Religious

দ্রৌপদী

কৃষ্ণা (দ্রৌপদী, যাজ্ঞসেনী) - পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদের কন্যা ও পঞ্চ পাণ্ডবের পত্নী। দ্রৌপদী পাঁচ সন্তানের জন্ম দেন (এঁরা সবাই পূর্বজন্মে বিশ্ব-নামধারী দেবতা ছিলেন) - প্রতিবিন্ধ্য (যুধিষ্ঠিরের), সুতসোম(ভীমের), শ্রুতকীর্তি (অর্জুনের),শতানীক (নকুলের) এবং শ্রুতসেন (সহদেবের)। রাজা দ্রুপদ (যজ্ঞসেন) বাল্যবন্ধু দ্রোণের কাছে অপমানিত হয়ে দ্রোণ-বধের নিমিত্তে পুত্রার্থে যে যজ্ঞ করেন, সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে প্রথমে পুত্র (ধৃষ্টদ্যুম্ন) ও পরে যজ্ঞবেদী থেকে এক কন্যা (কৃষ্ণা) উত্থিত হন। কৃষ্ণার আবির্ভাব-কালে দৈববানী হয়েছিল যে, সর্বনারীর শ্রেষ্ঠা এই কৃষ্ণা থেকে ক্ষত্রিয় ক্ষয় ও কুরুবংশের মহাভয় উপস্থিত হবে। যজ্ঞের আচার্য ব্রহ্মর্ষি যাজের আশীর্বাদে ধৃষ্টদ্যুম্ন কৃষ্ণা দ্রুপদ ও তাঁর মহিষী পার্ষতীকে পিতা ও মাতা বলে জানলেন। দ্রুপদের ইচ্ছা ছিল তৃতীয় পাণ্ডব ধনুর্বীর অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণার বিবাহ হোক। কিন্তু সেই ইচ্ছা প্রকাশ না করে তিনি একটি ধনু তৈরী করালেন যে, অসাধারণ ধনুর্বীর না হলে কেউ তাতে গুণ পরাতে পারবেন না। তারপর ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে এমন ভাবে একটি লক্ষ্য স্থাপন করলেন যাকে বিদ্ধ করতে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্য দিয়ে বাণ চালনা করতে হবে। এইবার কৃষ্ণার স্বয়ংবর সভার আয়োজন করে তিনি ঘোষণা করলেন, যে ঐ ধনুর্বাণ ব্যবহার করে লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন, তাঁকেই কৃষ্ণা বরমাল্য দেবেন। দ্রুপদ আশা করেছিলেন যে অর্জুন ব্যতীত কেউই এই কার্যে সক্ষম হবেন না। সমবেত রাজারা একে একে উঠে ধনুতে গুণ পরাতে গিয়ে পর্যুদস্ত হলেন। তখন কর্ণ উঠে এসে সহজেই ধনুতে গুণ পরিয়ে শরসন্ধান করলেন। তাই দেখে কৃষ্ণা বলে উঠলেন যে, তিনি সূতজাতীয়কে বরণ করবেন না। অপমানিত কর্ণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটু কঠিন হাস্যে ধনুর্বাণ ত্যাগ করলেন। আরও কয়েকজন রাজার নিষ্ফল চেষ্টার পর ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন (পঞ্চপাণ্ডব তখন মাতা কুন্তিকে নিয়ে বারণাবত থেকে পালিয়ে এসে ব্রাহ্মণের বেশ ধরে আত্মগোপন করে আছেন) উঠে এসে মহাদেব ও কৃষ্ণকে স্মরণ করে বাণযোজনা করে লক্ষ্যভেদ করলেন আর কৃষ্ণাও স্মিতমুখে সেই ব্রাহ্মণবেশী বীরের গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিলেন। ভীম ও অর্জুন কৃষ্ণাকে নিয়ে এসে মাতা কুন্তিকে বললেন যে,তাঁরা ভিক্ষা এনেছেন। কুন্তি ঘরের ভেতরে। কি আনা হয়েছে না দেখে বললেন, সকলে একসঙ্গে মিলে ভোগ কর। অর্জুন মাতৃবাক্য লঙঘণ করতে রাজি হলেন না। তখন পাণ্ডবরা স্থির করলেন কৃষ্ণা সবারই পত্নী হবেন। পঞ্চপাণ্ডবকে কন্যা দান করতে দ্রুপদ দ্বিধাগ্রস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাসদেব এসে তাঁকে বললেন যে, ইন্দ্র ও তাঁর পূর্ববর্তী চার ইন্দ্রকে তাঁদের দর্পের জন্য মহাদেব মনুষ্য হয়ে জন্মাতে বলেছেন আর এক লোকবাঞ্ছিতা রমনীকে তাঁদের ভার্যা করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। সেই শ্রীরূপিণী রমণীটি পূর্বে ছিলেন এক ঋষিকন্যা, যাঁকে মহাদেব পঞ্চপতি পাবার বর দিয়েছিলেন। পঞ্চপাণ্ডব হলেন সেই শাপগ্রস্থ পঞ্চ ইন্দ্রের অংশ, যাঁদের ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারদ্বয় মানুষীর গর্ভে উৎপাদন করেছেন, আর কৃষ্ণা হলেন সেই ঋষিকন্যা। মহাদেবের ইচ্ছাতেই কৃষ্ণা পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী হবেন। এরপর আর কোনও বাধা রইলো না। এর কিছুদিন পর পাণ্ডবরা ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে অর্ধরাজ্য লাভ করে ইন্দ্রপ্রস্থে বসবাস শুরু করলেন। দ্রৌপদীকে নিয়ে ভ্রাতাদের মধ্যে যাতে কোনও বিরোধ না হয় তারজন্য পাণ্ডবরা নিজেদের মধ্যে স্থির করলেন যে, দ্রৌপদীর সঙ্গে যিনি বাস যখন বাস করবেন, তখন তিনি ব্যতীত অন্য কেহ শয়নগৃহে প্রবেশ করবেন না। যদি করেন, তাহলে তাঁকে বার বৎসর বনবাসে গিয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে। এক ব্রহ্মণের গোধন রক্ষা করার জন্য অর্জুনকে এই নিয়ম ভঙ্গ করতে হয়েছিল। যুধিষ্ঠিরের বারণ সত্বেও অর্জুন বনবাসে গেলেন। পঞ্চ স্বামীকে ভলোবাসলেও অর্জুনই ছিলেন দ্রৌপদীর প্রিয়তম (কাম্যক বনে বনবাস কালে অর্জুন যখন তপস্যার জন্য হিমালয়ে গিয়েছিলেন, তখন অকপটেই কৃষ্ণা যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন যে, পাণ্ডবশ্রেষ্ঠকে দেখতে না পেয়ে, এই বনভূমি তাঁর আর ভালো লাগছে না)। তাই অর্জুন যখন বারো বৎসর পরে তাঁর নতুন ভার্যা সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে দ্রৌপদীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন, তখন অভিমানিনী দ্রৌপদী বলতে শোনা যায়, নতুন বন্ধন হলে পুরনো বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। অর্জুন সুভদ্রার কাছে গিয়েই থাকুন। দ্রৌপদীর অভিমান ভঙ্গ করতে অর্জুনকে বেগ পেতে হয়েছিল। পঞ্চপাণ্ডবের মত বীররা তাঁর স্বামী হলেও কৃষ্ণাকে সারা জীবন বহু অপমান সহ্য করতে হয়েছে। পণদ্যূতে হেরে যুধিষ্ঠির ভ্রাতা সহ কৃষ্ণার স্বাধীনতা হারিয়েছেন। ফলে দুরাত্মা দুর্যোধন দ্রৌপদীকে কেশ আকর্ষণ করে সভায় নিয়ে এসে দাসী বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁর বস্ত্র পর্যন্ত হরণ করার চেষ্টা করেছেন। ধর্মপরায়ণ পতিদের কাছে কোনও সাহায্য না পেয়ে দ্রৌপদী কৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়েছেন। যোগবলে সুদূরে থাকা সত্বেও কৃষ্ণ তাঁকে চরম লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। পণদ্যুতে দ্বিতীয়বার পরাজিত হয়ে পাণ্ডবরা যখন বনবাস করছেন, তখন কৃষ্ণ ওঁদের দেখতে এসেছিলেন। দ্রৌপদী তখন সভাগৃহে তাঁর চরম লাঞ্ছনার কথা শুনিয়ে কৃষ্ণকে অনেক অনুযোগ করে বলেছেন যে, চারটি কারণে কৃষ্ণ যেন ওঁকে নিত্য রক্ষা করেন। প্রথমত, কৃষ্ণের সঙ্গে ওঁর সম্বন্ধ (তিনি কৃষ্ণের ভ্রাতৃবধূ - তিন পাণ্ডবভ্রাতা কৃষ্ণের পিসীমাতার পুত্র); দ্বিতীয়ত, ওঁর পবিত্রতা (উনি যজ্ঞবেদী সম্ভূতা); তৃতীয়ত, ওঁর সখ্যতা (তিনি কৃষ্ণের অনুগতা সখী); এবং চতুর্থত কৃষ্ণের শক্তিমত্বা। পঞ্চপাণ্ডব মহাবীর হওয়া সত্বেও রক্ষক হিসেবে কৃষ্ণকে তাঁর দরকার হয়েছে। সাধারণত বিপদে আপদে ভীমই ছিলেন দ্রৌপদীর ভরসা। ভীমও দ্রৌপদীকে রক্ষা করতে সবসময়েই তৎপরতা দেখিয়েছেন। কৌরব সভায় দ্রৌপদীর অপমান প্রত্যক্ষ করে ভয়ানক প্রতিজ্ঞা, দ্রৌপদী-হরণ প্রচেষ্টার জন্য জয়দ্রথকে অমানুষিক প্রহার, দ্রৌপদীর ওপর বলপ্রয়োগের জন্য পাপিষ্ঠ কীচককে বধ, কীচকের স্বজন কর্তৃক কীচকের সঙ্গে দ্রৌপদীকে দাহ করার অপচেষ্টা নষ্ট করা, ইত্যাদি ব্যাপারে ভীমকেই সচেষ্ট দেখা যায়। দ্রৌপদী তাঁর তেজস্বিতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। অজ্ঞাতবাস শেষ হবার পর কৌরবদের সঙ্গে শান্তিস্থাপনের আগ্রহে যখন যুধিষ্ঠির, অর্জুন, এমন কি ভীমসেন পর্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করছেন, তখন দ্রৌপদী কৃষ্ণকে বলছেন যে, রাজ্যার্ধ না দিলে কখনোই সন্ধির প্রস্তাব যেন না করা হয়। সবাই কি ওঁর লাঞ্ছনার কথা ভুলে গেছেন? তারপর নিজের উন্মুক্ত কেশগুচ্ছ কৃষ্ণের সামনে তুলে ধরে বলেছেন যে, কৃষ্ণ যেন মনে রাখেন - দুঃশাসন এই কেশগুচ্ছ স্পর্শ করেছে! তারপর ভীমার্জুনকে উদ্দেশ্য করেই কৃষ্ণকে বলেছেন যে, ভীমার্জুন যদি যুদ্ধ করতে না চান, তাহলে ওঁর বৃদ্ধ পিতা ওঁর ভ্রাতাদের এবং ওঁর পাঁচ পুত্র ও অভিমন্যুকে সাথে নিয়ে যুদ্ধ করবেন। দ্রৌপদীর এই তেজোস্বিতা পাণ্ডবদের, বিশেষ অরে ভীমকে যেরকম উদ্দীপ্ত করেছে, কৌরবদের সেই রকম ভীতি উৎপাদন করেছে। মহাযুদ্ধের শেষে গভীর রাত্রে অশ্বত্থমা পাণ্ডবশিবিরে ঢুকে দ্রৌপদীর ভ্রাতা ও পুত্রদের হত্যা করেছেন যেনে দ্রৌপদী শোকে দুঃখে বিহবল হয়েছেন। বলেছেন অশ্বত্থমা নিহত না হলে অনাহারে প্রাণত্যাগ করবেন। যুধিষ্ঠির যখন ওঁকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছেন, তখন তিনি ভীমকে বলেছেন অশ্বত্থমাকে বধ করে ওঁর মস্তকের সহজাত মণি এনে যুধিষ্ঠিরকে দিতে। ভীম তখন অশ্বত্থমার খোঁজে গেছেন। যুধিষ্ঠির যখন যুদ্ধজয় করেও বিষাদগ্রস্থ হয়ে বনবাসের কথা ভাবছেন, তখন দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর এই চিন্তা ক্ষত্রিয়জনোচিত নয়। পুত্রদের হারিয়েও দ্রৌপদী বাঁচতে চাইছেন, তাহলে যুধিষ্ঠিরের এই অবস্থা কেন। ধর্মপথে যুধিষ্ঠির পৃথিবী শাসন করুন। মহাপ্রস্থানের পথে মহাশৈল মেরুর কাছে এসে কৃষ্ণাই প্রথমে পতিত হলেন। ভীমের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন যে, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর পক্ষপাত ছিল। সেই দোষেই ওঁর পতন ঘটল। সেই দোষ সত্বেও দ্রৌপদীকে হিন্দুদের প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চনারীর (কুন্তি, দ্রৌপদী, তারা, মন্দোদরী ও অহল্যা) অন্যতমা বলে গণ্য করা হয়।

