পড়ছে, কিন্তু এখনো অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বিরাজমান রয়েছে।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনের আরেকটা সুফল হচ্ছে, এখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনাক্তকরণের কাজ প্রাধান্য পাচ্ছে। আগের সরকারগুলি এ-নিয়ে আন্তরিক ছিল না। ১৯৮০-৮১ সালে একবার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিতর্কিতদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ভুয়াদের সনদ বাতিলের উদযোগ নিয়েছিল। আমি তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বক্তৃতা-বিবৃতি লেখার কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে কিছু কৌতুকর ঘটনা দেখেছি। প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলতে পারতো না কোন অস্ত্রে কয়টা গুলি থাকে, গ্রেনেড কীভাবে ছোড়ে কিংবা তার সেক্টর ও সাব-সেক্টর কমান্ডারের নাম। কারো কারো আমতা আমতা করার দশা দেখে বোঝা যেত যুদ্ধের সে কিছুই জানে না, মুখস্ত করে আসা উত্তর গুলিয়ে ফেলছে। সাক্ষাৎকারের বর্ণণা শুনে অনেক ভুয়া সাক্ষাৎকার না দিয়েই পালিয়ে গেছে। এখনও ভুয়াদের তালিকায় আমরা উচ্চপদস্ত আমলা ও পুলিশের সদস্যসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষই দেখতে পাচ্ছি। তাদের অপরাধ ভয়ঙ্কর অপরাধ। সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনাক্তকরণের জন্য একটি ঝড়ো ও আখেরি ছাক্নি প্রয়োজন।
এখন আসলে দরকার বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুযোগ-সহায়তা-সম্মান আরো বাড়ানো। মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু আর্থিক অনুদানই নয়,তাদের আনুষ্ঠানিক দাওয়াত দিয়ে মেহমান হবার সম্মান দিতে হবে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলিতে। প্রতি বছর প্রধানমন্ত্রী প্রতিজন মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক দু’টি করে বই উপহার দিতে পারেন। সরকারী বাস, ট্রেন, স্টিমারে তাদের বিন ভাড়ায় যাতায়াতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পৃথিবীতে এমন কিছু দেশ আছে যেখানে মুক্তি-সংগ্রামীরা রাস্তাদিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষ আর কিছু করতে না পারলেও ফুল ছুড়ে দেন তাদের দিকে, সম্মান জানাতে। সম্মান অন্তরের বিষয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সবাইকে একটি করে বিশেষ চাকতি বা মেডেল দেওয়া যেতে পারে যা প্রদর্শন করা হলে সব ক্ষেত্রেই বিশেষ সুবিধা ও সম্মান পাবেন। তাতে অনেক বেসরকারী সংস্থাও স্বত:স্ফূর্ত ভাবে সম্মান জানাতে এগিয়ে আসবে।
অনেকে আমেরিকার ভেটেরানদের উদাহরণ দেন। কিন্তু বাংলাদেশ আমেরিকা নয়। আমেরিকায় প্রায় দেড় কোটি কাগজপত্রবিহীন (‘অবৈধ’ শব্দটা এখানকার বিবেকবান শ্রেণী ব্যবহার করে না) অভিবাসী থাকা সত্ত্বেও তারা নানা ধরনের ভিসার ব্যবস্থা করে প্রতিনিয়ত লোক আনছেন আমেরিকায়। এখানে কাজ করার লোকের অভাব। আর বাংলাদেশে প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষিত বেকারসহ কর্মহীন মানুষের সংখ্যা চার কোটি বিরাশি লাখ। সেখানে ৫৬ শতাংশ কোটা অনেক বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের মধ্যে যারা মোটামুটি মানসম্মত জীবিকা থেকে পিছিয়ে থাকবেন বা চেষ্টার পরও চাকরি পাবেন না, তাদের কর্মসংস্থানের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্ট বা এ জাতীয় নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সে-সবের অধীনে গড়ে তোলা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে তাদের চাকরি দেওয়া যেতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানে একশ’ ভাগ তাদের দ্বারা পূরণ করলেও অযৌক্তিক হবে না বা কোনো প্রশ্ন উঠবে না। কল্যাণ ট্রাস্ট অতীতে তেমন দরকারী ভূমিকা রাখতে পারেনি দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে। কিন্তু এখন অবস্থা আগের মতো নয়। এখন বিশ্বমানের দক্ষ ব্যবস্থাপনাও বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। বহু মুক্তিযোদ্ধা অনেক বড় ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছেন, কেউ বা অবসর যাপন করছেন। নতুন-গড়া প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাদেরকে উপদেষ্টা বা শীর্ষ পদে রেখে সেসব প্রতিষ্ঠান চালানো যায়। ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কলসেন্টারসহ সেবাখাতের অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে দেশে, বাড়ছে সম্ভাবনা। জামায়াতের লোকেরা হাজার হাজার লাভজনক প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসার নজির আমরা দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধারা তা পারবেন না কেন?
মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লিখিত পর্যায়ের সন্তানদের জন্য ব্যবসার সুযোগও করে দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে ঋণেরও ব্যবস্থা করা যায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার বাইরেও যে-সব কোটা আছে, প্রতিবন্ধীদের কোটা ছাড়া বাকীগুলিও যৌক্তিক হারে হ্রাস করা যায়। সবকিছুকে সমকালের পরিপ্রেক্ষিত দিয়েই বিচার করতে হবে।
দুই
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পক্ষাবলম্বনকারী ভারতের প্রায় তিন হাজার সেনা নিহত ও নিখোঁজ হয়েছেন, আহত হয়েছেন বার হাজার। তাদের স্মরণেও কিছু করণীয় রয়েছে।
ক. শহীদ ভারতীয় বীরদের জন্মদিনে তাদের পরিবারের কাছে অন্তত কিছু ফুল ও উপহার পৌঁছে দিতে পারে ভারতে আমাদের দূতাবাস ও কনসুলেটগুলি। আহতদের পরিবারেও সম্মানসূচক কিছু পাঠানো যায়।
খ. ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর দূতাবাস-কনসুলেটে যৌথভাবে সব ভারতীয় শহীদদের জন্য স্মরণসভা করা যেতে পারে। আলোচনায় অংশ নিতে পারেন দুই দেশেরই বুদ্ধিজীবীগণ ।
গ. মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর শহীদদের স্মরণে দুই দেশের সীমান্তের সুবিধাজনক জায়গার নো-ম্যানসল্যান্ডে যৌথ শহীদ মিনার গড়া যেতে পারে, যেখানে দুই দেশের মানুষই কাছে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।
তিন
এবার আমি তুলে ধরছি গত ৯ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ফেসবুকে দেওয়া আমার ৭টি স্ট্যাটাসের বক্তব্য।
১. কোটা সংস্কারের ন্যায্য আন্দোলন অবশ্যই সফল হবে। প্রচলতি কোটা সিস্টেম মুিক্তযোদ্ধাদের জন্যও বিব্রতকর, কারণ তারাও ক্রমশ জনবচ্ছিন্নি হয়ে পড়বেন । অবশ্য ভুয়াদের জন্য স্বাগতকি। এ আন্দোলন সরকারের নড়বড়ে গদি ধরে টান দিতে পারে।
২. আজ-কালকার পলটিশিয়ানরা সব-সময় চালাকির মধ্যে থাকেন। তবে, ছাত্র-ছাত্রীদরে সঙ্গে চালাকি করলে খবর আছে। কারণ, ওরা সব চালাকি-ভন্ডামির মূল উৎপাটনের কায়দা জানে ও ক্ষমতা রাখে।
৩. একটি জাতির জীবনে কোনো কিছুই রাতারাতি ঘটে না । সব ধরনের সরকার এবং দলেরই দু’টি একাউন্ট থাকে – ভালো ও মন্দ জমা হওয়ার জন্য। মন্দ জমতে-জমতে পাল্লা ভারি হয়ে গেেল পতন ঘটে সরকারের। অবশ্য মানুষরে সামনে আস্থাভাজন বিকল্পও থাকা চাই। এটা আমার অভজ্ঞিতা ও পর্যবক্ষেণজাত উপলব্ধি।
৪. আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে তরুণদের মধ্যে যে স্থানটা করে নিয়েছিল, কোটা সংস্কারের নির্দলীয় আন্দোলনের বিরুদ্ধে দমনে গেলে তার অনেকটাই হারাবে। কারণ, প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষিত বেকারসহ সব ধরনের ৪ কোটি ৮২ লাখ কর্মহীন মানুষের দেশে ৫৬ ভাগ কোটার মহার্ঘ বিলাসতিা মানুষ বেশিদিন সহ্য করবে না । এই আন্দোলন ঘরে-ঘরের আন্দোলন। এমন কি ছাত্রলীগের অল্প-ব্যতক্রিম ছাড়া সবাই আন্দোলনে ছিল এবং ভবষ্যিতেও থাকবে – যদি আওয়ামী লীগ রাজপথের ভাষা পড়তে ভুলে গিয়ে থাকে। সব ধরনরে কোটা মলিেিয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন নয়।
৫. কোটা সংস্কারের নির্দলীয় আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগের কতপিয় এবং দলকানা কিছু শিক্ষক যে ঘৃণ্য ভূমিকা রাখছে ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না। ন্যায্য-আন্দোলন এবং দমন-বিশ্বাসঘাতকতা পাশাপাশি চললেও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনই জয়ী হয়। ঝড়ো হাওয়ায় সাময়িকভাবে আলো কমে আসলেও প্রদীপ নিভে যায়নি, নিভবে না । এই জুলুমের জন্য আওয়ামী লীগকে মাসুল দিতে হবে। একই সঙ্গে ভবষ্যিত ঘটনা-প্রবাহে কিছু নতুন মাত্রা যোগ হবে। যেমন, এতকাল দেখে আসছি, ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা হারানো দলের ছাত্র সংগঠনের বীর পুঙ্গবরা সব হল থেকে একযোগে লক্ষণ সেনের মতো পলায়ন করে এবং নতুন ক্ষমতাসীন দলের বীর পুঙ্গবরা সেসব দখল করে। হলে সিটের জন্য দলে যোগ দেওয়ারা সঙ্গে সঙ্গে দল পরিবর্তন করে। পরিবর্তন করে সুবিধাবাদীরাও। এখন থেকে হয়তো কিছু দলকানা শিক্ষককেও পালতে হবে; নানা রং-বর্ণের কিছু সুশীল ধাওয়ার শিকার হবে।
৬. অনুপস্থিত ভোটারের ভোটে ‘নির্বাচিত’ সরকারের সব-বক্তব্যের সঙ্গে মূলধারার অধিকাংশ মিডিয়ার কন্ঠমেলানো একটি দেশের জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
কোটা সংস্কারে আন্দোলনরতরা সাংবাদিকদের ওপর ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভের কারণ খুঁজতে সাংবাদিকদেরও আয়নার সামনে দাঁড়ানো উচিত।
বাংলাদেশের মানুষ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য যেমন সংগ্রাম করেছে, তেমনি গণ-বিরোধী ভূমিকার জন্য ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় দৈনিক বাংলা, মর্নিং নিউজ প্রভৃতি পত্রিকার অফিসে আগুনও দিয়েছে। বোমা মেরেছে দৈনিক সংগ্রামে।
আবার জনগণের পক্ষে থাকায় পাকিস্তানী হানাদাররা ইত্তেফাক, সংবাদ, গণবাংলা, দ্য পিপল প্রভৃতির অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমের পজিটিভ-নেগেটিভ ভূমিকাও এক ধরনের ভাষা যা মানুষের পড়তে অসুবিধে হয় না।
৭. কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সংগ্রামটাই মুখ্য। একে ঘিরে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা গুজব গৌণ ব্যাপার।
কেউ কেউ গৌণকে মুখ্য প্রচারণা দিয়ে আন্দোলনের সম্মানহানির চেষ্টা করেছেন যা অনৈতিক।
ভিসির বাড়িতে আক্রমণের নিন্দনীয় ঘটনাটির মূলে তিনটি কারণ অনুমেয় : ক. ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহের সরকারী অন্তর্ঘাত খ. বিরোধী দলের ফায়দা নেওয়ার অপচেষ্টা গ. সব আন্দোলনে কিছু হঠকারী লোক থাকে, এটা তাদেরই অপকর্ম ।
কারণ যাই হোক, এগুলি হচ্ছে আন্দোলনের কো-লেটারেল ড্যামেজ বা সিস্টেম লস। এসব বাই প্রোডাক্ট ব্যাসিক হওয়া উচিত নয়।
তা ছাড়া, ভিসির বাড়ি আক্রমণের উর্ধে থাকেনি । অতীতে বহুবার ভিসির বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এককালের ভিসি খাজা শাহাবুদ্দিনের বাড়ি ক্ষুব্ধ জনতার হাতে অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল একসময়।
আবার, জাতির ক্রান্তিকালে সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন আরেক ভিসি আবু সাঈদ চৌধুরী।
