Milu coaching centre
কর্তার ভূত
‘কর্তার ভূত’ রচনাটি রবি ঠাকুরের ‘লিপিকা’ (১৯২২) গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের এমন কিছু রচনাও আছে যেগুলি সাহিত্যের কোনো চেনা প্রকরণের মধ্যে পড়ে না। অর্থাৎ, সেগুলি গল্পও নয়, প্রবন্ধও নয়। ‘লিপিকা’র রচনাগুলিও সেই শ্রেণিতে পড়ে।
‘লিপিকা’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘কর্তার ভূত’ একটি রাজনৈতিক রূপক কাহিনী। রূপক কাহিনি বলতে সেই কাহিনিকে বোঝায় যার একটি অন্তর্নিহিত অর্থ থাকে। আলোচ্য গল্পে লেখক গল্পচ্ছলে উনিশ শতকের ভারতীয় সমাজের চালচিত্র তুলে ধরেছেন। গল্পটি আয়তনে ছোটো হলেও এর বিষয় ভাবগম্ভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
মনে রাখা দরকার, ‘কর্তার ভূত’ কোনো ভূতের গল্প নয় বরং বিজ্ঞানমনস্কতার গল্প। ‘ভূত’ শব্দের অর্থ অতীত এবং ভূত বলতে প্রেত, অশরীরী আত্মা ইত্যাদিকেও বোঝায়। এই গল্পে লেখক একদিকে যেমন ভারতীয়দের অতীতপ্রীতির দিকটি তুলে ধরেছেন, তেমনি ভূতের মূলে যে ভয়ের অস্তিত্ব থাকে সেই দিকেও আলোকপাত করেছেন। এরপর মূল গল্পের সারবস্তুটুকু দেখে নেওয়া যাক।
উনিশ শতকে সারা পৃথিবী যখন পুরাতন ধর্মতন্ত্রকে বিদায় জানিয়ে বিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছে তখন শুধু ভারতের মানুষ পুরাতন অচল ধর্মতন্ত্রকে নিয়ে বাঁচতে চাইছে। ভারতের মানুষ পুরাতনপন্থী এবং নতুন কিছুকে সহজে আয়ত্ত করতে দ্বিধা বোধ করে। সেইজন্য যখন সবাই শুনল যে পুরাতন ধর্মতন্ত্রের দিন শেষ হয়ে এসেছে সবাই ভাবতে বসল এবার তাদের কী হবে? নতুন কিছু এলে পুরাতনকে সরে যেতেই হয়। এটাই কালের নিয়ম। তাই ভারতের বুক থেকেও ধর্মতন্ত্র বিদায় নিল কিন্তু ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ ধর্মতন্ত্রের কঙ্কালকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইল। কর্তা অর্থাৎ ধর্মতন্ত্র রইল না কিন্তু কর্তার ভূত অর্থাৎ পুরোহিততন্ত্র কায়েম রইল। চারিদিকে বিজ্ঞানের জয়জয়কার আর তার মাঝে ভারতে চলে ভূতের রাজত্ব।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে ‘ভূতের রাজত্ব’ আর কতদিন চলবে? পৃথিবীর বাকি সব দেশ বিজ্ঞানের চর্চা করে নিজেদের উন্নতি করছে আর ভারতের মানুষ তখনো ভূতের সেবায় মগ্ন। ভারতীয় সমাজ যেন ভূতের জেলখানা। এমন এক অদৃশ্য বন্ধনে সবাই জড়িয়ে পড়েছে যে ইচ্ছে করলেও কারো সাহস হয় না ‘ভূতের রাজত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন করার। শেষমেষ দু’একজন বুড়ো কর্তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে যে ভূতের রাজত্ব আর কতদিন? কর্তা উত্তর দেন তিনি ধরে রাখেননি, ভারতীয়রাই ভুতকে জড়িয়ে ধরে আছে- তারা ছাড়লেই ছাড়া। এর উত্তরে তারা জানায় যে তাদের ভয় করে। কর্তা বলেন যে এই ভয়ই হল ভূতের মূল।
রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর
১) “ওরে অবোধ, আমার ধরাও নেই, ছাড়াও নেই, তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া।”এখানে কে কাদের অবোধ বলেছেন? উক্তিটির তাৎপর্য আলোচনা কর।
উত্তরঃ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ গল্পে বুড়ো কর্তা ‘ভূতগ্রস্ত’ দেশবাসীকে ‘অবোধ’ বলে সম্বোধন করেছেন।
গল্পের শেষ অংশে কর্তার এই কথাটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কর্তা মারা যাওয়ার পর দেশবাসী মনে করল যে কর্তা ভূত হয়ে তাদের ধরে রেখেছে। কর্তার অভিভাবকত্বে অনেকে শান্তি অনুভব করলেও দেশের নবীন প্রজন্ম বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এরকম অবস্থায় দেশের দু-একজন মানুষ যারা দিনের বেলায় ভুতুড়ে নায়েবের ভয়ে মুখ খুলতে পারে না, গভীর রাতে কর্তার শরনাপন্ন হয়। কর্তাকে তারা জিজ্ঞাসা করে যে কখন তিনি ছাড়বেন। কর্তা দেশবাসীকে অভয় দিয়ে বলেন-“তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া”।
কর্তা সম্পূর্ণ বাস্তব কথাই বলেছেন। আসলে কর্তা তো তাদের ধরে রাখেনি বরং তারাই কর্তাকে ধরে রেখেছে। কর্তা অনেক আগেই গত হয়েছেন কিন্তু পুরাতনপন্থী মানুষেরা নতুনের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না বলেই কর্তার ভূতকে আঁকড়ে ধরে পড়ে ছিল। কর্তার ভূতের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই- জ্ঞানবিমুখ, ধর্মভীরু মানুষের মনেই তার আধিপত্য। মনোবিজ্ঞান অনুসারে, মানুষের ভয় থেকেই ভুতের জন্ম হয় এবং মানুষই তাকে পোষণ করে। কর্তার ভূত প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য।
2) প্রশ্ন- “কেননা ভবিষ্যতকে মানলেই তার জন্য যত ভাবনা, ভূতকে মানলে কোন ভাবনাই নেই”- কোন প্রসঙ্গে এই কথাটি বলা হয়েছে? ভূতকে মানলে ভাবনা নেই কেন? উদ্ধৃত অংশটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘কর্তার ভূত’ গল্প থেকে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে। বুড়ো কর্তা যখন মরণাপন্ন হলো তখন দেশের সবাই বলে উঠেছিল ‘তুমি গেলে আমাদের কি দশা হবে?’ কর্তাও মনে মনে ভেবেছিলো যে তার মৃত্যুর পর দেশবাসীর অভিভাবক কে হবে। শেষ পর্যন্ত দেবতার দয়ায় একটা উপায় হয়েছিল। বুড়ো কর্তা যাতে মারা যাওয়ার পরও ভূত হয়ে দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে থাকে সেই ব্যবস্থা করা হল। দেশবাসীও নিশ্চিন্ত হল। এই প্রসঙ্গেই কথাটি বলা হয়েছে।
