বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এবং আমাদের স্বাধীনতার চেতনা
এ কে আজাদ
স্বাধীনতা মানুষের আজন্মের আকাঙ্ক্ষার বিষয়। প্রতিটি মানুষই চায় স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে, স্বাধীনভাবে পথ চলতে, স্বাধীনভাবে নিরাপত্তার সাথে জীবন যাপন করতে। তাই তো স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এই মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে মানুষের স্বাধীনতার বিকল্প নেই। স্বাধীনতার বিকল্প নেই মানুষের মৌলিক মানবিকতাবোধ বিকাশে। কিন্তু এ স্বাধীনতা এমনি এমনিই আসে না কোন কালেই। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠিত হয় মানুষের অধিকার। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মবলিদান এবং প্রায় দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানীর বিনিময়ে এক নদী রক্ত আর এক সাগর বেদনাশ্রু পাড়ি দিয়ে একজন মহান নেতার হাত ধরে লাল সবুজের পতাকা আসে বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই প্রতিদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই বাংলার মানুষের মনে তিলে তিলে তিনি রোপন করেছিলেন স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান আর সত্তরের নির্বচনের বাঁক পেরিয়ে অবশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে ষোলকলা পূর্ণ হওয়া, তার পেছনে একজন যাদুকরের চকচকে হাতের পাশাপাশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তাঁর অনলবর্শী ভাষণ যার সর্বশেষ বাণী ছিল-“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ অপরাহ্নে ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া মাত্র ১৯ মিনিটের সেই ভাষণে জেগে উঠেছিল সারা বাংলা। বাংলাদেশ শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিল নিজের স্বাধীনতা। প্রতিটি মানুষের প্রাণে লেগেছিল সাহসের দোলা। কী ছিল সেই ভাষণে? কেবলই কি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুক্তির কথা ছিল? কেবলই কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ছিল? কেবলই কি একটি ভূ-খন্ডের মুক্তির আহ্বান ছিল? তাহলে স্বাধীনতা অর্জনের পরে সেই ভাষণের কার্যকারী প্রভাব কি শেষ হয়ে গেছে? নাকি সে ভাষণের প্রভাব সকল দেশের সকল মানুষের পরাধীনতার বিরুদ্ধে এ এক মুক্তির ইশতেহার? এ ভাষণ কি কেবল ৭১ সালের জন্যই প্রযোজ্য ছিল নাকি সর্বকালের মানুষের জন্যই এটি এক মুক্তির মোম প্রজ্জ্বলন? এখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এ ভাষণের প্রেরণা কি অকার্যকর হয়ে গেছে? নাকি এ ভাষণ আমাদের প্রতিদিনের স্বাধীনতার চেতনা? অধিকারহীনের অধিকারের চেতনা? এতগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বহুমান প্রবন্ধের অবতারনা। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি বিশ্বের ইতিহাসে এক স্মরনীয় স্থান দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের অংশ হয়েছে এটি। আব্রাহাম লিংকন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মার্টিন লুথার কিং সহ জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাষণের সাথে তুল্য হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সেই মার্চের ভাষণ। অতি সম্প্রতি ইউনেস্কো তাদের মেমোরি অব দ্যা ওর্য়ান্ড কর্মসূচীর মাধ্যমে ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘ওয়ার্ন্ডস্ ডকুমেন্টারী হেরিটেজ’ এর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে সব মহাদেশ থেকে এপর্যন্ত সংগৃহীত ৪২৭ টি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট এর মধ্যে সারা বিশ্বের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সংরক্ষিত হলো এ ভাষণ, যা বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক ও গৌরময় ইতিহাসের সৃষ্টি করল। তার পূর্বে অবশ্য ইতিহাসবিদ ড. জ্যাকব এফ, ফিন্ড (Jacob F. Field) “উই শ্যাল ফাইট অন দ্যা বিচেস: দ্যা স্পিচেস দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্টরি” প্রচ্ছদ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংকলন সম্পাদনা করেন যেখানে আড়াই হাজার বছরের ৪১টি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষণ স্থান পেয়েছে, যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ’The Struggle, This time is the struggle for the independence' (দ্যা স্ট্রাগল, দিস টাইম ইজ দ্যা স্ট্রাগল ফর ইন্ডেপেন্ডেন্স) শিরনামে সংকলিত হয়। ২০১৩ সালে বইটি প্রকাশ করে লন্ডনের মাইকেল ওমেরা বুকস লিঃ (Michael Omara Books Ltd.)।