উল্লিখিত সাতটি স্ট্যাটাস ছিল সংগ্রামীদের পাশে থাকতে আমার কাগুজে কসরত। একই সঙ্গে আমি মনে করি, এগুলি মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তর-পুরুষদের সম্মান জানানোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। নতুন প্রজন্ম আরো গর্বিত ও উদ্ভাসিত হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরামহীনভাবে সম্মান দিয়ে গেলে রাজাকার-আলবদরদের আধিপত্য আরো কমে আসবে, ক্রমশ আরো ¤্রয়িমান হতে থাকবে তারা; এক সময় আর মাথা উঁচু করে কথাই বলতে পারবে না।
ওকলাহোমা, ২ এপ্রিল, ২০১৮।
আহমেদ মূসা লেখক-সাংবাদিক : সাপ্তাহিক বর্ণমালার উপদেষ্টা সম্পাদক।
email : ahmed.musa.57@gmail.com
website Address: https://sites.google.com/view/sreejonkal
Related links:
https://www.amadershomoy.com/bn/2018/04/15/516372.htm#.WtODkBZ75jA.email
আহমেদ মূসা : মনীষী আহমদ ছফা আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের উত্তাপ থেকে জন্ম নেওয়া দল বলে উল্লেখ করেছিলেন । বঙ্গবন্ধুর ‘সেন্স অব টাইমিং’ ড. কামাল হোসেনকে প্রধানভাবে আকর্ষণ করেছিল বলে জানিয়ে ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার-আন্দোলনে-সৃষ্ট রাজপথের ভাষা পাঠ করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন; দৃশ্যত ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তার কন্ঠের ক্ষোভ-অভিমান তিনি লুকোবার চেষ্টাও করেননি। সবকিছু নিয়ে একগুঁয়েমি না করার কারণেই আওয়ামী লীগ বার বার ফিরে আসে। একই সঙ্গে অনেকের জন্য এমন ‘রামকুন্ডুলি’ সৃষ্টি করে, যে, তারা আওয়ামী লীগ না করলেও এডহক ভিত্তিতে বা পার্টটাইম সমর্থন দিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ যা করে তা অতি দক্ষতার সঙ্গে করে, এমন কি দমন-লুন্ঠনও।
আমি কোটা সংস্কারের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়ায় কেউ কেউ বিস্মিত হয়েছেন। আমার অবস্থান আমি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করিনি বলে বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় এই ব্যাখ্যার চেষ্টা।
কোটা সংস্কারের নির্দলীয় আন্দোলন নিয়ে আলোচনার সময় অনেকে সরাসরি আন্দোলনের পক্ষে কথা বলেছেন। কেউ কেউ ক্ষীণ ধারায় হলেও বিরোধিতা করেছেন। কোনো কোনো ব্যক্তি আবার আন্দোলনকারী ও তাদের সমর্থকদের ‘রাজাকার’ বলে গালি দিয়ে ‘দেখে নেওয়া’র আষ্ফালন করেছেন। বর্তমানে দরে-বায়ে না বনলে ‘রাজাকার’ ও ‘নাস্তিক’ গালিদ্বয় দৈনন্দিন-বর্ষণে পরিণত হয়। রাজনৈতিক ব্যবসা শুধু ধর্ম নিয়েই নয়, কিছু ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও চলে। কারণ, এই দু’টির তেজারতিতেই তরক্কী প্রচুর। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের লাভতো ষোলো আনা।
লেখক-সাংবাদি-রাজনীতিক-আমলা প্রভৃতির সংমিশ্রনে সম্প্রতি-সৃষ্ট ‘সুশীলদের’ অনেককেও নিরব থাকতে দেখা গেল। কেউ আবার কচ্ছপের মতো মাঝে মাঝে গলা বাড়িয়ে হাল-হকিকত দেখে আবার গুটিয়ে নিচ্ছেন। একদল আবার টিভি চ্যানেলে তাদের ‘মধ্যরাতের বাণী চিরন্তনী’তে এতো বেশি ধানাইপানাই করেন, যে কিছুই বোঝা যায় না। কিছু ব্যতিক্রমও আছেন, যারা আগাগোড়া সাহসের সঙ্গে কথা বলেছেন।
কেউ কেউ বলেন, বঙ্গবন্ধু কোটা করে যাওয়ায় এর পরিবর্তন বঙ্গবন্ধুর অপমান। কিন্তু তারা ভুলে যান যে, উপযোগিতা হারানো বা সমসাময়িক-কালের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে অনেক কিছুরই রদবদল ঘটাতে হয়েছে, এমন কি বাদ দিতে হয়েছে বাকশালও।
কোটা সংস্কার-বিরোধীদের সঙ্গে সমর্থকদের পার্থক্য আকাশ-পাতাল নয়। পার্থক্য দৃষ্টিভঙ্গির। কেউ কেউ মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য কোটা তুলে দেওয়া বা হ্রাস করা মানে তাদের অপমান করা। কথাটি ঠিক নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য বর্তমান হারের কোটা রাখাটাই মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান ও বিতর্কের দিকে ঠেলে দেওয়া এবং জনগণের মূলধারা থেকে ছিঁটকে ফেলার ঝুঁকি নেওয়া । বিশেষ করে এ-নিয়ে যখন কথা উঠে গেছে এবং আন্দোলন ব্যাপকতর হচ্ছে। এই অবস্থায় তাদের কোটা একটি কোটারি শ্রেণীর জন্ম দেবে, মুক্তিযোদ্ধার বংশধরেরা করুণা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হবেন। অনেকে প্রয়োজনীয় উদযোগ গ্রহণে বিরত থেকে একশ্রেণীর পরজীবীতে পরিণত হবেন। এসবের পরিণাম কারো জন্যই ভালো হবে না। আন্দোলনের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধাও বিব্রত বোধ করেছেন। ফেসবুকে মুক্তিযোদ্ধার এক সন্তানকে দেখলাম ‘কোটা চাই না’ বলে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে। সবচেয়ে বড় কথা, মুষ্টিমেয় ও চিহ্নিত রাজাকার-আলবদর-আলশামস প্রভৃতি বিশ্বাসঘাতক ছাড়া দেশের সব মানুষই স্বাধীনতার জন্য নানাভাবে যুদ্ধ করেছেন, যার যার অবস্থানে থেকে। জান-মাল-সম্ভ্রম হারানো মানুষের সংখ্যা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়েছিলেন দেশের সবচেয়ে সাহসী ও অংগীকারবদ্ধরা। তারা যুদ্ধে গেছেন নিজের বা আপন পরিবারের কল্যাণের জন্য নয়, দেশের মুক্তির জন্য। কেউ সরাসরি রণাঙ্গনে ছিলেন, কেউ ভারতসহ অন্যান্য দেশে থেকে কাজ করেছেন। হাজার-হাজার মানুষ যুদ্ধ করতে গিয়েও বয়সের স্বল্পতা বা রোগের জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ পাননি। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ-সুযোগের স্বল্পতার কারণে অনেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি। তারা ইয়ুথ ক্যাম্প থেকেই ফেরত এসেছেন। যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে অনেককেই শুধুমাত্র কয়েকটি গ্রেনেড বা বেয়োনেট ধরিয়ে দিয়ে দেশের ভেতরে পাঠানো হয়েছে। অবশ্য এখানে যুদ্ধ করতে যাওয়াটাই মুখ্য, যুদ্ধ করার সুযোগ পেল কি পেল না সেটা মুখ্য নয়।
বহু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ইচ্ছে করেই সার্টিফিকেট নেননি। কেউ কেউ আবার বিশেষ রাজনৈতিক প্ররোচনায় সার্টিফিকেট পেয়েও ছিঁড়ে ফেলেছেন। হাজার-হাজার মানুষ দেশের ভেতরে থেকেই যুদ্ধ করেছেন বিভিন্ন বাহিনীর হয়ে, যেমন নরসিংদিতে আবদুল মান্নান ভুঁইয়া, মানিকগঞ্জে আবদুল হালিম চৌধুরি, বরিশালে সিরাজ সিকদার ও হেমায়েত বাহিনী প্রভৃতিতে যোগ দিয়ে। তাদের অনেকেই সার্টিফিকেট পাননি বা নেননি। অন্যদিকে বিলি করা হয়েছে হাজার হাজার ভুয়া সনদ। প্রতিদিনই এরা ধরা পড়ছে, কিন্তু এখনো অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বিরাজমান রয়েছে।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনের আরেকটা সুফল হচ্ছে, এখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনাক্তকরণের কাজ প্রাধান্য পাচ্ছে। আগের সরকারগুলি এ-নিয়ে আন্তরিক ছিল না। ১৯৮০-৮১ সালে একবার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিতর্কিতদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ভুয়াদের সনদ বাতিলের উদযোগ নিয়েছিল। আমি তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বক্তৃতা-বিবৃতি লেখার কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে কিছু কৌতুকর ঘটনা দেখেছি। প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলতে পারতো না কোন অস্ত্রে কয়টা গুলি থাকে, গ্রেনেড কীভাবে ছোড়ে কিংবা তার সেক্টর ও সাব-সেক্টর কমান্ডারের নাম। কারো কারো আমতা আমতা করার দশা দেখে বোঝা যেত যুদ্ধের সে কিছুই জানে না, মুখস্ত করে আসা উত্তর গুলিয়ে ফেলছে। সাক্ষাৎকারের বর্ণণা শুনে অনেক ভুয়া সাক্ষাৎকার না দিয়েই পালিয়ে গেছে। এখনও ভুয়াদের তালিকায় আমরা উচ্চপদস্ত আমলা ও পুলিশের সদস্যসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষই দেখতে পাচ্ছি। তাদের অপরাধ ভয়ঙ্কর অপরাধ। সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনাক্তকরণের জন্য একটি ঝড়ো ও আখেরি ছাক্নি প্রয়োজন।
এখন আসলে দরকার বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুযোগ-সহায়তা-সম্মান আরো বাড়ানো। মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু আর্থিক অনুদানই নয়,তাদের আনুষ্ঠানিক দাওয়াত দিয়ে মেহমান হবার সম্মান দিতে হবে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলিতে। প্রতি বছর প্রধানমন্ত্রী প্রতিজন মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক দু’টি করে বই উপহার দিতে পারেন। সরকারী বাস, ট্রেন, স্টিমারে তাদের বিন ভাড়ায় যাতায়াতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পৃথিবীতে এমন কিছু দেশ আছে যেখানে মুক্তি-সংগ্রামীরা রাস্তাদিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষ আর কিছু করতে না পারলেও ফুল ছুড়ে দেন তাদের দিকে, সম্মান জানাতে। সম্মান অন্তরের বিষয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সবাইকে একটি করে বিশেষ চাকতি বা মেডেল দেওয়া যেতে পারে যা প্রদর্শন করা হলে সব ক্ষেত্রেই বিশেষ সুবিধা ও সম্মান পাবেন। তাতে অনেক বেসরকারী সংস্থাও স্বত:স্ফূর্ত ভাবে সম্মান জানাতে এগিয়ে আসবে।
অনেকে আমেরিকার ভেটেরানদের উদাহরণ দেন। কিন্তু বাংলাদেশ আমেরিকা নয়। আমেরিকায় প্রায় দেড় কোটি কাগজপত্রবিহীন (‘অবৈধ’ শব্দটা এখানকার বিবেকবান শ্রেণী ব্যবহার করে না) অভিবাসী থাকা সত্ত্বেও তারা নানা ধরনের ভিসার ব্যবস্থা করে প্রতিনিয়ত লোক আনছেন আমেরিকায়। এখানে কাজ করার লোকের অভাব। আর বাংলাদেশে প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষিত বেকারসহ কর্মহীন মানুষের সংখ্যা চার কোটি বিরাশি লাখ। সেখানে ৫৬ শতাংশ কোটা অনেক বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের মধ্যে যারা মোটামুটি মানসম্মত জীবিকা থেকে পিছিয়ে থাকবেন বা চেষ্টার পরও চাকরি পাবেন না, তাদের কর্মসংস্থানের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্ট বা এ জাতীয় নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সে-সবের অধীনে গড়ে তোলা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে তাদের চাকরি দেওয়া যেতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানে একশ’ ভাগ তাদের দ্বারা পূরণ করলেও অযৌক্তিক হবে না বা কোনো প্রশ্ন উঠবে না। কল্যাণ ট্রাস্ট অতীতে তেমন দরকারী ভূমিকা রাখতে পারেনি দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে। কিন্তু এখন অবস্থা আগের মতো নয়। এখন বিশ্বমানের দক্ষ ব্যবস্থাপনাও বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। বহু মুক্তিযোদ্ধা অনেক বড় ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছেন, কেউ বা অবসর যাপন করছেন। নতুন-গড়া প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাদেরকে উপদেষ্টা বা শীর্ষ পদে রেখে সেসব প্রতিষ্ঠান চালানো যায়। ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কলসেন্টারসহ সেবাখাতের অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে দেশে, বাড়ছে সম্ভাবনা। জামায়াতের লোকেরা হাজার হাজার লাভজনক প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসার নজির আমরা দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধারা তা পারবেন না কেন?
মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লিখিত পর্যায়ের সন্তানদের জন্য ব্যবসার সুযোগও করে দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে ঋণেরও ব্যবস্থা করা যায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার বাইরেও যে-সব কোটা আছে, প্রতিবন্ধীদের কোটা ছাড়া বাকীগুলিও যৌক্তিক হারে হ্রাস করা যায়। সবকিছুকে সমকালের পরিপ্রেক্ষিত দিয়েই বিচার করতে হবে।
দুই
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পক্ষাবলম্বনকারী ভারতের প্রায় তিন হাজার সেনা নিহত ও নিখোঁজ হয়েছেন, আহত হয়েছেন বার হাজার। তাদের স্মরণেও কিছু করণীয় রয়েছে।
ক. শহীদ ভারতীয় বীরদের জন্মদিনে তাদের পরিবারের কাছে অন্তত কিছু ফুল ও উপহার পৌঁছে দিতে পারে ভারতে আমাদের দূতাবাস ও কনসুলেটগুলি। আহতদের পরিবারেও সম্মানসূচক কিছু পাঠানো যায়।
খ. ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর দূতাবাস-কনসুলেটে যৌথভাবে সব ভারতীয় শহীদদের জন্য স্মরণসভা করা যেতে পারে। আলোচনায় অংশ নিতে পারেন দুই দেশেরই বুদ্ধিজীবীগণ ।
গ. মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর শহীদদের স্মরণে দুই দেশের সীমান্তের সুবিধাজনক জায়গার নো-ম্যানসল্যান্ডে যৌথ শহীদ মিনার গড়া যেতে পারে, যেখানে দুই দেশের মানুষই কাছে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।
তিন
এবার আমি তুলে ধরছি গত ৯ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ফেসবুকে দেওয়া আমার ৭টি স্ট্যাটাসের বক্তব্য।
১. কোটা সংস্কারের ন্যায্য আন্দোলন অবশ্যই সফল হবে। প্রচলতি কোটা সিস্টেম মুিক্তযোদ্ধাদের জন্যও বিব্রতকর, কারণ তারাও ক্রমশ জনবচ্ছিন্নি হয়ে পড়বেন । অবশ্য ভুয়াদের জন্য স্বাগতকি। এ আন্দোলন সরকারের নড়বড়ে গদি ধরে টান দিতে পারে।
২. আজ-কালকার পলটিশিয়ানরা সব-সময় চালাকির মধ্যে থাকেন। তবে, ছাত্র-ছাত্রীদরে সঙ্গে চালাকি করলে খবর আছে। কারণ, ওরা সব চালাকি-ভন্ডামির মূল উৎপাটনের কায়দা জানে ও ক্ষমতা রাখে।
৩. একটি জাতির জীবনে কোনো কিছুই রাতারাতি ঘটে না । সব ধরনের সরকার এবং দলেরই দু’টি একাউন্ট থাকে – ভালো ও মন্দ জমা হওয়ার জন্য। মন্দ জমতে-জমতে পাল্লা ভারি হয়ে গেেল পতন ঘটে সরকারের। অবশ্য মানুষরে সামনে আস্থাভাজন বিকল্পও থাকা চাই। এটা আমার অভজ্ঞিতা ও পর্যবক্ষেণজাত উপলব্ধি।
৪. আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে তরুণদের মধ্যে যে স্থানটা করে নিয়েছিল, কোটা সংস্কারের নির্দলীয় আন্দোলনের বিরুদ্ধে দমনে গেলে তার অনেকটাই হারাবে। কারণ, প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষিত বেকারসহ সব ধরনের ৪ কোটি ৮২ লাখ কর্মহীন মানুষের দেশে ৫৬ ভাগ কোটার মহার্ঘ বিলাসতিা মানুষ বেশিদিন সহ্য করবে না । এই আন্দোলন ঘরে-ঘরের আন্দোলন। এমন কি ছাত্রলীগের অল্প-ব্যতক্রিম ছাড়া সবাই আন্দোলনে ছিল এবং ভবষ্যিতেও থাকবে – যদি আওয়ামী লীগ রাজপথের ভাষা পড়তে ভুলে গিয়ে থাকে। সব ধরনরে কোটা মলিেিয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন নয়।
৫. কোটা সংস্কারের নির্দলীয় আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগের কতপিয় এবং দলকানা কিছু শিক্ষক যে ঘৃণ্য ভূমিকা রাখছে ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না। ন্যায্য-আন্দোলন এবং দমন-বিশ্বাসঘাতকতা পাশাপাশি চললেও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনই জয়ী হয়। ঝড়ো হাওয়ায় সাময়িকভাবে আলো কমে আসলেও প্রদীপ নিভে যায়নি, নিভবে না । এই জুলুমের জন্য আওয়ামী লীগকে মাসুল দিতে হবে। একই সঙ্গে ভবষ্যিত ঘটনা-প্রবাহে কিছু নতুন মাত্রা যোগ হবে। যেমন, এতকাল দেখে আসছি, ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা হারানো দলের ছাত্র সংগঠনের বীর পুঙ্গবরা সব হল থেকে একযোগে লক্ষণ সেনের মতো পলায়ন করে এবং নতুন ক্ষমতাসীন দলের বীর পুঙ্গবরা সেসব দখল করে। হলে সিটের জন্য দলে যোগ দেওয়ারা সঙ্গে সঙ্গে দল পরিবর্তন করে। পরিবর্তন করে সুবিধাবাদীরাও। এখন থেকে হয়তো কিছু দলকানা শিক্ষককেও পালতে হবে; নানা রং-বর্ণের কিছু সুশীল ধাওয়ার শিকার হবে।
৬. অনুপস্থিত ভোটারের ভোটে ‘নির্বাচিত’ সরকারের সব-বক্তব্যের সঙ্গে মূলধারার অধিকাংশ মিডিয়ার কন্ঠমেলানো একটি দেশের জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
কোটা সংস্কারে আন্দোলনরতরা সাংবাদিকদের ওপর ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভের কারণ খুঁজতে সাংবাদিকদেরও আয়নার সামনে দাঁড়ানো উচিত।
বাংলাদেশের মানুষ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য যেমন সংগ্রাম করেছে, তেমনি গণ-বিরোধী ভূমিকার জন্য ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় দৈনিক বাংলা, মর্নিং নিউজ প্রভৃতি পত্রিকার অফিসে আগুনও দিয়েছে। বোমা মেরেছে দৈনিক সংগ্রামে।
আবার জনগণের পক্ষে থাকায় পাকিস্তানী হানাদাররা ইত্তেফাক, সংবাদ, গণবাংলা, দ্য পিপল প্রভৃতির অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমের পজিটিভ-নেগেটিভ ভূমিকাও এক ধরনের ভাষা যা মানুষের পড়তে অসুবিধে হয় না।
৭. কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সংগ্রামটাই মুখ্য। একে ঘিরে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা গুজব গৌণ ব্যাপার।
কেউ কেউ গৌণকে মুখ্য প্রচারণা দিয়ে আন্দোলনের সম্মানহানির চেষ্টা করেছেন যা অনৈতিক।
ভিসির বাড়িতে আক্রমণের নিন্দনীয় ঘটনাটির মূলে তিনটি কারণ অনুমেয় : ক. ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহের সরকারী অন্তর্ঘাত খ. বিরোধী দলের ফায়দা নেওয়ার অপচেষ্টা গ. সব আন্দোলনে কিছু হঠকারী লোক থাকে, এটা তাদেরই অপকর্ম ।
কারণ যাই হোক, এগুলি হচ্ছে আন্দোলনের কো-লেটারেল ড্যামেজ বা সিস্টেম লস। এসব বাই প্রোডাক্ট ব্যাসিক হওয়া উচিত নয়।
তা ছাড়া, ভিসির বাড়ি আক্রমণের উর্ধে থাকেনি । অতীতে বহুবার ভিসির বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এককালের ভিসি খাজা শাহাবুদ্দিনের বাড়ি ক্ষুব্ধ জনতার হাতে অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল একসময়।
আবার, জাতির ক্রান্তিকালে সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন আরেক ভিসি আবু সাঈদ চৌধুরী।
উল্লিখিত সাতটি স্ট্যাটাস ছিল সংগ্রামীদের পাশে থাকতে আমার কাগুজে কসরত। একই সঙ্গে আমি মনে করি, এগুলি মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তর-পুরুষদের সম্মান জানানোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। নতুন প্রজন্ম আরো গর্বিত ও উদ্ভাসিত হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরামহীনভাবে সম্মান দিয়ে গেলে রাজাকার-আলবদরদের আধিপত্য আরো কমে আসবে, ক্রমশ আরো ¤্রয়িমান হতে থাকবে তারা; এক সময় আর মাথা উঁচু করে কথাই বলতে পারবে না।
ওকলাহোমা, ২ এপ্রিল, ২০১৮।
আহমেদ মূসা লেখক-সাংবাদিক : সাপ্তাহিক বর্ণমালার উপদেষ্টা সম্পাদক।
email : ahmed.musa.57@gmail.com
website Address:
https://sites.google.com/view/sreejonkal
আহমেদ মূসা :
মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমার প্রিয় লেখক। দেশ-জগৎ ও মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা আমাকে আনন্দিত ও অনুপ্রাণিত করে। এমন কি তার বিরুদ্ধে ফেসবুক-এ মন্তব্য করায় কয়েকজনকে আমি আনফ্রেন্ড করেছি, কারো-কারো সঙ্গে নিরাপদ দুরত্ব রচনা করেছি। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে তার দুটি লেখা পড়ে মর্মাহত হলাম। লেখাতে তিনি কয়েকটি ভুল মন্তব্য করেছেন শুধু নয়, তার এ-সব মন্তব্যে কোটা সংস্কারের নির্দলীয় আন্দোলনরত লাখ-লাখ শিক্ষার্থীর প্রতি ঘোরতর অন্যায়, তাদেরকে বিপথগামী ও বিপদগ্রস্ত করার প্ররোচনা, সর্বোপরি আইডিয়ার সুখ-কল্পিত দম্ভ পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে আমার মনে হয়, সামাজিক মাধ্যমে সময় নষ্ট করেন না বা পাঠকের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আগ্রহ তার নেই বলে তিনি যে সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, সেই বাস্তবতাই দায়ী। তার ঊচিত ছিল চূড়ান্ত মন্তব্যের আগে অন্তত আন্দোলনকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলা।
যাহোক, পরিসর সংক্ষিপ্ত রাখার জন্য তার কয়েকটি মন্তব্যের প্রতিবাদ করে বলতে চাই, ক. এই আন্দোলন কিছু শিক্ষার্থীর চাকরি পাওয়ার আন্দোলন নয়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এটি ঘরে-ঘরের আন্দোলন। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানেরাও কোটার বর্তমান হারের বিরুদ্ধে। অতীতে আমরা দেখেছি, বিপ্লব যাদের প্রয়োজন ছিলো না তেমন বহু কোটিপতির সন্তান, অসাধারণ মেধাবীরাও বিপ্লব করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন। খ. কোটা সংস্কার হলেই মুক্তিযোদ্ধারা অপমানিত হবেন না, বরং পরিস্থিতি যে জায়গায় এসেছে, কোটা বর্তমান হারে বহাল থাকলেই মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকবেন, তাদের বংশধরগণ করুণা ও বিদ্রুপের পাত্রে পরিণত হয়ে কোটারি-গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হবেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনই বিব্রত বোধ করছেন। গ. কোটার মতোই যে কাজটি করা হয়েছিল, সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক বছরের সিনিয়রিটি প্রদান; সেটির পরিণতিও কিন্তু ভালো হয়নি। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধা বনাম রিপেট্রিয়টদের দ্বন্দ্বের জের ধরে জিয়াউর রহমান ও জেনারেল মঞ্জুরসহ বহু মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন, ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে ২২ জনকে যার ২১ জনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সেসব ঘটনার জের ধরেই এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক শাসন জারি করে মুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল রিপেট্রিয়টরা। ঘ. মুক্তিযোদ্ধারা কোটা-সিনিয়রিটির জন্য যুদ্ধ করেননি, যুদ্ধ করেছেন দেশ-মাতৃকার মুক্তির জন্য। কিছু চিহ্নিত বেঈমান ছাড়া গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তারপরও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জাতি যথাসাধ্য করে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে তাদের পরবর্তী বংশদরদের কোটা নিয়ে। ঙ. যে আলোকচিত্রটির কথা তিনিসহ অনেকেই বারবার উল্লেখ করেন সেটি রাজাকারিত্বকে গৌরব দেওয়ার জন্য নয়, মতিয়া চৌধুরীসহ অনেকেই আন্দলোনরত লাখ-লাখ শিক্ষার্থীকে নির্বিচারে রাজাকার বলে গালি দেওয়ার প্রতিবাদ বা কৌতুক হিসাবে। তবুও, এ ধরনেই ঘৃণ্য শব্দকে কোনোভাবেই টানা উচিত নয়। বয়স কম বলে শিক্ষার্থীটি বুঝতে পারেনি। বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাস্তায় হাজার-হাজার শিক্ষার্থীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রাজাকারিত্বকে এভাবে সত্যি-সত্যি গৌরবান্বিত করার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি কখনোই আসবে না, আজকের এই তারুণ্যই সে প্রয়াস প্রথম রুখবে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল অজ্ঞতা থেকেই ভুল সিদ্ধান্ত তুলে ধরেছেন লেখাতে । একজন মানুষের পক্ষে সবকিছু জানা সম্ভব নয়। অনেক বিষয়েই অজ্ঞতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু একজনের অজ্ঞতার শরিকানা যখন লাখ-লাখ মানুষের মধ্যে বন্টনের কারণে বিপর্যয় ডেকে আনে তখন বড় দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৩ সালে শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কেচ্ছা রচনা করায় হাসনাত আব্দুল হাইয়ের মতো লেখক ডাস্টবিনে চলে গেছেন। মুহম্মদ জাফর ইকবালের সেই পরিণতি হোক অন্তত আমি সেটা চাই না।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাছে অনুরোধ, গোটা বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে লিখুন। ছেলেমেয়েগুলোর সংগে কথা বলুন। দু’টি অনলাইন পত্রিকা ও আমার ওয়েবসাইট বা ফেসবুক ওয়ালে ‘কোটা সংস্কার মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক?’ শিরোনামের লেখাটিও কিছুটা ধারণা দিতে পারে।
আহমেদ মূসা : যুক্তরাষ্ট্র, ১০ এপ্রিল ২০১৮।
Email- Ahmed.musa.57@gmail.com
Web- https://sites.google.com/view/sreejonkal
প্রকাশের সময় : মে ২৭, ২০১৮, ২:১৬ পূর্বাহ্ণ
আপডেট সময় : মে ২৮, ২০১৮ at ২:৫৬ পূর্বাহ্ণ
