কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় বাংলার বৈশাখ ও কালবৈশাখী
এ কে আজাদ
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখী ঝড়।/তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!! [প্রলয়োল্লাস]
বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম মাস। সম্রাট আকবরের সময় আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজী কর্তৃক হিজরী সনকে ভিত্তি করে প্রবর্তিত বাংলা সনের বারো মাসের মধ্যে বৈশাখ একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মাস। এই বৈশাখ মাসেই বাংলাদেশের প্রকৃতি বড় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। প্রচন্ড ঝড়ো-হাওয়া এই বৈশাখ মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেহেতু বৈশাখ মাসে ঝড় হয় তাই এই ঝড়ের নাম দেয়া হয় কালবৈশাখী। প্রচন্ড দমকা হাওয়া আর বজ্রপাত যেন এই কালবৈশাখী ঝড়ের মূল উপাদান। ঝড়ে মানুষের ঘর বাড়ি ভেঙে যায়। দমকা হাওয়ার প্রকোপে উড়ে যায় ঘরের চালা, ভেঙে যায় গাছপালা। তবে দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টিও হয়। বৃষ্টির পরশে ভিজে যায় মাটি, উর্বর হয়। নতুন বীজের অঙ্কুরোদগম হয়। গাছের মরা পাতা, শুকনো ডাল ভেঙ্গে পড়ে। গাছে গাছে গজে ওঠে নতুন পাতা। এই বৈশাখ মাসে আবার প্রচুর পরিমাণে রসালো ফল পাওয়া যায়। আম, জাম কাঁঠাল, কলা, লিচু প্রভৃতি ফলের মধু-রসে তৃপ্ত হয় বাঙালীদের ভোজন বিলাসী রসনা। বোধ করি, সে জন্যই কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- কালবৈশাখী ঝড় কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে না নতুন প্রাণের সঞ্চারও করে। নতুন সবুজ পত্র পল্লবে সুশোভিত করে প্রকৃতি। এ যেন ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে নতুন পাতাকার উত্তোলন। কী বিজয়! কী সুখ! কী আনন্দ! কী উল্লাস! তাই তো কবি বলেছেন- ‘তোরা সব জয়ধ্বনি র্ক’। এ যে পরমানন্দ! ঠিক যেমন অনেক ব্যথা বেদনা সহ্য করে সন্তান জন্ম দেয়ার পর প্রশান্তির হাসি হাসেন একজন মমতাময়ী মা। তারপর ক্লান্ত শ্রান্ত মুখের পরে উথলে পড়ে খুশির ঝিলিক। মা হাসেন। আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী সকলকেই হাসান, সকলেই খুশী হন নতুন সন্তানের মুখ দেখে। সকলেই ভুলে যান মায়ের ব্যথা বেদনার কথা। এমনকি নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধনের মুখ দেখে মা নিজেও ভুলে যান প্রসব বেদনা। রক্তের সাগরে ভাসতে ভাসতে হেসে ওঠেন বিজয়ের হাসি।
কবি নজরুল মনে করেন- কালবোশেখী যেন কোন প্রলয় নয়, এ ধ্বংস যেন ধ্বংস নয়, এ যেন পুরাতনের বিনাশ, অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার, ভীরুতা ও কাপুরুষতার বিনাশ। এ যেন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনা। এ যেন নতুন জীবন জন্মদানের বেদনা। এ যেন নতুন বিপ্লবের অপ্রতিরোধ্য সূচনা। তাই তো কবি লিখেছেন -