ভাষণটি শুরু হয়েছিল একটি প্রেক্ষাপট বর্ণনার মধ্য দিয়ে। সেটি ছিল অধিকারহীন মানুষের দুর্দশার প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক নির্যাতন, অত্যচার ও নিপীড়নের প্রেক্ষাপট, সাধারন মানুষের উপরে ক্ষমতাসীনদের স্টিম রোলার চালানোর প্রেক্ষাপট। সেই প্রেক্ষাপটে বাঙালী জাতির কি করা উচিত তারও দিক নির্দেশনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের সর্বাঙ্গ জুড়ে। সর্বোপরি, যুগে যুগে ধেয়ে আসা নিপীড়নের বিপরীতে মানুষের সর্বকালীন মুক্তিই ছিল তাঁর সেই ভাষণের মূলমন্ত্র। অত্যাচারিত মানুষের মনে সংগুপ্ত স্বাধীনতার চেতনা এবং মানবিক মুক্তির প্রেরণা যেমন রয়েছে সেই ভাষণে, তেমনি ক্ষমতাসীনদের জন্যও রয়েছে দিক নির্দেশনা। এবার আসা যাক সেই ভাষণটির বিশ্লেষণে:
১। কোন্ প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু এমন ভাষণ দিয়েছিলেন তা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন-“.......আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে, আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপরে গুলি করা হয়েছে” - অর্থাৎ যেখানে অত্যাচার নিপীড়ন হয়, যেখানে মানুষের বুকের রক্ত নিয়ে হোলী খেলা হয়, সেখানেই মানুষকে সোচ্চার করতে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ জরুরী হয়ে পড়ে। যেখানে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ে, যেখানে মানুষের অধিকার হরণ করা হয়, সেখানেই মানবতার পক্ষে উচ্চারিত হয় ৭ই মার্চের ভাষণ। যে কোন কারনেই হোক, মানুষের অধিকার হরণ করে মানুষের বুকে গুলি চালানো যে বড় অন্যায় সে কথা প্রতিভাত হয় জাতির পিতার ভাষায়।
২। তারপরেই বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন তাঁর সমগ্র বক্তব্যের মূলসুর। কি কারণে তাঁর বক্তব্য, তাঁর মরণজয়ী সংগ্রাম, সে কথা উঠে এসেছে তাঁর পরবর্তী বাক্যে।
“আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়,”। বঙ্গবন্ধু ইচ্ছে করলে তাঁর বক্তব্যকে লিমিটেড করতে পারতেন এই বলে যে, “বাংলার মানুষ পাকিস্তান থেকে মুক্তি চায়” তা করেন নি। বরং বলেছেন সার্বজনীন মুক্তির কথা, বাংলার মানুষের চিরকালীন মুক্তির কথা। ফলে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়েছে বলেই বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, বা তাঁর ভাষণের প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। বাংলার মানুষেরা কিসের মুক্তি চায়, সে কথাও বলেছেন তারপরেই। “বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়-”, এ বাঁচার অর্থ কি কেবলই জ্যান্ত থাকা? তা কিন্তু মনে হয় না। কেননা তিনি বললেন- “বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়,” বাঁচা এবং অধিকার দুটো গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছেন তাঁর বক্তৃতায়। যতটুকু বুঝি- বাঁচা মানেই মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সাথে প্রয়োজন কথা বলার অধিকার, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার এবং নিরাপত্তার অধিকার। বাংলার মানুষের আজন্ম লালিত এমন অধিকার আদায়ের প্রতিনিধি যেন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বোধ করি, সে কারনেই তিনি বলতে পেরেছেন এমন কথা। এখান থেকে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায় করে নেবার যেমন ছবক আমরা পাই, তেমনি ক্ষমতাসীন যারা তাদের জন্যও রয়েছে শিক্ষা যে মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে হবে। নইলে তারাও একদিন বিদ্রোহে ফেটে পড়বে যার ফলাফল অত্যাচার নিপীড়নকারীদের জন্য খুব একটা সুখকর হয় না।
