* শিউলি *
মনতোষ মিশ্র
বিহাইকে গুঁতাইছে কাড়হাতে
বিহাই পইড়ে আছে আঁকবাড়ীর লালহাতে,
বিহাইকে গুঁতাইছে কাড়হাতে।
- কিছু বুঝলে ব শহুরে বাবু এই বাঁকড়ি পাড়াগাঁইয়া গান ?
- কেন বুঝব না জেঠু ! বিহাই মানে, বেয়াই মশাইকে মহিষে শিঙের গুতো মেরে আখবাড়ীর নালীতে ফেলে দিয়েছে।
- বা ঠিক বলেছ, তবে জমিয়ে গল্প করতে হলে তোমার ভাষাতেই কথা বলব।
- জেঠু তুমি বাথানজোড় স্কুলের মাষ্টার ছিলে ?
- হ্যাঁ, স্কুলের চারিদিকে ফুল, ফল, গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা, একটু দুরেই রেললাইন মনে হত বাথানজোড় গ্রামকে দু-ভাগ করে দিয়ে চলে গেছে দূরে বহুদুরে, খুব ভাল লাগতো বুম্বা।
- জেঠু তুমি আমাকে তোমার দেওয়া নাম সরিৎ বলে ডাকবে।
- তাই হবে সরিৎ , গাঁয়ের ছোট নদীতে তখন ছিল একুল ওকুল বান, বর্ষার নদী ভয়ংকর সুন্দর সেইসময় তুমি জন্মালে ! আমার মনে হল তুমি নদীর মতো সুন্দর গতিময় হবে, তোমার বাবা মানে আমার আদরের ছোটভাইকে বললাম বিজন ওর নাম রাখলাম সরিৎ -।
জেঠুকে অনেকবার ওখানে নিয়ে যেতে চেয়েছেন বাবা, কিন্তু কিছুতেই গ্রাম ছেড়ে যাবেন না তিনি। সুখ দুঃখ কান্না হাসি ঝগড়া ঝামেলা আর কষ্টের মধ্যেই এই গ্রামেই থেকে গেলেন। সামান্য জমি পুকুর চাষ বাস আর ছেলে-মেয়েদের টিউশনি পড়িয়েই তার প্রাত্যহিকী । কেন যে তিনি বিয়ে করলেন না ! এত কষ্টের মধ্যেও তাঁর সবসময় হাসিমুখ শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় ।
- কি ভাবছো সরিৎবাবু ?
- কিছু না, জেঠু একবার ছোট নদী দেখতে যাবো –
- ঠিক আছে, আমার প্রিয় ছাত্র মিতুনের সাথে যাও খুব ভালো লাগবে ।
পরের দিন গাছগাছালি, ঝোপ ঝাড়, ছোট পাহাড় পেরিয়ে নদীর কাঁচজলে সূয্যিমামার ডুব দেখে সে মুগ্ধ হয়ে উঠে। মিতুন কে বলে মিতুন নদীর কাঁচজলে সূয্যিমামার ডুব কেমন লাগছে তোমার ?