আহমেদ মূসা : কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০১৩ সালে একবার শুরু হয়েও থেমে গিয়েছিল নির্বাচনের কারণে। চলতি-পর্বে আন্দোলন শুরু হয় মধ্য-ফেব্রুয়ারি থেকে। আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডাদের যৌথ জুলুমের কারণে আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করলে ১১ মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে সংস্কারের পরিবর্তে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। সংস্কারের স্থলে বাতিলের ঘোষণা খাপছাড়া হলেও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আস্থা রেখে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের রাশ টানেন। তারা তাদের আন্দোলনকে কোটা সংস্কারের আন্দোলন হিসেবেই অভিহিত করতে থাকেন।
অন্যদিকে কিছু প্রচারমাধ্যম ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু লোক একে ‘কোটা বিরোধী আন্দোলন’ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টায় লিপ্ত হন। বিভ্রান্তির চেষ্টাটা শুরু হয় এখান থেকেই। প্রধানমন্ত্রী ‘বাতিল’ শব্দটি বলেছেন নিজ দায়িত্বে-সিদ্ধান্তে; আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বাতিল শব্দের কোনো সংযোগ নেই। ঘোষণার পর সংস্কার বা বাতিলের দায় এসে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ে। আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন সাপেক্ষে প্রজ্ঞাপন দাবি করতে থাকেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরপরই মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘কোটা বিরোধী’ আন্দোলনকারীরা “রাজাকারের বাচ্চা।”
এইচ টি ইমাম বলেন, ‘কোটা বিরোধী’ আন্দোলনের নেতারা “ছাত্র শিবির।” খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কোটা বিরোধী’ আন্দোলনকারীরা “পাকিস্তানীদের দোসর।” কতিপয় ‘সুশীল-দলান্ধ’ও তাদের সঙ্গে কন্ঠ মেলান। আন্দোলনকারীদের ‘ছবি তুলে রাখা হয়েছে’ বলে ভয় দেখানোর চেষ্টাও করা হয়।
এসব ঘটনায় সঙ্গতভাবেই সন্দেহ সৃষ্টি হয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরও তার আশপাশের লোকেরা আন্দোলনরত ছেলেমেয়েগুলোকে রাজাকার, রাজাকারদের ছেলেমেয়ে, শিবির ইত্যাদি বলে বিরামহীন প্রচারণা চালাতে থাকায় লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম গালি হচ্ছে রাজাকার গালি। এই গালি কোনো দেশপ্রেমিকে দেওয়া হলে আঘাতটা কোথায় গিয়ে লাগে তারা সেটা মোটেও ভেবে দেখেননি? এই উষ্কানী বন্ধের চেষ্টা কেউ করলেন না। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একবার শিক্ষার্থীদেরকে প্রধানমন্ত্রীর ওপর ধৈর্যের সঙ্গে আস্থা রাখার আহবান জানালেন। তিনি এবং আরো কতিপয় ধৈর্যের আহবান জানালেন অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে। কিন্তু যে-বয়সে মানুষ চোখে একটু কম দেখেন এবং কানে কিঞ্চিত কম শোনেন, সেই বৃদ্ধদের ধৈর্য ধরতে বলার গরজ কেউ অনুভব করলেন না।
এসবের পাশাপাশি চলল নেতাদের চোখ বেঁধে তুলে নেওয়া, মারধর, চরিত্র হনন, ভীতি প্রদর্শন প্রভৃতি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ এর যুগ্ম-আহ্বায়ক নুরুল হক নূরু এবং যুগ্ম-আহ্বায়ক রাশেদ খানকে ১৫ মে পিস্তল নিয়ে এসে হত্যার হুমকি দেন ছাত্রলীগ নেতারা। রাত দেড়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে ১১৯ নম্বর রুমে এই ঘটনা ঘটে। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। কুমিল্লাতে ঘটে ব্যাপক সংঘর্ষ। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, কুমিল্লাা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বহনকারী বাসে অতর্কিত হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় নগরের পুলিশ লাইনস এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের কর্মীরা মারধর করেন। ওই শিক্ষার্থী হল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এ ছাড়া আরও কয়েকটি স্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। পরিশেষে আন্দোলনের অন্যতম নেতা এ পি এম সুহেলকে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা প্রচন্ডভাবে মারধর করেন। তিনি এখন হাসপাতালে। তার চরিত্র হননের জন্যও লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে একদলকে। আন্দোলনকারীদের ফেসবুক গ্রুপে সদস্য সংখ্যা তেইশ লাখ ছাড়াবার পর সেটি হ্যাক করা হয়। ওরা আরেকটি গ্রুপ খোলার পর সেটিরও পেছনে লাগে। অনেকের পোস্টের মন্তব্যেও ঘরে কুৎসিত মন্তব্য এবং নোংরা ছবি দিতেও রুচিতে বাধেনি আন্দোলন-বিরোধীদের। এসবের পাশাপাশি আবার ওবায়দুল কাদের ও জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ সরকারী কর্মকর্তরাও আলোচনা করেন নেতাদের সাথে। ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থীদের বের হতে বাধা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সরকার কালক্ষেপণের কৌশল নিয়ে কোটা আন্দোলন বন্ধ করতে চায়। রোজা শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে। তখন ক্যাম্পাসে আন্দোলন করার কেউ থাকবেন না।
সরকারের কিছু লোক আন্দোলনকারীদের রাজাকার-শিবির প্রভৃতি বললেও বাস্তব ঘটনা ভিন্ন। এটা একেবারেই দল নিরপেক্ষ অথবা সর্বলীয় আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের মধ্যে মাঠ-পর্যায়ের অনেক ছাত্রলীগ ও বাম-ঘরানার নেতাকর্মীও আছেন। প্রথম সারির কয়েকজন নেতাও ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত। এ ব্যাপারে আন্দোলনের অন্যতম নেতারা একুশে টেলিভিশন ও দৈনিক মানবজমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকরে বিষয়টি তুলে ধরেন। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ- এর যুগ্ম-আহ্বায়ক নুরুল হক নূরু বলেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে প্রথম সারিতে থেকে আমরা যে চারজন নেতৃত্ব দিয়েছি- আমি, রাশেদ, ফারুক, মামুন। চারজনই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। মামুন আমাদের আহবায়ক। বর্তমানে মামুন মহসীন হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি। আমি মহসীন হল ছাত্রলীগের গত কমিটিতে মানব-সম্পদবিষয়ক উপ-সম্পাদক ছিলাম । ফারুক এস এম হলের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ছিল। রাশেদ রিদ্র পরিবারের সন্তান। সে কখনো সক্রিয় ভাবে রাজনীতি না করলেও, ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচীতে তাকে অংশ নিতে দেখা গেছে। এটা তো অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই, এখন হলে থাকতে হলে ছাত্রলীগ করেই থাকতে হয়।
শুধু ছাত্রলীগ নয়, বহু মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান পোষ্য-কোটা সংস্কারের পক্ষে। কারণ, তারা নিজেদের যোগ্যতা দিয়েই সমাজে স্থান করে নিয়েছেন। তা ছাড়া অনেকে বিব্রতও বোধ করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে আন্দোলন করায়। তাদের অনেকেরই অভিমত, মুক্তিযোদ্ধারা কোটা-সিনিয়রিটির জন্য যুদ্ধ করেননি, যুদ্ধ করেছেন দেশ-মাতৃকার মুক্তির জন্য। কিছু চিহ্নিত বেঈমান ছাড়া গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে তাদের পরবর্তী বংশধরদের কোটা নিয়ে। এই প্রশ্নবোধক চিহ্নের সঙ্গে ফয়সালা না করে রাষ্ট্রের পক্ষে আগানো কঠিন।
অনেকে আশঙ্কা করছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিতর্কিত, কোনঠাসা ও অসম্মান করার ধূর্ত উদ্দেশ্য কারো থাকতে পারে। এ জন্য মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারগুলিকে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চলছে। একটি জনপ্রিয় আন্দোলন থেকেও ওৎ পেতে থাকা অপশক্তি কী ভাবে ফায়দা নেয় তার নজিরও আমাদের নিকট-অতীতে রয়েছে। ১৯৮১ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্বে জামায়াত বিরোধী আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা বনাম পাকিস্তান প্রত্যাগতদের দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে এরশাদ কী করে ক্ষমতা খল করেন সবাই দেখেছেন। জিয়া ও মঞ্জুরসহ বহু উজ্জ্বল মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ গেছে। ফাঁসি দেওয়া হয়েছে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে। সেই রক্তের পথ বেয়ে এরশাদ পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের অতি ডানপন্থী অংশকে নিয়ে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশকে আরো পেছনের দিকে নিয়ে যান। এরশাদপন্থীরা একঢিলে অনেক পাখি শিকার করেন।
এখনো ঘটনাকে যদি মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পোষ্যদের সাথে সাধারণ মানুষকে মুখোমুখি করাবার দিকে নিয়ে যাওয়া হয় পরিণতি ভালো না হওয়ারই কথা। একাশির ঘটনা আমি দেখেছি আরো কাছে থেকে। আমি তখন সেই আন্দোলনের প্রধান নেতা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান কর্নেল নূর উজ্জামানের সম্পাদিত সাপ্তাহিক নয়া পদধ্বনির নির্বাহী সম্পাদক। নয়া পদধ্বনি ছিল বলতে গেলে সেই আন্দোলনের মুখপত্র। একই সঙ্গে শেষের দিকে আমি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতিগুলি লিখতাম, যা আগে লিখতেন শাহরিয়ার কবির । সেই সুবাদে কাছে থেকে দেখা। ঘটনাকে কেউ সেদিকে নিয়ে যায় কী না সে ব্যাপারেও সন্দেহ অমূলক নয়। তবে, আর কেউ না হলেও প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সচেতন বলেই পরিলক্ষিত হয়েছিল ১১ মে। তার পরের অবস্থান আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
কেউ কেউ বলছেন, কোটা কাগজে-পত্রে থাকলেও বাস্তবে নেই কিংবা এক/দুই পার্সেন্টের বেশি নেই। কিন্তু কোটাই যদি না থাকে তাহলে কাগজে-পত্রে রাখা হচ্ছে কেন ? যা নেই তা নিয়ে আন্দোলনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কেন।
প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষিত বেকারসহ সব ধরনের ৪ কোটি ৮২ লাখ কর্মহীন মানুষের দেশে ৫৬ ভাগ কোটা মহার্ঘ বিলাসিতা। এই আন্দোলন ঘরে-ঘরের আন্দোলন। এমন কি ছাত্রলীগের অল্প-ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই আন্দোলনে ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে – যদি আওয়ামী লীগ রাজপথের ভাষা পড়তে ভুলে গিয়ে থাকে। আমি আগেও লিখেছি যে, কোটা একেবারে তুলে দেওয়া যাবে না । সব ধরনের কোটা মিলিয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন নয়।
এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন দেশের কোটা পদ্ধতির উদাহরণ দিয়ে ড. সা’দত হোসেন বলেছেন, ভারত তো কোটাকে একটা সুন্দর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সেখানে কোটা আছে, তবে তা উপার্জনের ভিত্তিতে। উচ্চ আয়ের মানুষরা কোটা পায় না। এক্ষেত্রে তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকেও ছাড় দেয় না। একবার যে কোটার সুবিধা পাবে, সে আর কখনও কোটার সুবিধা পাবে না। অর্থাৎ বাবা যদি কোটা সুবিধা পায় তার সন্তানরা কোনো কোটা সুবিধা পাবে না। কেউ যদি কোটা দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়, তাহলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পাবে না। আর যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটায় ভর্তি হয়েছে, সে কখনও চাকরিতে কোটা সুবিধা পাবে না।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কেউ যদি ভেবে থাকেন নানা রকম কায়দা-নির্যাতন করে সমস্যাটি পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে, তাহলে তারা ভুল করবেন। আন্দোলনের ন্যায্যতা প্রবল। এ ধরনের ইস্যুর আন্দোলনের বিজয় নিশ্চিত। সংগ্রাম এবং মন-চক্রান্ত পাশাপাশি চললেও সংগ্রামী মানুষেরই বিজয় ঘটে। ষড়যন্ত্র ন্যায়ের সংগ্রামকে আরো বেগবান ও সৃজনশীল করে। চক্রান্ত প্রতিহত এবং এর মূলোৎপাটনের কায়া ও ক্ষমতা ছাত্র সমাজের করায়ত্বে অতীতে ছিল, এখন আছে, ভবিষতেও থাকবে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের অনেকগুলি প্রচারমাধ্যম প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার দিকে তাকিয়ে আছে। ন্যায্য আন্দোলনে প্রচার মাধ্যম বড় ভূমিকা রাখলেও কোনো কারণে ভূমিকা রাখতে না পারলে আন্দোলন ব্যর্থ হয় না। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় ক্ষুদ্র ব্যতিক্রম ছাড়া সবগুলি প্রভাবশালী দৈনিক ও সাপ্তাহিকের মালিককে মন্ত্রীত্ব, কূটনৈকিত চাকরি ও ব্যবসা দিয়ে এরশাদ পক্ষে রেখেছিলেন। ট্রাস্টের প্রভাবশালী পত্রিকাগুলিতো ছিলই। এমন কি কায়দা-কানুন করে হকার সমিতিকে দিয়ে বহুদিন সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ রাখার নজিরবিহিীন ঘটনা ঘটিয়েও গদি রক্ষা করতে পারেননি এরশাদ। গুটিকয়েক দৈনিক ও কয়েকটি সাপ্তাহিক এরশাদের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে ছিল।
ইরানে শাহ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সবগুলি প্রচারমাধ্যম শাহের করায়ত্বে ছিল। ফ্রান্সে থাকা আয়াতুল্লাহ খোমেনির মূল নেতৃত্বে শাহের পতন ঘটে। বড় ভূমিকা ছিল বামপন্থীদেরও। খোমেনি তার সমর্থকদের বলেছিলেন, প্রচারমাধ্যম নেইতো কী হয়েছে, আমাদের প্রতিটি কর্মীর মুখ হবে একেকটি মুখপত্র।
