ULHAAS DP MAGAZINE 22
কৌতুক যখন বাস্তব
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কৌতুক বা চুটকীর বিরাট একটা প্রভাব দেখা যায়। এটার গুরুত্ব আজকের দিনে আরও বেশী যখন আমরা ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে গিয়ে হাঁপিযে যাচ্ছি ও একটু দমকা হাওয়া, একটু প্রানখোলা হাসির জন্য চাতক পাখির মতন চেয়ে থাকি। এই ইঁদুর দৌড় এর দৌলতে নিজের অজান্তেই আমরা কখন যেন মানব থেকে মেশীনে রুপান্তরিত হয়ে যাচ্ছি।
মজার কথা হলো আমরা প্রায় সবাই কৌতুক/কৌতুক নক্সা/jokes ভালবাসি ও আজকের দিনে ওয়াট্সআপ এর দৌলতে প্রায় জোর করে রোজ গিলতে হয় এমন সব পোস্ট যেগুলো কোনো মতেই কৌতুকের আওতায় পরে না। অর্থাৎ আমরা প্রায় সবাই বিশুদ্ধ কৌতুকের স্বাদ পেতে সব সময় উদগ্রীব ও উৎসাহি। ঠিক, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আজ আমার জীবনে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনার কথা বলবো যা আমার বিশ্বাস সকলের মুখেই এক চিলতে নিখাদ হাসি নিশ্চই নিয়ে আসবে।
তখন আমি বিহারের ভাগলপুরে কলেজের পড়াশোনা করি ও আমার বাবা নালন্দা জেলায় চাকরিরত। ছুটির সময় আমার গন্তব্যস্থল তাই মায়ের কাছে বিহারশরিফ। ভাগলপুর থেকে খুব সকাল বেলায় একটি ট্রেন ধরতে হতো - ‘আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস’, বক্তিয়ারপুর জংশন যাবার জন্য। এই রকমই এক ছুটির সময় আমি সক্কাল সক্কাল সেই ট্রেনে চেপেছি। কোনো রকমে প্রচন্ড ভিড়ের মাঝেও বসার জায়গা পেয়ে গেছিলাম। সহযাত্রীদের মধ্যে একজনের ছিল ৭-৮ সদস্যের বেশ বড় পরিবার ও তার সাথে তাল মিলিয়ে বাক্স-প্যাঁটরা। ভাগলপুর থেকে ট্রেনটি ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই সেই সহযাত্রী ভদ্রলোকটি তাঁর ঠিক পাশে বসে থাকা সহযাত্রীটি কে একটি আবেদন করলেন। তিনি জানালেন যে তাঁর পরিবারকে নিয়ে তিনি প্রথমবার জামালপুর যাচ্ছেন। তাই সহযাত্রী ভদ্রলোকটি যদি জামালপুর স্টেশনটি আসার বেশ কিছুক্ষণ আগেই তাঁকে তা জানিয়ে দেন তাহলে তিনি তাঁর পরিবার ও লটবহর নিয়ে সময়মত কামরার গেটের কাছে চলে গিয়ে নামার জন্য প্রস্তুত থাকবেন অন্যথা নামতে ভারি অসুবিধে হবে। এই বক্তব্যটি সহযাত্রী কে বলতে ভদ্রলোকের প্রায় দশ মিনিটের মতো সময় লেগেছিল। কারণ তিনি ছিলেন তোতলা ও কথা বলতে গিয়ে তাঁকে প্রচন্ড বেগ পেতে হচ্ছিল। “ভভভাাাাাাাাাাইইইইই সসসসসসাাাাাাহহহহহহাাাব” বলতেই কয়েক মিনিট কাবার হয়ে যায়। পাশে বসা ভদ্রলোকটি সব শুনলেন ও তবে কিছু বললেন না শুধু ঘাড় নাড়লেন। জামালপুর পৌঁছবার কিছুক্ষণ আগেই পাহাড়ে একটি টানেল/সুরঙ্গ আছে যেটা আমাদের ইঙ্গিত দিত যে জামালপুর স্টেশন এবার আসছে। যখন দেখলাম আর দেরি করলে ভদ্রলোক সপরিবারে ট্রেন থেকে নামতেই পারবেন না তখন আমিই ওনাদের বললাম যে জামালপুর স্টেশন এসে গেল বলে ও ওনাদের লটবহর নামাতে সাহায্য করেছিলাম। পাশে বসা অন্য সহযাত্রী ভদ্রলোকটি আশ্চর্যভাবে উদাসীন ও নির্লিপ্ত