১৫ই অক্টোবর, ২০১৮
পুনে, মহারাষ্ট্র
-------------------------------
iPhone-এর সুরেলা এলার্মের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেলো, কিছু একটা স্বপ্ন দেখছিলাম, খেয়াল নেই। বিছানায় শুয়ে-শুয়েই মনে এলো আজ তো মহা-ষষ্ঠী কিন্তু কই ঢাকের শব্দ তো কানে আসছে না ! ঘোর কেটে হটাৎ-ই খেয়াল হলো প্রায় সাড়ে-নটা বাজে ল্যাব এ যেতে হবে আর শুয়ে থাকলে চলবে না।
- এবার ও পুজো তে আর বাড়ি যাওয়া হলো না, মনটা খারাপ হয়ে গেলো।এই বাঙালি ও বাংলার রূপ-রস-গন্ধ বর্জিত দূর-প্রবাসে, কর্ম-ব্যাস্ত জীবনের কর্কশতায় চাপা পড়ে, কেটে যাবে বাকি দিন-টাও।
সকালের নরম সূর্যের চড়া রোদটা পর্দার পাশ দিয়ে চোখে এসে পড়াতে অস্বস্তি সহযোগেই ঘুমটা ভেঙে-গেল।পর্দাটা সরিয়ে বিছানায় উঠে বসতেই, খোলা জানলা দিয়ে পাশের বহুতলটার ধার ঘেঁষে পার্কের মধ্যে চোখ পড়লো। না, এ তো সম্ভব না, এ দেশে তো ফোটে না কাশ-পদ্ম। তাহলে কি চোখের ভুল? নাকি শিকড়-এর টানের সম্মোহন। শুভ্রর দিন-খন ঠিক-ই মনে থাকে, হ্যাঁ আজ মহা-সপ্তমী।
- কিন্তু তা ভেবে মন খারাপ করার অবকাশ নেই। হিউস্টন-এর এক বিশাল বড় তেল কোম্পানীর জিওলজিস্ট সে, বেশ উঁচু পদেই আছে, কাজের চাপও খুব, তাই বাড়ি যাওয়া তো দূরের কথা, স্থানীয় বাঙালীদের সম্মিলিত উদ্যোগে আয়োজিত প্রবাসী দূর্গা পূজাটাও হয়তো ঠিক করে এনজয় করতে পারবেনা এবার সে।
~ iPhone টা হাতে নিতেই তারিখ-টা চোখে পড়লো ১৬ ই অক্টোবর, ওহ আজ তো আবার জ্যোতির্ময় এর জন্মদিন, একবার ফোন করে শুভেচ্ছা জানাতে হবে। যদিও ও এসব-এর ধার ধরে না, আর তখনই মনে মনে ভাবলো যে আজ বিকেলে বাড়িতেও একবার ফোন করবে যদিও ততক্ষন এ দেশে সকাল হয়ে অষ্টমী পড়ে যাবে।
------------------------
~লিখেছে পম।এমনিতে যদিও, অ্যালার্ম ছাড়াই পমের ঘুম ভেঙে যায় সকালে, কিন্তু আজ কোনো রিস্ক নেয়নি। গতকাল সন্ধ্যাবেলা ল্যাব এর সিনিয়র অনির্বান দা-দের সাথে বেরিয়েছিল ঠাকুর দেখতে, পুনেতে দূর্গা ঠাকুর বলতে হাতে গোনা ওই দু-তিনটি, বানের এ গোবিন্দ-গার্ডেন, খাড়কির কালীবাড়ি আর করেগাঁও পার্কে, এছাড়া হয়ত দু-একটা থাকতে পারে এদিক-ওদিক কিন্তু পমের সে-বিষয় এ কোন ধারনা নেই।
- ঠাকুর দেখে, আড্ডা দিয়ে ফিরতে প্রায় রাত ১টা বেজে গিয়েছিলো, শুতে যাবার আগে তাই সিরি কে অর্ডার করেছিল কাল সকাল ৮টায় জাগিয়ে দিতে। আসলে এক্সসাইটমেন্টের পারদটা কাল রাত থেকেই চড়তে শুরু করেছিল, প্রথম বার অষ্টমীর অঞ্জলি দেবে সে, থুড়ি তারা।
- যাদবপুর এ পড়াকালীন পমের হালকা করে কয়েকটা প্রেম হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সিরিয়াসলি কোনটাকেই, কোন কালে সে নেয়নি, তাই কালের নিয়মে সব কটাই ভেঙে গেছে। তার উপর পুজোর ছুটিতে সবাই বাড়ী চলে যেত, সে নিজেও যেত, তাই একসাথে অঞ্জলি দেওয়া হয়নি আগে কখনও, তার উপরতো একটি প্রেম ছিল অসমীয়া এক মেয়ের সাথে, অঞ্জলি তো দূরের কথা দূর্গা পুজো ব্যাপারটাই তার কাছে নতুন।
- সে যাকগে পুরনো কথা বলে আর কাজ নেই, কারণ পম অতীতে না বর্তমানে বাঁচতে ভালোবাসে। আই আই এস ই আর পুনেতে জয়েন করার পর, পমের আবার নতুন একটা প্রেম হয়, এক মালায়ালী মেয়ের সাথে। নাস্তিক মেয়ে, এর ক্যালচারেও দূর্গা পূজা নেই, জানেও না কি অষ্টমী, কি অঞ্জলি কিন্তু পম বলাতে সহজেই সম্মত হয়েছে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে। না পমের মালায়ালী প্রেমিকার দূর্গা-পূজা নিয়ে কোনো আবেগ বা উত্তেজনা নেই ঠিকই, যেটা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু রাজি-তো হয়েছে, হয়তো ভালোবাসার টানে বা নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চার এর গন্ধে।
