আইএমএফ (IMF) ঋণের আদ্যোপান্ত
এক নজরেঃ
মোট ঋণের পরিমাণ- ৪৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বা ৪৭০ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
৭ কিস্তিতে আগামী ৪২ মাসে পুরো ঋণ পাবে বংলাদেশ
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার এসেছে ১ম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
শতপূরণ সাপেক্ষে ৬ মাস পর পর আসবে বাকি ৬ কিস্তি
প্রতি কিস্তি হবে ৭০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের
২ দশমিক ২ শতাংশ সুদে নেওয়া হচ্ছে এই ঋণ
২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণের সর্বশেষ কিস্তি আসবে
ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরে।
ঋণ কার্যক্রমের সূচনা ও অগ্রগতিঃ
গত বছরের (২০২২) জুলাই মাসে আইএমএফ এর কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে সংস্থাটির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ২৬শে অক্টোবর ঢাকায় আসে। তারা ৯ ই নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আন্ত:মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে। সর্বশেষ ৩০ জানুয়ারি সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী ও পরিচালনা পর্ষদে পাস হয় বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব এবং ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার জমা হয়। ঋণের বাকি অর্থ পাওয়া যাবে তিন বছরে অর্থাৎ ছয়টি সমান কিস্তিতে ৩৬ মাসে। দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে এ বছরের ডিসেম্বরে আর শেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। এসব কিস্তির পরিমাণ ৭০ কোটি ৪০ লাখ ডলার করে।
যে বাস্তবতায় ঋণ নিতে হচ্ছে
আইএমএফ থেকে অর্থ চাওয়ার কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়-
বিশ্ববাজারে অভূতপূর্ব হারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কোভিডের ক্ষত সারিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন বিপদ হিসেবে আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। প্রায় এক বছরে চাল, গম, ভুট্টা, সার, ভোজ্যতেলের মতো নয়টি পণ্যে বাড়তি গুনতে হয় ৭৬০ কোটি ডলার।
আর আমদানিতে নাটকীয় উত্থান হয় দেশে। ২০২১-২২ অর্থবছরের (জুলাই-মে) ১১ মাসে আমদানি বাড়ে আগের তুলনায় ৩৯ শতাংশ। বাণিজ্য ঘাটতিও দাঁড়ায় ২ হাজার ৮২৩ কোটি ডলারের। এ ছাড়া চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয় ১ হাজার ৭২৩ কোটি ডলার। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ২৭৮ কোটি ডলার।
প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ।
অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে বিশ্বের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ হারাবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ, আর শেষ দিকে হারাবে জিডিপির ৯ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ১০০ বছরের ডেলটা পরিকল্পনার পাশাপাশি পাঁচ বছর মেয়াদি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করেছে সরকার। এ জন্য জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ অর্থ লাগবে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার চারটি মূল লক্ষ্য বলেন-
অর্থনীতির বহিঃ খাতকে স্থিতিশীল করা,
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উত্তরণ সামনে রেখে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেওয়া,
আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা এবং
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা করে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা
অন্যদিকে, রাহুল আনন্দ জানান, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং বিভিন্ন ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টিকারী উপাদান ঠেকাতে নতুন এ ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে।
ঋণের বিস্তারিত বিবরণঃ
বাংলাদেশ ৩ প্রকার ঋণের মাধ্যমে আইএমএফের বর্তমান ঋণ পাবে। সেগুলো হচ্ছে—
বর্ধিত ঋণসহায়তা- Extended Credit Facility (ECF): ১০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি;
বর্ধিত তহবিল সহায়তা- Extended Fund Facility (EFF): ২১৫ কোটি ডলার ও
রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি- Resilience and Sustainability Facility (RSF): ১৩০ কোটি ডলার।
যেসব দেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতায় ভোগে অর্থাৎ রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করে, IMF তাদেরই ECF আওতায় ঋণ দেয়। ECF-র অধীনে বাংলাদেশ পাবে ১০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এ জন্য কোনো সুদ দিতে হবে না।