দেবানাম্পিয় পিয়দসি লাজ হেবাম্ অহা...

দেবগণের প্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা এমত কহিলেন...

কী বলেছিলেন প্রিয়দর্শী রাজা? তাঁর পরিচয়ই বা কী? ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির মাসিক সভায় যখন বলতে উঠেছিলেন সম্পাদক জেমস প্রিন্সেপ, তখনও তিনি সেই রাজার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি। সাঁচি স্তূপের অনেক জায়গায় খোদাই করা ছোট ছোট লিপি থেকে প্রিন্সেপ সদ্য ব্রাহ্মী লিপির জট খুলেছেন প্রিন্সেপ। চিনতে পারছেন ব্রাহ্মীর বর্ণমালা। সেই গল্পই তিনি সে দিন শুনিয়েছিলেন সোসাইটির সদস্যদের। কিন্তু লিপির প্রাথমিক জট খুললেই তো হবে না, ঠিক মতো পড়তে হবে দিল্লি, ইলাহাবাদ, বেতিয়া-য় পাথরের স্তম্ভে, কিংবা গিরনার আর ধৌলি-র পাথরের গায়ে এই লিপিতে কী লেখা আছে! তার পরে তো দেবানাম্পিয় পিয়দসি রাজার পরিচয় জানার প্রশ্ন।

