অবশেষে কাশ্মীর ভ্রমণের সুযোগটা এসেই গেলো। যদিও বিগত প্রায় এক বছর ধরেই ভূস্বর্গ যাবার একটা পরিকল্পনা চলছিল কিন্তু তা বাস্তবায়িত করা যায়নি বিভিন্ন কারণে। ২০১৭ সালের জুন-জুলাই মাস নাগাদ আমাদের যাবার সব পরিকল্পনাই ঠিক হয়ে গেয়েছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা ভেস্তে যায়। আশা করি এবার স্বপ্ন সফল হবে।
ভূতত্ত্ব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করার সৌভাগ্যে এতো দিনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ আমরা ঘুরে বেরিয়েছি পড়াশোনার কাজে। তাছাড়াও নানান সময় এ বন্ধুবান্ধব সহযোগ এও আমরা এ -প্রদেশ ও-প্রদেশ এ বিচরণ করেছি। এতো দিন এ বাকি থেকেছে কেরালা র কাশ্মীর। আর উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে যাতায়াত এর সেই রকম সুবিধা না থাকায় বা রাজনৈতিক স্থিতাবস্থতা ভালো না হবার জন্য সেই ভাবে সাহসে-ও কুলিয়ে ওঠেনি। তারপর-ও আসাম আর মেঘালয় রাজ্য-র বেশ কিছু অঞ্চল ঘুরে দেখিছি।
সেবার ২০১৪ তে, তখন সাঁতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষে পড়া কালীন বদুর সাথে গেয়েছিলাম। মোটামোটি অনুভূতি ছিল, না বেশ ভালো আবার না খুব খারাপ। হয়তো বয়েস কম ছিল বলে অভিজ্ঞতটা-র প্রয়োজন টা বার বার ধরা পড়েছে সেই যাত্রায়। আশা করি এবার পূর্ব অভিজ্ঞতটা কাজে আসবে। সেই আমার প্রথম হিমালয় এ যাত্রা। বেশিরভাগ ভূতাত্ত্বিক-র ই হিমালয় নিয়ে একটা আলাদা অনুভূতি থাকে দেখেছি, এই তো 'যে-পি' ই তার একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ। সময় পেলেই হিমালয় এ দৌড়োয় । আর থাকবে-নাই বা কেন জিনিসটাই যে ও-রকম, সবসময় রোমাঞ্চ জাগায় দেহ মনে।
২০১৬ তে যখন আমি পুনে শহর এ চলে এলাম তারপর হটাৎ-ই একবার কোথায়ও ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা করতে করতে দু-দিন এর ছোট্ট ঝটিকা সফর করে ফেলি নীল র ঋষি দার সাথে। সেপ্টেম্বর মাসে সেবার হটাৎ এ চলে যাই আমরা উত্তরাখন্ড এর ল্যান্সডাউন এ। আমি পুনে থেকে বিমান যাত্রায় ভারত এর রাজধানী শহর নতুন দিল্লী-তে পৌছালাম রাত ১২ টা নাগাদ আর ওরা এলো ভারত এর পুরোনো রাজধানী শহর কলকাতা থেকে বর্তমান রাজধানী শহর এ। তিন জন এ অনেক দিন পর দেখা, তো সাময়িক উত্তেজনা কাটিয়ে আমরা ঠিক করতে শুরু করলাম যে কি করে যাওয়া হবে ল্যান্সডাউন এ। পূর্ব পরিকল্পনা সেই ভাবে ছিল না তাই আমাদের সে বার বেশ কাট-খড় পোড়াতে হয়েছিল যাত্রার বাহন ঠিক করতে। সে এক মজার অভিজ্ঞতটা, যাত্রাপথ এর ধকল আর সারা-রাত এর ক্লান্তিতে তো শেষ এ, আমরা অনাদ-বিহার অন্তর-রাষ্ট্রীয় বাস স্ট্যান্ড এর মেঝেতে শুয়েই পড়লাম। সে কথা আজ থাকে অন্য কোনো দিন বলা যাবে। আজ বরং আসন্ন কাশ্মীর যাত্ৰা-র বিহ্বলতায় বিভোরে হই।