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নূতন সৃজন বেদন,/ আসছে নবীন জীবন হারা অসুন্দরের করতে ছেদন।
তাই সে এমন কেশে বেশে/ প্রলয় হয়েও আসছে হেসে/ মধুর হেসে
ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চিরসুন্দর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
ঐ ভাঙা গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর? /তোরা সব জয়ধ্বনি কর! [প্রলয়োল্লাস]
বিদ্রোহ মিশে ছিল কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিটি রক্ত কণিকায়। বিপ্লব ছিল তার নিত্য নিশির স্বপন। মানুষ ও মানবতার মুক্তি ছিল তার প্রতিটি প্রহরের ধ্যান। অত্যাচার নিপীড়নের যাঁতাকল ভেঙ্গে মুক্তি পাগল মানুষ আর স্বাধীন একটা দেশ ছিল তার নিত্য দিনের সাধনা। তাঁর সেই বিপ্লবী চেতনা মূর্ত-প্রতীক হয়ে কাব্যরূপ লাভ করেছে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড় যেন তাঁর হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা বিদ্রোহের ভাষা। কবি বলেছেন-
আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি! / আমি পথ সমুখে যাহা পাই, যাই চূর্ণি।
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা! /আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর। [বিদ্রোহী]
তিনি দাবী করেছেন যে, তিনি নিজেই যেন একটা ঝড়। কিন্তু বাস্তবে তো তিনি অন্যায় অবিচারকে এই পৃথিবী থেকে নিঃশেষ করতে পারছেন না। কুনীতি, কুশাসন এবং অত্যাচারীর খড়গ শাসনকে ধুলিসাৎ করতে পারছেন না তিনি। কিন্তু কালবৈশাখী ঝড় তো অধিক প্রবল, অধিক শক্তিধর। ভেঙে চুড়ে সব কিছু করে দিতে পারে লণ্ডভণ্ড। কাজী নজরুল ইসলাম কালবৈশাখী ঝড়কে বেছে নিয়েছেন তাঁর বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে। তাঁর চির বিদ্রোহী প্রকৃতি আশ্রয় করেছে ঝড়কে। ঝড়ের ভয়াবহতা, প্রচন্ডতা, দুর্নিবার গতি, তার ধ্বংসাত্মক প্রলয়-নৃত্য বিশ্বপ্রকৃতিতে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তা অপূর্বরূপে ব্যক্ত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়ঃ -
ঝড় ঝড় উড়ে চলি ঝড়/ মহা বায় পঙ্খীরাজে চড়ি,
পড় পড় আকাশের ঝোলা সামিয়ানা / মম ধূলি-ধ্বজা সনে করে জড়াজড়ি ! [ঝড়]
ঝড়কে অপরিসীম, অদুর্দমনীয় এবং অপরিহার্য স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে কাব্য অভিধায় সমাদর করেছেন কবি। পৃথিবীর সকল শক্তি যখন জালিম শাহীর সিংহাসনের কাছে মাথা নোয়ায়, স্বাধীনতাকামী মানুষের পায়ে যখন পরানো হয় পরাধীনতার শৃঙ্খল, বিপ্লবী চেতনার বাতিঘরকে যখন তিলে তিলে নিঃশেষ করা হয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে, তখন প্রাকৃতিক কালবৈশাখীর শক্তিই যেন কাম্য হয়ে ওঠে নিপীড়িত কবির মনের মুকুরে। তখন “ভাঙার গান” যেন হয়ে ওঠে বিপ্লবী কবির কালবৈশাখী সুরের সারেগামাপা। তখন কবির কন্ঠে বাণী লাভ করে ঈশাণ কোণের ঝঞ্ঝা প্রলয়ঃ
কারার ঐ লৌহ কবাট/ভেঙে ফেল্ কররে লোপাট/ রক্তজমাট/ শিকল পূজোর পাষাণ বেদী,