অনেক দিন ধরেই দিল্লি থেকে মধ্যভারত হয়ে বিহার পর্যন্ত নানা জায়গায় পর্যটকদের চোখ পড়ছিল বিস্ময়কর সব পাথরের স্তম্ভের উপর। তিরিশ থেকে পঞ্চাশ ফিট উঁচু, পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ টন ওজনের এই সব স্তম্ভ একটাই পাথর কেটে তৈরি, গায়ে অসম্ভব ঝকঝকে পালিশ, কোনও কোনওটার মাথায় আলাদা ভাবে সিংহ, হাতি, ষাঁড় ইত্যাদির মূর্তি বসানো। কোনও স্তম্ভের গায়ে অপরিচিত লিপিতে খোদাই করা দীর্ঘ বক্তব্য। প্রায় সব জায়গায় স্থানীয় কিংবদন্তি, এ সবই নাকি মধ্যম পাণ্ডব ভীমের লাঠি! চতুর্দশ শতকে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক টোপরা (আজকের হরিয়ানা) এবং মেরঠ-এ এ রকম দুটো স্তম্ভ দেখতে পেয়ে খুবই অবাক হন। একটা তো সোনার মতো ঝকঝকে, ফিরোজ নামই দিয়ে দেন ‘মিনার-ই-জরিন’। ঠিক করে ফেলেন, দিল্লিতে তাঁর তৈরি নতুন রাজধানী সাজাতে দুটো স্তম্ভই তুলে নিয়ে আসবেন। করাও হল তাই। শুধু নিয়ে আসা নয়, আজ যেখানে ফিরোজ শা কোটলা-র বিখ্যাত ক্রিকেট মাঠ, সেখানে তাঁর দুর্গের চূড়োয় তোলাও হল একটাকে। অন্যটা ঠাঁই পেল আজকের দিল্লি রিজ-এ, ফিরোজের এক শিকারঘাঁটিতে। দুটোরই গায়ে কিছু লেখা আছে দেখে ফিরোজ নানা পণ্ডিতকে ডেকেছিলেন, কেউই কিছু বলতে পারেননি। ব্রিটিশ পর্যটক উইলিয়াম ফিঞ্চ জাহাঙ্গিরের সঙ্গে গিয়ে ইলাহাবাদে এমন একটি স্তম্ভ দেখেছিলেন। ১৬৭০-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী জন মার্শাল উত্তর বিহারে বেতিয়ার উত্তরে এ রকম আর একটি ‘ভীমের লাঠি’র খোঁজ পান, আজ জায়গাটি লৌরিয়া-নন্দনগড় নামে পরিচিত। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম দিকের এক সভায় শখের প্রত্নানুসন্ধানী টমাস ল বেতিয়ার দক্ষিণে লৌরিয়া অররাজ-এ আর একটি স্তম্ভের কথা জানান। ইয়োরোপীয়দের মনে হয়েছিল, এত চমৎকার সব স্তম্ভ ভারতীয়দের বানানো হতেই পারে না। এ নিশ্চয়ই গ্রিকদের কীর্তি। তবে এর সঙ্গে সম্রাট অশোকের সম্পর্কের কথা সে দিন কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি।

এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা, ভাষাতাত্ত্বিক উইলিয়াম জোন্স ভারতবিদ্যা চর্চায় নতুন দিগন্ত এনে দিলেন। তিনি অবশ্য ফিরোজ শাহের স্তম্ভে কী লেখা আছে পড়তে পারেননি। তার আগেই ভারতের প্রাচীন ইতিহাস উদ্ধার করতে গিয়ে তিনি পড়েছিলেন গভীর সমস্যায়। মুসলমান ঐতিহাসিকরা তাঁদের কালের খুঁটিনাটি সব লিখে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁরা আসার আগে এ দেশের ইতিহাস কী ছিল কোথায় জানা যাবে? তেমন তো কোনও বইপত্র নেই। জোন্সের সহকারী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা আঠারোটা পুরাণ ছাড়া আর কিছুই তাঁকে দেখাতে পারেননি। এই সব পুরাণ থেকে একটা ভাসা ভাসা ছবি মিলল ঠিকই, কিন্তু কার পর কোন রাজবংশ, কিংবা কার পর কোন রাজা কত দিন রাজত্ব করেন, তা নিয়ে দেখা গেল নানা মুনির নানা মত। তবে এটুকু জানা গেল, মগধে মৌর্য বংশে অশোক নামে এক রাজা ছিলেন, যদিও ব্রাহ্মণদের লেখা এই ইতিবৃত্তে অশোক আর পাঁচটা রাজার মতোই, তাঁকে আলাদা কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

অন্য দিকে, ইতালীয় পর্যটক মার্কো পোলো ভারত ঘুরে যাওয়ার পর ইয়োরোপে এটুকু প্রচারিত হয় যে বুদ্ধ নামের কোনও ধর্মগুরু বা দার্শনিকের সঙ্গে জড়িত কোনও ধর্ম এ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। কিন্তু ভারতে, জোন্সের সময়, বুদ্ধের উপাসনার কোনও প্রমাণ কেউ জানত না। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে কোথাও কোথাও বুদ্ধের নাম থাকলেও ভারতে সে সময় কোনও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ, কিংবা কোনও বৌদ্ধ স্থাপত্যের কথা জানা ছিল না। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসই যেখানে হারিয়ে গিয়েছিল, সেখানে সেই ধর্মের সব থেকে বড় পৃষ্ঠপোষকের কথা যে লোকে ভুলে যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক!

জোন্স দেখেছিলেন বুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর পণ্ডিতদের ধারণা রীতিমতো খারাপ। হিন্দু শাস্ত্রে বুদ্ধ বিষ্ণুর নবম অবতার, অথচ ব্রাহ্মণরা তাঁকে এক ধর্মদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা হিসেবেই ভাবেন। আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরি-তে ঠিক এই কথাই লিখেছিলেন। এই বৈপরীত্য কেন, জোন্স তা বুঝতে পারেননি।