বুড়ো কর্তা মারা গেলে তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে সেটাই দেশের লোকের প্রধান চিন্তা হয়ে ওঠে। আসলে এই দেশবাসী ভীতু, রক্ষণশীল এবং আত্মমর্যাদাহীন। নতুন কিছুকে গ্রহন করার সাহস এবং ক্ষমতা তাদের নেই। লেখক বলেছেন- ‘ভবিষ্যতকে মানলেই তার জন্য যত ভাবনা, ভুতকে মানলে কোন ভাবনাই নেই’। কারণ, ভুতকে মানলে স্বাভাবিকভাবেই সব ভাবনা ভুতের মাথায় চাপে। কিন্তু, ভুতের মাথা নেই তাই কারো জন্য তার মাথাব্যথাও নেই।
আসলে ভুত হল অজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ হল জ্ঞান। ভবিষ্যৎকে মানতে হলে অন্ধবিশ্বাস, অজ্ঞতা ও রক্ষণশীলতাকে বিসর্জন দিয়ে নতুন করে সবকিছু ভাবতে হবে। কিন্তু দেশবাসী এই পরিবর্তন চায় না। তাই লেখক এই কথাগুলি বলেছেন।
৩। “কর্তা বলেন, ‘সেখানেই তো ভূত”- কোন প্রসঙ্গে কর্তা একথা বলেছেন ? কথাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
উত্তরঃ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ গল্পের একেবারে শেষে কর্তা এই উক্তি করেছেন।
কর্তা মারা যাওয়ার পর ভূত হয়ে দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে ছিল। এরকম অবস্থায় দেশের দু-একজন মানুষ যারা দিনের বেলায় ভুতুড়ে নায়েবের ভয়ে মুখ খুলতে পারে না, গভীর রাতে কর্তার শরনাপন্ন হয়। কর্তাকে তারা জিজ্ঞাসা করে যে কখন তিনি ছাড়বেন। কর্তা বলেন যে তিনি তো তাদের ধরে রাখেননি- তারা ছাড়লেই কর্তার ছাড়া। একথা শুনে তারা বলেন ‘ভয় করে যে কর্তা’। এরপরই কর্তা বলেন- ‘সেইখানেই তো ভূত’।
কর্তার এই কথাটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কর্তা মারা যাওয়ার পর দেশবাসী মনে করল যে কর্তা ভূত হয়ে তাদের ধরে রেখেছে। কর্তার অভিভাবকত্বে অনেকে শান্তি অনুভব করলেও দেশের নবীন প্রজন্ম বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগল যে ভূতের হাত থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু আসল সত্যটা হল এই যে কর্তা তাদের ধরে রাখেনি বরং তারাই কর্তাকে ধরে রেখেছে। এমনকি যখন কর্তা দেশবাসীকে অভয় দিয়ে বলেন-“তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া”, তখনও ধর্মভীরু দেশবাসী সেটা পেরে ওঠে না। আসল কথা হলো- কর্তার ভূতের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষের ভয় থেকেই ভুতের জন্ম হয় এবং মানুষেই তাকে পোষণ করে।
8)প্রশ্ন। কর্তার ভূত গল্পে ‘ভুতুড়ে জেলখানার’ পরিচয় দাও।
উত্তরঃ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গল্পে ‘লিপিকা’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘কর্তার ভূত’ গল্পটি একটি রূপকধর্মী কথিকা। রূপকের আড়ালে লেখক সমকালীন ভারতবর্ষের অন্তঃসারশূন্য, ধর্মতন্ত্রশাসিত সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। এই গল্পে ভারতবর্ষকে ‘ভুতুড়ে জেলখানা: এবং দেশবাসীকে ‘কয়েদি’ হিসাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে।
জেলখানা বলতে যা বুঝি সেটা চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা থাকে। এই গল্পের ভূতুড়ে জেলখানাটির প্রাচীর অবশ্যই আছে কিন্তু সেই প্রাচীর কারো চোখে পড়ে না। ভুতের শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেকেই জেলখানার দেওয়ালে গর্ত করার কথা ভাবে। কিন্তু চোখে দেখা যায় না বলে সেই প্রাচিরে কেউ ফুটো করতে পারে না। এর ফলে দেশের লোককে ভুতুড়ে জেলখানায় আজীবন হাজতবাস করতে হয়।
রূপকের আড়ালে বাস্তব সত্যটি হল এই যে, রক্ষণশীল দেশবাসী নতুনকে স্বাগত জানাতে ভয় পায় বলে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যকে অর্থাৎ ধর্মতন্ত্রকে অবলম্বন করে বাঁচতে চায়। এই ধর্মতন্ত্র অনুদার, বদ্ধ এবং প্রগতির পরিপন্থী। পুরাতন রীতি সর্বস্ব ভারতীয় সমাজব্যবস্থাই হলো ‘ভুতুড়ে জেলখানা’ আর প্রাচীনপন্থী ভারতবাসীরা হল সেই জেলখানার কয়েদি। জেলখানায় যেমন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় তেমনি ভুতুড়ে জেলখানার কয়েদিরা সারাদিন ঘানি টানে আর শরীরের সমস্ত তেজ হারিয়ে হিমশীতল শান্তি অনুভব করে।
৫)প্রশ্ন- “দেশের লোক ভারি নিশ্চিন্ত হলো”- কোন প্রসঙ্গে একথা বলা হয়েছে? নিশ্চিন্ত হওয়ার কারণ কি? (২+৩)
উত্তরঃ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘কর্তার ভূত’ গল্প থেকে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে। বুড়ো কর্তা যখন মরণাপন্ন হলো তখন দেশের সবাই বলে উঠেছিল ‘তুমি গেলে আমাদের কি দশা হবে?’ কর্তাও মনে মনে ভেবেছিলো যে তার মৃত্যুর পর দেশবাসীর অভিভাবক কে হবে। শেষ পর্যন্ত দেবতার দয়ায় একটা উপায় হয়েছিল। বুড়ো কর্তা যাতে মারা যাওয়ার পরও ভূত হয়ে দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে থাকে সেই ব্যবস্থা করা হলো। এই প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে “দেশের লোক ভারি নিশ্চিন্ত হল”।