যেসব দেশ অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে লম্বা সময় ধরে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতায় ভোগে, তাদের ঋণ দেয় EFF থেকে। EFF-র অধীনে বাংলাদেশ পাবে ২১৫ কোটি ডলার।
আর RSF-র আওতায় আইএমএফ ঋণ দেয় সেসব নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশকে, জলবায়ু পরিবর্তন ও করোনাভাইরাসের মতো দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে যাদের কষ্ট হচ্ছে। RSF-র অধীনে বাংলাদেশ পাবে ১৩০ কোটি ডলার। সবমিলিয়ে ঋণের সুদ নির্ধারণ হয়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশের মতো।
ঋণ পরিশোধের সময়
তিন ধরনের ঋণের মধ্যে RSF-র ১৩০ কোটি ডলার পরিশোধে বাংলাদেশ সময় পাবে ২০ বছর। তবে ১০ বছরের একটা গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যাবে। প্রথম ১০ বছর অবশ্য কোনো ঋণ পরিশোধ করা লাগবে না। একাদশ বছর থেকে পরিশোধ করতে হবে এ অংশের কিস্তি।
ECF ও EFF-র বাকি ৩২০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে বাংলাদেশ সময় পাবে ১০ বছর। এ অর্থ দুই ভাগে পরিশোধ করা যাবে এবং আলাদা আলাদা গ্রেস পিরিয়ড থাকবে এখানেও। যেমন EFF-র ঋণ সাড়ে ৪ থেকে ১০ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে। এর জন্য সাড়ে ৩ বছর পর্যন্ত কোনো ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। আর ECF-র ঋণ পরিশোধ করতে হবে না সাড়ে ৫ বছর পর্যন্ত।
ঋণের শর্ত
সরকারের দপ্তরগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত মিশনের বৈঠকে মোটাদাগে তিনটি খাতের সংস্কারের বিষয় উঠে আসে। IMF-র ভাষায় এগুলো হচ্ছে-
গুণগত মান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত (কিউপিসি),
অবকাঠামোগত মান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত (এসপিসি) ও
সাধারণ প্রতিশ্রুতি।
এর মধ্যে কিউপিসি ও এসপিসি হচ্ছে বাধ্যতামূলক শর্ত। এ শর্ত মানতেই হয়। নইলে কিস্তি আটকে যায়।
গুণগত মান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্তঃ
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা,
বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পদ্ধতি ঠিক করা,
জিডিপির তুলনায় অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের হার বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।
অবকাঠামোগত মান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্তঃ
জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে পদ্ধতি কার্যকর করা,
আয়কর আইন সংসদে পাস করা,
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা,
আদায়ের অযোগ্য খেলাপি ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করা,
কর ছাড়ের ওপর বিশদ নিরীক্ষা করা,
বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ রাখা
ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করা,
বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করা,
ব্যাংকঋণের বর্তমান সুদহার ৯ শতাংশ তুলে দেওয়া,
নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা,
কার্বন ট্যাক্স প্রবর্তন,
বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ও সুদের হারের নির্দিষ্ট সীমা প্রত্যাহার করা ইত্যাদি।
সর্বোপরি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অনুমোদন করা ঋণ পেতে বাংলাদেশকে মোটা দাগে পাঁচ ধরনের সংস্কারকাজ করতে হবে। সেগুলো হলো-
রাজস্ব সংস্কার,
মুদ্রা ও বিনিময় হারের সংস্কার,
আর্থিক খাতের সংস্কার,
জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সংস্কার এবং
সামষ্টিক কাঠামো সংস্কার।
১২ মাসে যেসব শর্ত মানতে হবে
আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত এসব সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকলেও কিছু কাজ করতে হবে অনেকটা জরুরি ভিত্তিতে, আগামী এক বছরের মধ্যে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে যেসব সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে, সেগুলো হলো-
এমন কর রাজস্বব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর আদায় হয়। আইএমএফ মনে করে, পৃথিবীর যেসব দেশে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তার একটি। কর আদায় কম হওয়ায় প্রয়োজনীয় খাতে যথেষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ করা যায় না। তাই আগামী জুনের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে আইএমএফ। আগামী বাজেটেই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে। আইএমএফ বলছে, বাড়তি অর্থ পাওয়া গেলে অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোতে বাংলাদেশ আরও বেশি খরচ করতে পারবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক এবং ভ্যাট বিভাগে কমপ্লায়েন্স ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। আর এটি করতে হবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে। মূলত রাজস্ব আদায় বাড়াতে এ পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
