১. কোনো জাতির ইতিহাসকে যখন মিথ্যাচার দিয়ে বিকৃত করা হয়, তখন সেই জাতির প্রাণশক্তিই বিকৃত হয়ে যায়।
- আবুল কাসেম ফজলুল হক
২. আমি বহু আগে এক জেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'ভাই মাছ ধরা কি খুব কঠিন?' জেলে শান্ত গলায় জানতে চেয়েছিলেন, - 'কী ধরা সহজ?'
- মঈনুল আহসান সাবের
৩. আওয়ামী লীগের যারা বুদ্ধিজীবী তাদের অনেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমান সমাজের গ্রহণযোগ্য ভাষায় কথা বলতে জানেন না।
- আহমদ ছফা; বাঙালি মুসলমানের মন।
৪. এটা কোনো যুদ্ধ নয়, স্রেফ খুন। ইসরাইল তার অত্যাধুনিক জেটবিমান ও নৌবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জনবহুল শরণার্থী শিবির, স্কুল, এপার্টমেন্ট, মসজিদ ও বস্তির জনসাধারণের ওপর - যাদের সামরিক শক্তি নেই, নৌ ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই, ভারি আধুনিক অস্ত্রশস্ত নেই, যাদের নেই কেন্দ্রীয় কোনো কমান্ড কন্ট্রোল। অথচ এটাকে বলা হচ্ছে যুদ্ধ।
- নোম চম্স্কি; ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ইসরাইল প্যালেস্টাইনে বর্বর হামলার পর চমস্কি এ কথা বলেন।
সূত্র: হায় প্যালেস্টাইন - যেমন দেখেছি ওয়ান ইলেভেন।
৫. এমন সময়ে কি মননের চাষ সম্ভব? এমন দুর্দিনে কি পৃথিবীকে আলিঙ্গন করা যায়? যেখানেই নিশ্বাস নেই, কেবল বারুদের গন্ধ পাই, সবখানে। এখন দর্শন আর মনন নির্বাসিত। আমি তেমনি নির্বাসিত একজন এই অভিশপ্ত পৃথিবীর নাগরিক। বড় দুঃখ আমার, বড় যন্ত্রণা আমার। বাঁচব কেমন করে। এই তো আমার দর্শনের সন্ধান।
সূত্র: আহমেদ মূসার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ; সাপ্তাহিক আজকাল, ফেব্রুয়ারি, ২০১১।
৬. I don’t really have to come first in class. I don’t really have to be the highest earner in my little town. There is so many happiness that comes from just loving and companionship and even losing.
সূত্র: অরুন্ধতী রায়; দ্য শেপ অব দ্য বিস্ট
৭. আমার কথা হলো এখন আর আমি একটা ছোট্ট ভূখন্ডের অচেনা নাগরিক নই। আমিও বিশ্ব নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকব। তবে মূলভূমি বাংলাকে কখনো অস্বীকার করব না। বাংলার হয়েই, বাংলার থেকেই আমি বিশ্ব সভায় আমার ভাষা, শব্দ, সংস্কৃতিকে উদ্ভাসিত করতে চাই। এরজন্য উদার মন আর সংস্কারহীন আবেগ ও গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। এ সাধনা কেবল একদিনের বলাতে বা অভ্যাসে হবে না। সময় লাগবে, এক এক করে দীর্ঘ দিন।
উৎস: নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ; আহমেদ মূসার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে; সাপ্তাহিক আজকাল, ফেব্রুয়ারি, ২০১১।
৮. এখনকার ক্ষমতাসীন রাজনীতিতে এমন এক শ্রেণী প্রতিনিধিত্ব করছে যাদের অধিকাংশই লুটেরা। গণতন্ত্র বা জনগণের প্রতি এদের কোনো দায়বোধ ও শ্রদ্ধা নেই। এই লুটেরাদের কোনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও নেই - এরা সংস্কৃতি বর্জিত। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সংসদের ভেতর সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা পরস্পর যে ভাষায় খিস্তি-খেউর করেন তা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ করতে পারে না।
উৎস: হায়দার আকবর খান রনো; আহমেদ মূসার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে; সাপ্তাহিক আজকাল, এপ্রিল ২০১২।
পুনর্মুদ্রণ: যেমন দেখেছি ওয়ান ইলেভেন।
৯. আমরা বাস্তবে বাস করি। কিন্তু স্বপ্ন দেখি বাস্তবের জমিনে বসেই। শিল্পীর কাছে এসবের দূরত্ব খুব বেশি নয়। তাছাড়া আমাদের বাস্তব জীবনেও তো ইন্দ্রিয়াতীত বা পরাবাস্তব এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার বাস্তব ব্যাখ্যা নেই।
উৎস: গৌতম ঘোষ; আহমেদ মূসার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে; সাপ্তাহিক আজকাল।
পুনর্মুদ্রণ: যেমন দেখেছি ওয়ান ইলেভেন।
১০. George Bush lied, my son died.
উৎস: যুদ্ধ-বিরোধী সংগঠন ‘কোডপিঙ্ক’; দ্য শেপ অব দ্য বিস্ট’ - অরুন্ধতী রায়।
১১. ভাসো, ভাসতে থাকো ..