বুড়ো কর্তা মারা গেলে তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে সেটাই দেশের লোকের প্রধান চিন্তা হয়ে ওঠে। আসলে এই দেশবাসী ভীতু, রক্ষণশীল এবং আত্মমর্যাদাহীন। সেই জন্য তাদের পথ চলতে একজন অভিভাবক তথা অবলম্বন দরকার। নতুন কিছুকে গ্রহন করার সাহস এবং ক্ষমতা তাদের নেই। সেই জন্য তারা পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে থাকায় শ্রেয় বলে মনে করল। লেখক বলেছেন- ‘ভবিষ্যতকে মানলেই তার জন্য যত ভাবনা, ভুতকে মানলে কোন ভাবনাই নেই’। আবার অন্যভাবে বললে মানুষের মৃত্যু আছে কিন্তু ভূতের মৃত্যু নেই। সেইজন্য কর্তার ভূতকে স্বীকার করে নিলে নতুনকরে আর অভিভাবকহীন হতে হবে না। এই ভাবে অতীত ঐতিহ্যের কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করে দেশবাসী নিশ্চিন্ত হয়েছিল।
প্রথমবার গল্পটি পড়লে একটু খটকা লাগতে পারে। খটকা লাগার কারণ, এই গল্পের বিস্তার অন্যান্য গল্পের মতো নয়। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই যেন ধোঁয়াশায় ঢাকা। আবার, গল্পের মূল চরিত্রের কী নাম সেটাও উল্লেখ নেই। এইজন্য ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে গল্পের নির্যাসটুকু তুলে ধরা হল। তবে অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে মূল গল্পটিও পড়ে নেওয়া দরকার ।এবার মূল গল্পে আসা যাক।
কলকাতা থেকে তিনজন যুবক তেলেনাপোতা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তিনজনের মধ্যে একজন মনিদা, যার দেশের বাড়ি এই তেলেনাপোতা গ্রাম। বহুকাল আগে ম্যালেরিয়া-মহামারীতে এই গ্রামটি শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। অনেকেই গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস শুরু করেছিল। মনিদাও তাদের একজন। বাকি দু’জনের নাম গল্পে উল্লেখ নেই। এদের একজন গল্পের মূল চরিত্র যার নেশা মাছ ধরা এবং মনিদার মুখে তেলেনাপোতার সহজ-সরল মাছের কথা শুনে মাছ ধরার লোভে তার তেলেনাপোতায় আসা। তৃতীয়জন পানরসিক বন্ধু অর্থাৎ নেহাত মদ্যপান করাই তার উদ্দেশ্য।
শহর কলকাতা থেকে তেলেনাপোতা যাওয়ার যাত্রাপথটি লেখক সুন্দরভাবে বর্ননা দিয়েছেন। ভ্যাপসানি গরম, ঘন অন্ধকার পরিবেশ আর মশার কলরব- সব মিশিয়ে অদ্ভুত এক যাত্রাপথ। রাতের অন্ধকারে একটি গরুর গাড়ি চেপে তারা তেলেনাপোতায় উপস্থিত হয়। রাত্রির অন্ধকারে মৃত নগরীর মতো নিস্তরঙ্গ তেলেনাপোতা গ্রাম। বাকি দুজন ঘুমিয়ে পড়লেও গল্পের প্রধান চরিত্র অর্থাৎ শৌখিন-মাছশিকারী সেই বন্ধুটি ছাদে চলে যায়। সেখান থেকে তার চোখে পড়ে পাশের বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে একটি নারীমূর্তি। পরদিন সকালে মাছ ধরতে গিয়ে আবার তার দেখা পাওয়া যায়- কোমলে-কঠিনে মেশানো অপুর্ব এক নারী। এদিকে অনেক চেষ্টা করেও যখন সে কোনো মাছ পেলনা তখন হতাশ হয়ে ফিরে আসে এবং জানতে পারে সেই মেয়েটির নাম যামিনী আর তাদের দুপুরের খাওয়া-দাওয়া আজ যামিনীদের বাড়িতেই হবে।
যামিনীদের বাড়িতে গিয়ে এই বন্ধুটি (অর্থাৎ গল্পের প্রধান চরিত্রটি) জানতে পারে যে নিরঞ্জন নামে এক যুবক যামিনীকে বিয়ে করার কথা দিয়ে আর ফিরে আসেনি। যামিনী সেটা মেনে নিয়েছে কিন্তু যামিনীর পঙ্গু মা এখনো এই আশায় দিন গুনে চলেছে যে নিরঞ্জন এসে যামিনীকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। মনিদার সঙ্গে দুজন যুবক এসেছে শুনে যামিনীর মায়ের ধারণা হয়েছে যে নিরঞ্জন ফিরে এসেছে আর তাই যামিনির মা মনিদার সাথে দেখা করতে যায়। মনিদা বুড়ির এমন আবদার শুনে বিরক্ত হয়। এমন সময় মৎস্য-শিকারি সেই বন্ধুটি আবেগবশত মনিদার সঙ্গে যায় যামিনির মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এবং সেখানে গিয়ে নিজেকে নিরঞ্জন বলে পরিচয় দেয়। যামিনির মাকে সে এই প্রতিশ্রুতিও দেয় যে সে যামিনীকে বিয়ে করবেই।
মাছ-শিকারী সেই বন্ধুটি তেলেনাপোতা থেকে ফেরার সময় নিজের মাছ ধরার সরঞ্জাম রেখে দিয়ে যায়। কদিন পরেই তো সে আবার তেলেনাপোতা এসে যামিনীকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে- এমনটাই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সে কলকাতায় ফিরে ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ে। অনেকদিন পর যখন সে সুস্থ হল তখন কোথায় বা যামিনী আর কোথায় বা তেলেনাপোতা! সবই ঝাপসা স্মৃতির মতো আস্তে আস্তে মন থেকে সরে যেতে থাকে। আর যামিনী?? সবটা বুঝতে হলে গল্পটা পড়তেই হবে।
প্রশ্ন: গোরুর গাড়িতে করে যাওয়ার অভিনব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দাও।
রচনা পরিচয়: আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কথাকার প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে কাল্পনিক গ্রাম তেলেনাপোতায় যাবার প্রসঙ্গ রয়েছে। সেখানে যাবার প্রসঙ্গে এসেছে গোরুর গাড়ির কথা।
অভিনব অভিজ্ঞতা: যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গোরুর গাড়ির ব্যবহার গ্রাম-বাংলার প্রান্তবর্তী অঞ্চলে প্রায়শ দেখা যায়। আলোচ্য গল্পে নগর জীবনে অভ্যস্ত গল্পকথক ও তার দুই বন্ধু একটি বাসস্টপে নেমে পড়েন। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা আবছা অন্ধকারে একটি ক্ষীণ আলো দেখতে পান। এবং সেখান থেকে তারা একটি গোরুর গাড়ির আগমন হতে দেখে নিশ্চিন্ত হন।
জঙ্গলের ভিতর থেকে ‘ধীর মন্থর দোদুল্যমান গতিতে’ আসা গোরুর গাড়িটির বিবরণ দিয়ে গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র চলচ্চিত্রের মতো দৃশ্যমান জগতের ছবি অঙ্কন করেছেন। তিনি লিখেছেন—
‘যেমন গাড়িটি তেমনি গোরুগুলি। মনে হবে পাতালের কোনো বামনের দেশ থেকে গোরুর গাড়ির এই ক্ষুদ্র সংক্ষিপ্ত সংস্করণটি বেরিয়ে এসেছে।‘