বুদ্ধ এবং বৌদ্ধধর্ম নিয়ে জোন্স যা ভাবছিলেন, তা ১৭৮৯-এর এশিয়াটিক রিসার্চেস পত্রিকায় ছাপা হল। সঙ্গে সঙ্গে দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করল। ভারতে কোনও হদিশ না পাওয়া গেলেও আশপাশের নানা দেশ থেকে পালি ও সংস্কৃতে লেখা বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল। যাঁরা এ সব নিয়ে নিজেদের মতো করে চর্চা করছিলেন, তাঁদের চিঠিপত্র থেকে বোঝা গেল দুটো বিষয়ে সব পুথিই একমত এক, বৌদ্ধধর্মের সূচনা ভারতে, আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে মগধে; আর দুই, শাক্যমুনি বা গৌতম বুদ্ধই এই ধর্মের উদ্গাতা, তাঁরও জন্ম-মৃত্যু মগধে। ইতিমধ্যে এর সমর্থনে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও মিলতে শুরু করল।

কিন্তু সাল-তারিখের পুরনো সমস্যাটা তো মিটল না। জোন্স এ বার নজর ফেরালেন তাঁর ছোটবেলায় পড়া ক্লাসিকগুলির দিকে-- হেরোডোটাস, স্ট্রাবো, মেগাস্থেনিস, আরিয়ান, টলেমি... আলেকজান্ডারের ভারত-অভিযান ঐতিহাসিক ঘটনা, গ্রিক ঐতিহাসিকরা তো ফলাও করে সে কথা লিখে গিয়েছেন। সেই সব বিবরণীর মধ্যে কোথাও কি কোনও সূত্র লুকিয়ে থাকতে পারে?

পারস্যে দারিয়ুসকে পরাজিত করার পর খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে ভারত আক্রমণ করেন আলেকজান্ডার, আর দেশে ফেরার পথে ব্যাবিলনে তাঁর মৃত্যু হয় ৩২৩ অব্দের গ্রীষ্মকালে। আরও আঠারো বছর পর তাঁর অন্যতম সেনাপতি সেলুকস যখন অনেক দিন আগেই তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া ভারতীয় এলাকাগুলি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেন, তখন তাঁকে এক অত্যন্ত শক্তিশালী ভারতীয় সম্রাটের মুখোমুখি হতে হয়। গ্রিক বিবরণে এই যুদ্ধের ফলাফল স্পষ্ট করে বলা নেই, এটুকুই আছে যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তাতে সেলুকস পাঁচশো রণহস্তী উপহার পেয়েছিলেন আর নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় রাজপরিবারে। বোঝাই যায়, সেলুকসকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সিন্ধুনদের পূর্ব দিকের সব এলাকা, এমনকী গান্ধারও ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে।

কে এই ভারতীয় সম্রাট? আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়ী বাহিনী যাঁর বিরাট সেনাদলের কথা শুনে আর এগোতে চায়নি, ইনি তো সেই আগ্রামেস বা জান্ড্রামেস নন। গ্রিকদের নানা বিবরণীতে নানা রকম নাম আছে, মোটের উপর সান্ড্রোকোপ্টস নামটা দাঁড় করানো যায়। আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে এটা শুনলে হয়তো সহজেই ‘চন্দ্রগুপ্ত’ মনে হবে, কিন্তু আঠারো শতকের শেষে উইলিয়াম জোন্সের পক্ষে নিশ্চিত হওয়াটা আদৌ সহজ ছিল না। কী করে বোঝা যাবে চন্দ্রগুপ্তই সেলুকসের সমসাময়িক? সে জন্য দরকার আরও প্রমাণ। সেলুকস দূত পাঠিয়েছিলেন সান্ড্রোকোপ্টস-এর সভায়। সেই দূত মেগাস্থেনিস লিখেছিলেন ইন্ডিকা নামে ভারত-বিবরণ। ইন্ডিকা-র সামান্য অংশই আমাদের কাল অবধি পৌঁছেছে, তা থেকে জানা যায় সান্ড্রোকোপ্টস-এর রাজধানী ‘পালিম্বোথ্রা’ ছিল গঙ্গা এবং ‘এরানোবোয়াস’ নদীর সঙ্গমে।

জোন্স আর তাঁর সঙ্গী পণ্ডিতরা সংস্কৃত পুথিপত্র তন্নতন্ন করে খুঁজেও ‘পালিম্বোথ্রা’ কি ‘এরানোবোয়াস’-এর কোনও হদিশ পেলেন না। তবে দেখা গেল, মগধের রাজধানী পাটলিপুত্রের কথা সেখানে ঘুরেফিরেই এসেছে। এবং বাংলার প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল তথা মানচিত্রকার মেজর জেমস রেনেল জোন্সকে লিখলেন, পটনা, পাটলিপুত্র আর ‘পালিম্বোথ্রা’ একই হতে পারে। আধুনিক পটনার কাছেই গঙ্গা আর সোন নদীর সঙ্গম। এক সময় সোন নদীর পুরনো খাত গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে মাঝে একটা লম্বাটে ডিমের মতো দ্বীপ সৃষ্টি করেছিল, যার মধ্যে মেগাস্থেনিসের ‘পালিম্বোথ্রা’ ভাল ভাবেই ধরে যেতে পারে।