আর আজ? সবার হাতে কলম, সবার হাতে ক্যামেরা। জোরদার হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়া। বাংলাদেশের মূলধারার কিছু প্রচারমাধ্যমকে এটাও উপলব্ধি করতে হবে যে, পয়সা দিয়ে কেউ গোলামের বুলি কেনে না। যে প্রচারমাধ্যম মানুষের পাশে থাকে, ন্যায়ের পক্ষে তাকে, সেটিই লাভ করে গণমাধ্যমের সম্মান।
লেখক : সাংবাদিক-নাট্যকার ও সাপ্তাহিক বর্ণমালার উপদেষ্টা সম্পাদক
Ahmed.musa.57@gmail.com
Original Article URL: https://www.amadershomoy.com/bn/2018/05/27/556816.htm
আহমেদ মূসা :
।।এক।।
সামান্য স্ফূলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টির নজির ইতিহাসে রয়েছে । রয়েছে অল্প কিছু ব্যক্তি, ক্ষ্রদ্র সংগঠন কিংবা কোনো-কোনো গ্রন্থের নিষ্প্রাণ কিছু অক্ষরের মশাল হয়ে ওঠার অনেক উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের প্রকাশিত কয়েকটি গ্রন্থ নিকট-অতীতে সেই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯৮০-র দশকের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মূল নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রভাবিত মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ও জাসদ প্রভাবিত মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদসহ কিছু সংগঠনের প্রয়াসে গড়ে উঠেছিল যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতা-বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন।
জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু দল ও তাদের নেতারা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কোনো অনুতাপ প্রকাশ দূরে থাকুক, উল্টো তাদের সেই ভূমিকার জন্য তারা বহুবার দম্ভ করেছে, উস্কানী দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রথম গড়ে ওঠা আন্দোলন সে-সব দর্প-উষ্কানীরও ফসল।
১৯৮১ সালের ২৮ মার্চ জামায়াত নেতারা প্রথম সংবাদ সম্মেলনে দম্ভোক্তি করেন যে, ১৯৭১ সালে তারা কোনো ভুল করেননি এবং বাংলাদেশের কনসেপ্ট সঠিক ছিল না। গোলাম আযমও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে একই কথা বলেন। এই বক্তব্যের পর দেশে জামায়াত-শিবির-বিরোধী প্রচন্ড ক্ষোভ তৈরি হয়। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্বে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। কয়েকটি পত্রিকাও এগিয়ে আসে সোচ্চার ভূমিকা নিয়ে। দাবি ওঠে অবৈধ নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধেযুক্ত গোলাম আযমের বিচারের। কেউ কেউ দাবি তোলেন গোলাম আযমকে বহিষ্কারের ।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে গোলাম আযম পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতা ও পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছিলেন তা-ই শুধু নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিদেশে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে চেয়েছেন। এসব কারণে বাংলাদেশে তার নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়।
১৯৭৮ সালে গোলাম আযম পাকিস্তানি নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে এ দেশে আসেন অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে। তার ৬ মাসের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি আর পাকিস্তানে ফিরে যাননি। এ দেশে থেকে যান এবং একাত্তরে তাদের অবস্থানই সঠিক ছিল বলে প্রচারণা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেন অন্যদের। জামায়াত নেতাদের দম্ভোক্তির পর যুদ্ধাপরাধের বিচার ও গোলাম আযমের বহিষ্কারের দাবি জোরদার হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আন্দোলনের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আন্দোলনে এগিয়ে আসে। এ ব্যাপারে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। তারা পরপর কয়েকটি প্রচ্ছদ কাহিনী করে জনগণকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ হতে সাহায্য করে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। সারাদেশে তারা জামায়াত-শিবিরের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রতিরোধের ডাক দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে তখন কয়েকটি সফল হরতালও পালিত হয়। আন্দোলনে শাহরিয়ার কবির, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও সাদেক আহমদ খানসহ অনেকেই পালন করেন সাহসী ভূমিকা। আন্দোলনের মুখপত্র ছিল সাপ্তাহিক নয়া পদধ্বনি। কর্ণেল জামান সম্পাদক। আমি তাতে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর আন্দোলনের সঙ্গে আরো ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে পড়ি। পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বিবৃতি-স্মারকলিপি প্রভৃতি লেখার দায়িত্ব এসে পড়ে। ১২ জন মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি হবার পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করলে তিন সংগঠনের বিবৃতি লেখার ভারও আমার ওপর এসে পড়েছিল।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড ও এরশাদের ক্ষমতা দখলের কারণে আন্দোলনে সাময়িক বিরতি ঘটে। আন্দোলনের পুরোধা-নেতাদের এরশাদ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে বের করে দিয়ে একটি পকেট সংগঠন করেন। এরা এরশাদের তল্পীবাহক হয়ে কাজ করেছেন। এরশাদ একই সাথে প্রকাশ্যে এবং গোপনে আন্দোলনের পিছনে ছুরিকাঘাত করেন। তিনি ক্ষমতা দখল করেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী উল্লিখিত তিন সংগঠনের দুই নেতা কর্ণেল নূর উজ্জামান ও কর্ণেল শওকত আলীকে গ্রেফতার করেন, মেজর জিয়াউদ্দিন সুন্দরবনে পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পান। পাশাপাশি নঈম জাহাঙ্গীরসহ আরো অনেককে গ্রেফতার করা হয় ।
রাজনীতি ও সাংগঠনিক কার্যক্রম তখন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কর্নেল জামান জেল থেকে বের হয়ে আসার পর চিন্তা শুরু হয় কি ভাবে নতুন করে কাজ শুরু করা যায়। উল্লিখিত আন্দোলনে যাদের দলীয় পরিচয় প্রবল ছিল, তাদের ছাড়া পরবর্তীকালে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র। এতে আরো যোগ দেন ড. আহমদ শরীফ, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিনোদ দাশগুপ্ত, ড. সাঈদ উর রহমানসহ লেখক শিবির থেকে চলে আসা আরো অনেকে। জেনারেল ওসমানীকে সমর্থন করা ও না করা নিয়ে লেখক শিবিরে মতপার্থক্য তৈরীর প্রেক্ষাপটে এই নিরব বিভক্তি ঘটে, যদিও দ্বিখন্ডিত হয়নি। লেখক শিবিরে রয়ে যান বদরুদ্দীন উমর, আনু মুহাম্মদ, আবরার চৌধুরী প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র থেকেই প্রকাশিত হয় আকরগ্রন্থ ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’সহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই, যে-গুলির প্রধান প্রতিপাদ্য ও লক্ষ্য ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং একাত্তরের গণহত্যাকে দেশে-বিদেশে সম্যক গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা। তাই সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের কোনো বিজয় অর্জিত হলে ঘুরে-ফিরে আসে এই আকরগ্রন্থটির নাম। নাম চলে আসে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের। দুর্দিনে এই সংগঠন ও এর প্রকাশিত গ্রন্থগুলি সাহস ও আলোর মশাল হয়ে পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। এই সংগঠন আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থও প্রকাশ করে। এরশাদের সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু এড়িয়ে আন্দোলনের রেশ ধরে রাখার পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহের জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে কোটপিনও বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। র’নবী ও নিতুন কুন্ডের যৌথ সৃষ্টিকর্মের মূল কথা ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ বিচিত্রায় এ নিয়ে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিল। আদর্শিক ও আর্থিক উভয় ক্ষেত্রেই সফল হয়েছিল এই প্রয়াস। প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা ছিলেন বরেণ্য লেখক-বুদ্ধিজীবীরা। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে কর্ণেল জামান ও শাহরিয়ার কবির। আমাকে করা হয় প্রকাশনা সম্পাদক।
প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরও নানা জায়গায় দৌড়াদৌড়ির কাজগুলি আমাকে করতে হতো। অর্থাৎ, মস্তিষ্ক ও পা-যুগল সমানভাবে কাজ করেছে। ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃতভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে আছে। কারণ, আজকাল দেখতে পাচ্ছি, মাঝে-মাঝে নিজের ঢোল নিজে না পেটালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথাও তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। আজকাল আরো দেখতে পাচ্ছি, নিজের প্রবল অন্তর্মুখিতার কারণে সেই-সব ভূমিকার কথা অনেক ঘনিষ্ট বন্ধু বা কাছের জনেরও ভালোভাবে জানা নেই। সংশ্লিষ্ট সবাই নিজেকে তুলে ধরতে বা ঘটনা থেকে ফায়দা তুলতেই সদাব্যস্ত। অনেক বড়বড় মানুষেরও কিছু কিছু ক্ষুদ্রতার চেহারা কাছে না থাকলে দেখা যায় না।
১৯৮৭ সালে একুশের বইমেলায় ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ প্রকাশের পর লোকজন লাইন দিয়ে বই কিনতে থাকে। সে কারণে পরবর্তীতে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার ছাপা হলেও বাংলাটির চাহিদা ছিল আরো বেশি। তাই হাজার হাজার নকল বইয়ে বাজার ছেয়ে যায়।
আমাদেরকে এরশাদ ও জামায়াতীদের যুগপৎ রোষানল এড়িয়ে কাজ করতে হয়েছে। নকল সমস্যা ছাড়াও বই প্রথম প্রকাশের পর আরো কিছু ‘বিচিত্র’ সমস্যা দেখা দেয়। এরমধ্যে দু’টি হচ্ছে ঃ ক. একটি পত্রিকা আমাদের কাজের প্রশংসার পাশপাশি বইটিকে ‘উড়োচিঠি’ বলে পরিহাস করে। কারণ প্রথম সংস্করণে সম্পাদক, সংকলক বা লেখক হিসেবে কারো নামই ছিলো না। অভিযোগ যথার্থ ছিল। তাই দ্রুত দ্বিতীয় সংস্করণ করে আরো অনেক তথ্য দিয়ে এর আমুল পরিবর্তন আনা হয়। সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করা হয় ড. আহমদ শরীফ, কাজী নূর উজ্জামান ও শাহরিয়ার কবিরের নাম। দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় প্রথম সংস্করণ লেখার দায়িত্ব শফিক আহমদকে দেওয়া ও দ্বিতীয় সংস্করণের তথ্য সংগ্রাহক হিসেবে শফিক আহমদ ও আমার নাম উল্লেখ করা হয়। পরবর্তী সংস্করণগুলিতে আরো অনেক তথ্য সন্নিবেশিত হয়ে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে বইটি।
দ্বিতীয় অভিযোগটি ছিল আওয়ামী লীগের একজন মুক্তিযোদ্ধা নেতার। তিনি বলেন, গ্রন্থে ঘাতক-দালালদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগেরও কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। এই অভিযোগটিরও সারবত্তা আছে। সাধারণ ক্ষমা ও চিহ্নিত ঘাতক-দালালদের বিচারে গড়িমসির জন্য গ্রন্থে আওয়ামী লীগেরও ব্যাপক সমালোচনা করা হয়।
গণহত্যার ভয়াবহতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার জন্য ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল ‘জেনোসাইড সেভেন্টি ওয়ান ঃ এ্যান একাউন্ট অব কিলার্স এ্যান্ড কলাবরেটরস’ নামে। প্রায় ত্রিশ বছর আগে। এতে সম্পাদক হিসেবে আরো যোগ হয় ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নাম। অনুবাদ করেছিলেন ড. নিয়াজ জামান। সে কারণে ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। এটি ছাপা হয়েছিল আমার নিজের প্রেস বর্ণবিন্যাসে। কেউ একজনের করা বাংলাটির পিডিএফ কপি থাকলেও ইংরেজিটির ছিল না। অনেকেই দীর্ঘদিন থেকে আমাকে তাগাদা দিয়ে আসছিলেন। শেষ পর্যন্ত এবার ইংরেজিটিরও পিডিএফ দেওয়া গেল।
একদিন যে আওয়াজ কিছু লোকে তুলেছিলেন, সেই আওয়াজ অনেক আগেই পৌঁছে গেছে ঘরে-ঘরে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিও ছিল আগেরই প্রয়াস – মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের কার্যক্রমের সম্প্রসারণ। নির্মূল কমিটি প্রথমত গঠন করেন মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িতরা। পরে এটি আরো সম্প্রসারিত হয়। অন্তর্ভুক্ত হয় রাজনৈতিক দলও।
‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ গ্রন্থে ঘাতক-দালালদের তখন পর্যন্ত বিচার না হওয়ায় আওয়ামী লীগেরও কঠোর সমালোচনা ছিল। তবে ঐতিহাসিক এই সত্যকেও স্বীকার করতে হবে যে, বইটি যখন প্রকাশিত হয় তখন আওয়ামী লীগের নেতারাও বিপদগ্রস্ত এবং দল অগোছালো। ১৯৭৫ সালে দল ও নেতৃবৃন্দের ওপর দিয়ে যে রক্তাক্ত বিভীষিকা গেছে তার রেশ তখনো চলছিল।
