(আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং দ্বীন-দুনিয়ার শান্তি ও মঙ্গলের লক্ষ্যে গঠিত সকল তরিকার সালেকদের মজলিস; যা আশেক সংস্থার সুফীজম প্রোগ্রামের অধিন পরিচালিত ।)
‘’পীর যার যার, তরিকত মজলিস সবার। হক তরিকত মজলিস আত্মশুদ্ধির বাগান, যে বাগানে বসলে ইমান সজিব হয়। আর সজিবতাই সফতলার পূর্বশর্ত। নির্জিবতা নীরব পরাজয় । যে ইমানের সজিবতা ও নির্জিবতা অনুভব করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত ইমানদার।‘’–সূফী খন্দকার হারুন অর রশিদ।
‘‘ক্বালব বা অন্তর পরিশুদ্ধিতে করুন ইবাদত, নিরুপণ করুন ইমান; ইহকালের শান্তি, হবে পরকালে কল্যাণ। মানব জাতির কল্যাণের ধর্ম দ্বীন-ইসলাম!!–সূফী খন্দকার হারুন অর রশিদ’’
এলমে ক্বালব বা এলমে তাসাওউফ(আত্মশুদ্ধি বিদ্যা) কি ? ইসালামী জীবন ব্যবস্থায় ইহার গুরুত্ব কতটুকু ?
দ্বীনি এলেম সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে, এলেম দু’প্রকার (১) লিসানী বা জবানী এলেম। এটা হলো আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে আদম সন্তানদের প্রতি দলীলস্বরূপ। (২) ক্বালবী এলেম। এটা হলো উপকারী এলেম। (মিশকাত শরীফ)।
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মালিকী মজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম, ইমামুল আইম্মা রঈসুল মুহাদ্দিসীন ফখরুল ফুকাহা শায়খুল উলামা হযরত ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন – যে ব্যক্তি এলমে ফিকাহ (জবানী এলেম) অর্জন করলো, কিন্তু এলমে তাছাউফ (ক্বালবী এলেম) অর্জন করলো না, সে ব্যক্তি ফাসিক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাছাউফের দাবি করে, কিন্তু শরীয়ত স্বীকার করেনা, সে ব্যক্তি যিন্দীক (কাফের); আর যে ব্যক্তি উভয় প্রকার এলেম অর্জন করলো সে ব্যক্তি মুহাক্কিক তথা মুমিনে কামেল। (মিরকাত, কিতাবুল ইলম)।
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় এলমে ক্বালবের গুরুত্বঃ ইমানের ৭৭টি শাখা-প্রশাখা আলোচনা করলে দেখে যায় যে অন্তরের সাথে অনেক আমল জড়িত। তাই আমরা বুঝতে পারি ইসলামিক জীবন ব্যবস্থায় এলমে ক্বালব বা এলমে তাসাওউফ(আত্মশুদ্ধি বিদ্যা) গুরুত্ব অপরিসীম।
পৃথিবীতে সকল বিদ্যা শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেমন ওস্তাদের এর প্রয়োজন রয়েছে, তেমনী এলমে ক্বালব বা এলমে তাসাওউফ(আত্মশুদ্ধি বিদ্যা) অর্জনের জন্য ওস্তাদ রয়েছে।এলমে ক্বালব(আত্মশুদ্ধি বিদ্যা) এর ওস্তাদ হলেন, হক্কানী আলেম, পীর মাশায়েখগণ। তাঁরা সিরাতাল মুস্তাকিমে পৌঁছানোর জন্য একজন সালেককে যিকির, মোরাকাবা ও মোশাহাদার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে থাকেন এবং ফায়েজ ও তাওজ্জোহ এর মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর সাথে নিসবত হাসিলের কৌশল শিক্ষা দিয়ে থাকেন এবং খাঁটি মোমিন বান্দা হওয়ার সঠিক পথ (সিরাতাল মুস্তাকিম) এর সন্ধান দিয়ে থাকেন।