সমস্যা তবু থেকেই গেল। নদীর নামটা তো সোন, ‘এরানোবোয়াস’ কোথা থেকে এল? শেষে একটা সংস্কৃত সূত্র থেকেই দেখা গেল, নদীটি ছিল ‘হিরণ্যবাহ’, যা থেকে গ্রিকরা ‘এরানোবোয়াস’ লিখেছিলেন। আর ‘হিরণ্য’ থেকে সোন-এ পরিণত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। ফলে পাওয়া গেল পাটলিপুত্র, পাওয়া গেল চন্দ্রগুপ্তকে। একটা আবিষ্কার আর একটার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এর পরের রাস্তাটা খুলে দিল সংস্কৃত সাহিত্যেরই দুটো অপঠিত পুথি, সোমদেবের কথাসরিৎসাগর আর বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস। নন্দবংশ ধ্বংস করে বিক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ চাণক্যের সাহায্যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কী ভাবে পাটলিপুত্রে ক্ষমতায় এলেন, তার গল্প বিস্তারিত ভাবে পাওয়া গেল এখানে। পৌরাণিক বিবরণে এ গল্প ছিল, তবে এত খুঁটিনাটি ছিল না। এ বার তা মিলিয়ে নেওয়া গেল গ্রিকদের বর্ণনার সঙ্গে, নিশ্চিত হওয়া গেল সান্ড্রোকোপ্টস-ই চন্দ্রগুপ্ত। শুধু তাই নয়, বোঝা গেল, আলেকজান্ডারের সঙ্গে যাঁর দেখা হয়েছিল, গ্রিক বিবরণীর সেই ‘সিসিকোটাস’ বা শশীগুপ্ত আর চন্দ্রগুপ্ত অভিন্ন। একেবারে প্রদোষচন্দ্র মিত্র বা ‘সন্ধ্যাশশী বন্ধু’র নির্ভুল ডিডাকশন!

১৭৯৩-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটির দশম বর্ষপূর্তি সভায় উইলিয়াম জোন্স এক দিকে পটনা-পাটলিপুত্র-পালিম্বোথ্রা, আর অন্য দিকে সান্ড্রোকোপ্টস-চন্দ্রগুপ্ত, দুটি আবিষ্কারের কথাই ঘোষণা করলেন। এশিয়াটিক রিসার্চেস-এ ছাপা হল প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের প্রথম সুনির্দিষ্ট কালপর্ব। আলেকজান্ডারের দুই প্রতিনিধির ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় থেকেই চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য-সূচনা (৩১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ধরেছিলেন জোন্স। চন্দ্রগুপ্ত (৩১৭-২৯৩), বিন্দুসার (২৯২-২৬৮), অশোক (২৬৭-২৩০) হয়ে মৌর্য সাম্রাজ্য মোটামুটি ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রেখেছিল। জোন্সের ঘোষণা ভারতের অতীত ইতিহাসকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিল। পরের দুশো কুড়ি বছরে এই সময়সারণিতে খুব বড় রকম পরিবর্তন আনার মতো কিছু ঘটেনি।

চন্দ্রগুপ্তকে পাওয়া গেল, তাঁর সূত্র ধরে অশোককেও। কিন্তু দেশজোড়া নানা খোদিতলিপির আড়ালে কী লুকিয়ে আছে সেটা তো এখনও জানা যায়নি। মুশকিল হল, ১৭৯৫-এ উইলিয়াম জোন্সের মৃত্যুর পর এশিয়াটিক সোসাইটির কাজের গতিটাই নষ্ট হয়ে গেল। সভাপতি, সম্পাদকদের আসাযাওয়ার মাঝে দেশবিদেশ থেকে পাঠানো লেখা, খবরের স্তূপে ধুলো জমতে লাগল, কত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শুধু সামান্য উৎসাহের অভাবে চাপা পড়ে গেল তার ইয়ত্তা নেই। হোরেস হেম্যান উইলসন প্রায় বাইশ বছর সোসাইটির সম্পাদক ছিলেন, এই পর্বে সংস্কৃত চর্চা যতটা গুরুত্ব পেয়েছিল, বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক চর্চা তার ধারেকাছে নয়। অথচ এই পর্বেই চিন, শ্রীলঙ্কা ও ব্রহ্মদেশে বৌদ্ধ শাস্ত্র, কাহিনির বহু পুথির খবর আসছিল। বৌদ্ধধর্মের উৎস যে ভারত, বুদ্ধ যে সত্যিই ঐতিহাসিক চরিত্র, এ সবেরই আরও জোরাল প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল। ভারতের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল কলিন ম্যাকেঞ্জি অনেকটাই নিজের উদ্যোগে, নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সমীক্ষা চালালেন, অন্য দিকে সরকারি নির্দেশে ফ্রান্সিস বুকানন ব্রহ্মদেশ, নেপাল, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি এবং সব শেষে বাংলা-বিহারে তথ্য সংগ্রহ করলেন। এ সবের মাধ্যমে অনেক ধোঁয়াশা কাটতে লাগল। অন্ধ্রের অমরাবতী বৌদ্ধস্তূপ থেকে বিরাশিটি অমূল্য ভাস্কর্যফলক উদ্ধার করে নিয়ে আসার কৃতিত্ব ম্যাকেঞ্জির। এই অমরাবতী থেকেই পাওয়া একটি ফলকে ‘রাজচক্রবর্তী’র ভাস্কর্য খোদিত আছে। বর্তমানে প্যারিসের বিখ্যাত সংগ্রহশালা মুসে গিমে-তে রক্ষিত ফলকটিতে দেখা যাচ্ছে, রাজমূর্তির পিছনে স্তম্ভের উপর একটি চক্র রয়েছে। ‘চক্রবর্তী’ রাজার এই চিত্র যে অশোকের ধর্মের ভিত্তিতে সুশাসনের প্রতীক, তা বুঝতে অবশ্য আরও অনেক সময় লেগেছিল। সারনাথ থেকে পাওয়া চক্রের কল্যাণে আজ তা সবারই জানা, জাতীয় পতাকার মাঝেও তা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।