অবশ্য দীর্ঘকাল পরে হলেও আকরগ্রন্থের সমালোচনার যথাযথ জবাব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা; ঘাতক-দালালদের বিচারে অনড় অবস্থান নিয়ে ও বাস্তবায়ন করে। শেখ হাসিনা ছাড়া এ বিচার সম্ভব ছিলো না, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও সম্ভব হতো না, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা না থাকলে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এটাই ছিল সবচেয়ে দরকারী ও কঠিনতম কাজ। একই সঙ্গে গণহত্যার ভয়াবহতাকে দেশে-বিদেশে সর্বব্যাপী করে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েও তিনি ব্যাপক ভূমিকা রেখে গেলেন। ইতিহাস শেখ হাসিনাকে এ কাজের জন্য অমর করে রাখবে সন্দেহ নেই।
আবার একথাও ঠিক, এই লক্ষ্য-প্রত্যয় ২০০৮ সালের নির্বাচনী ঘোষণায় থাকাতেই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা সহজতর হয়েছে এবং শেখ হাসিনা হয়েছেন শক্তিমান নেত্রী। চূড়ান্তভাবে সবগুলি প্রয়াসের ইতিবাচক ফল ভোগ করেছে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক ফসলও কম তোলেনি দলটি। নয়া প্রজন্মের আকাক্সক্ষার অনুবাদ শেখ হাসিনা ঠিকই করতে পেরেছিলেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারের কাছাকাছি সময়ে গুলশানে এক ইফতার পার্টিতে সাময়িকভাবে-বিভক্ত বিএনপির সংস্কারপন্থী অংশও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিল, যার কারণে জামায়াতীদেরও রোষানলে পড়তে হয়েছিল তাদের। অবশ্য পরে সংস্কারপন্থীদের আর আলাদা নির্বাচন করা হয়নি। মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন ছাড়া সবাই ফিরে গেছেন মূল দলে। কেউ কেউ স্বতন্ত্র নির্বাচন করে অকৃতকার্য হন। ফিরে যাওয়া সংস্কারপন্থীরাদেরও কেউ কেউ মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হোন, কেউ কেউ মনোনয়ন পেয়েও অকৃতকার্য হন।
আওয়ামী লীগ যেমন অন্যান্যের আন্দোলনের ফসল নিজের গোলায় তুলেছে, তেমনি ফসল তোলার কম-বেশি অবকাশ বিএনপিরও ছিল। কিন্তু তারা ফসল তুলবে কী; মুক্তিযুদ্ধের ময়দানটাই ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগকে, যে ময়দানে দাঁড়িয়েই বিএনপির সংগ্রাম করার কথা আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব-ঐতিহ্য ধারণ-লালন অপরিহার্য। অথচ মুক্তিযুদ্ধের অনেক বায়া-দলিল বিএনপির হাতে থাকলেও পায়ের নিচে মুক্তিযুদ্ধের জমিন না থাকায় বিপর্যয়ে পড়ে দলটি। বিভিন্ন দিবসকে সামনে রেখে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে নানান কথা বলেন বটে, কিন্তু সেগুলি বিচ্ছিন্ন বলে পরিগণিত হয়। কিছু কিছু মানুষ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিভিন্ন ধরনের টনিক খেয়ে থাকেন স্বাস্থ্য ভালো থাকবে মনে করে Ñ খাবার আগে এক চামচ বা খাবার পরে দুই চামচ। ব্যাপারটা অনেকটা ঐ রকম।
একই সঙ্গে বিএনপি মাথায় তুলে নিয়েছে তাদেরকে, যারা বাংলাদেশটাই চায়নি এবং স্বাধীনতার সঙ্গে বেঈমানীর পাশাপাশি তাদের ভূমিকা নিয়ে দম্ভকরা অব্যাহত রেখেছে। বড় কথা, জামায়াতের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে বিএনপির বিদ্যমান জায়গাটাও দখল করা। এমন কি, ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী নির্বাচনের প্রাক্কালে জামায়াত ‘পনের বছরের মধ্যে ক্ষমতায় চলে আসার’ ছক এঁকেছিল বলেও শোনা যায়। বিএনপিকে চিন্তা-ভাবনা বা দরকষাকষির সুযোগ না দিয়ে বগলদাবা ও বাধ্য করে নির্বাচনে নিয়ে যাওয়াও ছিল সেই ছকেরই অংশ। জন্মের পর থেকেই জামায়াত সব সময় হটকারিতা ও ভুল হিসেব করে আসছে। আর বিএনপির ট্রাাজেডি হচ্ছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে যাওয়ার আগে যেখানে প্রবল দরকষাকষির দরকার ছিল বা যে-নির্বাচন বর্জন করলেও তেমন ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো না, সেই নির্বাচনে জামায়াতের ধাক্কায় লাফ মেরে চলে গেছে। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া অপরিহার্য হওয়া সত্ত্বেও সেটা বর্জন করে আমছালা দু’টোই হারিয়েছে। এই নির্বাচন বর্জনের পরামর্শ দিয়ে যারা বেগম খালেদা জিয়ার হাতে সবুজ পাসপোর্ট ধরিয়ে দিয়েছিলেন এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকলে বিএনপি কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অন্যদিকে জামায়াতকে ময়দানে-সংসদে দ্বিতীয় শক্তিতে পরিণত করতে আওয়ামী লীগও বাতাস দিতে পারে Ñ নিজের স্বার্থে বা বিএনপিকে আরো ঘায়েল করতে। সংসদে এরশাদের দলের সঙরা দ্বিতীয় শক্তি হিসাবে থাকলে যে আনন্দ, তা থেকে প্রতিনিয়তই মজা লুটছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, জামায়াত দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে পরিণত হলে আওয়ামী লীগ দেশ-দুনিয়াকে দেখাতে পারবে যে, তার বিকল্প হচ্ছে মৌলবাদী-জঙ্গিরা। অন্যদিকে জামায়াতের লাভ হচ্ছে বিএনপির বদলে তারা ব্যাপক শক্তি ও প্রচারণা ভোগ করবে। এমনটা ভেবে থাকলে এটা দুই পক্ষেরই অলীক কল্পনা। বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিতে জামায়াতের বড় ধরনের শক্তি হওয়া অসম্ভব। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের একাত্তরের ভূমিকার জন্য প্রকাশ্য ক্ষমা না চাইবে, উগ্রতা-হটকারিতা পরিহার না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ দেশের মানুষ জামায়াত বা পরিবর্তিত নামের সংগঠনের তাদেরকেও কার্যকরী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনায়ই আনবে না। তা ছাড়া তাদের রাজনৈতিক দল-কাম-এনজিওগিরি দুটো জায়গাতেই এসেছে ইতিহাস-নির্ধারিত চরম আঘাত। দান-খাম-ঋণ দেওয়ার ক্ষমতাও তাদের কমে আসছে। আওয়ামী লীগ বলতে গেলে জামায়াতের প্রাণ-ভেমরায় হাত দিয়েছে।
আর, ‘অসৎ-সঙ্গে সর্বনাশ’ বলে যে প্রবাদ আছে তার প্রতিফলন বিএনপিতে ঘটায় অনেক বড় আকারের ভুল বিএনপিও করেছে। ইতিহাসে কোনো কোনো ভুলের মাশুল খুবই চড়া।
।। দুই।।
চেতনা শব্দটিকে অসম্মান প্রসঙ্গে
কিছু লোকের বিতর্কিত কাজের জন্য আজকাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শব্দটি নিয়ে কাউকে কাউকে ব্যঙ্গ করতে দেখি। সুযোগ পেয়ে এটি বেশি-বেশি করছে তারাই, যারা একাত্তরে বাংলাদেশ চায়নি, পাকিস্তানীদের খুন-লুন্ঠন-ধর্ষণে সাহায্য করেছে এবং যারা বাংলাদেশকে অন্তর থেকে মেনে নেয়নি শুধু, এখনো তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো দেশে পরিণত করতে চায়। এরা চেতনা শব্দটি কলুষিত করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অসাবধানতা বা অভিমানবশত এটি যখন মুক্তিযুদ্ধের গৌরব-মহিমা ও চেতনার ধারক-বাহকদের মুখে শুনি কিংবা নব্যরাজাকার-আলবদর বা তাদের আদর্শ-অনুসারী উত্তর-পুরুষদের বাইরেও অন্যদের মুখে শুনি, তখন খারাপ লাগে। এ দেশে কিছু লোক ধর্মের অপব্যাখ্যা করে অন্যায় কাজ করে। এখানে অপব্যবহারকারীই সমালোচনার পাত্র, ধর্ম নয়। তেমনি চেতনার নামধারী কিছু অসৎলোক যখন অন্যায় কাজ করে, এখানেও অপকর্মের জন্য দায়ী অসৎ লোকটি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়।
যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনায় বিশ্বাস রাখেন বা এগুলিকে সর্বতোভাবে উর্ধে তুলে রাখতে চান তাদের সবারই চেতনা শব্দটাকে কলুষিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসা উচিত। আওয়ামী লীগের বা তার সরকারের কিংবা অন্য কোনো দল বা সরকারের অনেক কাজের বিরুদ্ধে অনেকের সমালোচনা আছে এবং ভবিষ্যওে থাকবে । কিন্তু সেই সমালোচনাটা দয়া করে মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়েই করুন, ময়দান ছেড়ে দিয়ে রাজাকার-আলবদরদের কাতারে গিয়ে নয়। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আওয়ামী লীগের একার নয়, তেমনি চেতনা শব্দটিও আওয়ামী লীগের একার নয়।
অনেকে মনে করেন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যেহেতু সীমান্ত নেই তাই একে আর পাকিস্তান বানানো সম্ভব নয়। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, পাকিস্তান শুধু একটি ভূখন্ড বা ইতিহাস নয়, এটা একটা নেতিবাচক-প্রতীক, একটি অপদেশ। বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো দেশে পরিণত করা বা পাকিস্তান-আফগানিস্তানের কার্বনকপি করতে চেষ্টা করার মতো কিছু মানুষ বাংলাদেশে আছে। এটা যারা অস্বীকার করছে বা রাজাকার-আলবদরদের ভাবাদর্শগত প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে তাদের উভয়পক্ষের প্রচারণাই মারাত্মক ক্ষতিকর।
কেউ কেউ আবার জাতীয় ঐক্যের দোহাই দিয়েও উল্লিখিত ক্ষতিকর প্রচারণার পক্ষে থাকার আহবান জানাচ্ছেন। কিন্তু তারা ভুলে যান যে, যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বকেই আজ পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনি, কিংবা বাংলাদেশের পতাকা হাতে পেলে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের দিকে দৌড় লাগাবে তাদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য হয় না। জাতীয় ঐক্য তাদের মধ্যেই হয়, দেশটা যারা একসঙ্গে যুদ্ধ করে সৃষ্টি করেছে, যাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও দেশের মৌলিক স্বার্থে তারা একমত। কিন্তু মতপার্থক্য ও বিশ্বাসঘাতকতা ভিন্ন বিষয়। বাংলাদেশটাকে এখনও পর্যন্ত কারো কারো মেনে নিতে না পারাটা অবশ্যই বিশ্বাসঘাতকতা। আমি উল্লেখ করেছি বিশ্বাসঘাতকদের কথা। তা ছাড়া এগার শ’ মাইল দূরের পাকিস্তান ভূ-খন্ডটি ২৩ বছর ধরে আমাদের লাথি-ঝাটার মধ্যে রাখা এবং দেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার ইতিহাস আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পনের খবর শুনে জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে দম্ভের সঙ্গে বলেছিলেন, বাংলা এখন আমাদের হাতছাড়া হলে কী হবে, একে আমরা যুগ-যুগ ধরে শায়েস্তা করে যাব। ভুট্টো মারা গেলেও পাকিস্তান সেই দম্ভ যে ধরে রেখেছে তার প্রমাণ প্রায়ই দিয়ে থাকে। নব্যরাজাকারদেরও এটা বোঝা উচিত, বাংলাদেশ টিকে থাকার জন্যই জন্ম নিয়েছে। পাকিস্তানী দাসত্বের হ্যাংওভার নিঃশেষ হয়ে যাবে বাংলাদেশ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক চেতনাও বলীয়ান হবে দিনে-দিনে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নির্বিশেষ মানুষের বহুমাত্রিক সেই চেতনার স্বরূপ তুলে ধরা ও বাস্তবায়নের তাগিদ অব্যাহত রাখা।
আওয়ামী লীগ বা ভারতের অনেক আচরণ কারো কারো কাছে পছন্দ না হলে মুক্তিযুদ্ধও তাদের কাছে সমালোচনা বা ব্যঙ্গ করার বিষয় হয়ে ওঠে। তাদেরও এ কাজ থেকে বিরত থাকার আহবান জানাই। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশপন্থী হয়েই প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পাকিস্তান বা ভারতের ন্যায্য সমালোচনা করতে পারে এবং করেও যাচ্ছে। সরকারের সমালোচনার প্রশ্নেও একই দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত।
আমরা কিছু লোক মুক্তিযুদ্ধের নির্বিশেষ মানুষের চেতনার বিষয়টি নিয়ে কিছু কাজ করে আসছি। সর্বস্তরের কিছু মানুষের বক্তব্য সংগ্রহ করা হয়েছে যথাক্রমে ১৯৯৬ ও ২০০২ সালে। বক্তব্যদানকারীদের অনেকে এরমধ্যে গতায়ু হয়েছেন। অনেকে বেঁচে আছেন। কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া বক্তব্য শাশ্বত। ‘জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান’ গ্রন্থে আমরা বক্তব্যগুলি মুদ্রিত করে রেখেছি। গ্রন্থটির সম্পাদনা আমার। প্রথম সংস্করণে সহকারী সম্পাদক ছিলেন শাকিল কালাম। বর্তমানে সৃজনকাল নামের বহুমাত্রিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এই সংগ্রহ অব্যাহত আছে। ফেসবুক, টুইটার, ওয়েব সাইটসহ নানা মাধ্যমে প্রচারও চলছে। কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে বক্তব্য ও তথ্য দিয়ে আমাদের সহায়তা করলে তা সাদরে গ্রহণ করা হবে।
সংযোজন-পরিমার্জন ঃ ঢাকা, ২০ ডিসেম্বর ২০১৭।
আহমেদ মূসা লেখক-সাংবাদিক-নাট্যকার। সাপ্তাহিক বর্ণমালার উপদেষ্টা সম্পাদক।
Email: ahmed.musa.58@gmail.com
website Address : https://sites.google.com/view/sreejonkal
আহমেদ মূসা : বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ এক কথাশিল্পী অতীন বন্দোপাধ্যায় গত ১৮ জানুয়ারি ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন । এই অমর কথাশিল্পীর জন্ম ১৯৩০ সালে, নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার রাইনাদি গ্রামে। তাঁর জন্মস্থানের খুব কাছেই রয়েছে উপমহাদেশের অন্যতম রাজনীতিবিদ, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পূর্ব-পুরুষের আদিভিটা বারদী। অবশ্য বারদী পড়েছে সোনার গাঁ-তে ।
