শিক্ষাক্রম বা শিক্ষা কারিকুলাম হলো একটি দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার সংবিধান। শিক্ষাক্রম বলতে মূলত বোঝানো হয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনাকে। কোনো একটি শিক্ষা কার্যক্রম কী উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, কী বিষয় বস্তুর মাধ্যমে উদ্দেশ্য অর্জিত হবে, কখন, কিভাবে, কার সহায়তা এবং কী উপকরণের সাহায্যে তা বাস্তবায়িত হবে, শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, এসবের যাবতীয় রূপ রেখাকেই শিক্ষাক্রম বা শিক্ষা কারিকুলাম বলে।
শিশু আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করবে। মুখস্থ বিদ্যায় কোনো আনন্দ নেই। শিক্ষার্থীরা মুখস্থ না করতে পারলে কয়েকবছর আগেও বেত মারা হতো। মারের ভয়ে স্কুল পালাতো শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়তো। আধুনিক শিক্ষা এসেছে ইউরোপ থেকে। বৃটিশদের বদৌলতে আমরা তা পেয়েছি। তখন মুখস্থ করেই বিদ্যা শিক্ষা করতে হতো। এখন যুগ পাল্টেছে, কাজের ধরণ পাল্টেছে, বিদ্যার ধরণ পাল্টেছে। ইউরোপে বর্তমানে মুখস্থ বিদ্যা সিস্টেম নেই। বর্তমান বাংলাদেশেও যে, শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে তাও ইউরোপ থেকে আমদানি করা হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে শিক্ষকদের ধারণা দিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই নতুন শিক্ষাক্রমের অধীনে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কর্তৃক একটি বিশেষ স্কীম প্রণয়ন করা হয়েছে। এই স্কিমের আওতায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমের অধীনে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণকে বেশ কয়েকটি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে।
প্রথম স্তরে শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রমের মূল বিষয় বস্তু ও পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করা হবে। দ্বিতীয় স্তরে শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তৃতীয় স্তরে শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবিজ্ঞতা বিনিময় ও পরামর্শ দেওয়া হবে।
কেউ কেউ বলছেন নতুন শিক্ষাক্রমে থাকছেনা পরীক্ষা তাহলে কীভাবে হবে মূল্যায়ন, গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাধারণ মূল্যায়ন পদ্ধতি হচ্ছে পরীক্ষা যেখানে পরীক্ষার নম্বর দিয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতার মূল্যায়ন করা হতো। এই কারণে পরীক্ষা ভিত্তিক মূল্যায়নে শিক্ষার্থীরা শেখার চেয়ে পরীক্ষার নম্বরের প্রতি বেশি মনোযোগ দিত। তবে নতুন কারিকুলামের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি এসেছে এই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। শিখনকালীন ও সামষ্টিক এই দুটি পর্যায়ে সম্পন্ন হবে নতুন মূল্যায়ন প্রক্রিয়া।
নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছেনা। তবে এর উপরের শ্রেণিতে পরীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হচ্ছে শিখনকালীন ধারাবাহিক পদ্ধতিতে। অর্থাৎ বিষয় শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সারা বছর ধরে অ্যাসাইনমেন্ট ভিত্তিক কাজ, প্রকল্প ভিত্তিক শিখন চর্চা, খেলাধুলা, গ্রুপ ওয়ার্ক, কুইজ, পোস্টার প্রদর্শনী সহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাবেন এবং তাদের কাজের মূল্যায়ন করবেন।
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান এই পাঁচটি বিষয়ের উপর ৬০% শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৪০% সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। সিলেবাস শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে সে মূল্যায়ন সেটাকেই বলা হচ্ছে সামষ্টিক মূল্যায়ন। এ বিষয়গুলো ছাড়া বাকি তিনটি বিষয় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্পকলা এগুলোর শতভাগ মূল্যায়ন শিখনকালীনই করা হবে, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান এই পাঁচটি বিষয়ের উপর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। এছাড়া বাকি চারটি বিষয় জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিখনকালীন শত ভাগ মূল্যায়ন করা হবে।
নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান এই পাঁচটি বিষয়ের উপর ৫০% সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। এছাড়া বাকি পাঁচটি বিষয় জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা ও শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ের শতভাগ মূল্যায়ন করা হবে। দশম শ্রেণি শেষে দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির উপর পাবলিক পরীক্ষা হবে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ডের অধীন বর্তমান এসএসসি পরীক্ষার আদলে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তবে এ পরীক্ষার নাম পরিবর্তন হতে পারে।
বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম প্রাইভেট, টিউশন ও কোচিং নির্ভর হয়ে পড়েছে। বর্তমান কারিকুলাম প্রাইভেট টিউশন ও কোচিংয়ের থাবা থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করবে। ছেলে মেয়েরা স্কুলের শিক্ষা স্কুলেই শিখে এবং আনন্দের মধ্যদিয়ে শেখে। আমাদের দেশে স্কুল বন্ধ দিলে ছেলে মেয়েরা খুশি হয়। ইউরোপ স্কুল খোলা থাকলে বরং ছেলে মেয়েরা খুশি হয়। প্রাইভেট, কোচিং ও মুখস্থ বিদ্যা উন্নত বিশ্বে না থাকলেও বাংলাদেশে বহাল তবিয়তে আছে। এসব বদলাতে গেলেও সমস্যায় পড়তে হয়। বিদ্যালয়ে যাওয়া হয় বিদ্যার জন্য। সেখানে শিক্ষক রয়েছেন তাহলে কেন প্রাইভেট পড়তে হবে বা কোচিং সেন্টারে যেতে হবে।বিদ্যা দানের বিষয়, অর্থের বিনিময়ে বিক্রির বিষয় নয়। বিদ্যা বিক্রির কারণে শিক্ষকরা প্রাপ্য সম্মান পান না। আমাদের দেশে পরীক্ষায় ভালো করাকে মূল্যায়নের একমাত্র চাবিকাঠি বলে বিবেচনা করা হয়। পরীক্ষায় ভালো করলে সে ভালো মানুষ হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মেধার সাথে অন্যান্য গুণাবলিও বিবেচনায় আনতে হবে। নতুন কারিকুলামে সামষ্টিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তার পরেও এটা একটা পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা। আশা করি এতে সুফল মিলবে। আর ব্যত্যয় হলে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে অসুবিধা নেই।