বৃথা বাক্য-ব্যয় না করে গল্পকথক ও তার বন্ধুরা গাড়িতে চেপে বসেছিলেন। গাড়িটি তাদের নির্দেশিত তেলেনাপোতা অভিমুখে যাত্রা করে। জায়গার নিতান্তই অভাবের কারণে তারা অত্যন্ত কষ্টে বসেছিলেন।
ঘন অন্ধকার অরণ্যের বুক চিরে গাড়িটি যখন চলতে থাকে তখন প্রতি মুহূর্তে মনে হয় ‘কালো অন্ধকারের দেয়াল বুঝি অভেদ্য'। গল্পকথকের মনে হতে থাকে, তারা যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক অন্ধকার দ্বীপে অবস্থান করছে। গল্পকার লিখেছেন—
‘অনুভূতিহীন কুয়াশাময় এক জগৎ শুধু আপনার চারিধারে।‘
গল্পকথকদের পথ চলার সময় আকাশে কৃষ্ণপক্ষের স্নান আলোর চাঁদ দেখা যাচ্ছিল। সেই অনুজ্জ্বল আলোয় দেখা যাচ্ছিল—
ক) প্রাচীন মন্দির।
খ) প্রাচীন অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ।
গ) শিহরণ জাগানো নানা দৃশ্য।
একাধিকবার বাঁক ঘুরে অবশেষে গাড়িটি একটি জীর্ণ, ভগ্ন, প্রাচীন অট্টালিকার সামনে কথকদের নামিয়ে দিয়েছিল।
প্রশ্ন: যে ঘরে চরিত্রেরা রাতের জন্য আশ্রয় নিয়েছিল, সেই ঘরটির বর্ণনা দাও।
সূচনা: সুখ্যাত লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে নগরজীবন থেকে অখ্যাত, অজ্ঞাত গ্রামে আসা এক যুবকের উপলব্ধির কথা শুনিয়েছেন। আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামেরই একটি ভগ্ন অট্টালিকায়।
ঘরের বর্ণনা: ব্যস্ত শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের ফাঁকে দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে কথক এসেছেন তেলেনাপোতায়। যে ঘরে তারা রাত কাটানোর ছাড়পত্র পেয়েছিলেন সেই ঘর বসবাসের পক্ষে অনুপযুক্ত৷ কেননা, গল্পকথক দেখেছেন এমন কয়েকটি দৃশ্য যা মোটেই সুখপ্রদ নয়। যেমন—
ক) ঘরের ঝুল, জঞ্জাল, ধুলো পরিষ্কারের ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছে।
খ) অস্পষ্ট ভ্যাপসা গন্ধ ঘরটিকে আমোদিত করেছে।
গ) ঘরটির ছাদ ও দেয়াল থেকে জীর্ণ পলস্তারা খসে পড়েছে।
ঘ) দু-তিনটি চামচিকা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অতি সচেতন হয়ে রীতিমতো বিবাদ শুরু করেছে।
রাতের অন্ধকার যখন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল ঠিক সেই সময় মশা নবাগতদের অভিনন্দন জানাচ্ছিল। এই মশারা ছিল 'ম্যালেরিয়া দেবীর অদ্বিতীয় বাহন অ্যানোফিলিস।' গল্পকথক নিদ্রাবিলাসী নন। তাই যখন ছাদে ওঠেন তখন তার চোখে ধরা পড়ে ভাঙনের নানা চকিত দৃশ্যাবলি,
অধিকাংশ জায়গাতে আলিসা ভেঙে ধুলিসাৎ হয়েছে, ফাটলে ফাটলে অরণ্যের পঞ্চম বাহিনী ষড়যন্ত্রের শিকড় চালিয়ে ভিতর থেকে এ অট্টালিকার ধ্বংসের কাজ অনেকখানি এগিয়ে রেখেছে।
কৃষ্ণপক্ষের মৃতপ্রায় জ্যোৎস্নায় ম্লান আলোকে চারিদিক মোহময় হয়ে উঠেছিল।
প্রশ্ন: 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পটির নামকরণের সার্থকতা লেখ।
ভূমিকা: ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের নামকরণ অভিনব। এ গল্প প্রচলিত সমস্ত ফর্ম বা টেকনিককে ভেঙে দিয়েছে। মধ্যমপুরুষের বয়ানে রচিত গল্পটি বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য গল্প।
এর বিষয়বস্তু অসাধারণ। এ গল্পের বিন্যাস কৌশল চমৎকার। আধা-বাস্তব ও স্বপ্নের সম্মিলনে ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার'-এর নামকরণ অসীম ব্যঞ্জনা প্রদান করে।
সার্থকতা বিচার
‘আবিষ্কার’ শব্দটি ক্রমান্বয়ে বহুবার ব্যবহার করেছেন লেখক। এমন এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ, বহু প্রাচীন এমন ভাঙা বাড়ি, আর রহস্যময় সে বাড়িতে পৌঁছানোর এমন এক কুয়াশা ঘেরা অন্তরীপের মতো পথ বলে দেয়—সত্যি সেখানে মিশে আছে আবিষ্কারের অন্য আর এক অনুভূতি, যা আমাদের কাছে একেবারে নতুন। যা আমরা অন্বেষণ করেছি এবং অবশেষে খুঁজে পেয়েছি—তাই হলো আবিষ্কার। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘Discovery’ । আবার এর পাশে আরেকটি শব্দও আসে, তা হল ‘Invention'.
‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে এমন একটি গ্রামের আবিষ্কার করেছেন এ গল্পের কথক, যা তার কাছে তৃতীয় ভুবনের মতো। তাই এই গ্রামে যাওয়াটা রোমাঞ্চকর। লেখক বারবার ধ্রুবপদের মতো বলে গিয়েছেন ‘আবিষ্কার’-এর কথা। যেমন—
ক) তেলেনাপোতা আপনারাও একদিন আবিষ্কার করতে পারেন।
খ) হঠাৎ একদিন তেলেনাপোতা আপনিও আবিষ্কার করতে পারেন।
গ) তেলেনাপোতা আবিষ্কার করতে হলে একদিন বিকেল বেলার পড়ন্ত রোদে জিনিসে মানুষে ঠাসাঠাসি একটা বাসে গিয়ে আপনাকে উঠতে হবে।
ঘ) তেলেনাপোতা আবিষ্কারের জন্যে আরো দু-জন বন্ধু ও সঙ্গী আপনার সঙ্গে থাকা উচিত।
এভাবে ক্রমান্বয়ে ‘আবিষ্কার' শব্দটি ব্যবহার করে প্রেমেন্দ্র মিত্র এ গল্পের নামকরণকে করেছেন ব্যঞ্জনাধর্মী।
গল্পের শেষে লক্ষ করি কথকের আবিষ্কারের গ্রাম তেলেনাপোতা তাঁর স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। আবিষ্কৃত স্থান পুনরায় হারিয়ে গেছে। ব্যস্ত শহুরে জীবনে একটুখানি নিরিবিলি শান্তির জায়গা এভাবেই একঝলক সামনে এসেই অদৃশ্য হয়। এ গল্পের নামকরণে প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রতীকের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। এজন্যে আলোচ্য গল্পের নামকরণ হয়েছে সংগতিপূর্ণ।
প্রশ্ন: ‘মনে হবে তেলেনাপোতা বলে কোথাও কিছু নেই’ – একথা কার, কেন মনে হবে? এই মনে হওয়ার কারণ কী?
