২০২২ এর একুশে বইমেলায় বেহুলাবাংলা প্রকাশনী থেকে আমার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম "আমাদের সময়ের অসমতায়"। সুন্দর প্রচ্ছদটি করে দিয়েছেন আর্টিস্ট এবং লেখক নির্ঝর নৈঃশব্দ্য।
প্রকাশ-পূর্ব আদি ভার্সনের লিংক
Published: দু'টি কবিতা: অপর্ণা হাওলাদার - সাহিত্য ক্যাফে (sahityacafe.com)
সহপথিক, যে কেউ
মানুষ, তুমি কাঁদছো যখন, আমার কাঁধে তোমার মাথা রাখতে পারো।
মানুষ, এই যে আমার আঙ্গুল, তুমি কোথাও তোমার ব্যথা জড়িয়ে রাখো।
মানুষ, তোমার নাম জানি না। মানুষ, তুমি নাম বোলো না।
মানুষ, আমি হাঁটছি যখন, চাইলে তুমি এই সড়কের
পুরোটা সাথে থাকতে পারো।
মানুষ, আমি একলা এপথ অনেক চিনি; তোমার গল্প তুমি অসংকোচে
আমার কাছে বলতে পারো।
মানুষ, আমি সমগ্র জীবন এখন এই মুহূর্তে ধরতে পারি;
অচেনা মানুষ, এই এক মুহূর্ত আমি কেবল তোমাকে দিলাম।
রাখতে পারো?
দংশনের জন্য কৃতজ্ঞতা
ধরে নাও, মরেপচে গেছি!
মরেপচে তো যায় মানুষ। আগেও কতশত গিয়েছে।
তেমন, অস্তিত্বের সংজ্ঞাতেই আমারো পড়েছে পুঁজের দাগ,
তোমাদের নামের পরে প্রমূখের মত গুঁজে আছি কোথাও!
কিংবা সেটুকুও নেই—
অশ্রদ্ধাজনিত যে প্রেম,
আদিনারীদের অভিধান থেকে দেখে নিয়ে-
আমি ব্যক্তিত্বরহিত হতে হতে চলে আসি বিনাশের খুব কাছে
অর্জনের মত ম্লান কিছু নেই আমার আলেখ্য—
ধরে নাও, এরকম হয়,
মানুষ তো লিখেছে কত প্রেম বা বিরহ, বিপ্লব বা দ্রোহ, এইসব—
আমি এলাম ঘৃণার কথা লিখে যেতে—
যেন এইসব কিছু হয়েছিলো আগেও কোথাও
যেখানে পা পড়েছে সেখানেই থামার কথা ছিলো
এভাবেই তরঙ্গস্থির স্রোতের সাথে এলিয়ে যাওয়া
আমার জীবন কেবল পুনরাবৃত্তি,
আমার শরীর কেবল বিতৃষ্ণা,
আমি অনেকটাই নেই, এইসব না থাকা’র
সওদায় রাজি হলে জানিও, প্রিয় সাপ—
দংশনের জন্য আজও কৃতজ্ঞতা।
গুচ্ছ কবিতাঃ প্রতিপক্ষ - এ প্রকাশিত, লেখার সময়কাল: ২০২০
অভাগার স্বর্গলোভ | প্রতিপক্ষ (protipokkho.com)
আমি এবং কয়েকজন
আমাদের প্রয়োজন নয় প্রেম— মানুষের ঘামের স্পর্শ কিংবা ঔদার্য।
এইসব ভেঙেচুরে এগিয়ে এসেছি কয়েকজন, নিজেদের পায়ের উপর
দানা বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে আধুনিক সময়, বিশ্বাসে নেই স্বর্গমর্ত্যপাতাল;
প্রথমে গিয়েছে বংশের নাম, তারপর আমরা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে
ক্ষমা করে দিয়েছি আমাদের পিতাদের, পিতামহকেও। এই ক্ষমা, আসলেও,
মহত্ত্ব নয়, এ কেবল পরিত্রাণ পাওয়ার নামে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলা—