দেশজ উৎস থেকে যে পরিমাণ অর্থ বাজেটঘাটতি পূরণে ব্যবহার হয়, অর্থাৎ সরকার যত ঋণ করে, তার এক-চতুর্থাংশের কম নিতে হবে সঞ্চয়পত্র থেকে। সে লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সরকার প্রতিবছর বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ বাবদ বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখে। আইএমএফ চায়, সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ খাতে খরচ কমিয়ে অগ্রাধিকার খাতে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করুক। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে।
পেট্রোলিয়াম–জাতীয় পণ্যের দাম একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সমন্বয়ের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার। ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজটি করতে হবে। এ প্রস্তাব করা হয়েছে মূলত জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে। এ পরামর্শের কারণও অভিন্ন—অগ্রাধিকারমূলক খাতের জন্য ব্যয় বাড়ানো।
ট্রেজারি সিঙ্গেল অ্যাকাউন্ট বা সরকারি কোষাগারের অর্থ জমার একক ব্যাংক চালুর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে একটি নীতি প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে এই কাজটি করতে হবে। সরকারের নগদ অর্থের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং রাজস্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে এ পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
বাংলাদেশ ব্যাংককে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে একটি সুদহার করিডর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সুদহার করিডর এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সুদহারের বেঁধে দেওয়া সীমা ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহারে পরিচালনভিত্তিক পরিবর্তন করা যায়।
নির্দিষ্ট সংজ্ঞা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের হিসাব করতে হবে। মূলত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব প্রদর্শনের পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এ কাজটি করতে হবে জুনের মধ্যে। আইএমএফ মনে করে, তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও রিপোর্টিংয়ের মান বাড়বে। পাশাপাশি একই সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আইএমএফের শর্ত মেনে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি অর্থবছরে একবার জিডিপির হিসাব প্রকাশ করা হয়। দাতা সংস্থাগুলোর অনেক দিনের পরামর্শ জিডিপির হিসাব আরও নিয়মিত ভিত্তিতে প্রকাশ করা। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি এবং নীতিনির্ধারণী কর্মকাণ্ড আরও শক্তিশালী হবে বলে আইএমএফ মনে করে।
ঝুঁকিভিত্তিক তদারকির কর্মপরিকল্পনা নিয়ে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প আগামী জুনে শেষ করতে বলা হয়েছে। এর লক্ষ্য ঝুঁকিভিত্তিক ব্যাংকিং তদারকি ব্যবস্থা চালু করা। আর সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২০ এবং আর্থিক কোম্পানি আইন ২০২০ জাতীয় সংসদে পেশ করতে হবে। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর খারাপ সম্পদের তথ্য প্রকাশের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। এ তথ্য প্রকাশ করা হলে ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা বাড়বে বলে মনে করে সংস্থাটি। আর এ কাজটি করতে হবে জুনের মধ্যে।
রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) ঋণের আওতায় চলতি বছরে বাংলাদেশকে যেসব শর্ত ১২ মাসের মধ্যে মানতে হবে তার মধ্যে রয়েছে-
১ম শর্তটি হলোঃ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরকারি কেনাকাটা-সংক্রান্ত একটি নীতি দলিল ও সহযোগী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। এ শর্ত দেওয়া হয়েছে মূলত সরকারের কেনাকাটা যেন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাস করতে ও পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করে সে জন্য।
২য় শর্তটি হলোঃ পেট্রোলিয়াম–জাতীয় পণ্যের দাম একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সমন্বয় করার ব্যবস্থা গ্রহণ। সরকারি অর্থ খরচের দক্ষতা বাড়াতে এক্সটেন্ডেট ক্রেডিট ফ্যাসিলিটির আওতায় এ শর্ত দেওয়া হয়েছে। এই কাজটি করতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে।
তৃতীয় শর্তটি পালন করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলেছে। এ নীতিমালার আওতায়সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জলবায়ুজনিত ঝুঁকি সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজটি করতে হবে।