রচনা ও রচনাকার: উদ্ধৃতিটি কবি-কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের অন্যতম একটি ছোটোগল্প ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ থেকে নেওয়া হয়েছে।
কার মনে হবে: আলোচ্য গল্পে গল্পকথকের একথা মনে হয়েছিল। যেকোনো পাঠকেরই এমন অনুভূতি হবে বলে মনে হয়।
কেন মনে হবে: তেলেনাপোতা থেকে ফিরে আসার পর ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে নাগরিক যুবক যামিনীর মাকে দেওয়া সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। তাই এমনও মনে হবে যে, তেলেনাপোতা বলে সত্যই কিছু নেই।
মনে হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ: গল্পের তেলেনাপোতা এমন এক গ্রাম যেখানে মাছ শিকারের জন্য অনেকেই আসে। তারা অনেক স্বপ্ন দেখে কিংবা দেখায়। কিন্তু মহানগরীতে ফিরে গেলেই সেইসব স্বপ্ন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়।
বাস্তবে তেলেনাপোতা নামে কোনো গ্রাম নেই। আসলে এ গ্রাম-বাংলার প্রতীক। তেলেনাপোতার ধ্বংসাবশেষ, রোগ-ব্যাধি, দারিদ্র, অসহায়তা, বিপন্নতা বাংলার যেকোনো গ্রামেরই প্রতিচ্ছবি। শহুরে মানুষ যারা গ্রামের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত নয়—এই ভাবুক নাগরিক যুবকেরা যামিনী বা যামিনীর মাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মনে রাখতে পারে না। কারণ—
‘তেলেনাপোতার স্মৃতি আপনার কাছে ঝাপসা একটা স্বপ্ন মনে হবে’।
এবং সেই অপেক্ষারত যামিনীকে মনে হয় “অবাস্তব কুয়াশার কল্পনা”।
প্রশ্ন: ‘আমি তোমায় কথা দিচ্ছি মাসিমা। আমার কথার নড়চড় হবে না’ – কে, কাকে একথা বলেছে? সত্যই কি তাঁর কথার নড়চড় হবে না?
গল্প ও গল্পকার: আলোচ্য অংশটির উৎস ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্প। লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র।
বক্তা ও শ্রোতা: আলোচ্য উক্তিটির বক্তা গল্পকথক। কথাটি যামিনীর মা-কে উদ্দেশ্য করা বলা হয়েছে।
প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতা: মধ্যবিত্ত নাগরিক মন কথা দেয়, কিন্তু কথা রাখতে পারে না। তাদের স্বপ্ন আছে, সামর্থ্য নেই। মনে হবে তারা যেন শুধু স্বপ্ন দেখতেই ভালোবাসে কিন্তু দায়িত্ব নিতে ভয় পায়। গল্পের নায়ক যামিনীর সম্পর্কে অনেক কথাই বন্ধু মণির কাছ থেকে শুনে নেয়। তখনই তিনি নিরঞ্জনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
গল্পশেষে দেখা যায়, নায়ক তার প্রতিশ্রুতি পালন করেনি। যামিনীকে গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়। নগর কলকাতার এই নায়কের কাছে একসময় তেলেনাপোতার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যায়। কারণ ম্যালেরিয়া তার স্মৃতিকে ঝাপসা করে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নিরঞ্জনেরা কখনো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনা। একারণে কথকের কথার নড়চড় হয়ই।
প্রশ্ন: ‘একদিন তেলেনাপোতা আপনিও আবিষ্কার করতে পারেন’ – বক্তা কে? আপনি বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? কিভাবে তেলেনাপোতা আবিষ্কার সম্ভব বলে লেখক মনে করেন?
সূচনা: আলোচ্য অংশটির উৎস প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্প।
বক্তা: বক্তা হলে গল্পকথক, এখানে লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র।
তেলেনাপোতা কিভাবে আবিষ্কৃত হবে: গল্পটি বাংলা সাহিত্যে আঙ্গিকগত দিক দিয়ে অভিনব। গল্পে অদ্ভুত এক স্বপ্নময় জগতের সন্ধান দিয়েছেন লেখক।
কর্মক্লান্ত তিন মধ্যবিত্ত যুবককে বেরিয়ে পড়তে হয় শনি বা মঙ্গলবারে। যেতে হয় সমস্তরকম সুবিধা বঞ্চিত অজ পাড়াগাঁয়ে। এখানে কয়েকটি প্রতিকূলতা সামনে আসতে পারে। যেমন,
[ক] গ্রামের আলোহীন পথঘাট
[খ] প্রবল মশার উৎপাত
[গ] পানাপুকুরের পচা দুর্গন্ধ
এসবকে উপেক্ষা করেই গল্পকথক দুই বন্ধুকে নিয়ে পৌঁছে যান রূপকথার তেলেনাপোতা গ্রামে।
গল্পে দেখা যায় প্রতীক্ষারতা দুই রমনীকে। একজন যামিনী অন্যজন যামিনীর অন্ধ বৃদ্ধা মা। মৃত্যু পথযাত্রী এই বৃদ্ধার সঙ্গে প্রতারণা করেছে নিরঞ্জন; তাই গল্পের নায়ক নিজেই নিরঞ্জন হয়ে যামিনীর মায়ের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয়।
যামিনীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিলেও ম্যালেরিয়া কথককে নগর কলকাতায় আটকে দেয়। কথক তেলেনাপোতায় আর ফেরেননি। এইভাবে তেলেনাপোতার স্মৃতি কথকের মন থেকে ঝাপসা হয়ে যায়। এইভাবে গল্পকার পাঠকদের উদ্দেশ্য করে জানিয়েছেন—
‘হঠাৎ একদিন আপনিও তেলেনাপোতা আবিষ্কার করতে পারেন’।
পাঠকও হয়তো এই ধরণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন। আর আবিষ্কৃত হবে পাঠকের মনে আর এক তেলেনাপোতা।
প্রশ্ন: মাছ ধরার সময় পুকুরঘাটের দৃশ্যের বর্ণনা দাও।
ভূমিকা: ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পটি সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের রচিত। গল্পটি যেন রূপকথার স্বপ্নপুরীর মতো। গল্পে বাস্তব ও রোমান্সের অদ্ভুত মেলবন্ধন লক্ষ করা যায়।
পুকুরঘাটের বর্ণনা: গল্পকথক সুদূর নগর কলকাতা থেকে এসেছিলেন মাছ শিকার করতে। মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে কথক যে ঘাটে এসে বসেন সেই ঘাট শ্যাওলায় আবৃত ছিল। পুকুরের জল ছিল সবুজ রঙের।
গল্পকথক টোপ সমেত বড়শি জলে নামিয়ে বসেছিলেন। সেইসময় তারই মতো শিকারি কয়েকটি প্রাণী সেখানে উপস্থিত ছিল। যেমন,
ক] একটি মাছরাঙা পাখি শিকার কাকে বলে তা গল্পকথককে শিখিয়ে দিয়েছিল।
খ] একটি সাপ ঘাটের ফাটল থেকে বেরিয়ে পুকুর সাঁতরে ওপারে উঠেছিল।
গ] দুটি ফড়িং পাল্লা দিয়ে ফাতনাটার উপর বসবার চেষ্টা করছিল।
ঘ] ঘুঘুপাখির ডাকে মাছধরার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছিল।
এইরকম ঘটনার মাঝেই হঠাৎ জলের শব্দে গল্পকথক চমকে ওঠেন। যামিনী গল্পকথকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল—“বসে আছেন কেন? টান দিন”। এরপর যামিনী চলে গেলে গল্প কথক খেয়াল করেন বড়শিতে টোপ আর নেই।