তুমি তোমার শিশুর রক্তে,
ভাসো তুমি তোমার আপন রক্তের স্রোতে,
হিংসার যে লেলিহান আগুন গ্রাস করেছে তোমার গ্রাম,
সে আলোয় দেখো
তোমার গোড়ালি হারিয়ে গেছে রক্তের ধারায় ..
উৎস: আলী রীয়াজ; দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের সাহিত্য সাময়িকীতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কবিতা থেকে।
১২. চিরকালের খোকারে তুই, চিরকালের খোকা,
সবাই হলো চালাক-চতুর তুই রইলি বোকা।
তোর হাতে দেয় মুড়কি মোয়া তোর গালে দেয় চুম,
যে-চোখ দিয়ে দেখবি জগৎ সেই চোখে দেয় ঘুম ..
উৎস: আবু সালেহ; চিরকালের খোকারে তুই ছড়াগ্রন্থ থেকে।
১৩. জীবনে প্রথম কাজ নিয়েছিলাম গৃহভৃত্য হিসাবে।
উৎস: বিপ্লবী নেতা দেবেন সিকদার; ১৯৮৭ সালের ১৫ অক্টোবর পাক্ষিক তারকালোকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে; সংকলন, সমকালের সাক্ষাৎকারঃ আহমেদ মূসা।
১৪. যে বয়সে লোকে বেড়ায় তেজী ঘোড়ায় চড়ে
তখন তুমি কোথায়, কোন চুলায় ছিলে পড়ে।
আঁকড়ে ধরে আদ্দিকালের খুঁটি
ভেবেছিলে ধরেছ ঠিক মহাকালের ঝুঁটি।
উৎস: কবি আবুল হোসেন; সময়-অসময়ের গান।
১৫. আমি অনেকগুলো ব্যবসা তৈরী করেছি। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও আমার সৃষ্ট কোনো ব্যবসায়ে আমার একটা শেয়ারও নেই। কিন্তু এতে আমি কিছুই হারাইনি। আমি যেসব বিষয় নিয়ে ভাবি আমি সেগুলো নিয়ে কাজ করছি, এবং মানুষ মনোযোগ দিচ্ছে, শিখতে ও শুনতে চাচ্ছে..
উৎস: ড. মুহাম্মদ ইউনূস; ১০ অক্টোবর ২০১৭ দি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারঃ ডেভিড বার্নস্টীন। পুনর্মুদ্রণ: সাপ্তাহিক পত্রিকা, ১৯ আক্টোবর ২০১৭।
১৬. আমি বন্ধুদের গুণগুলো দেখি। দোষগুলো আল্লাহ্ দেখবেন।
উৎস: এরশাদ মজুমদার; ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত স্ট্যাটাস থেকে।
১৭. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যক্তি/গোষ্ঠির নিয়ন্ত্রণমুক্ত গণতান্ত্রিক দল অপরিহার্য।
উৎস: নঈম জাহাঙ্গীর; ২৫ জুলাই ২০১৭ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত স্ট্যাটাস থেকে।
১৮. আমি তাঁকেই ভালো বলি, যিনি আমার সঙ্গে ভালো ব্যাবহার করেন। অন্যদের সঙ্গে তাঁর কি সম্পর্ক, সেটি বিবেচনায় আসে না। আবার কেউ যদি অন্যদের কাছে খুব ভালো, কিন্তু আমার সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করেন, তিনি আমার কাছে খারাপ। বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে আমি রাজনীতির ঠুলিটা চোখ থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। কারও কারও সঙ্গে আমার ছবি দেখে অনেকেই আমার ওপর হামলে পড়েন। তিনি হয়তো জীবনেও আমাদের কারও সঙ্গে কথা বলেননি, বা হয়তো কক্ষনো দেখাও হয়নি। তাঁদের সমস্যাটি কি, আমি বুঝি না। এদেশে সামান্য মতপার্থক্যের কারণে অনেকেই মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেন, গালাগাল করেন। আবার ফেসবুকে ভুয়া তথ্যের সূত্র ধরে অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করেন কেউ কেউ। এ যেন অনেকটা চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে চিলের পেছনে ছোটা।
উৎস: মহিউদ্দিন আহমদ; ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত স্ট্যাটাস থেকে।
১৯. Facebook has saved human lives from loneliness.
উৎস: Anupam Hayat; ১৯ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত স্ট্যাটাস থেকে।
২০. তৃণমূলের খবর রাখার গরজ নেই আমাদের জাতীয় রাজনীতির। সে জন্যই কি রাজনীতি কেবল জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে?
