অণুজীবের প্রাণরসায়ন ও প্যাথোজেনেসিস রিসার্চ গ্রুপ
সার্বজনীন কল্যাণের স্বার্থে অণুজীব
অণুজীবের প্রাণরসায়ন ও প্যাথোজেনেসিস রিসার্চ গ্রুপ
[+] স্থাননির্দেশক: গবেষণা > উপকারী অণুজীব | অন্যান্য পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুণ।
মানুষসহ বহু প্রানী আর উদ্ভিদের সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে অনুজীবের ভূমিকা অপরিসীম। মজার ব্যপার হল, প্রাণীদেহে অণুজীবকোষের সংখ্যা প্রানীকোষের চাইতেও বহুগুনে বেশি! আমাদের নিজেদের কথাই যদি বিবেচনা করি, মানবদেহে প্রতিটা মানবকোষের বিপরীতে ১০টি করে অণুজীবকোষ আছে! অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবিক পক্ষেই, আমাদেরই দেহে আমাদের নিজেদের কোষের চাইতেও অণুজীবের কোষ ১০ গুণ বেশি। অণুজীবকোষের সংখ্যা এতো বেশি হওয়া স্বত্বেও আমরা একে বলি "মানবদেহ"! এই অনুজীবগুলোর মাঝে বহু অণুজীব আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিনিয়ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের পাকস্থলীতে কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যেগুলো কয়েক ধরণের উৎসেচক নিঃসরণ করে আমাদের বিপাক প্রক্রিয়া, হজম আর পুষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহায্য করে। এই উৎসেচকগুলোর কোন কোনটা অত্যন্ত জরুরি কেননা এগুলো আমরা নিজেরা তৈরি করতে পারিনা বলে সম্পূর্ণভাবে অণুজীবের উপরই নির্ভর করতে হয়। অন্যদিকে, আমাদের দেহে বিভিন্ন বিপাকক্রিয়ায় যে ক্ষতিকর পদার্থগুলো তৈরি হয়, সেগুলোর নিষ্ক্রমণের ক্ষেত্রেও অণুজীবের অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়া আমাদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিকাশ, মানসিক চাপ কমানো, ভিটামিন তৈরিসহ নানাবিধ কাজে অণুজীবের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। কিছু কিছু অণুজীব যেমন ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া এমনকি আমাদের দেহে "ভালো কোলেস্টেরলের" পরিমাণ বাড়াতে, আবার একইসাথে "খারাপ কোলেস্টেরলের" পরিমাণ কমাতে পর্যন্ত কাজ করে। শুধু যে প্রাণীদেহের জন্যই দরকারি তাই না, উদ্ভিদের গঠন আর বিকাশেও অণুজীব, বিশেষত ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নাইট্রোজেন ফিক্সেশন, খনিজ পদার্থ শোষণ, উদ্ভিজ্জ হরমোন প্রস্তুতসহ উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় নানাবিধ দরকারে অণুজীবের রয়েছে সমান গুরুত্বপূর্ণ অবদান। উদ্ভিদ এবং প্রাণীদেহের সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অণুজীবের এই আবশ্যকীয়তা বিবেচনায় আমরা মূলত দুই ধরণের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার অনুসন্ধান এবং বৈশিষ্ট নির্ধারণের কাজ করছিঃ (১) প্রোবায়োটিক ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া এবং (২) উদ্ভিদের বৃদ্ধিকারী ব্যাকটেরিয়া।