ঘটনার এই শেষাংশ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই অংশ প্রমাণ করে, গল্প কথকের মাছ শিকার শুধু ব্যর্থ নয়; যামিনীর সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্রটিও ছিন্ন হতে চলেছে। এককথায় গল্পের এই অংশটুকু বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: যামিনী চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকা: ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের মূল নারী চরিত্র হলো যামিনী। সে শান্ত, ধীর, স্থির। তার মুখে দেখা যায় বেদনার প্রতিচ্ছবি। যামিনীর চরিত্র আলোচনায় যে বিশেষ দিকগুলি সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে তা আলোচিত হলো।
চরিত্র বৈশিষ্ট্য
১] সংকোচহীন ব্যবহার: যামিনীর ব্যবহারে আড়ষ্টতা ছিল না। তার মধ্যে সংকোচবোধ দেখা যায়নি। সে সহজ-সরল আন্তরিক। মণির কাছে মায়ের কথা আন্তরিকভাবে জানিয়েছিল।
২] শান্ত-করুণ প্রতিচ্ছবি: গল্পের প্রথমেই লেখক বলে নিয়েছেন যামিনীর মধ্যে অদ্ভুত এক শান্ত করুণ প্রতিছবি রয়েছে। তার অপুষ্ট শরীর চিন্তায় যেন থমকে গিয়েছে। লেখকের বর্ণনা—
“দীর্ঘ, অপুষ্ট শরীর দেখলে মনে হবে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়া তার যেন স্থগিত হয়ে আছে”।
৩] নিঃসঙ্গ যামিনী: যামিনী নিতান্তই নিঃসঙ্গ। যামিণী জানতো, শহুরে নিরঞ্জন ফিরে আসে না গ্রামবাংলার যামিনীর কাছে। গল্পের শেষেও নিঃসঙ্গ একাকী যামিনীর কথা পাঠকের মনে পড়বে।
৪] সেবাপরায়নতা: অসুস্থ মাকে সেবা যত্নে ভরিয়ে রেখেছে যামিনী। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার উপর। যামিনীর মায়ের মুখেই মেয়ের এই গুণের কথা পাঠক জানতে পারে।
৫] বুদ্ধিমত্তা ও বিচারক্ষমতা: যামিনী গ্রামের মেয়ে হলেও বুদ্ধিমতী। নিরঞ্জনের কথায় যামিনী উচ্ছ্বসিত ছিল না। তাই যখন গল্প কথক যামিনীর মাকে প্রতিশ্রুতি দেয় তখনও যামিনী জানতো গল্প কথক ফিরে আসবে না।
বিষাদ করুণ এক ছায়ামূর্তি: তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে যামিনী চরিত্রটি যেন নম্র, বিষাদ এক ছায়ামূর্তি। এককথায় যামিনী চরিত্র উল্লেখযোগ্য ও ব্যতিক্রম।
প্রশ্ন: 'আপনার আসল উদ্দেশ্য আপনি নিশ্চয় বিস্মৃত হবেন না’। - আসল উদ্দেশ্য কোনটি? সেই উদ্দেশ্য সাধনে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কী করলেন?
১) আসল উদ্দেশ্য : ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে আসল উদ্দেশ্য বলতে মৎস্য শিকারের কথা বলা হয়েছে।
২) উদ্দিষ্ট ব্যক্তির মৎস্য শিকার বৃত্তান্ত : তেলেনাপোতা গ্রামের নির্জন পুকুরে মাছ শিকারের অসাধারণ একটি বর্ণনা আছে। পানাপুকুরে বঁড়শি ফেলে একাকী বসেছিলেন গল্পকথক। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেখলেন, 'একটা মাছরাঙা পাখি ক্ষণে ক্ষণে’ উপহাস করবার জন্যে পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ঠোঁটে মাছ নিয়ে সে প্রমাণ করছে কীভাবে শিকার করতে হয়। একটি সাপ ভাঙা ঘাটের কোনো এক ফাটল থেকে বেরিয়ে ধীর গতিতে পুকুরের এধার থেকে ওধারে ওঠে। দুটি ফড়িং পাল্লা দিয়ে পাতলা কাচের মতো পাখা নেড়ে ফাতনার উপর বসে। ঘুঘু পাখি উদাস করা সুরে ডাকতে থাকে।
গল্পকথক জলের শব্দে চমকে ওঠেন। দেখেন ফাতনা দুলছে। পুকুরের পানা সরিয়ে একটি মেয়ে জল ভরছে। মেয়েটি কথকের দিকে তাকায়। তারপর ফাতনা লক্ষ করে। মুখ ফিরিয়ে কলসিটা কোমরে তুলে নেয়।
ডুবে যাওয়া ফাতনা জলের উপরে ভেসে ওঠে। দেখা যায় ‘বঁড়শিতে টোপ আর নেই।' পুকুরের ঘাটের নির্জনতা আর ভঙ্গ হয় না। মাছেরা শিকারিকে উপেক্ষা করে জলের তলায় খেলতে থাকে। গল্পকথকের পক্ষে মৎস্য শিকার করা সম্ভব হয় না। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন, 'এক সময় হতাশ হয়ে আপনাকে সাজসরঞ্জাম নিয়ে উঠে পড়তে হবে।' তার বন্ধুরা মৎস্য শিকারের ব্যর্থতা নিয়ে রীতিমতো কৌতুক করতে থাকে।
প্রশ্ন: ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পের নায়ক চরিত্রটির বৈশিষ্ট্যগুলি নির্দেশ করো।
[অথবা]
'তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পে নিরঞ্জনের ভূমিকায় আসা শহুরে মধ্যবিত্ত নায়ক চরিত্রটির সংবেদনশীলতার পরিচয় দাও।
‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পটি বাংলা সাহিত্যে অভিনব। এ গল্পে মধ্যবিত্ত মন-মানসিকতাকে লেখক তীব্রভাবে আঘাত করেছেন। গল্পের কথক হলেন গল্পের নায়ক। তাঁর চরিত্রের আলোচনায় কতকগুলি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। যেমন--
শহুরে মানুষের প্রতিনিধি: এ গল্প স্বপ্ন দেখার গল্প, স্বপ্ন পূরণের গল্প নয়। আর যাকে অবলম্বন করে এ গল্প কেন্দ্রস্থ হয়েছে সেই নায়ক হয়ে ওঠেন শহুরে মানুষের একমাত্র প্রতিনিধি।
সংবেদনশীল মন: তিন বন্ধুর মধ্যে গল্পকথক অপেক্ষাকৃত সংবেদনশীল। দুই বন্ধু নিজেদের মতো পানাসক্ত ও নিদ্রায় আচ্ছন্ন হলেও তার চোখে ঘুম আসে না। অবশেষে কোনোরকমে রাত কাটিয়ে যখন সকাল হয় তখন তিনি যান নির্জন স্থানে পুকুরটিতে মাছ ধরতে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। জল ভরতে আসে যামিনী। তার চোখে কৌতূহল।
নায়কের প্রতিশ্রুতি: যামিনী বলেছিল তার মা বারবার তার কাছে জানতে চেয়েছে, নিরঞ্জন এসেছে কিনা। তখন গল্পের কথক জানতে পারে নিরঞ্জন নামের এক যুবক কথা দিয়েও কথা রাখেনি। কথকের মনে হয় যামিনীকে ঠকিয়েছে নিরঞ্জন। ফলে গল্পের কথকের মনে হয় তিনি যামিনীকে ঠকাবেন না।
উদার মানসিকতা: কিন্তু তার এই কথা বাস্তবায়িত হয় না। যদিও আমরা প্রত্যক্ষ করি নায়কের মন উদার। তার দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে অনেকখানি প্রসারিত। তাই বৃদ্ধা যখন যামিনীর কথা শোনান এবং বলেন এই মেয়েটির জন্যেই তিনি মরতে পারছেন না, তখন নায়কের মনের অবস্থা নির্দেশে প্রেমেন্দ্র মিত্র লেখেন—
“একাস্ত ইচ্ছে সত্ত্বেও চোখ তুলে একটিবার তাকাতে আপনার সাহস হবে না। আপনার নিজের চোখের জল বুঝি আর গোপন রাখা যাবে না”।
পলায়নবাদী মানসিকতা: গ্রাম থেকে কথক চলে আসেন শহরে। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রতিশ্রুতিদাতা কথক শেষপর্যস্ত কোনোভাবে ফিরতে পারেন না তেলেনাপোতা গ্রামে। ফলে গল্পের কথক হয়ে ওঠেন পলায়নপর মধ্যবিত্তের অন্য আর এক রূপ।
প্রশ্ন: 'একবার ক্ষণিকের জন্যে আবিষ্কৃত হয়ে তেলেনাপোতা আবার চিরন্তন রাত্রির অতলতায় নিমগ্ন হয়ে যাবে।'—কোন প্রসঙ্গে এই মন্তব্য? তেলেনাপোতা কীভাবে 'চিরন্তন রাত্রির অতলতায় নিমগ্ন হয়ে যাবে বলে লেখক মনে করেন?