৩। এর পরে এসেছে গণতন্ত্রের কথা। এসেছে সামগ্রিক মুক্তির কথা, এসেছে দেশ গড়ার স্বপ্নের কথা। “নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।”
(ক) গণতন্ত্রের প্রধান অনুষঙ্গ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা গণতান্ত্রিক ক্ষমতাসীনদের যেমন দায়িত্ব, তেমনি নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরও দায়িত্ব। কিন্তু গণতন্ত্রের লেবাসধারী তৎকালীন সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের হাতে তথা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। তার প্রতিবাদ করেছেন বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে।
(খ) বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল জনগণের কল্যাণে একটি শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন; ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী হিসেবে গড়ে তুলবেন। এখানে রাজনৈতিক হানাহানি থাকবে না, কথা বলার অধিকার থাকবে, থাকবে অন্যায় সিদ্ধান্তের সমালোচনার অধিকার। দলমত নির্বিশেষে সকলেই মানুষ ও মানবতার কল্যাণে আদর্শিক এবং গঠনমূলক রাজনীতি করার অধিকার পাবে এবং নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমুন্নত করতে পাবে সাংস্কৃতিক অধিকার। কিন্তু বাস্তব অর্থে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন এবং বঙ্গবন্ধুর সেই মুক্তির দর্শনকে আমরা আমাদের জীবনে ও রাষ্ট্রে কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি তা এখন পর্যালোচনা করা প্রয়োজন আছে বৈকি।
৪। এরপর ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পরে দীর্ঘ ২৩ বছরে বাংলার মানুষেরা কিভাবে পাকিস্তানীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে, কিভাবে আবাল বৃদ্ধবণিতা দুঃখের দহনে পুড়েছে, ক্ষুধা ও দারিদ্রে আর্তনাদ করেছে, ৬ দফা আন্দোলনের সময় কিভাবে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা শেষে বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন পাকিস্তানী নেতাদের সাথে ভেস্তে যাওয়া আলোচনার কথা বলেছেন, বলেছেন পাক নেতাদের টালবাহানার কথা। এসেছে আলাপ আলোচনার কথা এবং আলাপ আলোচনা ভেস্তে যাবার পরে অনিবার্য প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের কথাঃ-
“এ দেশের মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো, আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন, আমি বললাম, আপনারা কল কারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন, জনগণ সাড়া দিল, আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।”
উপরোক্ত উক্তিগুলো থেকে একথা পরিস্কার হয়ে যায় যে, প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদ বিদ্রোহ কিভাবে করতে হবে- সে পদ্ধতিও বাতলিয়ে দিলেন মহানায়ক; বললেন- প্রথমে ‘শান্তিপূর্ণ ভাবে’, তারপর বিদ্রোহ। প্রতিবাদ করার অধিকার ও প্রতিবাদ করার প্রাথমিক পন্থার ব্যপারে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি এখানে উচ্চারিত।
৫। “যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী আর্ত মানুষের মধ্যে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি”। শাসকদের অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে চমৎকার চোখে আঙ্গুল দিয়েছেন এখানে বঙ্গবন্ধু। নিপীড়ন-নির্যাতনের বিপরীতে কঠোর মনোভাব জাগ্রত করতে চেয়েছেন তিনি। এই অত্যাচারের বিপরীতে স্বাধীনতার চেতনাকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন তিনি বারবার। জনগণের নিকট থেকে আদায় করা টাকা দিয়ে অস্ত্র কেনা হয় দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য, কিন্তু সেই অস্ত্র যখন দেশের মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়, তখন সেটা যে জগতের সব থেকে ঘৃণ্যতম কাজ, সে কথাই বুঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। কোন স্বাধীনচেতা মানুষ এমন গর্হিত কাজকে সমর্থন করা তো দূরের কথা, সহ্যও করতে পারে না। তাই তো তিনি বলেছেন- “.. .. আমি তো অনেক আগেই বলেছি, কিসের আর,টি,সি? কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসব?”