ভাবেই বসে রয়ে গেলেন ও কোন উচ্চ-বাচ্যই করলেন না স্টেশন এসে যাওয়া সম্বন্ধে। সপরিবারে ওই সহযাত্রীটিকে স্টেশানে নামিয়ে দিয়ে আবার নিজের জায়গায় এসে বসলাম। অন্যান্য সহযাত্রীরা আমার বেশ প্রশংসাও করলেন ওনাদের সাহায্য করার জন্য। তবে আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল ওই নির্লিপ্ত ভাবে বসে থাকা সহযাত্রীটির ওপর যিনি নির্বিকার ভাবে বসেছিলেন ও কোনো কিছুতেই রা কাটছিল না। থাকতে না পেরে আমি তখন ওনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে অন্যান্য সহযাত্রীদের বলছিলাম যে কত রকম লোকই না এই পৃথিবীতে আছে যারা অন্যকে সামান্য সাহায্যটুকুও করতে নারাজ। শুধু মুখ খুলে বলে দেওয়া, তাও আর কেউ কেউ করতে চায় না। ঘোর কলিকাল … ইত্যাদি, ইত্যাদি। অন্য সহযাত্রীরাও আমার কোথায় শুধু সায়ই দিলেন না বরং আরও দু কথা ঠেস দিয়ে শোনাতে লাগলেন। ক্রমশঃ ওই সহযাত্রীটি যেন এক ঘরে হয়ে যাচ্ছিলেন আমাদের সেই তির্যক বাক্যবাণে। আমাদের সেই বাক্যবাণের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়ে আর থাকতে না পেরে, শেষে ওই সহযাত্রীটি প্রচন্ড রেগে ফেটে পড়লেন ও তত্পশ্চাত ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন - “মমমমমাাাাাররররররর খখখখাাাাননননাাাাাাাাা থথথথথথাাাাাাা কককক্ য়য়য়যয়াাাাাাাা”। ওঁনার মুখ থেকে ওই কথা শোনার পর কামরায় তখন যেন ছুঁচ পড়লেও শুনতে পারতাম গোছের নিরবতা। না হাসতে পারছি না কথা বলতে পারছি। সবার বাকরুদ্ধ হয়ে চক্ষুচরক গাছ গোছের অবস্থা। বাস্তবে যে এই ঘটনা ঘটতে পারে, তার আগে কখনো ভাবি নি। কৌতুক যদি বাস্তবে ঘটে তখন সেটা কতটা রোমাঞ্চকর হতে পারে আমি তার ভুক্তভোগী।
এই ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৬ এর ২৬শে জানুয়ারি। আমার বড়মামুর বিয়েতে আমরা সবাই শেওরাফুলী পৌঁছেছি। উঠেছি দাদুর এক বোনের বাড়িতে।সেখানেই নান্দিমুখ, গায়ে-হলুদ ইত্যাদি অনুষ্ঠান হওয়ার পর বিকেলে লোকাল ট্রেনে চড়ে আমরা সবাই কলকাতা আসছি। আমার ঠিক পাসেই বসেছেন ছোট-দাদু(দাদুর ছোট ভাই)। নানা রকম কথাবার্তা হচ্ছিল আমাদের মধ্যে। হটাত তিনি আমাকে বললেন - “এটা কোননগর”। আমার তৎক্ষণাৎ উত্তর “জানিনা”।
দাদু : আরে এটা কোননগর ;
আমি : জানিনা তো ;
দাদু : এটা কোননগর ভাই !
আমি : আমি জানিনা ভাই !
দাদু : আচ্ছা ছেলে তো তুমি - এটা কোননগর
আমি : দাদু, আমি সত্যি জানিনা
দাদু : দাদুভাই, এই স্টেশানটার নাম কোননগর;
আমি : ও তাই।
ততক্ষণে আমাদের কথোপকথন অনেকেই শুনতে পেয়েছেন ও বরযাত্রীর দলে তখন হাসির রোল উঠেছে। আজও মামাবাড়ির পুরোন দিনের স্মৃতিচারণে শৈশবের ওই ঘটনা টা যেন জ্বল জ্বল করছে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া এই রকম বহু ঘটনাই কিন্তু কৌতুকে ভরা। অনুভবটা আমাদেরকেই করতে হবে যাতে আমাদের জীবনে হাস্যরসের সরবরাহটা অব্যাহত থাকে।
Note: Picture courtesy-from ABOL TABOL for the write up ALHADI.
- প্রবীর রায়