ওরে ও তরুণ ঈশান!/ বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/ ধ্বংস নিশান/ উড়–ক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদি। [ভাঙার গান]
কিন্তু কেন? কেন নজরুল ইসলামের কবিতায় এত কালবৈশাখীর বন্দনা? কেন ঈশাণ কোণকে কাল বৈশাখীর প্রলয় বিষাণ বাজাতে বললেন কবি? তিনিও কি তাহলে কেবলই ধ্বংসের পূজারী? তিনি কি কেবলই নৈরাজ্যবাদী? কেবলই মানব বিদ্বেষী? কেবলই সমাজ বিদ্বেষী? তাঁর কবিতায় কি সৃষ্টি বলে কিছু নেই? কি ধ্বংস করতে চান কবি? সমাজ রাষ্ট্র সবই কি ধ্বংস করে ধূলিসাৎ করে দিতে চান তিনি? না, এমন ধ্বংসে বিশ্বাসী নন কবি। তিনি নতুন জীবনের প্রত্যাশী। ঝড়ের মাধ্যমে পুরাতন জীর্ণ-জরাকে বিলীন করতে চান কবি। সেই সাথে গাইতে চান মুক্ত স্বাধীন জীবনের জয়গান। ভীষণ যে কারা মানুষকে শৃঙ্খলিত করে, মানব ও মানবতাকে ভূলুন্ঠিত করে, তার ধ্বংস চান কবি। দেশাত্মবোধের জ্বলন্ত বিদ্রোহের মন্ত্র-বহ্নিতে দীক্ষা লাভ করতে বলেন পিঞ্জিরাবদ্ধ সিংহ শাবকদেরকে। তিনি বলেন -
নাচে ঐ কালবোশেখী/কাটাবি কাল বসে কি? / দে রে দেখি/ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি/
লাথি মার ভাঙরে তালা/আগুন জ্বালা/ আগুন জ্বালা ফেল্ উপাড়ি। [ভাঙার গান]
অনিয়ম অনাচার দেখে যারা নীরব থাকে, সেই সমস্ত মরা, জড় পদার্থ আর পা চাটার গোলামদের ধ্বংসও কাজী নজরুলের কাম্য। তবে যারা স্বাধীনতাকামী, যাদের অন্তর স্বদেশ প্রেমের রসে সিক্ত, যাদের হৃদয়ে সত্যের প্রতি সীমাহীন দরদ, তাদেরকে উৎসাহিত করেছেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে মানুষের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক মুক্তির মধ্যেই নজরুলের বিদ্রোহের সুর নিহিত। অরাজকতা, আইনহীনতা, অপসংস্কৃতি, অবিচার, শোষণ ও নৈতিকতা বিবর্জিত শাসন ব্যবস্থার প্রতি তাঁর সীমাহীন ঘৃনাই মূলতঃ তাঁকে নবচেতনা ও নবজাগরনের দিকে ধাবিত করেছে। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার উপর অনাস্থা ও তীব্র ঘৃণা তাঁকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলো। তিনি নিজেই লিখেছিলেন-
বন্ধু গো আর বলিতে পারি না বড় বিষ জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে। [আমার কৈফিয়ত]
পুরাতন দিনের জরা-জীর্ণতাকে পায়ে দলে গ্লানি বেদনা মুছে ফেলে নতুন জীবনের পথ চলাই যেন কাজী নজরুল ইসলামের বৈশাখ বিষয়ক কবিতার মূল সুর। এখানে প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বাংলা সাহিত্যকে যিনি বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন ধর্ম সঙ্গীতের মাধ্যমে, সেই ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানেও একই সুর পরিলক্ষিত। রবি ঠাকুরের গীত বিতানের ২৮৩টি গানের মধ্যে ১১টি গানেই বর্ণিত হয়েছে বৈশাখের রুদ্র রূপ। তিনি ধর্মীয়ভাবে অগ্নি পূজারী ছিলেন। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে মঙ্গল কামনা করা হিন্দু ও ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় রীতি। বৈশাখের এমন রুদ্ররূপকে আগুনের সাথে তুলনা করেছেন কবি। তাই তো “এসো হে বৈশাখ” গানে বৈশাখী ঝড়ের আগমণে অগ্নি-স্নানে ক্লান্তি জরা সব মুছে যাবার প্রার্থনা করেছেন তিনি। তিনি লিখেছেন-