উৎস: বিভুরঞ্জন সরকার; দৈনিক আমাদের সময়, ২১ অক্টোবর ২০১৭।
২১. আমাদের এখানে যে সাংস্কৃতিক বিকাশ এটা ব্যাহত হচ্ছে রাজনীতির কারণে। পাকিস্তান আমলে প্রবণতা, পাকিস্তানের পক্ষে থাকলে, পক্ষে লেখা ছাপা হলে অমুক কমিটির মেম্বার হওয়া যাবে, বিদেশি ডেলিগেশনের সদস্য হওয়া যাবে এই তো ব্যাপারটা। এটা এখনো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ গভর্নমেন্ট এলো, দেখা গেল একশ্রেণীর লোককে তারা সামনে নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এরা দেশভ্রমণ করছে। আবার একটা সরকারের পতন হয়ে আরেকটা সরকার এলো, তখন আরেক শ্রেণীর উদ্ভব হচ্ছে। আরেক ধরনের লেখক, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক সুবিধা পাচ্ছে। এই হচ্ছে এ এলাকার ঘটনা। এর বাইরে যারা থাকে বা থাকতে পারে, তারা জেনুইন কাজ করতে পারে।
উৎস: শওকত আলী; সাক্ষাৎকারঃ তরুণ সরকার, ১৯ অক্টোবর ২০১৭, সাপ্তাহিক পত্রিকা।
২২. বাংলায় অর্থনীতি নিয়ে যা প্রকাশিত হয় তার সিংহভাগ হচ্ছে রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে ডান-বামের তরজা আর খিস্তি-খেউর। আজ যাকে মূলধারার অর্থনীতি বলা হয় সে সম্পর্কে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নেহাত অপ্রতুল।
উৎস: ড. আকবর আলি খান; আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি, পৃষ্ঠা - ১৪
২৩. যারা খুন করে তারা জানে না একজন মানুষ মানে একটা জগৎ। কত সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে একটা মানুষ - বৌ-বাচ্চা-মা-বাবা-ভাই-বোন-বন্ধু - ওরা তা ভুলে যায়। ওরা মারে বিচ্ছিন্ন একটা মানুষকে। সেই মার সেই লোকটাকে ছাড়িয়েও ছড়িয়ে ছড়িয়ে যায়। একজন মানুষের সঙ্গে আরো কত মানুষ শেষ হয়। যারা খুন করে তারা কি তা জানে?
উৎস: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়; উপন্যাস ‘ফেরা’।
২৪. আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসি।
উৎস: হুমায়ূন আহমেদ; উপন্যাস ‘হিমুর আছে জল’, পৃষ্ঠা - ৪৪
২৫. যতগুলি ছেলে সেক্টরে রাখার অনুমতি ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছেলেকে আশ্রয় দিত খালেদ। নির্দিষ্ট সংখ্যক ছেলের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ রেশন দুইগুণ বেশি ছেলেরা ভাগ করে খেত। খালেদ বলত, ঢাকায় গেরিলা তৎপরতা অব্যাহত রাখার জন্য আমার প্রচুর ছেলে দরকার। অথচ আওয়ামী লীগের ক্লিয়ারেন্স, ইউথ ক্যাম্পের সার্টিফিকেট বা ভারত সরকারের অনুমোদন পেরিয়ে যে কয়টা ছেলে আমাকে দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট নয়।
উৎসঃ শহীদ রুমির বরাত দিয়ে জাহানারা ইমাম; একাত্তরের দিনগুলি, পৃষ্ঠা - ৩০৬
২৬. রাজনীতি হইতেছে এমন একটি মহৎ কর্মপ্রয়াস যাহার লক্ষ্য সমাজ হইতে অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতনের অবসান ঘটাইয়া জাতিধর্ম নির্বিশেষ সমাজের সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ প্রশস্ত করা, সমাজে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা তথা সামগ্রিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা।
উৎসঃ ভাসানী; সৈয়দ আবুল মকসুদ; প্রথম খন্ড, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা – ১৫
২৭. আমরা যারা সামরিক বাহিনীর লোক ভারতে গিয়েছিলাম, তারা ভারতীয় বাহিনীকে পাকিস্তানিদের সম্পর্কে যতটা সামরিক তথ্য দিয়েছি, ভারত তা পঞ্চাশ বছরেও জানতে পারত না।
উৎসঃ সেক্টর কমান্ডার এ কে খন্দকার; মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন, পৃষ্ঠা - ৮৩
২৮. আমি আর শহীদ রুমি এক এয়ারব্যাগের নিচে কাটিয়েছি বহুদিন। রুমি ছিল সত্যিকারের সাহসী ও দেশপ্রেমিক। রোমান্টিক ভাবালুতা ছিল তার। এটা তখন যে-কোনো গেরিলারই অহংকার। রুমি শহীদ হয়েছে, তার বাবা জনাব শরীফ ও ভাই জামিকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গিয়ে অকথ্য অত্যাচার করেছে। সে অত্যাচারের কারণেই কিছুদিন পর শরীফ সাহেব মারা যান।
উৎসঃ সাদেক হোসেন খোকা; মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা থেকে।
২৯. বামপন্থী দলগুলো সহসাই আবিষ্কার করতে সক্ষম হলো যে স্বাধীনতা অর্জনের একক লক্ষ্যে সংগ্রাম পরিচালনার জন্য সবাই সাময়িকভাবে ভারতে আশ্রয় নিলেও ভারতে এসে বামপন্থী অন্যান্য দলের ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়েছে এবং সংগ্রামের গোটা নেতৃত্ব রেখে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে।