অতীন বন্দোপাধ্যায়ের মহৎ সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, ‘ঝিনুকের নৌকা’, ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগান’, ‘মানুষের ঘরবাড়ি, ‘পঞ্চযোগিনী’ প্রভৃতি।
আমার জন্মস্থানও আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের ইজারকান্দী গ্রামে। দূরত্ব খুব বেশি নয়। ঢাকা থেকে থানা সদর হয়ে গ্রামের বাড়িতে গেলে রাইনাদির পাশ দিয়ে যেতে হয়। নিজের অজান্তেই তখন একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বাংলা-ভাগ কত প্রতিভাবান মানুষকেই না আমাদের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
অতীন জন্মভূমি ছেড়ে কেন, কীভাবে গেলেন এবং ভারতে গিয়ে কী ভয়াবহ জীবন-সংগ্রাম তাঁকে করতে হয়েছে, সেসব তাঁর লেখনীতেই রয়েছে। তাঁর পূর্ব-পুরুষ রূপগঞ্জে মুড়াপাড়ার জমিদারদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। নিজেদেরও অনেক সহায়-সম্পত্তি ছিল। কিন্তু অতীনরা রাতারাতি পরিণত হয়েছিলেন উন্মুল-উদ্বাস্তুতে। জাহাজের শ্রমিকের কাজ নিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে অতীন শুরু করেন তাঁর জীবিকা। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরনের পেশায় নিযুক্ত থেকেও সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন।
সম্ভবত বছর ত্রিশেক আগে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ‘আনন্দলোক’ পত্রিকায় অতীন বন্দোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস পড়ে চমকে উঠেছিলাম। লেখার পটভূমি আড়াইহাজার, বৈদ্যরবাজার, বারদী, গোপালদী প্রভৃতি অঞ্চল। তারপর খুঁজে-খুঁজে তাঁর অন্যান্য লেখা পড়তে থাকি। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’-র মধ্যে আড়াইহাজারের প্রতিবেশ-পৃথিবী উঠে এসেছে মোহনীয় চিত্রকল্প নিয়ে। সেই ফাওসার বিল, জালালীর জীবন-সংগ্রাম, সমকালের দারিদ্র্য-দৈন্য, ভাগ্য-বিপর্যয় পাঠকদের অন্তরে গেথে থাকবে।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল লেখককে তাঁর জন্মস্থানে এনে সম্বর্ধনা দেওয়ার। ২০০২ সালে আমি যখন সোনার গাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক, তখন একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমার কার্যালয়ের সঙ্গেই একটি উন্নতমানের ডাকবাংলো। ভেবেছিলাম তিনি এলে এখানেই কয়েকদিন থাকার ব্যবস্থা করব। তাঁর পৈত্রিক ভিটাসহ গোটা এলাকা ঘুরিয়ে দেখাব। কিন্তু প্রথম দরকার লেখকের সম্মতি। লোকশিল্প জাদুঘরে পশ্চিম বাংলার দূরদর্শন (আকাশটিভিও হতে পারে) চ্যানেলের একজন সাংবাদিক প্রায়ই আসতেন। তার সঙ্গে অতীন বন্দোপাধ্যায়ের জানাশোনা আছে শুনে তাঁকেই অনুরোধ করলাম লেখকের সম্মতি আদায়ের। সম্মতি পেলে এলাকার বিশিষ্ট লোকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে বাকী কাজ সম্পন্ন করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর সেই সাংবাদিক জানালেন, অতীন বন্দোপাধ্যায় আসতে পারবেন না। তাঁর নাকি পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা আছে। ভারতে পাসপোর্ট পাওয়া বা নবায়ন বেশ কঠিন জানতাম, কিন্তু অতীন বন্দোপাধ্যায়ের মতো এতো বড় লেখক এই সামান্য ব্যাপারে আটকে থাকবেন এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অথবা এমনও হতে পারে, তিনি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছেন। জন্মভূমির সজীব চিত্রকল্পটা হয়তো বুকের মধ্যেই তাজা রাখতে চেয়েছেন। পিতৃ-ভিটার পরিবর্তনটা তার হয়তো দেখার ইচ্ছে ছিল না। সে কারণে বুকে কোদাল চালাতে চাননি। কিন্তু তাঁর কলম আমৃত্যু হাহাকার করে গেছে বাল্যকালে ফিরে।
আমার আরেকটা ইচ্ছে ছিল লেখকের সঙ্গে দেখা করার। ২০০৫ সালে আমি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে কলিকাতা বইমেলায় যোগদান করি। ইচ্ছে ছিল মেলাশেষে দেখা করতে যাব। কিন্তু মেলা শেষ হওয়ার আগেই দুটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হই। এর একটি হচ্ছে মুখের বামপাশে ভয়ানক ভাইরাল ইনফেকশন এবং অন্যটি পেরিফেরিয়াল ভাসকুলার ডিজিজÑ উপরের দিক থেকে পায়ে রক্ত চলাচল হ্রাসের কারণে হাঁটলে ব্যথা করা। তাই আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি সেবার। পরবর্তীকালে পায়ের সমস্যার জন্য ঢাকা ও নিউইয়র্কে দুবার মেজর অপারেশন করতে হয়। ভাইরাল ইনফেকশনও আরেকটু উপরের দিকে উঠলে অচল হয়ে পড়তাম। সময়মতো চিকিৎসার জন্য রেহাই পাই। কিন্তু এগুলি একেবারে যায়নি। রেশ রয়ে গেছে বাম কান, বাম চোখ ও জিহবার বাম পাশে।
২০০৬ বাংলাভিশনের সাংবাদিক ও কারিগরি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লী থেকে ফেরার পথে অল্প সময়ের জন্য কলিকাতা গিয়েছিলাম। সেবারও জটিলতার কারণে যেতে পারিনি। কিন্তু একদিন অবশ্যই যাব বলে স্থির করে রেখেছিলাম। কিন্তু তা আর হলো না। তাঁর সাহিত্যকর্মের ওপর একটি বিস্তারিত লেখার ইচ্ছেটা এখনো জারি আছে। আমার প্রিয় এই লেখকের স্মৃতির প্রতি রইলো বিন¤্র শ্রদ্ধা। কামনা করি তাঁর আত্মার চিরশান্তি।
নিউ ইয়র্ক, ২০ জানুয়ারি, ২০১৯।
|| আহমেদ মূসা||
১৪ ফেব্রুয়ারি এলে সব ছাপিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদের পুলিশের গুলিতে ঝরে যাওয়া অনেক মুখের সঙ্গে আরো একটি নিষ্পাপ মুখ মনে পড়ে আমার। তার লাশ পাওয়া যায় নি। পড়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার দূর-সম্পর্কের মামাতো ভাই । তার বাবা ঢাকা শহরে অনেক পরিশ্রমের কাজ করে ছেলেকে পড়াতেন আর স্বপ্ন দেখতেন। খুবই মেধাবী ছিল তমিজউদ্দিন। মা-বাবা কত
আহমেদ মূসা
আতিপাতি করে খুঁজেছে তাকে। আমিও মামার সঙ্গে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ঘটনার দিন আমি সাংবাদিকতার পেশাগত কারণে হাইকোর্ট এলাকায় ছিলাম। হত্যাকা-ের পর কিছু লাশ ঘটনাস্থল থেকেই গুম করা হয়। কিছু লাশ ছাত্ররা জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে রেখে অপেক্ষা করছিল জাতীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে মিছিল করার। কিন্তু জাতীয় নেতৃবৃন্দ রহস্যজনক কারণে’ আসতে দেরি করার ফাঁক দিয়ে এরশাদের পুলিশ বাহিনী অসংখ্য আর্মার্ড কারসহ প্রায় যুদ্ধ সাজে এসে লাশগুলি ছিনিয়ে নেয়। অসংখ্য লাশের মাত্র কয়েকজনের নাম প্রকাশ করা হয় । আমার সঙ্গে সেদিন সম্ভবত তরুণ সাংবাদিক ফজলুল বারী ছিলেন। সেদিন অসহায়ের মতো দেখছিলাম পুলিশের ছিনতাই।
১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদ স্বৈরাচারের হত্যাযজ্ঞের মিছিলে নাম না জানা আরো অনেকের সঙ্গে গুম হয়ে গেল তমিজের লাশও। কিন্তু মামার মন মানতো না, যদিও পরবর্তীকালে তিনি আমার ব্যাখ্যায় একমত হয়েছিলেন। না পুলিশের খাতায়, না শহীদের তালিকায়, কোথাও নাম নেই তমিজের । নাম আছে শুধু স্বজনের হৃদয়ে। কেউ খোঁজও নেয় নি। তার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের ঝাউকান্দি গ্রামে। তমিজের বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন ছেলের শোক বুকে নিয়ে। আল্লাহ তাদের দুজনেরই বেহেস্ত নসীব করুন।
আগামী মাসে এলাকার উদ্যোগী তরুণদের নিয়া আমরা একটি পাঠাগার চালু করতে যাচ্ছি। ছোট আকারের একটি আলোচনা কক্ষ রাখছি বহুমুখী ব্যবহারের জন্য। ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ তমিজের উপর একটি আলোচনা সভা করে তার স্মৃতি অম্লান রাখার আশা পোষণ করছি। । একই সঙ্গে বিপুল ত্যাগ ও অবদান রেখে হারিয়ে যাওয়া অন্যদের নিয়ে আলোচনা ও স্মৃতিচারণ অব্যাহত রাখার ইচ্ছে আছে।
বাঙালী মুসলমানের উৎসবের সংখ্যা কম। অসাম্প্রদায়িক উৎসবের সংখ্যা আরো কম। সে কারণে নতুন উৎসব পেয়ে মেতে উঠা স্বাভাবিক। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি খুনি এরশাদ যেভাবে আমাদের বীর-তরুণদের রক্তে দিনটি ভাসিয়ে দিয়েছিলো, সেখানে কর্পোরেট হাউসেগুলির প্ররোচনা-সমৃদ্ধ ভেলেন্টাইন দিবসের মাতামাতিটা নিদেনপক্ষে আরো সংযত হওয়া দরকার। আর এটি এড়িয়ে গেলেও ভালোবাসা খুব একটা খারাপ অবস্থায় পড়বে না। মহাভারতও অশুদ্ধ হবে না।
বীর-তরুণদের রক্তেভেজা শহীদ-স্মৃতি অমর হোক : শহীদ তমিজের স্মৃতি অমর হোক।
– আহমেদ মূসা লেখক-সাংবাদিক-নাট্যকার : সাপ্তাহিক বর্ণমালার উপদেষ্টা সম্পাদক।
প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯, ৮:৪১ অপরাহ্ণ
আপডেট সময় : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯ at ৮:৪১ অপরাহ্ণ
আহমেদ মূসা : জামায়াতে ইসলামী এমন একটি দেশে দোর্দন্ড-প্রতাপে বিরাজ করছে যে দেশটি তারা চায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-বিরোধীদের অন্যতম পুরোধা হয়েও জামায়াতে ইসলামী এদেশে রাজনীতি করছে, প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে এনজিও-ওর মতো, অবাধে ব্যবসা করছে, দায়ে পড়লে বিদেশি লবিস্টও নিয়োগ করছে। কিন্তু আপত্তি তাদের একটামাত্র জায়গায় একাত্তরে তাদের কৃতকর্মের জন্য, অন্যায়-অপরাধ-পাপ ও ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনায় ও ভুল স্বীকারে। জনগণের কাছে ভোট চাইতে তাদের লজ্জা করে না, লজ্জাটা শুধু ভুলের প্রায়শ্চিত্র বা ক্ষমার মাধ্যমে মুমিন বান্দা হওয়ার ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমা করুক আর না করুক, দেশ ও জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া ছিল অত্যাবশ্যকীয়। দেরিতে হলেও দলের শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা ড. রাজ্জাক এবং তার অনুসারীরা বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন, কেউ কেউ দলত্যাগও শুরু করেছেন। দুইজনের কথা প্রকাশ্যে এলেও তৃণমূল পর্যায়ে দলত্যাগ ও নিষ্ক্রিয়তা শুরু হয়েছে অনেক আগেই।
একাত্তরে তাদের কৃতকর্মের জন্য জামায়াতে ইসলামীর ভুল স্বীকার না করার সরল অর্থ হচ্ছে, তারা তাদের তখনকার অবস্থানকেই সঠিক মনে করে। এর আরো সরল অর্থ হচ্ছে, সুযোগ পেলে বা ক্ষমতায় যেতে পারলে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে আবার একীভূত হবে বা বাংলাদেশকেই পাকিস্তান-আদলের আরেকটি দেশে রূপান্তরিত করবে। অবশ্য বাংলাদেশে জামায়তে ইসলামীর ক্ষমতায় যাওয়ার আশঙ্কা শূন্যের কোঠায়, যদিও জামায়াত মনে করে সেটা সম্ভব। এমন কি ২০০৮ সালে জামায়াতের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ঘোষণাও দিয়েছিলেন, যে ১৫ বছরের মধ্যে তারা ক্ষমতায় আসবেন। এসবেরও সরলতম অর্থ হচ্ছে, তারা বাংলাদেশের মানুষকে বোকা ছাড়া আর কিছু ভাবেন না। অথচ, জন্মের পর থেকে এই দলটিই চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা, নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা, হঠকারিতা ও গোয়ার্তুমির পরিচয় দিয়ে আসছে।
অন্যদিকে, পৃথিবীতে বাংলাদেশের জনগণকেও একটা নজিরবিহীন দুর্ভাগ্য বহন করতে হচ্ছে। বলীয়ান আতত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়লাভ করেও পরাজিত-বিশ্বাসঘাতক-শত্রুদের দম্ভ সহ্য করতে হয় তাদের। করতে হয় এদের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম। আরো দুর্ভাগ্য, দলীয় স্বার্থের কারণে সেই পরাজিতদের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন সমঝোতা করতে হয় মূলধারার দলগুলিকে, পেশাজীবী সংগঠনগুলিকে। স্বাধীন দেশের পাতাকাও ওড়ে তাদের গাড়ি-বাড়িতে। কখনো কখনো তাদের দম্ভ আকাশচুম্বীও হয়ে ওঠে, ছাড়িয়ে যায় সহ্যের মাত্রা।
স্বাধীনতার পর জামায়াতসহ ধর্মাশ্রয়ী দলগুলিকে প্রথম নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু একসময় সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল গঠন করায় ধর্মাশ্রয়ী দলগুলিকে নিষিদ্ধের আলাদা-গুরুত্ব হারিয়ে যায়। জিয়াউর রহমানের আমলে পিপিআর-এর আওতায় আবার সবগুলি দল পুনরুজ্জীবিত হয়। জামায়াত তখন বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের লেবাস নিয়ে কাজ শুরু করে। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলি থেকে আসা অঢেল অর্থ ব্যয় করে তারা গ্রহণ করে সুদূর-প্রসারী কর্মসূচি। দরিদ্রের মেধাবী সন্তানদের স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত আর্থিক সাহায্য করে সামরিক-বেসামরিক অনেক উচ্চ ও অন্যান্য পদে অনুপ্রবেশ ঘটায়। আজকে আমরা শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল প্রভৃতির মধ্যে বিপুল-সংখ্যক জামায়াত-শিবির করার যে চিত্র বিষ্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, এটা জামায়াতের সুদূর-প্রসারী কর্মসূচির পেকে-যাওয়া ফল। বিশাল মূলধনের অংশ-বিশেষ দিয়ে তারা কব্জা করে সেবাখাতগুলিও। তাদের কর্জে হাসানার সূক্ষè বেড়াজাল ঘিরে ফেলে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। এরসঙ্গে মিশেল দেওয়া ধর্ম-ব্যবসাতো আছেই।