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
আবার আমাদের আলোচ্য কবি কাজী নজরুল ইসলামও একদিকে যেমন বৈশাখী ধ্বংসকে আহ্বান করেছেন, তেমনি নূতন কেতনের প্রতিচ্ছবিও দেখেছেন দুই চোখে। কাজী সাহেব ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসও ঝঞ্ঝা-প্রলয়ের মাঝে তাঁকে দেখিয়েছে আলোর দিশা। বৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে সকল অমানিশা ধ্বংস হয়ে নতুন ভোরের সূচনা হবে এমনটি আশা করেছেন তিনি:-
মাভৈঃ মাভৈঃ জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে, / জরায় মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে
এবার মহানিশার শেষে/আসবে ঊষা অরুণ হেসে.. [প্রলয়োল্লাস]
তবে যতই ঝড় ঝঞ্ঝা আসুক না কেন, প্রলয়ের দাপটে সমুদ্রের মাঝে বয়ে চলা নৌকা যতই দুলুক না কেন, সে নৌকার মাঝিরা যদি সত্যাশ্রয়ী হয়, তরীর মাঝিদের বুকে যদি ইমান থাকে, মুখে যদি এক আল্লাহর নাম থাকে তাহলে তাদের কোন ভয় নেই। রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় অগ্নি-পূজার বিশ্বাস যেমন প্রবল, কাজী নজরুল ইসলামের মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাসও তেমনি তার চেয়ে ঢের বেশী প্রবল। তিনি লিখেছেন-
পূণ্য পথের এ যে যাত্রীরা নিস্পাপ/ ধর্মেরই বর্ম্মে সু-রক্ষিত দিল-সাফ।
নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতেও /কান্ডারী আহমদ, তরী ভরা পাথেয়!
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
কান্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা / দাড়ি মুখে সারি গান- লা শারীক আল্লাহ।
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়া-ভার / ঐ হলো পূণ্যের যাত্রীরা খেয়া পার। [খেয়া পারের তরণী]
শুধু বাংলার বিদ্রোহী কবি কিংবা ঋষি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা কিংবা গানেই ঝড়ের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না, ইংরেজী সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের বিখ্যাত বিদ্রোহী কবি পার্সি বিশি শেলীর কবিতার দিকে আমরা যদি দৃষ্টিপাত করি তাহলে সেখানেও আমরা দেখতে পাই প্রায় একই অনুভূতির অনুরণন। ১৮১৯ সালের ২৫ শে আক্টোবর শেলী লিখেছেন তার বহুল আলোচিত একটি কবিতা- Ode to the west wind ( ওড টু দ্যা ওয়েস্ট ওইন্ড) । এই কবিতায় শেলি ঝড়কে আহ্বান করে লিখেছেন-
Drive my dead thoughts over the universe, / Like withered leaves to quicken a new birth
.............................................
O wind! / If winter comes, /Can spring be far behind!
(আমার মৃত চিন্তাগুলোকে তুমি উড়িয়ে নিয়ে যাও/ পৃথিবীর (মাথার) ওপর দিয়ে
উড়িয়ে নিয়ে যাও পুরাতন ঝরা পাতার মতন/ একটা নতুন জন্মের আশায় /
....................................