উৎসঃ জগলুল আলম; বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা, পৃষ্ঠা - ৫৬
৩০. মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ইতিহাস এতটাই ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বিস্তৃত যে জনগণ, রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি, সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী, বুদ্ধিজীবী-গবেষক, ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতা, নারীসমাজ - সবারই মুক্তিযুদ্ধে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও ভূমিকা রয়েছে। .. স্বীকার করতে দোষ নেই, তার সার্বিক ইতিহাস এখনো রচিত হয়নি।
উৎসঃ মালেকা বেগম; মুক্তিযুদ্ধে নারী, পৃষ্ঠা - ১১
৩১. আমি যোদ্ধা, কিন্তু যুদ্ধবাজ নই। শান্তি আমার একমাত্র কাম্যবস্তু। শান্তির জন্যেই অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম শত্রুর বিরুদ্ধে। জয়ী আমাদের হতেই হবে … দেশমুক্তির জন্যে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী যুদ্ধ করেছেন। ভারতে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয়নি, উচিতও না। আমার গেরিলাদের বলতাম, দেশের লোককে বলতে, তারা যেন অপ্রয়োজনে দেশত্যাগ না করেন। প্রত্যেকেরই লড়তে হবে। গেরিলা যুদ্ধে সবচে যা বেশি প্রয়োজন, তা হচ্ছে গণ-আবরণ। সাতকোটি মানুষ এই আবরণ সৃষ্টি করে রেখেছিল।
উৎসঃ খালেদ মোশাররফ; সেক্টর কমান্ডাররা বলছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা; সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির।
৩২. পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ১১নং সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে একটা জিনিস দেখে বার বার অবাক হয়েছি। দেখেছি প্রত্যয় আর দৃঢ়তায় সকালের সূর্যের মত হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য নির্বাচিত না হতে পেরে অতৃপ্তির ব্যথা নিয়ে ফিরে গেছে, তারপর যুব শিবিরে অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন, কখন জীবন দেবার ডাক আসে। … পৃথিবীতে এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে যোগ দেয়ার দৃষ্টান্ত আর নেই। গণচীন থেকে শুরু করে ইন্দোচীনের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কোনটাই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মত এ দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতির সঙ্গে। সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব ছাড়া বাংলার তরুণরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই। মুক্তিযোদ্ধারা এই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে - অন্য কেউ নয়। যদি কোন দল বা গোষ্ঠী এককভাবে মুক্তিযোদ্ধা তথা জনগণের এই বিজয়কে নিজের বলে মনে করে তা হবে অবৈধ, মিথ্যা।
উৎসঃ কর্নেল তাহের; সেক্টর কমান্ডাররা বলছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা; সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির।
৩৩. জাপানে এটম বোমার আক্রমণের সত্যিই কি কোনও প্রয়োজন ছিল? এমন কথিত আছে যে প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রটির বিষ্ফোরণের সময় প্রিন্সটনের সেন্টার অব এডভান্সড স্টাডিজের গবেষণা কক্ষে আলবার্ট আইনস্টাইন মাথায় হাত দিয়ে মুখ কালো করে বসেছিলেন। হাহাকার করেছেন অন্য অনেক বৈজ্ঞানিক। কিন্তু তারাই এই অস্ত্র তুলে দিয়েছেন এক রাষ্ট্রনায়কের হাতে। এই অস্ত্র যে মানব সভ্যতার ওপরই চরম আঘাত করতে পারে সেটুকু বোঝা মতো ক্ষমতা ওপেনহাইমারদের ছিলো না?
উৎসঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়; অর্ধেক জীবন, পৃষ্ঠা - ৬৩
৩৪. ইতিহাস রচনার পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আগেকার ঐতিহাসিকদের রচনার কোনো মূল্যই নেই। তা ছাড়া এখানে তাঁদের পান্ডিত্য সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির যে অসম্পূর্ণতা, তা অনেক সময়ই তাদের যুগেরই অসম্পূর্ণতা। কেননা যে-কোনো ঐতিহাসিক নিজের অজ্ঞাতসারেই তাঁর নিজের যুগের প্রতিনিধি।
উৎসঃ রোমিলা থাপার; ভারতবর্ষের ইতিহাস; অনুবাদ - কৃঞ্চাগুপ্তা, পৃষ্ঠা – ৭
৩৫. ভাবি খাবার নিয়ে এলেন। আমাকে প্রথমে চিনতে পারলেন না, মুখে দাড়ি বলে। পরে চিনতে পেরে খুব হাসলেন। কিছু ব্যক্তিগত কথার পর বললাম, ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে আর আমরা এখন পালিয়ে বেড়াই। যত তাড়াতাড়ি পারো ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা কর।’ মুজিব আমার কথার উত্তর না দিয়ে মোহাইমেন সাহেবের দিকে ফিরে বললেন, ‘কি মোহাইমেন, ঠিক বলেছিলাম না আমি? তোয়াহার মাথা খুব পরিষ্কার।’ তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘আমিও তোমার সঙ্গে একমত। তোমরা আমাকে সাহায্য করবে এ ব্যাপারে।’