সুস্বাস্থ্য আর খাদ্যাভাস বিবেচনায় গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক হল আমাদের খাদ্যদ্রব্যে এবং চিকিৎসায় অণুজীবের ব্যবহার। বিশেষ করে সুস্থতা আর রোগ প্রতিরোধে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ইতোমধ্যেই স্বীকৃত ও সর্বজনবিদিত। ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া হল গ্রাম পজিটিভ মাইক্রোঅ্যারোফিলিক বা অ্যানেরোবিক অণুজীব যারা শর্করাজাতীয় পদার্থের বিপাক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে মূল প্রোডাক্ট হিসাবে ল্যাকটিক এসিড উৎপাদন করে। এই অণুজীবগুলো বেশকিছু জরুরী মেটাবোলাইট তৈরি করতে পারে যেগুলো একই সাথে খাদ্যের পুষ্টি এবং গুণগত মান বৃদ্ধি করে, পাশাপাশি আমাদেরকে সুস্বাস্থ্য এবং রোগপ্রতিরোধ সংক্রান্ত বহুবিধ সুবিধা প্রদান করে। যেমন অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, অ্যান্টিম্যুটাজেনিক, অ্যান্টিক্যান্সার অ্যাক্টিভিটি, ক্ষতিকর জীবাণু থেকে সুরক্ষা, উন্নত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রভৃতি আমরা এসব অণুজীব থেকে পেয়ে থাকি। এতোসব গুণাবলীর কারণে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অনুজীবগুলোর মাঝে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়াকে একেবারে প্রথম কাতারে বিবেচনা করা হয়। ইতোমধ্যেই কিছু কিছু খাদ্যদ্রব্য আর ঔষধে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়ার কয়েকটি প্রজাতিকে উপকারী অণুজীব হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদেশের ফার্মেসীগুলোতে এমন ঔষধ-পথ্য এখন তুলনামূলকভাবে বেশ সহজলভ্য। অনুজীবগুলোর অপরিসীম গুরুত্বের কারণে উচ্চ প্রোবায়োটিক ক্ষমতা সম্পন্ন নতুন নতুন ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়ার অনুসন্ধান বুহুদিন ধরে অব্যাহত আছে। আমরাও দেশীয় কিছু নমুনায় নোভেল প্রোবায়োটিক স্ট্রেইনের খোঁজ করছি। এরই মধ্যে কিছু সম্ভাব্য প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া আইসোলেট এবং সংরক্ষণ করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এই স্ট্রেইনগুলোর প্রোবায়োটিক বৈশিষ্ট মূল্যায়ন করা হবে।
রাইজোবিয়া হল উদ্ভিদের মূল সংলগ্ন মাটিস্থ ব্যাকটেরিয়া যেগুলো মূলের বহির্ভাগে বা মূলের নোড্যুলে অবস্থান করে নাইট্রোজেন ফিক্সেশনসহ বিভিন্নভাবে উদ্ভিদকে সহায়তা করে। অন্যদিকে এন্ডোফাইটের অবস্থান উদ্ভিদদেহের অভ্যন্তরভাগে টিস্যুর ভেতরে। রাইজোবিয়া এবং এন্ডোফাইটে উভয় ধরণের অণুজীবই উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন উদ্ভিদের জন্য জরুরী হরমোন উৎপাদন, মাটি থেকে প্রয়োজনীয় খনিজ পুষ্টি আহরণে সহায়তা, ক্ষতিকর জীবাণু দমন, পরিবেশগত-পীড়ন (environmental stress) রোধ করা ইত্যাদি। অবশ্য বহুদিন ধরে উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য আমরা মূলত রাসায়নিক সার ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে আসছি, এর বেশ কিছু ক্ষতিকর দিক স্বত্বেও। রাসায়নিক সার উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করলেও চূড়ান্ত পরিণামে আমাদের পরিবেশের জন্য এটি যথেষ্ট ক্ষতিকর। তদুপরি, উদ্ভিদের রোগ-প্রতিরোধে রাসায়নিক সারের কোন ভূমিকা তো নাই-ই বরং তুলনামূলকভাবে অনেকটাই ব্যায়বহুল। বিপরীতদিকে, উদ্ভিদের বৃদ্ধিকারী অণুজীবগুলো (Plant Growth Promoting Bacteria/PGPB) শুধুমাত্র যে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজে উদ্ভিদকে সাহায্য করে তাই না, এদের ব্যবহার পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী। এসব কারণে উদ্ভিদের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই অণুজীবগুলোকে রাসায়নিক সারের উপযুক্ত বিকল্প হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই অণুজীবগুলো ধীরে ধীরে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বহুলাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