আমাদের কেবল সম্মুখে এগিয়ে যাবার নেশা, আমাদের প্রয়োজন
ব্যাকপ্যাকে রাখা তোয়ালে-টুথব্রাশ এবং একটি মাত্র জামাপাজামা,
এইসব জামাও কেবল পরিধানযোগ্য, এর ললিত কারুকার্য নেই;
এই হলেই চলে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে সবদিন— আমাদের এমনকি তুমুল অসময়েও
মনে পড়ে না প্রিয় কোনো বন্ধুর মুখ, মুখিয়ে আছে যদিও কিছু গৌরী সেন –
পথ নেই ঘর নেই আমাদের দুঃখের দিনে বিয়ারের গ্লাস আছে, বন্ধুর কাঁধ থেকে
মাথা তোলবার প্রয়োজনবোধই নেই। এই নেই, এই না থাকাতেও আমাদের
আনন্দ আছে। নিজেকে চেনার আনন্দ। না ফুরিয়ে যাবার সুখ আছে।
আমাদের আর কিছু না থাকুক, পাপেপূণ্যে সুখেব্যথায় এইসবকালে—
আমাদের আমরা আছি। অবশেষে আয়নার সামনে যেতে এত সহস্রাব্দ পর
দেখো, অনুভব করো, আমরা কেউ আর ভয় পাচ্ছি না।
অভাগার স্বর্গলোভ
মন্দির ভেবে কালরাতে মসজিদে ঢুকে গিয়েছিলাম
একইরকম প্রহরায় বসানো ছিলো,
উঁচু দেওয়ালের ভেতর দেখতে পারিনি অতশত
পাঁচিল টপকাতে গিয়ে তাই বুঝিনি কই ঢুকলাম –
প্রাণের প্রণীত ব্যাকরণ ভুলে আরও কিছুদূর হামাগুড়ি দিয়ে
ঈশ্বর ভেবে হাত তুলে বললাম
জানি না এইসব কোথায় কখন কবে মুখস্থের মত আছে, তাঁর নাম –
“যিনি সবকিছুকে পুনরায় সৃষ্টি করেন,
যার থেকে সবকিছু অগ্রসর হয়,
যার কাছে সবকিছু অবশ্যই ফিরে যাবে…”
এইটুকু বলে একঘেঁয়ে লাগলো তাই ঈশ্বর বা আল্লাহর ঘর ছেড়ে বের হয়ে দেখি
দারুণ ক্ষুধা ছিলো সমস্ত শরীর কাঁপছিল
শিশু যেমন মায়ের মত যে কোনো নারীর বুকে মুখ পুরে দিতে চায়,
এত বাছবিচারে কি চলে অভাগার স্বর্গলাভ, খোদা, বান্দা পাপীরও অধম;
ধুর শালা ঈশ্বর ডাকার কথা ছিলো –
যা পারি তাই দিলাম প্রভু, বাকিটা তুইই বুঝে নিস নিজের হিসাবমতো
যা পারি তাই দিলাম মা, বাকিটা তুইই বুঝে নিস নিজের হিসাবমতো
যোগাযোগ
এলাম আবার। বারবার আসি। এভাবেই, জানো—
তোমাদের এই অহংকারের দাবানল কিছুটা ম্লান হলে
আমাকে আসতে হয় পৃথিবীতে—
ঐ আগুনে ঘিয়ের কয়েক ফোঁটা হওয়ার চাইতে বড়
যোগ্যতা আমার ছিলো না কোনো জন্মেই,
ফিরে আসতে চাইলেই আসা যায়, অথচ
পরিব্রাজনের লোভ আমাদের বড় হতে হতে
স্থিরতা পুড়ে যায় বেদনার সবকটি গ্রাহ্য সড়ক থেকে;
কিছুটা জলের লোভে—
হয়তো বেশিটাই খুঁজে নিতে মানুষের যেকোনো মুখ,
আমি চেনা ঠিকানা ভিন্ন সব বাড়িতে কড়া নেড়ে নেড়ে যাই
পান্থশালা ভেবে ঢুকে পড়ি হিমঘরে আবার –
এভাবেই আসি। বারবার।
এই জন্মে আমাকে ফেরাও কেউ!