ম্যাকেঞ্জির মতো বুকাননও ছিলেন স্কটল্যান্ডের লোক। ভারতে বৌদ্ধধর্মের মূল শিকড় খুঁজে বার করার কাজে এই মানুষটির গুরুত্ব বোধহয় সবথেকে বেশি। বিহারে সমীক্ষার সময় বুকানন দেখেন, পুরো অঞ্চলটাই সুপ্রাচীন ধ্বংসস্তূপে ভর্তি। বুদ্ধগয়ার মূল মন্দির আর তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র মূর্তি যে বৌদ্ধদের, তা বুকানন প্রথমে বুঝতে পারেননি। হিন্দু ভক্তরাই সেখানে থাকেন, পুজোও দিতে আসেন হিন্দুরা, বিশেষ করে মন্দিরের দুটি জায়গায়একটি পাথরের বেদী আর অন্যটি এক অশ্বত্থ গাছ। একেবারেই কাকতালীয় ভাবে বুকাননের সঙ্গে স্থানীয় একজনের দেখা হল, কয়েক বছর আগে ব্রহ্মদেশের রাজার পাঠানো দুই তীর্থযাত্রী তাঁকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁরাই বলেন, বুদ্ধ এখানে থাকতেন, আর এই মন্দির ছিল ভারতবিখ্যাত ধর্মীয় কেন্দ্র। ব্রহ্মদেশের মানুষের কাছে এই মন্দিরের গুরুত্ব তখনও বিপুল। আর ওই পাথরের বেদী বা অশ্বত্থ গাছ রাজা ধর্মাশোকের কীর্তি, হিন্দুদের অনেক আগে থেকেই তা বৌদ্ধদের শ্রদ্ধার স্থান। এ বার বুকানন বুঝলেন, যে সব মূর্তি হিন্দু দেবদেবীর বলে তাঁর মনে হচ্ছিল, আসলে সেগুলি বৌদ্ধ মূর্তি ব্রহ্মদেশ বা কাঠমান্ডুতে তিনি যেমন মূর্তি দেখেছেন, তেমনই।

Beloved-of-the-Gods speaks thus:[39] This Dhamma edict was written twenty-six years after my coronation. Happiness in this world and the next is difficult to obtain without much love for the Dhamma, much self-examination, much respect, much fear (of evil), and much enthusiasm. But through my instruction this regard for Dhamma and love of Dhamma has grown day by day, and will continue to grow. And my officers of high, low and middle rank are practicing and conforming to Dhamma, and are capable of inspiring others to do the same. Mahamatras in border areas are doing the same. And these are my instructions: to protect with Dhamma, to make happiness through Dhamma and to guard with Dhamma.

দক্ষিণ বিহারে ঘুরতে ঘুরতে বুকানন বুঝতে পারলেন, এই অঞ্চলটি এক সময় বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র ছিল। যেমন রাজগির পুরাণে জরাসন্ধের রাজধানী বলা হলেও বৌদ্ধদের কাছে বিন্দুসারের রাজধানী হিসেবেও সমান গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁরই রাজত্বকালে বুদ্ধ ধর্মপ্রচার করেন। ভারতে বৌদ্ধধর্ম কত ব্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটা পণ্ডিতরা বুঝতে পারছিলেন। বুদ্ধ এবং অশোক কাছাকাছি আসছিলেন, কিন্তু সূত্রগুলো চোখের সামনে থাকলেও কেউ সে ভাবে নজর দিচ্ছিলেন না। হোরেস হেম্যান উইলসন এই পরিস্থিতির জন্য অনেকটাই দায়ী।

এশিয়াটিক সোসাইটির স্থবিরতা কাটল ১৮৩২-এ। দায়িত্বে এলেন এক তরুণ প্রতিভা, জেমস প্রিন্সেপ। প্রিন্সেপ দেখলেন, ইলাহাবাদ, দিল্লি আর বিহারের স্তম্ভগুলির গায়ে যা খোদিত আছে, তা একই রকম দেখতে। কী লেখা থাকতে পারে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এই সব লিপিতে? কোনও রাজার বিজয়বার্তা? ভারতজোড়া কোনও সাম্রাজ্যের সীমানাচিহ্ন? নাকি কোনও ধর্মীয় বাণী? এই সময়েই শ্রীলঙ্কা থেকে জর্জ টার্নার দেখালেন, বৌদ্ধ পুথি দ্বীপবংশ-মহাবংশে গৌতম বুদ্ধের জীবনী এবং পরে বৌদ্ধধর্মের বিপুল সমৃদ্ধির পিছনে সম্রাট অশোকের ভূমিকা বিস্তারিত ভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠল পৌরাণিক বিবরণে সম্পূর্ণ অবহেলিত অশোকের ছবিটা। বৌদ্ধবিরোধী ব্রাহ্মণরা কেন পুরাণে অশোককে আদৌ গুরুত্ব দেননি, এ বার বোঝা গেল সেটাও।

ইতিমধ্যে প্রিন্সেপের হাতে এল ভুবনেশ্বরের ধৌলি লিপি, লেফটেনান্ট মার্কহ্যাম কিটো জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে ভাল্লুকের তাড়া খেয়েও কোনও রকমে যেটার কপি করে পাঠিয়েছিলেন। সাঁচি থেকেও এল বেশ কিছু লিপির কপি। সাঁচির লেখাগুলো পরপর সাজাতে গিয়ে প্রিন্সেপের মনে হল, প্রায় সবগুলোই দুটো একই অক্ষরে শেষ হচ্ছে। তার আগের অক্ষরটাও অনেক ক্ষেত্রেই এক। তা হলে কি এটা সাঁচির বৌদ্ধস্তূপে ভক্তদের কিছু দান বা উৎসর্গের কথা বোঝাচ্ছে? শব্দটা ‘দানম্’ হতে পারে কি?