উৎসঃ মোহাম্মদ তোয়াহা; পাক্ষিক তারকালোকে আহমেদ মূসাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে; ১৬-৩১ ডিসেম্বর সংখ্যা - ১৯৮৭
৩৬. আমি কামালকে বললাম, কি করছো তুমি এখানে? উত্তরে কামাল আমাকে জানালো কিছু দিন হয় সে ট্রেনিং সেরে এখানে এসেছে। এখনও তার পোস্টিং সে জানে না। অপেক্ষা করছে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম মুজিবনগর সরকারের একাধিক কর্তাব্যক্তি ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ চেষ্টা চালাচ্ছে শেখ কামালকে রণাঙ্গনে না পাঠাতে। কেউ কেউ চাইছেন তাকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী অথবা সর্বাধিনায়কের এডিসি করে যুদ্ধের অনিশ্চয়তা ও বিপদ থেকে দূরে নিরাপদ অবস্থানে রাখতে। এসব আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যে করেই হোক কামালকে ৮নং থিয়েটার রোডেই রেখে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
উৎসঃ কাজী নূর উজ্জামান; সেক্টর কমান্ডাররা বলছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা: সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির।
৩৭. আমার মনে পড়ে ‘ভট্টাচার্য’ নামক দশ বছরের একটি ছেলে বেগের বিশেষ ‘বাহিনীতে’ যোগ দেয়। এই বিশেষ বাহিনীটির নাম ‘হার্ড কোর অব সার্জেন্টস্’। এর বিশেষত্ব ছিল বারো বছরের ঊর্ধ্বে কোনো বালককে এই বাহিনীতে নেয়া হতো না। নতুন এসেও, ভট্টাচার্য কঠিন পরিশ্রমের বলে সার্জেন্ট মেজরের পদে উন্নীত হলো। সে নিজে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। উপরন্তু, চারদিকে শত্রু থাকা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান, শক্তি, সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ রাস্তায় পারুলিয়া ব্রীজের খুঁটিনাটি - সব মূল্যবান সংবাদ সংগ্রহের জন্য তার ক্ষুদে বাহিনীকে যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করেছে ...
উৎসঃ মেজর জলিল; সেক্টর কমান্ডাররা বলছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা: সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির।
৩৮. আমার ধারণা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যদি আরও প্রলম্বিত হতো, ভারতীয় বাহিনী যদি যুদ্ধে জড়িয়ে অকস্মাৎ যুদ্ধের ছেদ না টানত তা হলে এদেশের ইতিহাস হতো ভিন্ন। যুদ্ধের পর সুবিধাবাদ, স্বজনপ্রীতি, স্বৈরচিন্তা, দুর্নীতি-লুণ্ঠন ও আত্মকেন্দ্রিকতার যে চিত্র আমরা দেখেছি, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে ঘটত না। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়েই মানুষের চেতনা আরও শাণিত হতো, আরও বলীয়ান হতো। যুদ্ধ চলাকালেই ঝরে যেত সুবিধাবাদী পরগাছারা, দুর্নীতবাজ ও লুটেরারা। সামনে চলে আসত দেশপ্রেমিক নির্লোভ নেতৃবৃন্দ। ক্ষমতা চলে যেত যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ ও তাদের প্রতিনিধিদের হাতে। সম্ভবত এই ভয়েই যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ও অনিচ্ছুক তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি টানতে চেয়েছেন। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এমন একটা যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে যে-যুদ্ধ তারা আহ্বান করেননি।
উৎসঃ আবদুল মান্নান ভুঁইয়া; বাংলাদেশের রাজনীতি ও সুশাসন ভাবনা, পৃষ্ঠা - ২৩
৩৯. ২৭ মার্চ বিকেলে পরিষ্কার শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এই ঘোষণা শুনে আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এই ভেবে যে, হ্যাঁ, এখন মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারণ তাদের সঙ্গে বাঙালি সেনারাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে। মানুষ পাকিস্তানি হামলার কথা আগেই জেনেছিল। কিন্তু এই ঘোষণার ফলে বিষয়টি সব স্তরে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, সবাই ঘটনা জানতে পারে।
উৎসঃ এস আর মীর্জা; মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন: প্রথমা প্রকাশন।
৪০. কিসিঞ্জার: আমরা ইয়াহিয়াকে সন্তুষ্ট রাখবো।
নিক্সন: ভারতের আসলে দরকার ... তাদের জন্য আসলে দরকার ...