আত্মশ্লাঘা
কাল রাত দশটা আঠাশে আমার বাম চোখ থেকে কর্নিয়া খুলে মেঝেতে পড়ে গেল।
অনেকদিন ধরেই আমার মনে হচ্ছিলো, কিছু একটা খুলে পড়ে যাবে,
আশা করছিলাম, কান বা একটা হাত গেলে ভালো হয়।
ডান চোখটা আমার আগে থেকেই কমজোরি,
তবুও প্রায় দশটা পঁয়ত্রিশে খুঁজে পেতে উঠিয়ে নিলাম কর্নিয়াটা
মেঝেতে একটু বাদামী দাগ বসে গেছে, বুঝতে পারছি –
কিন্তু পরে সেটা ঠিক করে নেওয়া যাবে
গত আঠারো ঘণ্টা ধরে আমি দরজায় লাগানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
আমার ডান হাতের তালুতে বাম চোখের কর্নিয়া
কিছুতেই কোটরে বসানো যাচ্ছে না আর।
মেঝেতে কিছুটা থেঁতলে যাওয়ার পর আকৃতি ভীষণ বদলে গেছে।
কিন্তু থেঁতলানো কর্নিয়াটা তালুতে দেখতেও আমার খারাপ লাগছে না।
একচোখের মানুষের এমন হয় হয়তো।
প্রস্তাব
আমাদের যৌথ প্রকল্পের সবকিছু ভেঙেচুরে গেছে;
সেই দালান হাতড়ে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না আমাদের পুরানো আঙুল—
তবুও প্রতিবিম্বের কাছে এলে বারবার মনে হয়,
আমাদের, দেখো, অমিলের চেয়ে বহুলাংশে বেশি ছিল মিল,
এই তল্লাটে তুমি আর আমি ভিন্ন কেউ জানেনা সেই গাছের বাকল,
ঘষেমেজে কার গায়ে তুলে দেবে পাখির লোমের মতো নরম দুপুর;
এই তল্লাটে কেবল আমরাই দুজন পায়েপায়ে ফিরে আসতে পারি
ঠিকানা না রেখে মিলিয়ে গেছে যেসব নদী
তার উৎসের দিকে –
প্রকৃতঅর্থে আমরাই কেবল দুইজন গভীরভাবে আমাকে ঘৃণা করি
এত ঘৃণা কোনো মাঝরাতে উঠে গলা টিপে ধরেনি আর কারো কোনোদিন।
আমাদের সব ভবিষ্যৎ প্রকল্প বানচাল হয়ে গেছে।
কিন্তু আমরা এখনো অংশীদার হতে পারি কিছু মহত্ত্বর দুঃখবোধের
আমরা দুজন মিলে আমাকে খুন করে অন্তত
কালরাতে যৌথভাবে ফেরারি হতে পারি।
গুচ্ছ কবিতাঃ প্রতিপক্ষ - এ প্রকাশিত, লেখার সময়কাল: ২০২১
অভিবাসী জীবন | প্রতিপক্ষ (protipokkho.com)
ইঁদুর
ইঁদুরেরা ছুটে ছুটে আসে যায় এই ঘরে, বিশেষত নিচে;
বসবার ঘরে রান্নার ঘরে বাসনের ভেতর নড়েচড়ে—
ছোটো ছোটো ইঁদুর, জলের পাইপ বেয়ে আসার মতো
ছোটো এবং চতুর—
খুব কাছে থেকে কয়েক মুহূর্ত দেখেছি
ওদের আমি, ভয় করে সরে আসার আগে—
ভয়ার্ত ইঁদুর কিংবা ভয়ার্ত আমি পরস্পরকে আড়চোখে অনুভব করি,
আমাদের চোখাচুখি হয়না যদিও—
সেইদিন সকালের নাস্তায় আধখাওয়া রুটি খুলে—
দেখে ভাবি আমারই দাঁতের দাগ, আজকাল অন্যমনে
কতভুল থেকে যায়, তেমন দাঁতের দাগ—
অযথাই পরে জানা গেলো সেও ছিলো ইঁদুরের মুখ।
ইঁদুরের দাঁত কিছু লেগে আছে আমার দাঁতেও তাই,
ইঁদুরের মুখ কিছু আমার মুখে,
ইঁদুরের জিহ্বার স্বাদ নিয়ে আমি ঘুরে ফিরে আসি উপরের ঘরে—
