50 Years of Bangladesh

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি


এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বাঙ্গালির হাজার বছরের পরাধীনতার শৃংখল, শোষণের জিঞ্জির ভেঙ্গে স্বাধীনতার লাল সূর্যের রঙের সাথে মিশে আছে ত্রিশ লাখ শহিদের রক্ত,দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা এবং বিপুল স¤পদ ক্ষতির মাশুল। বিশ্বের অন্যকোনো জাতি, অন্যকোনো দেশের স্বাধীনতা অর্জনে এত ত্যাগের নজির ইতিহাসে বিরল এবং অনন্য। অর্থনৈতিকভাবে বা অবকাঠামোগতভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের এক রোল মডেল আজ সারা বিশ্বে। অথচ এদেশের জন্মের সময়ে হেনরী কিসিঞ্জার মন্তব্য করেছিলেন একে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি‘ হিসেবে। এক সময়কার শুধুমাত্র পাট ফলানো, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত, তলাবিহীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ নামের এই দেশটি আজ বিশ্বের দরবারে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে আছে। বেড়েছে শিক্ষার হার, বেড়েছে কর্মসংস্থান, বেড়েছে রপ্তানি বাণিজ্য। বাংলাদেশ উন্নতির গতিতে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে পূর্ণ করল ৫০ বছর।

১৯৭১ সালের লাখ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন স্বাধীনতার বেদীমূলে! তারা তাদের বর্তমান উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের ভবিষ্যৎ রচনা জন্য। ত্রিশ লাখ শহিদ কয়েক লাখ মা-বোন তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন এই স্বাধীনতার জন্য। ১৯৬৬ সালেই বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীনতার গন্তব্যে যাওয়ার। সেসব ইতিহাস আজ সর্বজনবিদিত। স্বাধীনতার ৫০ বছর তথা সুবর্ণজয়ন্তী আর স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও পূর্ণ হলো চলতি বছরে।তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ মহিমায় এবারের স্বাধীনতা দিবস অনন্য ঐশ্বর্যে ভাস্বর। আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবী অভিনন্দিত করছে বাংলাদেশকে তার অনন্য এই দুটি চিরস্মরণীয় উৎসবকে ঘিরে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনে বিজয় থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় । পাকিস্তান নামক ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক আর সামরিক শাসনে রাষ্ট্রের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দুর্বার আকাক্সক্ষায় বাংলার মানুষের নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ ২৩ বছর যে কঠিন ত্যাগ স্বীকার আর প্রাণপণ সাহসী সংগ্রাম সেই সংগ্রামের স্মৃতি আজ আমাদের চেতনায় দেদীপ্যমান হয়ে উঠছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সেদিনের যুবনেতা শেখ মুজিব বুঝে ফেলেছিলেন পাকিস্তানের অধীনে থাকা স্বাধীনতায় বাংলার মানুষের মুক্তি মিলবে না। তাই বলতে গেলে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলার মানুষের ওপর আঘাত আসার পর থেকে স্বাধিকারের সংগ্রাম এসে উপনীত হয় একাত্তরের সংগ্রামে। একাত্তরে বাংলাদেশে যে কঠিন মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তার সোনালি ফসল আজ ঘরে তুলছে বাংলাদেশ। একদিন সাম্রাজ্যবাদীরা যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি‘ বলে অপমানের অপচেষ্টা করেছিল আজ তারাই বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দেখার জন্য স্বল্পোন্নত ও দারিদ্র্য দেশসমূহকে পরামর্শ দিচ্ছে।

সংগত কারণেই আজ ৫০ বছর পেরিয়ে এসে আমাদের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ করা দরকার। ৩০ লাখ শহিদের রক্তাত এই বাংলাদেশে যদি সর্বক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হয়ে উঠতে না পারে, তাহলে সকল আনন্দই ¤¬ান হয়ে যাবে। অর্জনের আনন্দ আমাদের গর্বিত করছে আজ। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে যদি উন্নয়নের এই প্রবাহ বেগবান রাখা না যায় তাহলে তা হবে লাখো শহিদের মৌন দীর্ঘশ্বাস আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হতাশার, যা আমরা কখনও চাই না।

৫০ বছর অতিক্রম করে আজ বাংলাদেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা কোনো অংশেই কম গৌরবের নয়। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে যে অকল্পনীয় সাফল্য অর্জন করেছে তা বিশ্ববাসীর কাছেও বিস্ময়। বঙ্গবন্ধু যদি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার না হতেন যদি আর দশটি বছরও বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি হিসেবে গৌরবের আসন নিশ্চিত করতে পারত। কিন্তু পরাশক্তিসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তির গভীর চক্রান্ত সেই স্বপ্ন নস্যাৎ করে দিয়েছিল জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে।