কিসিঞ্জার: দে আর সাচ বাস্টার্ডস।
নিক্সন: দরকার একটা মহাদুর্ভিক্ষ। কিন্তু তা হচ্ছে না। কারণ আমরা তাদের খাওয়াচ্ছি। নতুন ধরনের গম খাওয়াচ্ছি। কিন্তু দুর্ভিক্ষ না হলে শেষ পর্যন্ত তাদের দরকার বড় ধরনের একটা যুদ্ধ। লেট দ্য গডড্যাম ইন্ডিয়ানস ফাইট এ ওয়ার।
উৎসঃ মার্কিন গোপন দলিল - ২; মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন দলিল: জগলুল আলম।
৪১. আমরা যখন নরসিংদী মুক্ত করি, ভারতীয় বাহিনী তখন নরসিংদী থেকে অনেক দূরে। মাত্র ভৈরব পর্যন্ত পৌঁছেছে। টি.অ্যান্ড.টি. ক্যাম্প দখল করে সেখানে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। ক্যাম্প দখলের পর ভেতরে ঢুকে অস্ত্রের সম্ভার দেখে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। ঘরবোঝাই হালকা ও ভারী মেশিনগান। থরে থরে সাজানো রকেট লঞ্চার আর দুই ইঞ্চি মর্টার। অফুরন্ত গোলাগুলি আর গ্রেনেড। এত অস্ত্র আজ আমাদের হস্তগত। অথচ পুরো যুদ্ধের সময় অস্ত্রের কত অভাবই না আমরা বোধ করেছি। … ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার ও কয়েকজন ভারতীয় সৈনিক, তাঁরা আমাদের নরসিংদী মুক্ত করার জন্য ধন্যবাদ জানালেন এবং ঐ ক্যাম্পের দায়িত্ব তাঁদের হাত ছেড়ে দিতে বললেন। আমরা দখল করা অস্ত্রসম্ভার ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে মনটা খারাপ করেই শিবপুর ফিরে এলাম।
উৎসঃ হায়দার আনোয়ার খান জুনো; একাত্তরের রণাঙ্গন: শিবপুর।
৪২. একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তা-ই আমায় গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।
উৎসঃ শেখ মুজিবুর রহমান; অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের প্রারম্ভ-নোট।
৪৩. এরপর গেলাম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছে। তিনি মায়াভরা কন্ঠে বললেন, ‘দেখ, আমি বুড়ো হয়ে গেছি। আমাকে নিয়ে আর টানাটানি করো না। আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও।’ হঠাৎ এক পর্যায়ে আমাদের নাম জানতে চাইলেন। নাম বলতেই তিনি বললেন, ‘তোমরা মুসলমান ছেলে? না-না, তাতো আমি আগে বুঝতে পারিনি। মুসলমান ছাত্রদের আমি ফেরাতে পারি না। আমি নিশ্চয়ই তোমাদের অনুষ্ঠানে যাব।’ তারপরে বললেন, ‘জানো, আমার মুসলমান ছাত্রদের আমি সবসময়ই বিনয়ী হতে দেখেছি।’
উৎসঃ আবু সাঈদ চৌধুরী; পাক্ষিক তারকালোক; সেপ্টেম্বর ১৯৮৭, অনুলিখন - আহমেদ মূসা।
৪৪. রাজদরবার থেকে সাহিত্যকে ছিনিয়ে এনে আমরা রাস্তায় স্থাপন করেছি পানির কলের মতো। আমরা বলছি, এসো ভাই-বোনেরা, যারযার প্রয়োজনমতো নিয়ে যাও। বিশ্বব্যাঙ্কের মতো আমরা তোমাদের ধোঁকা দেব না। এটা ঋণ নয়। আর পূর্বসুরীদের সাহিত্য-বাণিজ্যকে আমরা ভেঙ্গে দিয়েছি।
উৎসঃ অ্যালেন গিন্সবার্গ; নাসির আলি মামুনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে: ঈদসংখ্যা অন্যদিন - ২০০৭।
৪৫. রেশনের ঘাটতি সম্পর্কে এসব কি শুনছি আমি? এই দেশে কি গরু-ছাগল কিছুই নেই? এটা শত্রুর এলাকা। যা দরকার, যা চাও, এখান থেকে নিয়ে যাও, কেউ বাধা দেবে না। আমরা বার্মায়ও এ রকম করেছি একসময়। ... ‘সুইপ অপারেশনের’ সময় যা প্রয়োজন তা সংগ্রহ করার লিখিত আদেশ পর্যন্ত তাদের দেওয়া হয়েছিল।
উৎসঃ জেনারেল নিয়াজী; বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ: বৃটিশ দলিলপত্র, পৃষ্ঠা - ২৭০
৪৬. তেলিয়পাড়ায় যে সভা হয়েছিল, সেখানে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটা সরকার গঠন করা প্রয়োজন। এই সরকার স্বাধীনতা ঘোষণা করবে এবং সেই সহকারের অধীনেই যুদ্ধ পরিচালিত হবে - এ বিষয়ের ওপর তাঁরা জোর দেন। এটা ছিল একটা মনুমেন্টাল সিদ্ধান্ত। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ চালানোর পক্ষে এবং স্বাধীন সরকার গঠনের পক্ষে তখনই একটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শক্তি তৈরি হয়ে গেল। নয় মাসের যুদ্ধকালে আপস-মীমাংসার কথা বারবার উঠেছে। হয়তো রাজনৈতিক নেতারা আপস-মীমাংসায় যেতে পারতেন। কিন্তু এই বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তা ও সেনাদের পক্ষে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ খোলা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের এটা ছিল একটা শক্তিশালী অবলম্বন।
উৎসঃ মঈদুল হাসান; মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন, পৃষ্ঠা - ৯
৪৭. ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের অধিকাংশই কর্মজীবনে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাদের অনেকে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই নামের তালিকা অনেক দীর্ঘ। সে তালিকায় নারী পুরুষ উভয়েই আছেন। আছেন রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা, প্রশাসনিক প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, গবেষক, শিক্ষক, উন্নয়ন কর্মী, সেনা কর্মকর্তা, পরিবেশবিদ, চিকিৎসক, আইনজীবী, বিচারক প্রায় সব পেশার সদস্য। ... এদের কেউ কেউ আবার আন্তর্জাতিকভাবে দেশের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন পর্বতসম উচ্চতায়। এদেশের নেতৃস্থায়ী কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিত্র নির্মাতা, কণ্ঠ শিল্পী, চিত্র শিল্পী, নাট্যাভিনেতা নাট্য নির্দেশকদের অনেকেই ছাত্র জীবনে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী। পাকিস্তান সরকারের হাতে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতিতদের তালিকায়ও এদের সংখ্যা সবচে বেশি। এরা বিরোধীদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকারও হয়েছেন।