১) প্রসঙ্গ : ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পে নগর কলকাতা থেকে ব্যস্ত নায়ক মাছ ধরার নেশায় তেলেনাপোতা গ্রামে উপস্থিত হন। যামিনীর বৃদ্ধা মাকে কথা দেন তিনি যামিনীকে বিবাহ করবেন। গল্প-কথক কথা দিয়েও আর ফিরে আসতে পারেননি তেলেনাপোতা গ্রামে। সেই প্রসঙ্গে এই উক্তি।
২) রাত্রির অতলতায় নিমগ্ন হওয়ার কাহিনি : ব্যস্ত জীবন থেকে তিন বন্ধু নিজেদের ইচ্ছাসুখে একদিন ‘শনি ও মঙ্গলের, মঙ্গলই হবে বোধহয়' উপস্থিত হন তেলেনাপোতা গ্রামে। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন—
“কাজে কর্মে মানুষের ভিড়ে হাঁফিয়ে ওঠার পর যদি হঠাৎ দু-দিনের জন্যে ছুটি পাওয়া যায়—আর যদি কেউ এসে ফুসলানি দেয় যে কোনো এক আশ্চর্য সরোবরে”।
মানচিত্রহীন অজ্ঞাত গ্রামে তিনবন্ধু এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র দেখান
ক) অদ্ভুত সেই ভগ্ন গৃহ।
খ) চারিদিকে রোমাঞ্চকর পরিবেশ।
কথক মাছ ধরার নেশায় পুকুরে ছিপ ফেলেছিলেন। তারপর একসময় তার চোখে পড়েছিল এ গল্পের নায়িকা যামিনীকে। ‘যামিনী’ নামের মধ্যে রয়েছে রাত্রির মায়া, না পাওয়ার শূন্যতা।
গল্পের নায়ক নাগরিক মানুষ হলেও তার মধ্যে স্বপ্ন রয়েছে। তার মনে হয়েছে, নিরঞ্জনের মতো তিনি আর এমন মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধাকে কষ্ট দেবেন না। তাই কঙ্কালসার বৃদ্ধার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কথা দিয়েছিলেন, যামিনীকে বিয়ে করবেন।
যদিও এই নায়ক শেষপর্যন্ত যামিনীর কাছে ফিরে আসেননি। ফলে তিনিও অন্য আরেক অর্থে নিরঞ্জনসত্তায় পরিণত হন। মধ্যবিত্ত পলায়নী মনকে প্রেমেন্দ্র মিত্র চিনতেন।
ফলে গল্পের পরিসমাপ্তিতে এসে প্রেমেন্দ্র মিত্র জানান, কলকাতায় ফিরে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত নায়ক আর কখনোই তেলেনাপোতা গ্রামে ফিরে যাবে না। কেননা, ততদিনে নায়কের মনেরও পরিবর্তন ঘটেছে—
“অস্ত যাওয়া তারার মতো তেলেনাপোতার স্মৃতি আপনার কাছে ঝাপসা একটা স্বপ্ন ব’লে মনে হবে। মনে হবে তেলেনাপোতা ব'লে কোথাও কিছু সত্যি নেই”।
গল্পের শেষে তেলেনাপোতা কীভাবে চিরন্তন রাত্রির অতলতায় হারিয়ে যায় সেদিকে দৃষ্টি দিয়েছেন লেখক। এই উক্তির মধ্যে নাগরিক মধ্যবিত্ত নায়কের প্রতি তির্যক ব্যঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে।
প্রশ্ন- “কে, নিরঞ্জন এলি?” নিরঞ্জন কে? কোন পরিস্থিতিতে গল্পকথক নিরঞ্জনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন? ১+৪
উত্তর- প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের প্রধান নারী চরিত্র যামিনীর সঙ্গে যার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার নাম নিরঞ্জন। সে ছিল যামিনীর মায়ের দূর সম্পর্কের বোনপো।
তেলেনাপোতা আবিষ্কারে গিয়ে গল্পকথকের দৃষ্টি এবং হৃদয় আকর্ষণ করেছিল যামিনী। সে ছিল কথকের পানরসিক বন্ধু মণিদার জ্ঞাতিস্থানিয়া। যামিনীদের বাড়িতেই তাদের মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন হয়েছিল। খাওয়ার পর তারা যখন বিশ্রাম করছিল তখন যামিনী এসে মণিদাকে ডাকে এবং নিচু স্বরে কিছু কথা বলে যায়। কথক মণিদার মুখে নিরঞ্জন-বৃত্তান্ত শুনে।
চার বছর আগে নিরঞ্জন এসে যামিনীর মাকে কথা দিয়েছিল যে বিদেশ থেকে ফিরেই সে যামিনীকে বিয়ে করবে, কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি। যামিনীর মা গল্পকথকদের কাউকে নিরঞ্জন ভেবেছিল এবং তার কাছে নিরঞ্জনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যামিনীকে জোর করছিল। মাকে শান্ত করার জন্যই যামিনী মণিদাকে ডাকতে এসেছিল।
সব শুনে গল্পকথক যামিনীর মায়ের সাথে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করে। এরপর মনিদার সঙ্গে যামিনীর মায়ের কাছে গেলে দৃষ্টিশক্তিহীন বৃদ্ধা কথককে নিরঞ্জন বলে সম্বোধন করেন। এভাবেই তাকে নিরঞ্জন সাজতে হয়েছিল।
ব্যাপারটা কী এবার হয়তো আপনারা জানতে চাইবেন’- কোন ব্যাপারের কথা বলা হয়েছে? ব্যাপারটা জানার পর উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কী করেছিলেন? ৩+২
উত্তর- প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে তিনজন বন্ধু তেলেনাপোতায় বেড়াতে গিয়েছিল। তাদেরই একজন মণিদার পুর্বপুরুষের বাড়ি সেখানে। মনিদার জ্ঞাতিস্থানীয়া যামিনীদের বাড়িতে তারা দুপুরে খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছিল। কিন্তু যামিনীর বৃদ্ধা, অন্ধ মা মনে করেন যে মণির সঙ্গে যারা এসেছে তাদের একজন নিরঞ্জন। এই নিরঞ্জন আসলে যামিনীর মায়ের দূর সম্পর্কের এক বোনপো। সে যামিনীকে বিয়ে করব বলেছিল কিন্তু আর ফিরে আসেনি। যাইহোক, যামিনীর মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস যে নিরঞ্জন এসেছে। আর তাই তিনি বারবার যামিনীকে ডেকে বলেন যেন একবার নিরঞ্জনকে তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। উদ্ধৃত অংশে এই ব্যাপারের কথা বলা হয়েছে।
মনিদার মুখে বাকি দু’জন ব্যাপারটি সবিস্তারে জানতে পারে। মণিদা ভাবতে থাকে কী করে যামিনীর মাকে আশ্বস্ত করা যায়। এমন সময় একজন বন্ধু বিশেষ আগ্রহ দেখায়। গল্পে যাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে, সে নিজে থেকে যামিনীর মায়ের কাছে যায় আর নিজেকে নিরঞ্জন বলে পরিচয় দেয়। যামিনীকে দেখে সে আগে থেকেই মুগ্ধ ছিল, এবার যামিনীর মায়ের কথা শুনে সে নিতান্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তাই যামিনীর মায়ের কাছে সে যামিনীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসে।
তেলেনাপোতা আবিষ্কার কি আসলে আধুনিকতার মোড়কে শকুন্তলা-কাহিনি ?