- আমি তো প্রায়ই দেখছি, সারাদিন পরিশ্রম করে আর ভালো লাগে না, তোমার জেঠু দয়াল মাষ্টার এখানে এসে ছবি আঁকতেন, তুমি ওনার কাছে গিয়ে দেখতে পাবে কত সুন্দর সুন্দর ছবি। চল অন্ধকার হয়ে আসছে, এখানে খুব সাপের ভয় তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে যাই।
বাড়ী ফিরে দেখে জেঠু হ্যারিকেনের আলোতে কবিতা পড়ছেন তাকে দেখে বলেন কেমন দেখলে আমাদের ছোট নদী – -
- খুব সুন্দর ! জেঠু, মিতুন বলছিল তোমার আঁকা অনেক ছবি আছে, আমাকে দেখাও –
- ঠিক আছে দেখাচ্ছি, বলেই তিনি পাশের ঘরে থেকে একটা ফাইল থেকে এক এক করে দেখান তাঁর আঁকা ছবিগুলো, সরিৎ-আমি ছবি আঁকা কারো কাছে শিখিনি রবিঠাকুরের সহজপাঠের ছবিগুলো খুব ভালো লাগত ! একদিন আমার হাইস্কুলের মাষ্টার মশাই রঞ্জিতবাবুর কাছে ছবিগুলো নিয়ে জানতে চাইলে উনি বললেন’ নন্দলাল বসুর ঐ সব রৈখিক সাদা-কালো ছবি অসাধারন ! ইউরোপে তখন শিল্পীরা উডকাট ব্যবহার করতেন, কিন্তু নন্দলাল বাবু উডকাটের বদলে লিনো ব্যবহার করেন বিশ্বে প্রথমবার। বিখ্যাত শিল্পী শিকাগো তার পনের বছর পর লিনোকাট করেছিলেন। একটার পর একটা ছবি দেখে অবাক হয়ে যায় সে, এরই মাঝে ফুলের জঙ্গলের পাশে একরাশ ঘন কালোচুল টানাটানা চোখ ছাপা ফ্রক পরা একটি মেয়ের ছবি দেখে জিজ্ঞেস করে “জেঠু এই ছবিটা কার ? জেঠু বলেন রাত হয়েছে, আজ নয় কাল সকালে এই ছবির কথা জানাব। যাও আর দেরী করো না শুয়ে পড় গিয়ে।
ভোরে উঠেই জেঠুর সাথে বেরিয়ে পড়ে একটা শিশির ভেজা কালো পাথরের উপর বসে জেঠু বলেন- এখান থেকে একমাইল দূরে আমাদের হাইস্কুল রবি, শম্ভু, মানিক, ঝিলিক, মাধুরী শিউলি সকলে মিলে স্কুলে যেতাম, যে ছবিটা দেখছ ওটা আমাদের শিউলির ছবি। ভগবান, ঠাকুর, দেবতা ওসব কিছু বিশ্বাস করতো না, বলত মানুষই সব। ওর মা মারা যাওয়ার পর, ছোট ভাইকে উপোসে রেখে মাথা ন্যাড়া করতে দেবে না বলাতে বামুন পুরোহিত, আত্মীয় স্বজনদের অত্যাচারে পেরে উঠেনি। কিছুদিন পরে মন্দিরের পুজোতে পাঁঠাবলি হতে দেবে না বলে রুখে দাঁড়ায়, এরকম কুসংস্কার সে হতে দেবে না। কিন্তু গ্রামের লোকজন ও মোড়লের আদেশে শিউলিকে মাথা ন্যাড়া করে, মুখে চুন-কালি মাখিয়ে মারধোর করে নদীর জলে ফেলে দেয়। পরের দিন তার লাশ নদীর জলে ভাসছিল ! সব শেষ…।
শিউলি কবিতা খুব ভালবাসত; একটা কবিতার লাইন প্রায়ই শোনাত আমাদেরকে –
- কি কবিতা শোনাও না !
- কবিতাটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে নাজিম হিকমতের। কিছু কিছু লাইন মনে পড়ছে শোনাচ্ছি –
“রাত্রির অন্ধকারে গ্রামদেশে শুকনো পাতায় আমি জ্বালিয়েছিলাম আগুন আমি স্পর্শ করেছি সেই আগুন- / নক্ষত্রের নিচে জ্বালা অগ্নিকুন্ডের মত তুমি / আমার প্রিয়তমা তোমাকে স্পর্শ করেছি / আমি আছি মানুষের মাঝখানে, ভালবাসি আমি মানুষকে ….
-দারুন আবৃত্তি কর তুমি ! চল না জেঠু আমাদের ওখানে কয়েকদিন - !
- না সরিৎ, আমার এই গ্রাম ছেড়ে আর কোথাও যাবো না এখানের সুখ দুঃখ, ব্যথাবেদনা, ইর্ষা, লোভ, কুসংস্কার, স্বার্থপরতা, নদী, মাঠ, ঘাট, গাছগাছালি ছেড়ে কোথায় যাবো না ! আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, শিউলিফুল ! সারাগ্রাম ম – ম – করছে সুগন্ধে, শিউলি ফুলের গন্ধে…।
MANOTOSH MISRA
KOLKATA, INDIA