- মাহফুজ উল্লাহ
উৎসঃ মাহফুজ উল্লাহ; পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের গৌরবের দিনলিপি, পৃষ্ঠা - ৯
৪৮. বুকের ছাতি আর উচ্চতার মাপ দিয়ে তাদের মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে হয়নি। তাঁদের আকাশ ছোঁয়া সাহস সংকল্প আর মনের আগুনই ছিল মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য যথেষ্ট … এই আগুন আর সংকল্পটাকে মূলধন করে, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, অস্ত্রের ভাষা শিখিয়ে একেকটা দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেওয়ার জন্য। মতিনগরের দর্শন ছিল একটাই - নদীর স্রোতের মতো যে ছেলেরা আসছে, তাদের গ্রহণ করা। থাকার ঘর নেই, খাওয়া নেই, যথেষ্ট অস্ত্র নেই, কুচ পরোয়া নেই। মতিনগরে অনেক গাছ আছে। গাছ কেটে ডালপালা দিয়ে ঘর বানাও। পাতা দিয়ে বিছানা পাতো। থাকুক না দু-একটা পোকামাকড় বা বিছা। খাবার যা আছে ভাগ করে খাও। প্লেট নেই, তো গ্রেনেডের চোঙা কেটে প্লেট বানাও। অস্ত্র নেই তো কি হয়েছে, পাকিস্তানিদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে আসো।
উৎসঃ মেজর (অব.) ডা. আখতার আহমদ বীর প্রতীক; মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্তক বিদায়: জহিরুল ইসলাম, পৃষ্ঠা - ৬৭
৪৯. হিমু-বিষয়ক প্রতিটি লেখাতেই আমি এই ভুবনের রহস্যময়তার দিকে ঈঙ্গিত করেছি। এর বেশি কিছু না। আমি নিজে জগতের রহস্যময়তা দেখে প্রতিনিয়ত অভিভূত হই। আমি চাই আমার পাঠকরাও অভিভূত হোক।
উৎসঃ হুমায়ূন আহমেদ; উপন্যাস ‘হিমু এবং Phd বল্টু ভাই, পৃষ্ঠা - ৭
৫০. অতিশয় দুর্বল দু’একটি রচনা প্রসব করে, মাথায় অহংকারের বিশাল বোঝা নিয়ে চারপাশে কাউকে কাউকে ঘুরে বেড়াতে দেখি, কিন্তু সত্য বলতে কি তাদের দিকে তাকিয়ে আমার বড় মায়া হয়। বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ওরা জানে না বাংলা সাহিত্যের জল কতদূর গড়িয়ে গেছে।
উৎসঃ ইমদাদুল হক মিলন; অন্তরঙ্গ ইমদাদুল হক মিলন: শহিদুল ইসলাম মিন্টু, পৃষ্ঠা - ৭
৫১. মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন, রক্তের বন্যায় ভেসে যেত চারদিক। একটা পা উড়ে গেছে, হাত নেই, গুলি লেগেছে বুকে। অথচ তার পরও সে কী উদ্দীপনা তাঁদের চোখেমুখে! অপারেশন হতো, একটু ভালো হতে না হতেই দেখতাম তাঁরা হাওয়া। চিরকুট রেখে গেছেন - “আবার যুদ্ধে যাচ্ছি।” ওই সময়টায় আমরা বোরকা পরে যেতাম একেক জায়গায়। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতাম। আর তখনই মনস্থির করলাম, চিকিৎসক হব।
উৎসঃ ডাঃ নায়লা খান; মুক্তিযুদ্ধে নারী, পৃষ্ঠা - ৬১
৫২. বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে এখনো সফলভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই জীবন এখানে বিকারগ্রস্ত। এখানে ধনী, গরীব, শিক্ষিত, নিরক্ষর জাতীয়ভাবে সবাই হীনমন্যতায় ভোগে। এগুলিকে ভাল বলার কিছু নেই। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের আকাংক্ষা আছে। নেতৃত্ব গড়ে তোলা গেলে মানুষ জাগবে। জাতি এখন ঘুমন্ত অবস্থায় বলা যায়।
উৎসঃ আবুল কাসেম ফজলুল হকের রচিত আটাশ দফার ভূমিকা। প্রকাশ করেছে স্বদেশ চিন্তা সংঘ।
৫৩. পুরো লেখা হাতে পাওয়ার পর মৌলানা আজাদ ঠিক করেন যে, পান্ডুলিপির গোটা তিরিশেক পৃষ্ঠা আপাতত প্রকাশ হবে না; এই অংশে প্রধানত ব্যক্তিগত গোছের কিছু ঘটনা আর মন্তব্য ছিল। পুরো পান্ডুলিপির একটি করে কপি শিলমোহর করে কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে ও নয়াদিল্লীর জাতীয় মোহাফেজখানায় গচ্ছিত করে রাখার তিনি নির্দেশ দেন।
উৎসঃ ভারত স্বাধীন হল - পূর্ণাঙ্গ সংস্করণঃ কথক মৌলানা আজাদ, অনুলেখক হুমায়ুন কবীর। বাংলায় অনুবাদঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। গ্রন্থের ১৯৫৯-সংস্করণের মুখবন্ধ থেকে।
৫৪. তুমি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সূত্র মেলাতে পারবে না। শুধুমাত্র পেছনের দিকে তাকালেই সব বুঝতে পারবে। যে-কোনো সময় আমি মারা যেতে পারি, এমনটা ভেবে নেয়া, আমার জীবনের বড় সিদ্ধান্তগুলি নেয়ার পেছনে অনেক কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল।
উৎসঃ স্টিভ জবসের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে। ভাষণের একটি অংশ ইদানিং ফেসবুকে ভিডিও আকারে প্রচারিত হচ্ছে।
৫৫. অধঃপতনের ধূম চারিদিকে,সভ্যতার সেয়ানা গুন্ডার মতো
মতবাদ, রাজনীতি, শিল্পকলা শ্বাস ফেলছে এদিকে ওদিকে,
শহরের সবদিকে সাজানো রয়েছে শুধু শাণিত দুর্দিন, বন্যা অবরোধ আহত বাতাস!
