পাগলা ঘোড়া যখন বিন্দু থেকে সিন্ধু
বাল্যকালে প্রতিবেশি এক দরিদ্র মহিলাকে প্রতিরাতেই, ‘পাগলা ঘোড়ারে, কই থাইকা কই লইয়া যাস’ লাইনটি বিনিয়ে বিনিয়ে গাইতে শুনতাম। লাইনটি বহুকাল থেকে চলে আসা একটি বাংলা প্রবচন। নদীভাঙা পরিবারটি আমাদের পাশের বাড়িতে এসে উঠেছিল। দীর্ঘাঙ্গী, গৌরবর্ণের প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই মহিলার ছিল তিনটি কন্যা। মেয়েদের তিনি প্রচন্ড ভালোবাসতেন। তাই সবাইকে তিনি খুব কাছাকাছি বিয়ে দেন। এরমধ্যে অভাবের তাড়নায় দূরের এক জেলায় চলে যেতে হয় এক মেয়েকে। আরেকজন হয়ে পড়েন অকাল-বিধবা। সেই বিচ্ছেদ প্রতিরাতেই মহিলাকে এক লাইনের একটি গানের গায়িকা করে তুলেছিল। এই লাইনটি তিনি আমার বুকেও খোদাই করে তার পাগলা ঘোড়ার সওয়ারি করে দিয়ে গেছেন। এই ‘পাগলা ঘোড়া’ বারবার ঘুরে-ফিরে এসেছে আমার সৃজনশীল কাজে।
১৯৯৪ সালে নদীভাঙা মানুষ নিয়ে আমি ধারাবাহিক মাটির মায়া লেখার সময় এই একটি লাইনকে একটি পূর্ণ গানের রূপ দেই। এর আগে এই লাইনটিকে সামনে রেখে অন্য কারো লেখায় পূর্ণ গান হিসেবে ছিল কী না আমার জানা নেই ; হয়তো কেউ কেউ তাদের সুরে ও কথায় গেয়ে থাকতে পারেন, এবং এর সম্ভাবনাই বেশি। আমার গানের সুর আমিই করি। ‘পাগলা ঘোড়ারে, কই থাইকা কই লইয়া যাস’ লাইনটি দ্বিতীয় লাইনে নিয়ে এসে প্রথম লাইনে যুক্ত করি, ‘দড়ি ছিইড়া পরাণ কাইরা কইরা সর্বনাশ ’...। পেছনে যোগ করি আরো ডজনখানেক লাইন। গোটা সিরিয়াল জুড়ে গানটি একলাইন, দুইলাইন করে গাওয়া হয়। শেষ পর্বে পুরোটি গাওয়া হয় সুর সামান্য বদল করে। গেয়েছিলেন মীনা বড়ূয়া। এরপর মীনা বড়ূয়ার প্রায় সব গানের অনুষ্ঠানেই তিনি অনুরোধ পেতেন এই গানটি গাইতে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও তিনি এটি গেয়েছিলেন, যেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমার লেখার প্রায় দেড় যুগ পর হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকে ‘পাগলা ঘোড়ারে .. কুদ্দুস বয়াতি গেয়েছেন অন্য সুর ও কথায়। সেটিও অনবদ্য গান হয়ে ওঠে। এরপর নগর বাউল, উয়িন্ড অব চেঞ্জ প্রভৃতি ব্যান্ড-এর রোদেলা দোলা, তাপস, কাশফি প্রমুখ শিল্পীর মাধ্যমে গানটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যান্ড ভিন্ন কথা ও ঢঙে উপস্থাপন করছে, যদিও ‘পাগলা ঘোড়ারে, কই থাইকা কই লইয়া যাস’ এর সঙ্গে আমার যুক্ত করা ‘দড়ি ছিইড়া পরাণ কাইরা কইরা সর্বনাশ ’ লাইনটিও কমন হয়ে উঠেছে। এমনকি কুদ্দুস বয়াতিও এখন আমার লাইন তার গানে যুক্ত করছেন। অবশ্য আসিফেরটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার ‘দড়ি ছিইড়া পরাণ কাইরা কইরা সর্বনাশ ’-এর জায়গায় তার গানে রয়েছে ‘যখন তখন আমায় দিয়া কাটাইয়া নেস ঘাস’ লাইন। গীতিকার হিসেবে মারজুক রাসেল এবং টিউনে এসআই টুটুলের নাম রয়েছে। এটিও খুবই শ্রুতিমধুর।
প্রবাদ-প্রবচনের একটি বাক্যও বিন্দু থেকে সিন্ধু সৃষ্টি করতে পারে। ‘পাগলা ঘোড়ারে, কই থাইকা কই লইয়া যাস’ তেমনি এক সিন্ধুর উৎস। আমার পরম সৌভাগ্য, এই সিন্ধুর সঙ্গে খাল হিসেবে এখন যুক্ত হয়ে গেছে আমার ‘দড়ি ছিইড়া পরাণ কাইরা কইরা সর্বনাশ ’- লাইনটিও। তবে কখনো কখনো গানের ভিন্ন ভিন্ন গীতিকারদের কথাও যদি আজকের শিল্পী বা উপস্থাপকরা দর্শক-শ্রোতাদের একটু বলেন তা হলে সেটা শুধু আনন্দেরই হবে না, হবে পূর্বসুরীদের ঋণ স্বীকারও; যে ঋণ বিশ্ব ব্যাংকের বিলিয়ন ডলারের ঋণ না হলেও ডঃ ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণ তো বটেই। ফেসবুক বন্ধুদের জন্য গানটির বিভিন্ন সুর ও শিল্পীর ৩টি লিঙ্ক দিলাম। অবশ্য আমার লেখা পুরো গানটির লিঙ্ক এই মুহূর্তে আমার হাতের কাছে নেই। জোগাড়ের চেষ্টায় আছি।