শর্ত বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতিঃ
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশ যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে করছে সেটি আন্তর্জাতিক মাণদণ্ড অনুযায়ী করা হচ্ছে না। রিজার্ভ থেকে যেসব অর্থ বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করা হয়েছে সেটি হিসেব থেকে বাদ দিতে হবে। ফলে প্রকৃত রিজার্ভ আরো কমে যাবে।
ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেলের দাম কয়েকমাস আগে জ্বালানী তেলের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছিল বাংলাদেশ সরকার। বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার চিন্তাভাবনাও করা হচ্ছে।
বছরে দু’বার মুদ্রানীতি ঘোষণা শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ভোক্তা ঋণের সুদহার তিন শতাংশ বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংক আমানতের বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে দেওয়া হয়েছে।
ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
আর্থিক খাতের সংস্কারে কয়েকটি নতুন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি পুরনো আইন সংশোধনে কাজ চলছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গিয়েছে ইত্যাদি।
IMF থেকে নেয়া পূর্বের যত ঋণঃ
বাংলাদেশ যে এবারই প্রথম আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে তা নয়। ছোট-বড় আকার মিলিয়ে সংস্থাটি থেকে মোট ১০ বার ঋণ নিয়েছে আগে। প্রথমবার নেয় ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৮০-৯০ সময়ে ঋণ নেওয়া হয় পাঁচবার। ১৯৯০ সালে নেওয়া ঋণের বিপরীতে আইএমএফের শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করা। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান তা সফলভাবেই কার্যকর করেছিলেন। বাণিজ্য উদারীকরণসহ ব্যাংক খাতের সংস্কারের শর্তও ছিল তখন। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বাড়তে থাকে এবং আসতে থাকে বিদেশি বিনিয়োগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানিও বাড়তে থাকে।
১৯৯১-২০০২ সময়ে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশকে কোনো ঋণ নিতে হয়নি। তবে পরের বছর অর্থাৎ ২০০৩ সালেই নিতে হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনার শর্ত ছিল তখন। লোকসানি পাটকলগুলোও বন্ধ করা হয়েছিল তখন। আদমজী পাটকলও বন্ধ করা হয়েছিল। আবার প্রায় এক দশক পর ২০১২ সালে সাত কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলার আইএমএফ থেকে নেওয়ার চুক্তি করে বাংলাদেশ। অন্যতম শর্ত নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা। এ আইন করতে দেরি করায় শেষের দুই কিস্তি আটকেও দিয়েছিল আইএমএফ।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরদের মতে অর্থনীতিতে এই ঋণের ভালো ও খারাপ প্রভাবঃ
আইএমএফ বাংলাদেশকে শর্ত দিয়েছে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নেবার জন্য। এজন্য সরকার এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। অতীতেও ঋণ দেবার সময় ভর্তুকি তুলে নেয়া এবং নানা ধরণের সংস্কারের শর্ত বাংলাদেশকে মানতে হয়েছিল।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের মতে, আইএমএফের ঋণে একটা অবশ্য লাভ সরকার আশা করছে। সেটা হচ্ছে এখন অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও ঋণ দিতে চাইবে। অথচ দরকার হচ্ছে বেশি ঋণের পরিবর্তে বরং অভ্যন্তরীণ আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সুসংহত করা। আর আইএমএফ বললেই সংস্কার, নইলে নয়—এমন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তবে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, সরকার সংস্কার কর্মসূচি ঠিক মতো বাস্তবায়ন করলে স্বল্পমেয়াদে কিছু অসুবিধা তৈরি হতে পারে। যেমন টাকার অবমূল্যায়ন হলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে কিন্তু সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমে আসবে। ফলে ব্যাংক তারল্য সংকট কমবে এবং মূল্যস্ফীতির ওপর এর প্রভাব পড়তেও পারে।
তথ্যসূত্রঃ
https://bangla.thedailystar.net/economy/news-417341
https://www.prothomalo.com/business/economics/1p1y3e4rm9
আইএমএফ-এর ঋণ পাওয়ার শর্ত কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে?
আইএমএফ এর শর্ত বাস্তবায়ন কি সরকারের জন্য কঠিন হতে পারে?
https://www.bbc.com/bengali/news-62515898
https://bangla.bdnews24.com/economy/cbut9xwsn2
https://www.prothomalo.com/business/bank/un93lory8r
মাহিন জামান লাবিব- ১২/০২/২০২৩
To get the PDF- Click here