হে ঝড়! যদি আসে শীত/ থাকতে পারে কি বসন্ত অনেক দূরে।)
এখানে পার্সি বিশি শেলী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলাম যেন এক হয়েছেন চিন্তার একই মোহনায়, যদিও শেলীর ওয়েস্ট উইন্ড Autumn বা শরৎকালীন ঝড়ের বিষয়।
যাহোক কালবৈশাখীর ভয়ঙ্কর প্রলয়কঙ্করী রূপ কেবল প্রকৃতিতেই লক্ষ করেননি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি রাগে ক্ষোভে সে প্রলয়ঙ্করী কম্পন অনুভব করেছেন নিজের শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকাতেও। “বাঙালীর বাঙলা” নিবন্ধে নজরুল নিজেই বলেছেন- ‘‘যারা ঘরের পাশে পাহাড়ের অজগর, বনের বাঘ নিয়ে বাস করে, তারা আজ নিরক্ষর [সম্ভবতঃ ধর্মীয় ও ঐশী জ্ঞানহীন] বিদেশীদের দাসত্ব করে। শুনে ভীষণ ক্রোধে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে, সারা দেহ মনে আসে প্রলয়ের কম্পন, সারা বক্ষ মন্থন করে আসে জল।” অর্থাৎ একদিকে অনাচার, অবিচার ও স্বাধীনতা হরণকারীদের ধ্বংসের জন্য প্রতীকি শক্তি হিসেবে কাজী নজরুল যেমন বৈশাখী ঝড়কে আহ্বান করেছেন, অন্যদিকে এদেশীয় পুরুষত্বহীন ভীরু- অন্যায় দেখে যারা নীরব থাকে, সেই সব কাপুরুষদের ধ্বংসের জন্যও কাল বৈশাখীকে আহ্বান করেছেন।
১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে এক গণ সংবর্ধনার জবাবে বক্তৃতা করতে গিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন- “শুধু লেখা দিয়ে নয়, আমায় দিয়ে যারা আমায় চেনেন, অন্ততঃ তারা জানেন যে, সত্যি সত্যিই আমি ভালো মানুষ। কোন অনাসৃষ্টি করতে আসিনি আমি। আমি যেখানে ঘা দিয়েছি, সেখানে ঘা খাবার প্রয়োজন অনেক থেকেই তৈরী হয়েছিলো। পড় পড় বাড়িটাকে কর্পোরেশনের যে কর্মচারী এসে ভেঙে দেয় অন্যায় তার নয়, অন্যায় তার যে ঐ পড় পড় বাড়িটাকে পুষে রেখে আরো দশজনের প্রাণনাশের ব্যবস্থা করে রাখে। আমাকে বিদ্রোহী বলে খামোখা লোকের মনে ভয় ধরিয়েছেন কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতিটাকে আঁচড়ে কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছে আমার কোন দিনই নেই। তাড়া যারা খেয়েছে, অনেক আগে থেকেই মরণ তাদের তাড়া করে ফিরছে। আমি তাতে একটু আধটু সাহায্য করেছি মাত্র।”
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, নজরুলের কালবৈশাখী-প্রেম বা বিদ্রোহ কেবল তৎকালীন রাজ-রাজড়া কিংবা শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে নয়, কেবল তৎকালীন স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে নয়, নিছক ধর্মহীনতার বিরুদ্ধে নয়। শোষকের ধ্বজাধারী অনিয়ম অনাচারীর দোসর কিংবা পদলেহন কারীর বিরুদ্ধে নয়, বরং এটি সর্ব যুগের সর্বকালের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে, সর্বকালের কাপুরুষতার বিরুদ্ধে, সকল যুগের অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, সকল প্রকার স্বাধীনতাহীনতার বিরুদ্ধে। নজরুলের কবিতায় বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের হৃদয় জ্বালার সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে বিপ্লবী উদ্দীপনা, বিদ্রোহীর আক্রোশ - যে আক্রোশের লক্ষ্য হলো মানব সমাজে যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত অনাচার, অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, অপসংস্কৃতি, অপধর্ম কিংবা ধর্মহীনতা, কুসংস্কার, অপবিত্রতা, পরাধীনতা