উত্তর- প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে প্রধান নারী চরিত্রটি হল যামিনী। তার করুণ জীবনবৃত্তান্ত আমাদের শকুন্তলার কথা মনে করিয়ে দেয়।
শকুন্তলা বৃত্তান্ত- মহাভারতের আদিপর্বে শকুন্তলা আখ্যানটি রয়েছে। মহর্ষি কণ্বের পালিতা কন্যা শকুন্তলা। রাজা দুষ্মন্তের সঙ্গে তার গান্ধর্বমতে বিবাহ হয়েছিল। বিবাহের পর রাজা দুষ্মন্ত রাজধানিতে ফিরে যান। যাবার সময় তিনি শকুন্তলাকে কথা দিয়ে গিয়েছিলেন যে শীঘ্রই ফিরে এসে তিনি শকুন্তলাকে নিয়ে যাবেন। শকুন্তলা দুষ্মন্তের জন্য প্রহর গুনতে থাকে কিন্তু দুষ্মন্ত আর ফিরে আসেন নি। এদিকে, স্বামী বিরহে কাতর শকুন্তলাকে অহংকারী মনে করে ঋষি দুর্বাশা অভিশাপ দেন যে যার চিন্তায় সে মগ্ন সেই তাকে চিনতে পারবে না। যাইহোক, বাবার সঙ্গে শকুন্তলা স্বামীর কাছে হাজির হয়। কিন্তু দুষ্মন্ত তাকে চিনতে পারেন নি। ভাগ্যাহত শকুন্তলা এরপর এক তপোবনে থাকতে শুরু করে।
যামিনী চরিত্রে শকুন্তলার ছায়া- তেলেনাপোতার অভিশপ্ত জীবনে পঙ্গু মায়ের সেবা করে দিন কাটায় যামিনী। নিরঞ্জন নামে একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হবার কথা ছিল। নিরঞ্জন কথা রাখেনি। তারপর তার শুন্য জীবনে আসে আরেকজন- যাকে গল্পে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। যামিনীর জ্ঞাতিস্থানীয় মণিদার সঙ্গে সে তেলেনাপোতায় এসেছিল মাছ ধরার জন্য। যামিনীর দুঃখের কাহিনি শুনে, আবেগের বশে সে যামিনীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয়। যামিনীর নিস্তরঙ্গ জীবনে ঢেউ তুলে সে শহরে ফিরে যায়। কিন্তু শহরে ফিরে যাবার পর তার মন থেকে যামিনীর স্মৃতি ম্লান হতে থাকে। এমন সময় দুর্বাশার অভিশাপের মতো ম্যালেরিয়ার জীবাণু তাকে গ্রাস করে। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর যামিনীর মুখচ্ছবি তার মন থেকে একেবারে মুছে যায়। ওদিকে তেলেনিপোতার মৃত্যুর তপোবনে তখনো পথ চেয়ে বসে থাকে যামিনী।
বাস থেকে তিনটি চরিত্র যেখানে নামল সেই স্থানটির পরিচয় দাও।
উত্তর- প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে তিনটি চরিত্রের অদ্ভুত এক অভিযানের কাহিনি বর্নিত হয়েছে। একদিন পড়ন্ত বিকেলের রোদে জিনিসে-মানুষে ঠাসাঠাসি একটি বাসে তারা তিনজন উঠে পড়ল। দু’ঘণ্টার কষ্টকর বাসযাত্রার পর যে স্থানে নামল লেখক সেই স্থানটির পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে-
যেখানে বাসটি থামল সেটি রাস্তার মাঝখান, শেষপ্রান্ত নয়। তার চারিদিকে ঘন জঙ্গল- সুর্য অস্ত যাবার আগেই সেখানে যেন অন্ধকারের রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে। স্থানটি যে শুধু নির্জন তাই নয়, ভয়ঙ্করভাবে নির্জন। পাখিরাও যেন সভয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেছে।
বড় রাস্তার পাশেই একটি কাদাজলে পূর্ণ জলা। সেখান থেকে একটি নালা জঙ্গলে ঢুকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। নালার দু’পাশে বাঁশঝাড় এবং অন্যান্য ঝাঁকড়া গাছের সারি স্থানটির নির্জনতা ও নিষ্প্রাণতাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
মহানগর থেকে মাত্র তিরিশ মাইল দূরে অবস্থিত এই স্থানটি যেন বাস্তব জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সেখানে চির-অন্ধকারময় অসম্ভবের রাজত্ব। মনুষ্য-বর্জিত এই স্থানটিতে প্রকৃতিও যে কতখানি বিরূপ লেখক তার সুন্দর বর্ননা দিয়েছেন। সেখানকার আবহাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে, ভিজে আর ভ্যাঁপসা। রাস্তার নিচের জলা থেকে একটি নির্মম-নিষ্ঠুর জলীয় অভিশাপ যেন তার ভয়ঙ্কর ফণা তুলে উঠে আসছে।
যে স্থানে তারা নেমেছিল সেই স্থানটি আমাদের পরিচিত জগত থেকে ভিন্নতর। সন্ধ্যার অন্ধকারে মশাদের অত্যাচারে স্থানটিকে আরও বন্য করে তুলেছে। সর্বোপরি, লেখকের বর্ননার গুণে উক্ত স্থানটি যেন পাঠকের চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।