৬। গণতন্ত্রের প্রতি দূর্বার আকাঙ্ক্ষা থেকে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছেন- “সামরিক আইন মার্শাল ’ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যরাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।”
ক্ষমতায় থেকে যারা মানুষকে হত্যা করে তারও বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি, কেননা যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়, জনগণের উপর অত্যাচার না করে সেবা করাই তাদের ধর্ম হওয়া উচিত। আর জনগণ যাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে স্বৈরাচারী আচরণ দেখানো সম্পূর্ণ অনৈতিক ও বেআইনী। বঙ্গবন্ধু অত্যাচারী পাক বাহিনীর স্বৈরাচারী মনোভাবের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। এখানে রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একটা শিক্ষা এই যে কেবল মাত্র নিজেদের ক্ষমতার লোভে রাজনীতি নয়, “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না”। মানুষের জন্য রাজনীতি হওয়া চাই, সে কারনে তিনি বলেছিলেন- “গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না, রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে।”
সাধারণ মানুষদের জন্য চমৎকার প্রশংসনীয় মনোভাব ফুটে উঠেছে তার বক্তৃতার ছত্রে ছত্রে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রতিবার মানুষের কথা বলতে গিয়ে তিনি সম্বোধন করেছিলেন: ‘আমার মানুষ’/ ‘আমার লোক’। এমন দরদী মনোভাব রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে বিরল। এখান থেকেকে রাজনৈতিক নেতারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।
৭। তাঁর বক্তব্যের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “.. .. আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। .. ... সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।”- উপরোক্ত উক্তিগুলো থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যখন অত্যাচার নিপীড়ন চরম পর্যায়ে নিয়ে যায় স্বৈরাচারী বাহিনী, তখন তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয় জনগণকে, প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয় না। অধিকার আদায় করা সম্ভবপর হয় না; এবং ক্ষমতাসীনদের নিপীড়নকে থামাতে হলে সর্বস্তরের জনগণকে একযোগে জেগে উঠতে হয়। জনগণের জাগরণই পারে অত্যাচারী শক্তিকে প্রতিরোধ করতে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে স্বৈরাচারী শক্তিকে থামানো যায় না।
৮। তারপরে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বঙ্গবন্ধু। যখন কোন অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে জেগে উঠতে হয়, তখন জাতি-ধর্ম বা বর্ণের বিভেদ ভুলে যেতে হয়। সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় অন্যায় প্রতিরোধে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষায়ঃ “এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালী নন-বেঙ্গলী যারা আছে তারা আমার ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।”
৯। তাঁর বক্তৃতা শেষ করার পূর্বে বঙ্গবন্ধু বললেন সকলকে মজবুত বুহ্য গড়ে তুলতে। একতাই বল। নির্দিষ্ট নেতৃত্বের অধীনে একাতাবদ্ধ হওয়াটা খুব জরুরী, আর যখন সংগ্রাম শুরু হবে তখন সংগ্রাম থেকে পিছ পা হবার সুযোগ নেই। তাহলে সমস্ত রক্ত বৃথা যাবে। রাজনৈতিক আন্দোলনের চমৎকার দিক নির্দেশনা তাঁর ভাষণে: “প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দেব- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।” এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যপারে যেমন গুরুত্ব তিনি দিয়েছেন, তেমনি এই সংঘবদ্ধ জনগণকে কিভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে সে ব্যপারেও