এলমে তাসাউফের বিশেষ পরিভাষা হলো তরিকা। তরিকা আরবি শব্দ। এটি এক বচন, বহু বচন হলো তারাইক। প্রখ্যাত আরবি অভিধান লিসানুল আরবে এর অর্থ লেখা হয়েছে সিরাত, মাজহাব, অবস্থা। (লিসানুল আরব দশম খ-, ২২১ পৃষ্ঠা)। তরিকার আরও কতগুলো অর্থ করা যায় যেমনঃ পদ্ধতি, রীতি, উপায়, রাস্তা, পথ মত, মাধ্যম, স্তর। তরিকার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জুরজানি বলেছেন, আল্লাহর পথের অনুসারীদের বিভিন্ন মানজিল অতিক্রম করে উঁচু স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য যে বিশেষ রীতি-পদ্ধতি তাই হলো তরিকা। (আত্তারিফাত লিল আল্লামা জুরজানি, পৃ. ১৪১)।
ইসলামী জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় যেমন পদ্ধতিগত ভিন্নতা রয়েছে তেমনি এলমে তাসাউফের ক্ষেত্রেও এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন ভিন্ন রীতি-পদ্ধতি রয়েছে- এটাকেই বলা হয় তরিকা। এলমে ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফি, মালেকি, শাফেঈ ও হাম্বলি মাজহাব, ঠিক এলমে তাসাউফের ক্ষেত্রেও এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন ভিন্ন রীতি পদ্ধতি রয়েছে এটাকেই বলা হয় তরিকা। এলমে ফিকহের ক্ষেত্রে যেমন প্রসিদ্ধ চার মাজহাবের ইমামদের নামানুসারেই মাজহাবের নামকরণ করা হয়েছে, তেমনি এলমে তাসাউফের তরিকাগুলোকেও বিশেষ সুফিসাধকদের নাম দ্বারা নামকরণ করা হয়েছে। যে সকল তরিকা বিশেষভাবে প্রকাশ বা বিস্তার লাভ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-১. চিশতিয়া তরিকা ( প্রতিষ্ঠাতা হযরত খাজা মু’ঈনুদ্দিন চিশতি রহ.)। ২. কাদেরিয়া তরিকা ( প্রতিষ্ঠাতা হযরত আবদুল কাদির জিলানি রহ.)। ৩. নকশবন্দিয়া তরিকা (প্রতিষ্ঠাতা হযরত খাজা বাহাউদ্দিন রহ.)। ৪. মুজাদ্দিদিয়া তরিকা (প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানি রহ.)। ৫.শাযিলিয়া তরিকা(প্রতিষ্ঠাতা আবুল-হাসান-আশ-শাযিলি রহ.)। ৬. সুহ্রাওয়ার্দিয়া তরিকা (প্রতিষ্ঠাতা হযরত শিহাব উদ্দ্বীন উমার সোহরাওয়ার্দী রহ. )।
চরমোনাই পীর সৈয়দ মোঃ ফজলুল করীম রহ. সাহেবের ভেদে মারেফত বা ইয়াদে খোদা কিতাবে ১২৬ তরিকা কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে উল্লেখ যে, পদ্ধতিগতভাবে বিভিন্ন তরিকার জিকির ও মোরাকাবার পার্থক্য থাকলেও বিশ্বের সকল তরিকার লক্ষ্য এক এবং অভিন্ন।
অনেক পীর রয়েছেন, তাঁরা একাধিক তরিকার ছবক সালেকদের দিয়ে থাকেন; যাতে করে সালেকগণ সহজেই মাকাম হাসিল করতে পারেন। হাঁ, মাসুদিয়া তরিকত মজলিসে চিশতিয়া,কাদেরিয়া নকশবন্দিয়া-মুজাদ্দেদিয়া ও শাযিলিয়া তরিকার ছবকসমূহের তত্ব জ্ঞানের প্রেক্ষিতে সহজ নিয়মে সালেকদের শিক্ষা প্রদান করা হয়। ফলে অতি সহজেই এলমে ক্বালব বা এলমে তাসাওউফ (আত্মশুদ্ধি) অর্জন করতে পারেন । মনে রাখবেন জাহেরি আমল ও বাতেনী আমল এই দুয়ের সমন্বয়েই পরিপুর্ণ দ্বীন ইসলাম। সুতারং পরিপূর্ণ ইসলামে দাখিল হওয়ার জন্য আপনে যেমন যাহেরী আমল তথা শরীয়তি শিক্ষা নিতে হবে, অনুরুপ ভাবে বাতেনী আমল তথা এলমে ক্বালব বা এলমে তাসাওউফ (আত্মশুদ্ধি বিদ্যা) শিক্ষা নিতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে জাহেরী এবং বাতেনী আমলে মাধ্যমে পূর্নাঙ্গ দ্বীন ইসলাম মতে চলার তৌফিক দান করুন-আমন।