কবিতা আবৃত্তি

আবৃত্তির পাঠশালা

বাংলা ভাষার বিশুদ্ধ প্রয়োগ,উপস্থাপন,উৎকর্ষ,কন্ঠের কৌশল, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা, সাহসীকতা, এসব অর্জন করা সম্ভব যদি আবৃত্তি শিল্পের প্রতি চর্চা ও দখল থাকে। আবৃত্তি বলতে শুধু দু’দশ লাইন কবিতা নিচু বা উচ্চ স্বরে বিভিন্ন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা নয়। আবৃত্তির একটা নিজেস্ব ব্যাকরণ রয়েছে। নিজেস্ব তাল, লয়, রস,বোধ আছে। যা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে একটি পুস্তকবন্দি জড় শব্দ জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। আমরা এই ‘ভয়েজ অব মণিরামপুর’ পত্রিকার নির্দিষ্ট বিভাগের মধ্যে শুরুতে শিশুদের আবৃত্তি শেখার কৌশল এবং পদ্ধতি এবং তারপর ক্রমান্বয়ে আমরা আবৃত্তি নির্মাণ, প্রমিত উচ্চারণসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করবো, যা নিয়মিত চর্চার মধ্য দিয়ে আপনার সন্তান বা আপনি হয়ে উঠবেন ব্যক্তিত্বশীল,স্পষ্টভাষী সাহসী মানুষ হিসেবে। আমরা আজ ১ম সংখ্যায় কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করবো। ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে থাকবে...

টেইল ড্রপিং বা অসম্পূর্ণ উচ্চারণ:

বাক্যের শুরুটা যেমন হয়, শেষটায় গিয়ে গলার জোর তেমন থাকে না। মনে হয় গলা নেমে যাচ্ছে। ফলে শেষের দিকের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায় না। মনে হয় দম কমে এসেছে বা শেষ হয়ে এসেছে। উচ্চারণের এই ত্রুটির নাম টেইল ড্রপিং। বাক্যের টেইল বা লেজের দিকে উচ্চারণ নেমে যায় বলে এই নাম। শুধুমাত্র সচেতন থাকলেই এ দোষ কাটিয়ে ওঠা যায়। অনেকে বাক্যের শেষ দিকে অকারণে জোর দেয়। এটাও স্বাভাবিক নয়। এ ব্যাপারে শিশুকে শুরু থেকেই সচেতন করে দিতে হবে। সতর্কভাবে চর্চা করলে অতি দ্রুত এ দোষ কাটিয়ে ওঠা যায়।

কন্ঠস্বরে জোর:

কণ্ঠস্বরে জোর থাকতে হবে। মাইক না থাকলেও যেন গলার স্বর মৃদু মনে না হয়। গলাকে ওঠাতে নামাতে জানতে হবে। শিশু বড় হতে থাকলে তাকে ধীরে ধীরে এ বিষয়টা শেখাতে হবে। হারমোনিয়াম ধরে অনুশীলন করানো যেতে পারে। কণ্ঠ যতো উঁচুতে উঠবে এবং নিচে নামবে কণ্ঠ তত নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এটা করার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকেও ধরে রাখার অনুশীলন করতে হবে। মনে রাখতে হবে শ্বাস প্রশ্বাসের অনেক ব্যায়াম আছে। শিশু যখন বড় হতে থাকবে তখন তাকে এ বিষয়গুলো শেখাতে হবে।

দ্রুত না বলা:

দ্রুত কথা বলে অনেকে। তাকে ধীরে ধীরে কথা বলায় অভ্যাস করতে হবে। এজন্য ধৈর্য প্রয়োজন। শব্দ দ্রুত উচ্চারণ করলে একটা শব্দ আরেকটা শব্দের গায়ের ওপর উঠে আসে। তখন ভালো ভাবে বোঝা যায় না বক্তা কি বলতে চাইছে। এক ধরনের শব্দজট তৈরি হয় এভাবে বলার ফলে। কিভাবে দুই শব্দের মধ্যে ফাঁক রেখে উচ্চারণ করতে হয় এজন্য খুব সহজ এবং বয়স অনুযায়ী গদ্য নির্বাচন করে নিতে হবে। সহজ পাঠ জাতীয় বই এক্ষেত্রে ভালো নির্বাচন হতে পারে।

অর্থ বোঝা:

কবিতা শেখানোর পাশাপাশি তার অর্থটা বোঝানো দরকার। খুব ছোট শিশুকে হয়তো অর্থ বোঝানো কঠিন হবে। তবে একটু বড় হয়ে উঠলে তাকে অবশ্যই কবিতাটির অর্থ বুঝিয়ে দিতে হবে। অর্থ না বুঝে তোতা পাখির মতো কবিতা আওড়ানো অর্থহীন। নিজে কবিতা বুঝে পড়লে ভবিষ্যতে কবিতা এবং আবৃত্তির প্রতি শিশুর আগ্রহ জন্মাবে। আর না বুঝে অন্যের কণ্ঠ নকল করতে থাকলে কবিতা ও আবৃত্তির প্রতি তার আগ্রহ ক্রমেই কমতে থাকবে। তাই কবিতা পড়ার আগে কিংবা পাশাপাশি শিশুকে কবিতার অর্থ বুঝতে সাহায্য করতে হবে।

মুখস্থ:

কবিতা আবৃত্তি করতে হলে মুখস্থ করাও শিখতে হবে। অবশ্য অধিকাংশ কবিতাই কয়েকবার পড়লে আপনা থেকেই মুখস্থ হয়ে যায়। দেখে দেখেও আবৃত্তি করা যায়। তবে মুখস্থ থাকলে আবৃত্তি করতে গিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না, হোঁচট খাবার ভয় থাকে না। মুখস্থর আরেক অর্থ হতে পারে মনোযোগ দিয়ে কবিতাটি বারবার পড়া।

ছন্দ :

ভালো আবৃত্তি করতে হলে কি ছন্দ জানা দরকার? মোটেই না। বিশেষত ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে ছন্দ শব্দটাই ভীতিকর হয়ে উঠতে পারে। কবিতা আবৃত্তি করলে ছন্দ দোলাটা আপনা থেকেই আয়ত্তে আসবে। এভাবে ছন্দ বিষয়ে না জেনেও ছন্দবোধ তৈরি হবে ভেতরে ভেতরে। এই ছন্দবোধ সবসময় যথা স্থানে থামতে বা লাইনকে ভাঙতে সাহায্য করবে। বড় হয়ে যখন ছন্দ বিষয়ে পড়ার ইচ্ছে হবে, তখন অনেক সহজ হবে ব্যাপারটা।

শ্বাস প্রশ্বাস:

আবৃত্তির সঙ্গে শ্বাস প্রশ্বাসের একটা গভীর যোগাযোগ আছে। দম ধরে রাখতে না পারলে ভালো আবৃত্তি করা যায় না। খুব ছোট শিশুকে এই দমের ব্যাপারটা বোঝানো যাবে না হয়তো। তবে একটু বড় হওয়ার পর থেকেই এটা শেখাতে হবে নিয়ম করে। ঘড়ি ধরে দশ সেকেন্ড শ্বাস নেয়া, দশ সেকেন্ড শ্বাস বন্ধ করে রাখা এবং পরবর্তী দশ সেকেন্ড মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ত্যাগ- এভাবে শুরু করে ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে সময়। নিয়মিত অভ্যাস করলে দম বাড়বে, কণ্ঠে জোর বাড়বে, একই সঙ্গে কণ্ঠস্বর নমনীয় হবে।

শব্দ চর্চা:

শিশুকে আবৃত্তি শেখানোর জন্য সেইসব কবিতা বেছে নেবেন যা তাকে আনন্দ দেবে। শিশুকে জোর করে এমন কবিতা শেখাবেন না যা কবিতার প্রতি তার আগ্রহকে নষ্ট করে দেয়; ছড়া দিয়ে শুরু করবেন। ছড়ায় থাকে গতি, ছড়ায় থাকে আনন্দ। ছড়ার বিষয়বস্তু প্রায়শঃই শিশু মনের চাহিদা মেটায়। সে কারণেই ছড়া শিশুদের প্রিয়। নির্বাচন করণে সেসব ছড়া যা মজাদার। যখন শিশু ছড়াটি আবৃত্তি করা আয়ত্ত করে ফেলবে তখন তাকে বুঝিয়ে দেবেন অর্থ। শিশুর আবৃত্তি আরো আনন্দময় হয়ে ওঠবে এর ফলে।

সাহস জোগানো:

শুরু থেকেই শিশু চমৎকার আবৃত্তি করবে- এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তাকে সাহস জোগাতে হবে। প্রশংসা করতে হবে। ধীরে ধীরে তার জড়তা কাটবে। সাহস বাড়বে। উচ্চারণ স্পষ্ট হবে। কবিতার সঙ্গে তার পরিচয় যত বাড়বে তত তার আবৃত্তিতে আগ্রহ বাড়বে। শিশুর অপারগতায় বিরক্ত না হয়ে তার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাকে ভুলগুলো শুধরে দিতে হবে।