আমাদের লক্ষ্য হল, স্থানীয় উদ্ভিদ এবং মাটি থেকে যথাক্রমে এন্ডোফাইট ও রাইজোবিয়া পৃথক করে উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে এদের ভূমিকাগুলো পর্যালোচনা করা যাতে করে পরিবেশবান্ধব পন্থা অবলম্বন করেই উদ্ভিদের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা সম্ভব হয়। এর মধ্যে কিছু রাইজোবিয়ার আইসোলেশন সম্পন্ন হয়েছে। এই অণুজীবগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে এদের মাঝে কয়েকটি অণুজীব অক্সিন নামের উদ্ভিদ হরমোন নিঃসরণ করে। এছাড়া উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে অণুজীবগুলোর অন্যান্য কোন উপকারী ভূমিকা আছে সেসবও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
বায়োক্যাটালাইসিস
জৈবপ্রযুক্তি ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পকারখানাগুলোতে গবেষণা, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষা, কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাতকরণ সহ নানা কাজে এনজাইম বা উৎসেচকের ব্যাপক চাহিদা। এসব উৎসেচক সংগ্রহ ও উৎপাদন করা হয় মূলত অণুজীব থেকে। বাণিজ্যিক হারে উৎসেচক উৎপাদনের জন্য কারখানাগুলোতে প্রধানত দুই ধরণের অণুজীব যেমন ব্যাকটেরিয়া আর ফানজাই সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত হয়। এর কারণ হল এই অণুজীবগুলোকে খুব সহজে ও স্বল্প পরিসরে দ্রুততম সময়ে কালচার করা যায় এবং সেটাও তুলনামূলকভাবে খুব কম অর্থ ব্যয় করেই। এছাড়া উৎসেচক উৎপাদনে অণুজীব ব্যবহারের আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের পরিবেশে যেমন অত্যধিক বেশি বা কম তাপমাত্রা, ক্ষার, এসিড, বা লবনাক্ততায় কিংবা ভিন্ন কোন প্রয়োজনে এনজাইমের সর্বাধিক উৎপাদন নিশ্চিত করতে অণুজীবগুলোকে সহজেই জিনগতভাবে পরিবর্তন (genetic manipulation) করা যায়। তদুপরি, অন্য কোন প্রাণীর তুলনায় অণুজীব থেকে সংগৃহীত উৎসেচকের একটা বিশেষ সুবিধা হল এই উৎসেচকগুলো অত্যন্ত বৈচিত্রপূর্ণ পরিবেশে এবং অনেক ব্যাপক পরিসরে সমান দক্ষতায় কাজ করতে সক্ষম। তাই আমরা বিভিন্ন ধরণের উৎস থেকে অণুজীব সংগ্রহ করে সেগুলোকে সংরক্ষণ করেছি এবং পরীক্ষা করে দেখছি অণুজীবগুলো কি ধরণের উৎসেচক নিঃসরণ করতে পারে। এই মুহূর্তে আমরা হাইড্রোলাইটিক এনজাইম এবং শর্করা-সংশ্লিষ্ট যৌগের বিপাকের সাথে জড়িত এনজাইমের ব্যপারে বেশি আগ্রহী। এছাড়াও চরমভাবাপন্ন পরিবেশ, যেমন মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা, চাপ, পিএইচ, বা লবণাক্ততায় বেঁচে থাকতে পারে এমন "প্রচন্ডতাপ্রিয়" অণুজীবের (extremophiles) অনুসন্ধানও আমরা করছি কেননা এসব অণুজীব থেকে নিঃসৃত উৎসেচকগুলোও একইধরণের চরমভাবাপন্ন পরিবেশে কাজ করতে পারে যা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাবহারের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।