দিক নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন। সেই সাথে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসও উল্লেখিত হয়েছে তাঁর কন্ঠে। তিনি বলেছেন- “এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।” একজন মুমিন মুসলমান হিসেবে মহান আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস থেকে ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দ উল্লেখ করেছেন তিনি। শুধু ৭ই মার্চের ভাষণেই নয়, তাঁর সব বক্তৃতাতেই আল্লাহর সাহায্য ও দয়া প্রার্থনা করেছেন তাঁর জীবনে।
১০। সবশেষে কালজয়ী একটা কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু, আর তা হলো- “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ইচ্ছা করলে তিনি বলতে পারতেন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম। তা না বলে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তিনি বললেন- “মুক্তির সংগ্রাম,” কিসের মুক্তি? সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি, সকল প্রকার পরাধীনতা থেকে মুক্তি। কেবল পাকিস্তান থেকে মুক্তি নয়, এ মুক্তি সর্বকালীন অন্যায় অবিচার এবং শৃংখল থেকে মুক্তি। “একটি ভাষণের বিনির্মান: নির্দেশ থেকে দেশ” প্রবন্ধে খোন্দকার আশরাফ হোসেন বলেছেন- “বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই শিরা ও শোনিতের, অগ্নি ও তুষারের এক অবিশ্বাস্য মহড়া দিয়ে রেখেছিলেন মনে মনে; না হলে জনসমুদ্রের উদ্বেল আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য পশ্চাতে দণ্ডায়মান ছাত্র নেতাদের প্রবল চাপ, অন্য দিকে এক পাক্ষিক স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত বিপদের সম্ভাবনা এবং সর্বোপরি ইতিহাসের তুঙ্গতম মুহূর্তে পৌছাঁর হিরন্ময় সুযোগের হাত ছানি, সব কিছুর মধ্যে একটি ফাইন ব্যালেন্স তিনি যেভাবে ঘটালেন তা এক কথায় বিস্মিত ও শিহরিত করার মত ঘটনা। তিনি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে শত্রুকে সুযোগ দিলেন না, আবার একই সাথে যা করলেন তা স্বাধীনতা ঘোষণারই অন্য নাম। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ আসলে সশস্ত্র হওয়ার নির্দেশ, প্রাণপণ প্রতিরোধ ও সম্ভাব্য রক্তবন্যার ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির তীরে পৌঁছানোর নির্দেশ। এই নির্দেশ সফলভাবে পালন করেই বাঙালী অর্জন করতে পেরেছে দেশ। ‘নির্দেশ’ কথাটির একটি অর্থ হতে পারে দেশহীনতাও, সেই অর্থে নির্দেশ থেকে দেশে উত্তরণের যে পথ, তারই মানচিত্র ও দিগদর্শন ৭ই মার্চের ভাষণ”। [গ্রন্থ: বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ: বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, পৃ: নং ১২৪]।
ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড লিখেছিলেন- “রোববার ৭ই মার্চ প্রদত্ত মুজিবের ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন, তার চেয়ে লক্ষ্যণীয় হলো তিনি কি বলেন নি, কেউ কেউ আশঙ্কা করছিলেন, আবার কেউ কেউ আশা করছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করবেন। এর বদলে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান তিনি জানালেন।”.. .. .. .. “স্পষ্টতই বুঝা যায় যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ক্ষমতাবান সরকারসমূহ ও বিশ্ব সম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল, সকল আন্তর্জাকিত সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা ঢাকায় উপস্থিত থেকে ভাষণের বিবরণ প্রদান করেছেন। নিউজ উইক সাময়িকীর বিখ্যাত রিপোর্ট, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ হিসেবে, সে কথা আমরা জানি। তবে এই ভাষণের তাৎপর্য পরিপূর্ণ ভাবে বুঝতে পারা তাৎক্ষনিকভাবে ছিল দূরূহ। কেননা অসাধারন এই ভাষণের পরতে পরতে যে দূরদর্শিতার ছাপ ছিল, তার উম্মোচন ঘটেছিল ক্রমান্বয়ে, ----।” [গ্রন্থ: বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ: বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ পৃ: ৯৪-৯৮]।