আর এ বার এর কাশ্মীর যাত্রা টা সম্পূর্ণ হলে, তা হবে তৃতীয় বার এ জন্য হিমালয় এ যাত্রা, হয়তো সেই ভাবে বললে এটাই হবে প্রথম বার এর জন্য প্রকৃত অর্থে হিমালয় দর্শন। আশা করি হিমালয় আমাদের সদর এ অভ্যর্থনা জানাবে। আপাততো আজ শেষ করি। গোছ-গাছ বাকি কাল সকাল এ যাত্রা শুরু, এবার ও আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য ভারতের রাজধানী শহর। পুনে থেকে ট্রেন এ যাবো তাই সব কিছু ঠিক থাকে চললে পরশু সকালে পৌঁছে যাবো দিল্লীতে। ওখানে এক দিনে-র বিশ্রাম, পর দিন মানে ১৭ তারিক, সকালে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের লেহ শহর এর জন্য যাত্রা করবো বিমান পথে। কয়েক ঘন্টায় হটাৎ করে প্রায় সমতল দিল্লী থেকে করেক হাজার মিটার উঁচু লেহ তে পৌঁছে শরীর কিভাবে প্রতিক্রীয়া জানাবে জানিনা, তা নিয়ে একটা চাপা ভয় তো কাজ করছেই, দেখা যাক কি হয়, রোমাঞ্চ বা ভয় না থাকলে ভ্রমণের সার্থকতাই বা কি ?
মাঝে ১৬ তারিক এ দিল্লীতে কিছু পুরোনো বন্ধু-বান্ধব এর সাথে দেখা সাক্ষাৎ এর পরিকল্পনায়ও আছে দেখা যাক কত-দূর কি করতে পারি।
দিল্লী - ভারতের রাজধানী শহর হবার সুবাদে হয়তো সব বাঙালি বাচ্চারাই সেই শিশুকাল হতে এই শহরটির সাথে পরিচিত, ধন্যবাদ আমাদের ইতিহাস বইকে। কত ঐতিহাসিক স্থাপত্য আর তাকে ঘিরে তার সৃষ্টি-কর্তা দের জীবন কাহিনীর ইতিহাস, কিন্তু কালের নিয়ম এ সে সব ই গেছে উত্থান-পতনের গর্ভে। জানি না বাকিদের কথা তবে আমাকে বেশি টানতো ভাস্কর্যের সৌন্দর্যতা দেখার টান, ইতিহাস সেই অর্থে বিশেষ কিছু করতে পারেনি। ছোটবেলায় পরিচিত হওয়া ঐতিহ্যবান স্থাপত্য গুলোর মধ্যে তাজমহল এর নামটা হয়তো সবার ই বেশি পরিচিত কারণ তার নির্মাণ এ যেমন আছে অদ্ভুত সৌখিনটা ও নিপুনতা আর তার প্রেক্ষাপটেও এ আছে তেমন অদম্য প্রেমের উদ্দাম আকুলতা। যদিও আমার ভালোলাগার শুরু অন্য কারণ এ, শুধু ইতিহাস না।ঘরে একটা পুরোনো ছবি আছে ঠাকুমার, যেটা নাকি তাজমহল এর সামনে তোলা, সেই ভ্রমন যাত্রায় যদিও আমি সামিল ছিলাম না কিন্তু তার নানান গল্প আমি সেই অজন্ম কাল শুনে আসছি, কিন্তু দিল্লী আর কোনো ভাবেই যাওয়া হয়না, যদিও ততদিন এ জেনেছি তাজমহল আসলে আগ্রাতে, যেটি দিল্লির প্রতিবেশী শহর এ।