মাঝরাতে মাংসের ঝোলে চড়িয়ে ছড়িয়ে যায় ইঁদুরের দল
ফ্রিজারে লুকিয়ে রাখা যায় কিছু বাসি তরকারি, তবু
ইঁদুরের জন্য মায়া করে আমি ফেলে রাখি কিছু
চুলার উপর
অভিভাবকহীন। মাঝরাতে—
মানুষের সাথে কথাটথা হয় না আজকাল তেমন—
রান্নাঘরে দৌড়ে চলে যাওয়া ইঁদুরটাকেও আবার—
আবার ডেকে এনে দেখতে ইচ্ছে হয়।
ঘোর লাগা একাকীত্ব
আজ বিকেলে একটা হরিণের সাথে দেখা হয়ে গেল।
হঠাত ট্রেইলে হাঁটতে গিয়ে—
মনে পড়লো, অনেককাল কারও সাথে দেখা হয় না।
হঠাৎ আমার মতো বড়সড় মানুষ দেখে—
হরিণটা চমকে ঠায় দাঁড়িয়েছিলো দিক ঠিক না বুঝে;
ছোটো হরিণ, দলছুট হয়ে গেছে হয়তো—
এদিকে মানুষ আসে না— আমি ভুলে ঢুকে গেছি,
বিকেলে হরিণটার অত চমকে যাওয়া দেখে মনে হোলো
অনেকদিন কারও চোখ দেখা হয়নি এত কাছে থেকে,
চমকে যাওয়া চোখ! নিজেরও না।
অথচ আয়নায় চোখ পড়ে প্রতিদিনই;
ভয়ে চমকে যাওয়া শিশু হরিণটাকে পথ ছেড়ে দিতে গিয়ে
আমি ধীরে ধীরে ঢুকে পড়লাম আরও গভীর জঙ্গলে
এইদিকে পথ কিছু চিনি না তেমন—
হঠাত হরিণটাকে দেখে মনে পড়লো—
কারও এত কাছে যাওয়া হয়নি আজ অনেকদিন।
যাওয়া যে হয়নি, সেই কথা—
আজকাল আর তেমন মনে পড়ে না।
আবর্তিত
প্রতিবার যখন ফুল হাতে আসো এই পুরোনো শ্মশানে—
দূর থেকেই দেখতে পাই তোমায়
প্রতিবারই তোমার আসতে থাকা আমার মনে
প্রথমবার দেখা হওয়ার মতো আকস্মিক চঞ্চলতা জাগায়—
এই এত যুগ হোলো, কতো বছর যেন?
প্রতিবারই আমি ভুলে যাই অপরাধবিজ্ঞানের মতে
খুনী বারবার ঘটনাস্থলে ফিরে আসে নিশ্চিত হতে ।
আমার এই এক দেহ তুমি আর কতবার চিতায় তুলবে?
জ্ঞানপাত্র (পোস্ট পিএইচডি ডিপ্রেশন)
অনেক শিখেছি আমি
পূর্বে ও পশ্চিমে
দালানে দালানে
ভিক্ষুকের মতো জ্ঞানপাত্র হাতে
আমিও
ঘুরেছি অনেক তোমাদের সভা সেমিনারে
অনুগ্রহ করে, গুরু, কৃপা হয় যদি,
অজ্ঞানে দিয়ে যান কিছু দিশা
বিনিময়ে এই আছে আমার মেরুদণ্ড
প্রাচ্যের নারীসুলভ কমনীয়তা
কণ্ঠ, চামড়া, রক্ত, ঘাম,
আরও কী চাই, গুরুদেব, বলুন।
অনেক শিখিয়াছি আমি উহাদের কাছে।
সব তীর্থ চাষ শেষে ফিরে দেখি দর্পণে
ক্লেদময় মুখ ও চোখ, কণ্ঠে আনত ভৃত্যের তোষণ
সমগ্র শরীর চিৎকার করে অনবরত বলতে থাকে,
“যতদিন বেঁচে আছেন,
গোলাম হোসেনকে গোলাম বলেই জানবেন হুজুর”
এইসব জ্ঞানপাত্র আমি এখন
কোনো গঙ্গায় তর্পণ করে পাপমুক্ত হই?
ব্ল্যাসফেমি
মুঠোর মধ্যে ছিলো যতটা পয়সা দরকার খাবার কিনতে;
দু’য়েক পয়সা বেশি, হয়তো চাইলে ফুলও জুটে যেত –
খাদ্য এবং ফুলের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও
ক্ষুধার্ত কিংবা পুষ্পবিলাসী আমি পথে নেমে
কেবল মদের দোকান খোলা পেলাম।