এবার বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের সারমর্ম টেনে আমরা যদি স্বাধীনতার চেতনা খুঁজতে যাই, তাহলে আমরা লক্ষ্য করি যে, তাঁর বক্তব্যের মূলসুর ছিল -
১। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি।
২। কথা বলার অধিকার।
৩। সরকারী যে কোন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার অধিকার এবং শক্তি ও সাহস।
৪। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সকল অধিকার।
৫। দেশের অধিকাংশ জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটে এমন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন।
৬। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার।
৭। জনগণের পয়সায় কেনা অস্ত্র দিয়ে জনগণকে যাতে হত্যা না করা হয়, তার গ্যারান্টি।
৮। নাগরিক নিরাপত্তা।
৯। ক্ষমতাকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে জনগণকে নিপীড়ন ও শোষণ থেকে মুক্তি।
১০। যে কোন হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার।
১১। জনগণের ভোটাধিকার ও জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।
১২। লুটতরাজ থেকে মুক্তি।
১৩। হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-অবাঙালীসহ সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা।
১৪। সকল ধর্মের নির্দ্বিধায় ও নির্ধিঘ্নে ধর্ম পালনের অধিকার। অর্থাৎ সকল সম্প্রদায়ের অধিকার বা অসাম্প্রদায়িক মনোভাব।
৭ই মার্চের সেই বক্তব্যের চেতনা ধারন করে বাংলার দামাল মুক্তি যোদ্ধারা নিজেদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে এদেশকে স্বাধীন করেছিলেন।
এবার আসা যাক স্বাধীনতার চেতনায়? স্বাধীনতার চেতনা বলতে আমরা কি বুঝি? স্বাধীনতার সেই চেতনার সাথে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও দর্শনের মিল আছে কি না? আমরা যদি স্বাধীনতার চেতনার সাথে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে সম্পর্কযুক্ত করতে যাই তাহলে স্বাধীনতা বলতে আমরা কি বুঝি তার আলোকপাত করা দরকার আগে।
জীবন বাঁঁচানোর অধিকারই স্বাধীনতা। অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কি স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন: - By liberty I mean the eager maintenance of the atmosphere in which men have the best opportunity to be their best selves. অর্থাৎ স্বাধীনতা বলতে সে পরিবেশের সাগ্রহ সংরক্ষণ বুঝি যা দ্বারা মানুষ তার শ্রেষ্ঠ সত্তা উপলব্ধি করার সুযোগ পায়।
থিওডোর পার্কারের মতে- “চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে, কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে এবং উপাসনার স্বাধীনতা থাকবে - এই হলো গণতন্ত্রের আদর্শ।”
আর ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলতে গেলে আমরা বুঝি- মত প্রকাশের অধিকার, শিক্ষা ও বাসস্থানের অধিকার, বাস্তুচ্যুত হওয়া থেকে বাঁচার অধিকার, ন্যায় বিচার পাবার অধিকার, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার, নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার, গণমাধ্যমের সহায়তা পাবার অধিকার, আইনের সুবিধা ও সহায়তা পাবার অধিকার, সকল গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার।
আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় প্যারায় বলা হয়েছে যে, “আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।”