এর পর ব্রাহ্মী লিপির বাকি অক্ষর খুঁজে বার করতে প্রাচীন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ প্রিন্সেপের খুব অসুবিধে হয়নি।

অক্ষর তো চেনা গেল। এ বার লিপিগুলো পড়া শুরু করা যাক। দেখা গেল, সব কটিরই শুরু ‘দেবানাম্পিয় পিয়দসি লাজ হেবাম্ অহা...’ দিয়ে। কোন রাজা এমন ভাবে প্রজাদের উদ্দেশে বলছেন? দেশের সব প্রান্তে তাঁর লিপি, কত বড় ছিল তাঁর সাম্রাজ্য? টার্নারের অনুবাদে যাঁর কথা ছিল, প্রিন্সেপ ভেবেছিলেন, ইনি বোধহয় সেই শ্রীলঙ্কার রাজা দেবানামপিয়তিস্স। তবে টার্নারই ফের আসল হদিশ দিলেন। শ্যামদেশ থেকে পাওয়া দ্বীপবংশ-এর আরও পুরনো এক পুথি থেকে জানা গেল, স্তম্ভলিপির প্রিয়দর্শীই অশোক মৌর্য। ভারত-ইতিহাসের বোধহয় সবথেকে বড় জট খুলে গেল এ ভাবেই। ১৮৩৮-এর মধ্যে প্রিন্সেপ অশোকের বেশ কিছু লিপি অনুবাদ করে ফেললেন। বোঝা গেল, ভারতজোড়া সাম্রাজ্য স্থাপন শুধু নয়, বৌদ্ধধর্মকে পরের প্রায় দেড় হাজার বছর টিকে থাকার শক্তি দিয়ে গিয়েছিলেন অশোক, যে শক্তির জোরে দেশের মাটি থেকে মুছে যাওয়ার পরও তা এশিয়ার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম হয়ে উঠতে পেরেছিল। পাশাপাশি রাজধর্মকে তিনি দিয়েছিলেন নতুন মাত্রা, যা তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল আদর্শ রাজা হিসেবে।

অশোককে আলোয় ফিরিয়ে আনার পর খুব অল্প দিনই বেঁচেছিলেন জেমস প্রিন্সেপ। উনিশ শতকের বাকি সময়টা অশোক এবং বৌদ্ধচর্চার কেন্দ্রে ছিলেন দুই চিনা পর্যটক-- পঞ্চম শতকে ফাহিয়ান আর সপ্তম শতকে জুয়াংঝাং (এক সময় যাকে হিউয়েন সাং লেখা হত)। এঁদের লেখাপত্র ১৮৪১ থেকেই অনুবাদ হতে শুরু করে, আর ১৮৪২-এই প্রিন্সেপের শিষ্য আলেকজান্ডার কানিংহাম দেখান, বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থলগুলির অবস্থান বুঝতে এই দুই পর্যটকের লেখা বিবরণী খুবই সাহায্য করবে। বস্তুত, কানিংহাম ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই বিবরণী পকেটে নিয়েই বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র খুঁজে বার করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। তবে অশোকের রাজধানী পাটলিপুত্রের ধ্বংসাবশেষ তিনি খুঁজে বার করতে পারেননি। বিশ শতকের গোড়ায় ডেভিড স্পুনার পটনার কাছে কুমরাহার-এ পাথরের স্তম্ভযুক্ত যে বিশাল স্থাপত্য উদ্ধার করেন, সেটি সম্ভবত তৃতীয় বৌদ্ধ ধর্মসম্মেলনের জন্যই অশোক তৈরি করিয়েছিলেন। অজাতশত্রুর রাজত্বকালের পটভূমিতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘অমিতাভ’ গল্পে আছে: “(তথাগত) বহুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে গঙ্গা-শোণ সঙ্গমে দুর্গভূমির প্রতি তাকাইয়া রহিলেন। শেষে স্বপ্নাবিষ্ট কণ্ঠে কহিলেন, ‘আমি দেখিতেছি, ... এই ক্ষুদ্র পাটলিগ্রাম... এক মহীয়সী নগরীতে পরিণত হইবে। বাণিজ্যে, ঐশ্বর্যে, শিল্পে, কারুকলায়, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে পৃথিবীতে অদ্বিতীয় স্থান অধিকার করিবে। সদ্ধর্ম এইস্থানে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা লাভ করিবে।”

অশোকের উদ্যোগে সদ্ধর্ম সত্যিই দৃঢ়প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।

তথ্যসূত্র:

অশোক, চার্লস অ্যালেন (হ্যাচেট ইন্ডিয়া)