জামায়াত ধরে নিয়েছিল, প্রচুর অর্থ ছিটানোর পাশাপাশি মূলধারার দলগুলির সঙ্গে সখ্যতা সৃষ্টি বা তার রদবদল করে ও পর্যায়ক্রমে কর্মসূচি অনুসরণের মাধ্যমে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। তারপর একসময় বড় জায়গা করে নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় চলে আসবে। এই চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির ওপর জামায়াত খুব বেশি নির্ভর করায় একাত্তরের ভূমিকার জন্য ভুল স্বীকার বা ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। গোটা এরশাদ আমল ও ছিয়ানব্বইয়ে বিএনপি-বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে অনুসরণ করায় তাদের নৈতিক বা রাজনৈতিক সঙ্কট তেমনভাবে দেখা যায়নি। চলতি পর্বে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করার পাশাপাশি তাদের প্রাণ-ভোমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলি থেকে একপ্রকার উচ্ছেদ করে প্রায়-মিসকিনে পরিণত করেছে। জান-মাল ধরে একসাথে টান দিয়ে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে। এ কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায়-একক উদ্যোগ-সাহসের জন্য সম্ভব হতে পেরেছে। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে এটা সম্ভব ছিল না। এতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবেও বিপুল লাভের মুখ দেখেছে। দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বিএনপি ও জামায়াতকে পাটের একগাছিতে মুড়ে কঠিন এক দড়ি পাকিয়ে বিএনপিকেও ফেলেছে ভয়াবহ বিপর্যয়ে। অন্যদিকে জামায়াত এবং বিএনপির ভেতরকার ছদ্মবেশি-জামায়াতিরা মিলে রাজপথের দল বিএনপিকে প্রথমে ঢুকিয়েছিল কানাগলিতে, তারপর টানছিল কসাইখানার দিকে। জামায়াতকে ক্ষমতায় নেওয়ার আগে দ্বিতীয় রাজনৈতিক শক্তি করার পরিকল্পনাও চলছিল সমান্তরালভাবে। সে বিতর্ক ভিন্ন। আমাদের চলতি প্রসঙ্গ জামায়াতের ক্ষমা প্রার্থনা ও ভুল স্বীকার নিয়ে।
আশির দশকের শেষভাগে একবার জামায়াত একাত্তরের ভূমিকার জন্য ভুল স্বীকার করে গণ-তওবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে কানাঘুষা চলছিল। এনিয়ে আমি একটি প্রতিবেদনও করেছিলাম সাপ্তাহিক আগামী বা একই ভবনের তারকালোক পত্রিকায়। অধুনা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক মইনুদ্দিন নাসের এ ব্যাপারে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু জামায়াত সেই চিন্তা থেকে সরে আসে। অবশ্য আমার প্রতিবেদনের প্রতিবাদও তারা করেননি। কিছুদিন পর এ ব্যাপারে ছাত্র শিবিরের একজন প্রভাবশালী নেতাকে জিজ্ঞেস করায় তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তার সারমর্ম হচ্ছে, ভুল স্বীকার বা ক্ষমা চাইলে একাত্তরে তাদের যে-সব লোকের প্রাণ গেছে (তাদের ভাষায় ‘শহীদ’ হয়েছে) তাদের প্রতি ‘অন্যায়’ করা হবে। এই জবাবের মধ্যেও নিহিত দেখতে পেয়েছিলাম বাংলাদেশকে মেনে না নেওয়ার ঔদ্ধত্য। এই ঔদ্ধত্যও তাদের সংকটের অন্যতম কারণের একটি।
বাংলাদেশে জামায়াত-বিরোধী সূচনা-আন্দোলন একক কোনো বা কারো পরিকল্পনার ফসল নয়। বরং জামায়াত নেতাদের ঔদ্ধত্যই বড় দুইটি আন্দোলনকে ডেকে এনেছিল। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বাপর সময় ধরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে অনেক লিখেছি। পরিশ্রম লাঘব ও পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা হ্রাসের জন্য এই লেখায় আমি আমার আগের কিছু লেখার উদ্ধৃতি দেব। এতে আমার এই সংক্ষিপ্ত লেখার বিভিন্ন প্রসঙ্গ সম্পর্কে কেউ বিস্তারিত জানতে চাইলে উৎসগুলি তাদের উপকারে আসবে। সবগুলি লেখাই ঢাকার অনলাইন ও মুদ্রিত দৈনিকসহ নিউইয়র্কের বেশ কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়। পরবর্তীকালে আমার কলাম-ভিত্তিকগ্রন্থ ‘যেমন দেখেছি ওয়ান ইলেভেন’ ও সবশেষে ‘ধেয়ে আসছে নন্দে মাতরম্ এবং অন্যান্য নির্বাচিত কলাম’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছি।
‘১৯৮১ সালের ২৮ মার্চ জামায়াত নেতারা প্রথম সংবাদ সম্মেলনে দম্ভোক্তি করেন, যে ১৯৭১ সালে তারা কোনো ভুল করেননি এবং বাংলাদেশের কনসেপ্ট সঠিক ছিল না। গোলাম আযমও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে একই কথা বলেন। এই বক্তব্যের পর দেশে জামায়াত-শিবির-বিরোধী প্রচন্ড ক্ষোভ তৈরি হয়। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্বে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।
কয়েকটি পত্রিকাও এগিয়ে আসে সোচ্চার ভূমিকা নিয়ে। দাবি ওঠে অবৈধ নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধেযুক্ত গোলাম আযমের বিচারের। কেউ কেউ দাবি তোলেন গোলাম আযমকে বহিষ্কারের ।
‘১৯৮০-র দশকের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মূল নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রভাবিত মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ও জাসদ প্রভাবিত মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদসহ কিছু সংগঠনের প্রয়াসে গড়ে উঠেছিল যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতা-বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন।
‘মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে গোলাম আযম পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতা ও পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছিলেন তা-ই শুধু নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিদেশে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে চেয়েছেন। এসব কারণে বাংলাদেশে তার নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়।
১৯৭৮ সালে গোলাম আযম পাকিস্তানি নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে এ দেশে আসেন অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে। তার ৬ মাসের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি আর পাকিস্তানে ফিরে যাননি। এ দেশে থেকে যান এবং একাত্তরে তাদের অবস্থানই সঠিক ছিল বলে প্রচারণা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেন অন্যদের। এটাও ছিল এক ধরনের উষ্কানী (নিষ্প্রাণ অক্ষর যখন মশাল : ‘ধেয়ে আসছে নন্দে মাতরম্ এবং অন্যান্য নির্বাচিত কগলাম’)।
‘গোলাম আযম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে মুসলিম দেশগুলিকে প্রভাবিত করার কাজে লিপ্ত থাকেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের’ বৃথা-অপচেষ্টাও করেন অনেকদিন ধরে। ৭২ সালে তার নেতৃত্বে পাকিস্তানে পালিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার’ সপ্তাহ।
‘জামায়াত-শিবির বিরোধী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বও শুরু হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর উস্কানীতে। জামায়াত ১৯৯১ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত অধ্যাপক গোলাম আযমকে দলের আমির নির্বাচন করে। গোলাম আযম তখন পাকিস্তানি নাগরিক। এই পদক্ষেপ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ¡াসী জনগণকে শুধু অপমানই নয়, বাংলাদেশের সংবিধানেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ, কোনো বিদেশি নাগরিকের বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তি দূরে থাকুক, কর্মী হওয়ারও সুযোগ নেই।
‘প্রতিবাদ করার জন্য ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে কাজী নূর-উজ্জামান সভা আহবান করলেন তার বাসায়। গিয়ে দেখি অনেক মানুষ। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, নয়া পদধ্বনি এবং ৮০-৮১ সালের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জামায়াত-শিবির বিরোধী আন্দোলনে জড়িত অনেকেই উপস্থিত। কথা উঠল প্রতিবাদ-প্রতিরোধে নামার জন্য বড় সংগঠন করার। একেক জন সংগঠনের নাম প্রস্তাব করতে থাকেন। নির্মূল কমিটি নামটি লুফে নেন কাজী নূর-উজ্জামান। ..গঠন করা হয় আমাকেসহ ১০১ সদস্যের নির্মূল কমিটি। এই আন্দোলনের শুরুর দিকে বিএনপি এবং ছাত্রদলের অনেকেও সমর্থন করেছেন। কিন্তু মার্চে গণআদালত গঠনের পর বিএনপির সমর্থকেরা সরে পড়ে।’
(বাংলাদেশের জন্ম-শত্রু প্রতিরোধ আন্দোলনের অনুক্ত কথা : প্রাগুক্তগ্রন্থ)।
‘স্বদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা আর রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মধ্যে তফাত আকাশ-পাতাল। বাংলাদেশে কেউ গণতন্ত্র চান, কেউ সমাজতন্ত্র চাইতে পারেন, কেউ ইসলামী ব্যবস্থাও দাবি করতে পারেন। এগুলি রাজনৈতিক অধিকার, রাজনৈতিক মতপার্থক্য। কিন্তু একাত্তরে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে বেঈমানী করেছে, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা-লুটতরাজ-ধর্ষণে শত্রুবাহিনীকে সহায়তা করেছে বা নিজেরা সে-সব অপকর্ম করেছে, তারা গুরুতর অপরাধী। কিন্তু এখন বিষয় দুটিকে গুলিয়ে ফেলার একটা প্রচারণা চলছে দেশে-বিদেশে। এই প্রচারণা বিশেষ করে চলছে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বিতর্কিত ও লঘু করে দেখানোর জন্য। কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীও কৌশলে এহেন মতলবপূর্ণ প্রচারণা চালাচ্ছেন। কেউ কেউ ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন যে, ওরা ‘আদর্শিক কারণে পাকিস্তান রক্ষা’ করতে চেয়েছে ইত্যাদি…..।
‘যুদ্ধবন্দি এবং যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যেও রয়েছে বিশাল ফারাক। অনেকে আজকাল এই ব্যাপারটাও গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। উদ্দেশ্য অভিন্ন। একাত্তরে যুদ্ধবন্দি ছিল ৯৫ হাজার। আর পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী ছিল ১৯৫ জন, যদিও তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল চুক্তির কারণে। যুদ্ধবন্দি ও যুদ্ধাপরাধীর বিষয়টি ভালো করে খোলাসা করেছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। আমেরিকার স্বাধীনতার পর তিনি বলেছিলেন, ধৃত বৃটিশ সৈন্যরা যুদ্ধবন্দি। তারা প্রয়োজনে উদারতা পাবে। কিন্তু স্বদেশের বিশ্বাসঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি ভোগ করতে হবে।’
(সফেদ সত্যের বিরুদ্ধে রঙিন প্রচার : প্রাগুক্তগ্রন্থ)।
‘জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত হলেও বৃহৎ অর্থে এটি একটি এনজিও। চাকরি ও ঋণ দিয়ে তারা অধিকাংশ কর্মীকে বেঁধে রেখেছে। ইসলামী ব্যাংকের ব্যবসাপাতি, ইসলামী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি বা কোচিং সেন্টারের গাইড বইয়ের মতো ইসলামও তাদের কাছে রাজনৈতিক হাতিয়ার বই কিছু নয়। সে কারণে ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগের পদাঙ্ক অনুসরণে যেমন তাদের আপত্তি নেই, তেমনি আপত্তি নেই বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনে। আবার চিরবৈরী কওমী-ওয়াহাবীদের সঙ্গ পেতে বা তাদের ব্যবহার করতেও আপত্তি দেখা যাচ্ছে না। এককালের বহু কমিউনিস্ট-বামকে খাম সরবরাহেও তাদের দ্বিধা নেই। একটি রাজনৈতিক দল এনজিও হয়ে পড়লে তার সামনে বহু সীমাবদ্ধতা উপস্থিত হয় এবং ক্রমনিঃস্বায়নের দিকে যেতে থাকে। বাংলাদেশে জামায়াতের ঘাঁড়ে আছে আরো অনেক বড় বোঝা, যুদ্ধাপরাধীদের বোঝা। এ বোঝা অতিশয় ভারী যা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেও নাড়াতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা, যে দলের কর্মীদের উত্তেজিত করতে চাঁদে মুখ দেখতে পাওয়ার গুজব ছড়াতে হয় কিংবা কাবা শরীফের গিলাফ নিয়ে জালিয়াতি করতে হয় সে দল পানি ঘোলা থাকা পর্যন্তই সজীব থাকতে পারে, সব সময় নয়।’ (মোমের আগুনে দাবানলের উত্তাপ : প্রাগুক্তগ্রন্থ)।
আজকে জামায়াত তার ইতিহাস ও নিয়তি-নির্দিষ্ট ভাগ্যকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছে। তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত যা-ই থাক, সবার আগে প্রয়োজন তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা। ভুল স্বীকার করা। এ দাবি এতোদিন বাইরের লোকেরা করেছেন। এবার দাবি উঠছে দলের ভেতর থেকেও। এই দরকারী দায়িত্বটি পালন না করে জামায়াতীরা নতুন নামে দল করলেও একাত্তর চিরকালই তাদের তাড়া করে বেড়াবে। দেশপ্রেমিক জনগণ এদের অস্তিত্ব দেখলে অপমান বোধ করবেন। নাম পরিবর্তন করে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ জামায়াতি ইসলামী হয়ে বা ছাত্র সংঘ থেকে ছাত্র শিবির হয়েও ইতিহাসের জেরা ও ধাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়নি, এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। বাংলাদেশ প্রতিদিন উত্তর আমেরিকা সংস্করণ।
আহমেদ মূসা লেখক-সাংবাদিক-নাট্যকার। সাপ্তাহিক বর্ণমালার উপদেষ্টা সম্পাদক।
Original Article URL: https://www.amadershomoy.com/bn/2019/02/23/802306.htm