স্বাধীনতা বলতে আমরা মোটা দাগে বুঝি - উদারনৈতিক গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায় বিচার, আইনের শাসন এবং জনগণের জন্য তৈরী সংবিধানের স্বাধীন প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা। মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধুও তাই চেয়েছিলেন। মানুষের অধিকার আদায়ই ছিল তাঁর সেই ৭ই মার্চের ভাষণের মূল প্রতিপাদ্য। তাঁর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা- “আমি প্রধান মন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদশের মানুষের অধিকার চাই।” মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনই ছিল তাঁর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে দূর্নীতিহীন, ন্যায়নীতি নির্ভর সৎ ও নিষ্ঠাবান সোনার মানুষ বড় প্রয়োজন। ঘুষখোর, সুদখোর, মুনাফাখোর, টেন্ডাবাজি, কালোবাজারী, মজুদদারী এবং লুটেরা মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে।
৭ই মার্চের ভাষণসহ পরবর্তীতে যতগুলো ভাষণ তিনি দিয়েছেন প্রতিটি ভাষণেই লুকিয়ে আছে তাঁর মুক্তির দর্শন, স্বাধীনতার চেতনা। আমরা যদি নিজেদেরকে পর্যালোচনা করতে পারি যে, বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে তিনি কি দর্শন তুলে ধরেছেন, কি আদর্শ তুলে ধরেছেন, এবং আমরা তাঁর সেই দর্শন ও চেতনাকে কতটা ধারণ করতে পেরেছি, তাহলেই আমরা তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে সক্ষম হবো। এখন সময় এসেছে পর্যালোচনা করার যে, আমরা সত্যিই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করতে পেরেছি কি না? তাঁর দেখানো সেই স্বাধীনতার চেতনাকে এবং সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে আমরা আমাদের বুকের ভেতর ধারণ ও লালন করতে পারছি কি না? বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে যদি ধারণ করতে না পারি, তাঁর সেই স্বাধীনতার চেতনাকে যদি বুঝতে না পারি, তাহলে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্য ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে চেতনার মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করেছিলেন, তার আলো জ্বালিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই আমাদের আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে বৈকি। ৭ই মার্চের সেই ভাষণের প্রয়োজনীয়তা ‘৭১ সালেই শেষ হয়ে গেছে মনে করলে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা হবে, বরং তাঁর সেই বার্তা যুগে যুগে সব সময় বর্তমান আছে বলেই তা সারা বিশ্বব্যপী এত সমাদৃত হয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টারী হেরিটেজ’ হিসেবে ইউনেস্কো গ্রহণ করার পেছনে এই ভাষণের বৃহৎ ব্যপকতার দিকটা অবশ্যই বিবেচনা করা হয়েছে বলে বহমান প্রবন্ধকার মনে করে।
অতএব প্রকৃত স্বাধীনতার চেতনাকে লালন করতে হলে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে সব সময়ই বৃহৎ পরিসরে নির্মোহ ও নিঃস্বার্থভাবে আমাদের বুকে ধারণ করতে হবে। তবেই আমাদের প্রকৃত মুক্তি লাভ সম্ভবপর হবে, নচেৎ মুক্তির বাসনা সুদূর পরাহত হবে এবং আমরা বঙ্গবন্ধুর যে চেতনার কথা বলি সেটাও ভূলুণ্ঠিত হবে। # ১০.০৩.২০২০
[লেখকঃ এ কে আজাদ, কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক।
ইমেইল: akazadkobi@gmail.com]
গ্রন্থ সহায়িকাঃ
১। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণঃ বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ। সম্পাদনা: শামসুজ্জামানা খান, বাংলা একাডেমি। ১ম প্রকাশ- ৭ই মার্চ, ২০১৫।
২। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। রচনা: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১ম প্রকাশ-মার্চ-২০১১।
৩। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ১ম প্রকাশ- ২১ ফেব্রুয়ারি-২০০১, ২য় সংস্করণ: আগস্ট-২০১৩।
৪। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর সংবিধান।