২০১৪ তে যখন স্নাতোকত্তোর দ্বিতীয় বর্ষে আমি, তখন এক বিজ্ঞান-ভিত্তিক আলোচনা সভায় যোগদান এর জন্য তানজানিয়া যাবার সুযোগ আসে কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত যাওয়া হয়নি, হলুদ-জ্বর এর প্রতিষেধক নেওয়া বাধ্যতামূলক অনেক আফ্রিকা মহাদেশীয় দেশে যাবার আগে, আর তানজানিয়া সেই দেশ গুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তানজানিয়া যাবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমি সে প্রতিষেধক নিতে অক্ষম ছিলাম বলে আমি যাবার অনুমোদন পাইনি। তো সেই আলোচনা সভার ই অনুরূপ বিজ্ঞানসভায় যোগদান করতে দিল্লী গেলাম সে বছরই। প্রথমবার দিল্লী যাত্রার সে আনন্দ তো ছিলই সাথে ছিল প্রথম বার বিমান চড়ার অভিজ্ঞত, এনেছিল অন্য রোমাঞ্চ।
অক্টোবর মাস সবে উত্তর-পূর্ব ভারত ঘুরে এসেছি বদর সাথে তার পর এ দিল্লির জন্য বেরিয়ে পরেছিলাম।
এই সময়টায় দিল্লীতে আবহাওয়া মোটামটি ভালো থাকলেও কিন্তু ভূপৃষ্ঠ কয়েক হাজার ফুট উপরে বায়ুমণ্ডলে যেখানে বিমান ওড়ে সেখানে বায়ু প্রবাহের গতিমুখ সদা পরিবর্তিত যাকে বিজ্ঞান এর ভাষায় টার্বুলেন্স বলে, এই টার্বুলেন্স এর মধ্যে দেয়া বিমান চলাচল করলে বিমানের মধ্যে ভয়ঙ্কর রকমের দোলা অনুভূত হয় যা মোটেই সুখকর না।
সে বার ই দিল্লির প্রায় সবটাই ঘুরে দেখে ফেলেছিলাম, নতুন কিছু মানুষ এর সাথে পরিচয় হয়েছিল যারাও বিজ্ঞানসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে কিছু জন এর সাথে ছোট গ্রুপ বানিয়ে তাজমহল গেয়েছিলাম, সাথে আগ্রা দুর্গ ও দেখে এসেছিলাম। আর এবার এ দিল্লি আর আগ্রার মধ্যে দূরত্ব টা যে আসলে কতদূর তা জানলাম আগে ভাবতাম এপাড়া-ওপারা হবে, কিন্তু টা না, প্রায় ঘন্টা চারেক গাড়িতে যেতে হয় কোথায়ও না থেমে , যদিও যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের দৌলতে সে যাত্রা খুবই সরল হয়েছে আজকাল।
তাছাড়া দিল্লির লালকেল্লা, কুতুবমিনার তো ছিলই। তারপর যখন কর্মসূত্রে রাজস্থান রাজ্যের আজমের শহর এ গেলাম তখন দিল্লী যাত্রা প্রায় নিত্য যাত্রায় পরিণত হয়েছিল, বাড়িফেরা বা বাড়ি থেকে আজমের ফেরার সময় দিল্লিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। লাগাতার যাতায়াত বন্ধ হয় যখন আজমের ছেড়ে পুনে তে চলে এলাম, তারপর এ প্রত্যেক বছর কোনো না কোনো কারণ একবার দিল্লী ঠিক পৌঁছে গেছি আর এবার ও গন্তব্য দিল্লী। হয়তো এবার বিশেষ সময় কাটাতে পারবো না দিল্লীতে। কাল পৌঁছে ঝটিকা সফর কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে পরশু ভোরে বেরিয়ে পড়বো লেহ এর উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার পর ও দিল্লী এক আলাদা এক অনুভূতির যোগান দেয়।