~
"অষ্টমীর সন্ধ্যায় প্রেম ওঠে ভরে
যৌবন কন্যার চোখ নাহি সরে।"
দিপু ল্যাবে বসে ভাবছিলো আজ নবমী হয়ে গেল মানে কালই পুজো শেষ, এমন সময় জানালা দিয়ে, পেঁজা তুলোর মতো মেঘে ভর্তি, বাইরের আকাশটার দিকে তাকাতেই, তার কিছু পুরোনো কথা মনে পড়লো হটাৎ-ই--------
- দিপুর জীবনের প্রথম দশ-এগারো বছর গ্রামে-ই কেটেছে। পরে তারা এক নিকটবর্তী মফসল-টাউন এ চলে আসে, যখন সে ক্লাস ফাইভ-এ উঠবে। দিপুদের গ্রামটা খুবই ছোট আর পাঁচটা পশ্চিমবাংলার গ্রামের মতো - অজ পাড়া-গাঁ।
- গ্রামে দূর্গা পুজো বলতে বামুন পাড়ার ওই একটি পুজো। তাও সে আবার বামুনদের পারিবারিক পুজো, নিতান্তই সাবেকী ধাঁচে এক চালের উপর সোলার সাজ দেওয়া ছোট ছোট আকারের মা ও তার সন্তান সমূহ। প্রত্যেক বছরই এক জিনিস, তাস্বত্তেও কিন্তু দিপুর কোনো দিন একঘেঁয়েমি লাগেনি। সব থেকে মজার ছিল মহিষাসুরটা, নেংটি পরা বিকৃত আকৃতির, আজও দিপু বোঝেনি কেন মহিষাসুর টিকে ওমন রূপ দেওয়া হত, হয়তো ভিলেন বলেই এই পুজোর দিনেও তার কপালে ভালো সাজ জুটতো না।
- স্কুল যাওয়া-আসার পথে দুবেলা তারা দেখতো প্রতিমা গড়া সেই জন্ম-অষ্টমী থেকে। কয়েক বার তো বদমায়েশি করে নরম প্রতিমাকে বিকৃত করতেও ছাড়েনি। সে যাই হোক, সব শিশুই কম বেশি দুস্টুমি করে থাকে শিশু কালে। যদিও অনেক বারই তারা প্রায় শুরু থেকে, মানে খড়ের কাঠামো থেকে প্রতিমায় রং হওয়া পর্যন্ত দেখেছে, কিন্তু কোন দিন দৃষ্টি-দান পর্ব দেখেনি সে, তার একটা কারণ আছে অবশ্য, যখন দৃষ্টি-দান হত ততো দিন-এ হয় স্কুল-এ পুজোর ছুটি পড়ে যেত বা বিকেলে তারা স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে যাবার পর প্রতিমার মুন্ডো-তে চোখ ফোটাতো প্রতিমা-শিল্পী।
- ঠিক কারণটা কি সে জানে না, মনেহয় ছোটবেলা হতে দূর্গা পুজোর সাথে সেই ভাবে ইনভল্বমেন্ট ছিলনা বলেই হয়তো দিপুর পুজো-টুজো নিয়ে বিশেষ কোন উচ্ছ-বাচ্ছ থাকে না। হ্যাঁ যখন দেশে থাকতো, দু-এক বছর কলেজের কিছু বন্ধু-বান্ধবের সাথে কলকাতার ওলিগলি ঘুরেছে পুজোর সময়, হয় ঠাকুর দেখতে, আড্ডা দিতে, খেতে বা সুন্দরী দেখতে, তাও সে খুব-বেশি হলে ষষ্ঠী থেকে অষ্টমী পর্যন্ত, কারণ তারপর তাকে বাড়ি যেতে হতো, হোস্টেল অলরেডি বন্ধ হয়ে গেছে মহালয়ার পর পরই। আর বাড়িতে গিয়েও সে একা, কারণ মধ্য-কৈশোরে নতুন শহর এসে, সে বিশেষ কোন বন্ধু-বান্ধব জোটাতে পারেনি।
- বিগত কয়েক বছর ধরে তার পুজোটা বিদেশেই কাটছে। সে এখন জার্মানিতে আছে বার্লিন শহর এ, এখানে সে জিও-কেমিস্ট্রি-তে পিএইচডি করছে। এবারও তো সে দেশে গেল না পুজোতে, কিন্তু পরের বার যাবার খুবই চেষ্টা করবে, কারণ টা শুধু পুজো না। আসলে সামনের বছর তার পুরোনো যাদবপুর এর জিয়োলজি ডিপার্টমেন্ট এর রিইউনিয়ন আছে, ঠিক মহালয়ার পরে পরেই, দু বছর-এ এক বার আসে তাই এক বার মিস করলে হাঁ করে আবার দুটি বছর অপেক্ষা করো। আগেরটা মিস হয়ে গেছে, সদ্য সেবার জার্মানি এসেছিলো অক্টোবর-এর গোড়ায়, তাই আর যেতে পারেনি। অনেক সিনিয়র জুনিয়র ও বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, সে এক আলাদাই রোমাঞ্চ বলে ঠিক বোঝানো যাবে না, তাই সে এবার যাবেই।
~ ল্যাব এর খ্যান-খ্যানে ইন্টারকম-টার ডাকে তার হুঁশ ফিরলো, বস (পিএইচডি গাইড) এর ফোন।