এখন পৃথিবীতে যে ১১টি দেশকে ভবিষ্যত উন্নয়নের জন্য ‘ উদীয়মান এগারো‘ বলে অভিহিত করা হয়, তাদের মধ্যে আমরা একটি দেশ হিসেবে বিরাজ করছি।আমরা গত কয়েক বছর ধওে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও হার ৭ শতাংশের আশেপাশে ধওে রেখেছি। আমাদের দেশে দারিদ্যের হার ১৯৭৪ সালে ছিল ৭৫ শতাংশ। অর্থাত শতকরা ৭৫টি পরিবারই বেঁচে থাকার মতো খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না।আজ সেই হার ২০ শতাংশ নেমে এসেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছিল কৃষিপ্রাধান দেশ। আজ জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ১৩ শতাংশ, শিল্পে ৩০ শতাংশ এবং সেবা খাতের অবদান ৫৭ শতাংশ। বাংলাদেশ আজ কাঠামোগতভাবে আধুনিক শিল্পায়িত দেশে পরিণত হতে চলেছে।কিন্তু প্রায় ১৬ কোটি লোককে আজ আমাদের কৃষকেরা কম জমিতে দ্বিগুন-ত্রিগুণ উতপাদন বৃদ্ধি করে খাইয়ে পড়িয়ে রেখেছে-এটা মোটেও কম কোনো অর্জন নয়। আমাদের দেশে প্রায় শতভাগ শিশু এখন প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। শিশু মৃত্যুও হার,মাতৃ মৃত্যুও হার, গড় আয়ুষ্কাল ইত্যাদি মানব উন্নয়ন সূচকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ প্রতিবেশী দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে।ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে এমডিজির (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল) অধিকাংশ লক্ষ্য অর্জনসহ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের শ্রেণিভুক্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। কিন্তু আরও বহুদূর যেতে হবে সত্যিকারের সুখী-সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলতে হবে। যে অর্থনৈতিক উন্নতি ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে, তার সুফল আরও অধিক মাত্রায় জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছাতে হবে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে সত্য কিন্তু তার সিংহভাগ কয়েক হাজার কোটিপতির ঘরে বৃত্তাবদ্ধ হয়েছে। দেশের অর্থ কালো টাকার মালিকরা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যে সংকট মোকাবিলা করতে হিমশিম খেয়েছেন, সেই সংকট ৫০ বছর পরও বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে আছে। আজও বাংলাদেশের জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য জরুরী ও কার্যকরী পদক্ষেপ

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর পেছন ফিরে তাকালে অনেক অর্জন আমাদের আশান্বিত করবে। কিন্তু তৃপ্ত হবার সুযোগ নেই। এখনও জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি হীন ব্যক্তিস্বার্থ দলীয় সংকীর্ণতায় আমাদের জাতীয় ঐক্যের পথে বড় বাধা। আমরা ৫০ বছর পরেও সবার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি, চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে বটে। প্রাইভেট হাসপাতাল বেড়েছে। কিন্তু গরিব মানুষের চিকিৎসা দেয়ার সংকুচিত সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলো দুর্নীতিমুক্ত নয়, চিকিৎসকদের অধিকাংশই অর্থলিপ্সায় নিমগ্ন, সরকারি হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা দিতে তারা অধিক আগ্রহী। এ সংকট নিরসনের কথা ভাবতেই হবে। উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে গরিব মানুষের কল্যাণে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রসার ঘটেছে সন্দেহ নেই কিন্তু শিক্ষা এখন বাণিজ্য। শিক্ষাকে মানস¤পন্ন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ সফল হচ্ছে না, শুধু দুর্নীতির কারণে অর্থ-স¤পদে ধনী হলেও একটি জাতির সমৃদ্ধশালী হয় না। চাই শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার যাতে উন্নত মানবিক গুণস¤পন্ন মানবস¤পদ সৃষ্টি হয়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমাদের প্রত্যাশার ঝুড়ি কেন পূর্ণ হচ্ছে না, তা ভাবতে হবে। আমাদের শিক্ষার গলদ তথা উগ্র ভোগবাদী মূল্যবোধ থেকে বের হতে হবে। মানবিক মূল্যবোধের পথ রচনা করতে হবে যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মানুষের মতো মানুষ হিসেবে ৩০ লাখ শহিদের রক্তাাত এই মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।সর্বক্ষেত্রে যেন প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যায়বিচার। শুনতে যেন না হয় মৌলবাদের হুঙ্কার, মুক্তি যেন ঘটে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে, বিকাশ ঘটে যেন মুক্তবুদ্ধি চর্চার। যেখানে শত ফুল ফুটবে, শত পাখি গাইবে বিজয়ের গান। স্বাধীনতার সুবাতাসে ভরে উঠবে প্রতিটি নাগরিকের সুখী গৃহকোণ। স্বাধীনতার ৫০তম বছরে ৭১ এর সকল বীর শহীদের আত্মবলিদান এবং পূণ্য স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অভিবাদন জানিয়ে ভবিষ্যতের সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের প্রতীক্ষায় রইলাম। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় -বাঙালি ‘বাঙালি‘ হয়ে উঠেছিল সেই ৭১ এ। আবারো বাঙালি যেন বাঙালি হয়ে ওঠে, ভুলে যায় সকল বিভেদের বেড়াজাল, সেই প্রত্যাশাই করি কায়মনোবাক্যে।