এই যে জ্বলছে চাঁদ জ্যোৎস্না আর জ্যোৎস্না ফুল।
জ্বলছে এই যে স্বপ্ন, স্মৃতি, শব্দ, অলঙ্কার, অভাবের মরিচীকা।
এ শহর কার?
উৎসঃ কবি আবুল হাসান; জন্মঃ ১৯৪৭, ৪ আগস্ট - মৃত্যুঃ ১৯৭৫, ২৬ নভেম্বর। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে আমান-উদ-দৌলার ফেসবুকে প্রকাশিত স্ট্যাটাস থেকে।
৫৬. আমার বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স পাঁচ। বাবার (দীননাথ মঙ্গেশকর) মৃত্যুর পর আমাদের পারিবারিক অবস্থা খুবই সংকটপূর্ণ হয়ে পড়ে। মা আমাদের নিয়ে হিমশিম খেয়েছেন। তাই ওই সময় আলাদা করে জন্মদিন নিয়ে ভাবার সময় পাইনি। তবে আমার কাছে জন্মদিনের সেরা উপহার বাবা-মায়ের আশীর্বাদ। জন্মদিনে তাঁদের কথা বেশি মনে পড়ে।
উৎসঃ লতা মঙ্গেশকর; প্রথম আলো, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
৫৭. আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধে আব্বা লিখতে শুরু করেন। যতবার জেলে গেছেন আমার মা খাতা কিনে জেলে পৌঁছে দিতেন। আবার যখন মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলি সংগ্রহ করে নিজে সযতনে রেখে দিতেন। তাঁর এই দূরদর্শী চিন্তা যদি না থাকত তাহলে এই মূল্যবান লেখা আমরা জাতির কাছে তুলে ধরতে পারতাম না।
উৎসঃ শেখ হাসিনা; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থের ভূমিকার শেষাংশ থেকে, পৃষ্ঠা - ১৬
৫৮. বিচারহীনতা মানেই দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতার অভাব। এটা সত্যি, বাতাসে ভয়ের আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক।
উৎসঃ এনামুল হক, সাবেক আইজি; বাংলা ট্রিবিউন, ২৮ নভেম্বর ২০১৭।
৫৯. যদি এই গুমের পেছনে রাষ্ট্রীয় মদত থাকে বা রাজনৈতিক কোনও স্বার্থ থাকে কিংবা রাষ্ট্র যদি এক্ষেত্রে কোনও উদাসীনতা দেখিয়ে থাকে, তাহলে এই গুমের নৃশংসতা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। গুম একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং এই অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবেও আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি।
উৎসঃ মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন; বাংলা ট্রিবিউন, ২৮ নভেম্বর ২০১৭।
৬০. ধাঁধা বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। পায়ের তলার ধূলামাটি থেকে শুরু করে সুদূর আকাশের ছোট্ট তারাটি পর্যন্ত ধাঁধার খোরাক জুগিয়েছে। ধাঁধার মধ্যে জনসাধারণ নিজের অভিজ্ঞতাকে সুন্দরভাবে রূপ দিয়েছে। পল্লী বাংলার ধাঁধার মধ্যে সঞ্চিত করে রেখেছে। পল্লীর অতিসাধারণ জনগণ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেও জীবনে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে। ধাঁধা পল্লীর জনগণের অর্জিত অভিজ্ঞতাকে প্রশ্নের আকারে লিপিবদ্ধ করে। ধাঁধা হল পল্লীর গণসমাজে অতি সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষার উপায়। ধাঁধা পল্লী বাংলার আপামর জনসাধারণের মনে জীবন ও জগতকে জানার কৌতুহল সৃষ্টি করে।
উৎসঃ ড. শীলা বসাক; বাংলা ধাঁধার বিষয়বৈচিত্র্য ও সামাজিক পরিচয়, পৃষ্ঠা -১। পুস্তক বিপণি।