ও জ্ঞানহীনতা। কোন বিশেষ কালের কিংবা বিশেষ দেশের শাসন ব্যবস্থা নয়, অথবা স্থূল অর্থে কোন সম্রাজ্যবাদও নয়, বরং নজরুলের প্রতিবাদ হলো বহুরকম যুক্তিহীন রীতিনীতির বিরুদ্ধে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির যাঁতাকালে নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে, সর্বকালের সর্বযুগের শাসনের নামে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, যে বন্ধনের শেকলে মানুষের বিবেক যুগ যুগ ধরে অবরুদ্ধ তার বিরুদ্ধে। সকল দেশের সকল কালের মানসিক বক্রতা ও বৈকল্যের বিরুদ্ধে, পঙ্কিলতা ও অপবিত্রতার বিরুদ্ধে, ভন্ডামী ও শঠতার বিরুদ্ধে। আর নজরুলের এই বিদ্রোহী চেতনার একটা বড় প্রতীকী রূপকে পরিগ্রহ করেছে কালবৈশাখী ঝড় বা প্রলয়।
তবে কবিতায় প্রকৃতির নানান অনুষঙ্গের ব্যবহার করতে করতে অনেক কবিই প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধ হয়েছেন অনেক বেশী। মানুষের মানবিক সৌন্দর্যকেও কখনো কখনো প্রকৃতির কাছে হতে হয়েছে বিবর্ণ, ফ্যাকাশে। শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, ইংরেজী সাহিত্যের উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ ওয়ার্থ, শেলী, কিটস, বায়রনদের মত কাজী নজরুল ইসলাম হয়তো অত বেশী প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন না। প্রকৃতি প্রেমের চাইতে মানব প্রেম নজরুলকে আকৃষ্ট ও মোহাবিষ্ট করেছে সবচেয়ে বেশী। জীবনের অসমতা, বিকৃতি, সামাজিক অসংগতি, দারিদ্র, ধনী গরীবের ব্যবধান- এসব নজরুলকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করলেও তাঁর কবি কল্পনায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির শক্তি ও ঐশ্বর্য জীবনানুগ অর্থে ব্যঞ্জিত হয়েছে তাঁর কবিতায় ব্যাপকভাবে, যা কি না হয়ে উঠেছে সত্যিকারার্থে তাৎপর্যোদ্যোতক। বিশেষ করে বৈশাখ এবং কালবৈশাখী নজরুলের অনুভূতির আলোকে এবং শব্দের উপমা-উৎপ্রেক্ষার নান্দনিকতায় হয়ে উঠেছে জীবন্ত এক শক্তিধর ব্যক্তি। বাক্যালঙ্কার আর ব্যক্তিত্ব আরোপনের মায়াজালে বৈশাখ যেন হয়ে উঠেছে মহাবিদ্রোহী এক প্রলয়ঙ্করী ইসরাফীল ফেরেস্তার ডান হাত এবং বিপ্লবী চেতনার এক মহা উদ্বোধক। আর এভাবেই কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে উঠেছেন জীবন, জগৎ, প্রকৃতি ও পরিবেশের বিশেষ দ্রষ্টা এবং পাঁড় পাঠক। তবে বায়রন যেমন বলেছেন যে- "I love not man, less, but Nature more” [আমি মানুষকে ভালোবাসি না, যদি বাসিও তবে তা কিঞ্চিৎ, বরং বেশী ভালবাসি আমি প্রকৃতিকে]। নজরুলের কাছে ঠিক তেমনটি নয়। বরং নজরুলের কাছে হবে ঠিক এর উল্টোটা- "I love not Nature, less, but man more” [আমি প্রকৃতিকে ভালো বাসি না, আর বাসলেও তা কিঞ্চৎ, বরং মানুষকে ভালোবাসি তার চেয়েও ঢের বেশী] ।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলার বৈশাখ ও প্রাকৃতিক কালবৈশাখী ঝড় দুটোই কাজী নজরুলের কবিতায় দখল করে আছে এক বিশিষ্ট স্থান। কালবৈশাখীর প্রলয়ঙ্করী রূপ তাঁর কাছে যুগপৎভাবে ধ্বংসের মহাশক্তি ও বিপ্লবের অতি কাঙ্খিত উদ্দীপক। ধ্বংসের ভেতর থেকে নব জাগরণের উৎস শক্তিতে বলীয়ান বৈশাখ মাস যেন নজরুলের কাছে বিজয়ী এক প্রাকৃতিক বলবান পালোয়ান। #
[লেখকঃ এ কে আজাদ # কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক। সম্পাদক, বঙ্গীয় সাহিত্য দর্পণ, বাংলাদেশ শাখ। ইমেইলঃ akazadkobi@gmail.com]