ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের সংক্রমণ
ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দিলে উপেক্ষা না করে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দিলে উপেক্ষা না করে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
আমাদের শরীর থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত পানি প্রস্রাব হিসেবে বেরিয়ে যায়। প্রস্রাব বেরিয়ে যাওয়ার এই ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত অঙ্গগুলো নিয়ে আমাদের মূত্রতন্ত্র গঠিত। মূত্রতন্ত্রের মধ্যে থাকে দুটি কিডনি, দুটি ইউরেটার, একটি মূত্রথলি বা ব্লাডার ও একটি মূত্রনালী।
মূত্রতন্ত্রের কোনো অংশে জীবাণুর সংক্ৰমণ হলে সেটিকে ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের সংক্ৰমণ বলে। ডাক্তারি ভাষায় একে ‘ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন’ বা ‘ইউটিআই’ বলা হয়।
ইউরিন ইনফেকশনের সবচেয়ে কমন লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
প্রস্রাবের সময়ে ব্যথা অথবা জ্বালাপোড়া হওয়া
স্বাভাবিকের চেয়ে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
রাতে বারবার প্রস্রাবের বেগ আসা
অস্বাভাবিক গন্ধযুক্ত অথবা ঘোলাটে প্রস্রাব হওয়া
হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ আসা অথবা বেগ ধরে রাখতে সমস্যা হওয়া
তলপেটে ব্যথা হওয়া
প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া
কোমরের পেছনে পাঁজরের ঠিক নিচের অংশে ব্যথা হওয়া
জ্বর আসা কিংবা গা গরম লাগা এবং শরীরে কাঁপুনি হওয়া
শরীরের তাপমাত্রা ৩৬° সেলসিয়াস বা ৯৬.৮° ফারেনহাইট এর চেয়ে কমে যাওয়া
ক্লান্তি ও বমি বমি লাগা
ওপরের লক্ষণগুলোর পাশাপাশি বয়সভেদে প্রস্রাবের ইনফেকশনের লক্ষণগুলোতে কিছুটা ভিন্নতা দেখা দিতে পারে।
বয়স্ক ও প্রস্রাবের নল (ক্যাথেটার) দেওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পরিবর্তনগুলো হলো—
অস্বাভাবিক আচরণ
মানসিক বিভ্রান্তি অথবা ক্ষোভ
নতুন করে শরীরে কাঁপুনি অথবা ঝাঁকুনি হওয়া
প্রস্রাব করে জামাকাপড় নষ্ট করে ফেলা
আবার বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাধারণ লক্ষণগুলোর পাশাপাশি ভিন্ন ধরনের কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন—
মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করা বন্ধ করে দেওয়া
জ্বর আসা বা শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া
ঘন ঘন প্রস্রাব করা কিংবা হঠাৎ বিছানায় প্ৰস্রাব করতে শুরু করা
বমি হওয়া
সাধারণত পায়খানায় থাকা বিভিন্ন জীবাণু মূত্রতন্ত্রে প্রবেশ করে ইউরিন ইনফেকশন ঘটায়। প্রস্রাবের রাস্তা বা মূত্রনালী দিয়ে এসব জীবাণু মূত্রতন্ত্রে প্রবেশ করে।
নারী-পুরুষভেদে সবারই প্রস্রাবের ইনফেকশন হতে পারে। তবে নারীদের মধ্যে এই রোগের সংক্ৰমণ হওয়ার প্রবণতা বেশি। এর কারণ হলো, নারীদের মূত্রনালী পুরুষদের মূত্রনালীর তুলনায় দৈর্ঘ্যে অনেক ছোটো।
এ ছাড়া নারীদের মূত্রনালী পায়ুপথের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ফলে ব্যাকটেরিয়া পায়ুপথ থেকে মূত্রনালীতে প্রবেশ করে প্রস্রাবের সংক্ৰমণ ঘটানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
যেসব কারণে ইউরিন ইনফেকশনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়—
পর্যাপ্ত পানি পান না করলে
মূত্রতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে এমন রোগ হলে। যেমন: কিডনিতে পাথর হওয়া
যৌনাঙ্গ পরিষ্কার ও শুকনো না রাখলে
যেকোনো কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে। যেমন—
টাইপ ২ ডায়াবেটিস অথবা এইচআইভি আক্রান্ত হলে
কেমোথেরাপি অথবা দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবনকালে
গর্ভবতী হলে
মূত্রথলি পুরোপুরি খালি করতে বাধা সৃষ্টি করে এমন রোগ হলে। যেমন: পুরুষদের ‘প্রস্টেট গ্রন্থি’ বড় হয়ে যাওয়া, শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা স্নায়ুতন্ত্রের কোনো অসুখ
মাসিক চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলে। এই ঘটনাকে ‘মেনোপজ’ বলা হয়। এক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন কমে যাওয়ায় সংক্ৰমণ প্রবণতা বেড়ে যায়
যৌন সহবাস করলে
প্রস্রাবের রাস্তায় নল বা ক্যাথেটার পরানো থাকলে
ইতঃপূর্বে প্রস্রাবের ইনফেকশন হয়ে থাকলে
ইউরিন ইনফেকশন তেমন গুরুতর না হলে রোগী কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠে। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলার পাশাপাশি ঘরোয়াভাবে নিচের উপদেশগুলো মেনে চলতে পারেন—
ব্যথা ও জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল খাওয়া যায়। প্রস্রাবের ইনফেকশনের ব্যথা কমাতে অন্যান্য ঔষধের তুলনায় প্যারাসিটামল অধিক কার্যকর।
শিশুদের প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়ানো যেতে পারে। শিশুকে প্যারাসিটামল খাওয়ানোর নিয়ম জানতে শিশুদের জন্য প্যারাসিটামল আর্টিকেলটি পড়ুন।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং প্রচুর পানি পান করতে হবে। এমন পরিমাণে পানি পান করা উচিত যেন নিয়মিত স্বচ্ছ ও হালকা হলুদ রঙের প্রস্রাব হয়। নিয়মিত প্রস্রাব করলে সেটি শরীর থেকে ব্যাকটেরিয়া বের করে দিতে সাহায্য করে।
পেটে, পিঠে ও দুই উরুর মাঝে গরম সেঁক নেওয়া যায়। এটি অস্বস্তি উপশমে সাহায্য করতে পারে।
সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যৌন সহবাস থেকে বিরত থাকা ভালো। ইউরিন ইনফেকশন ছোঁয়াচে না হলেও ইনফেকশন থাকা অবস্থায় যৌন সহবাস অস্বস্তিকর হতে পারে।
কিডনি রোগ, হৃদরোগ অথবা প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারার মতো বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দৈনিক কতটুকু পানি পান করা নিরাপদ সেটি ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
চিকিৎসা নেওয়ার পরে আবারও ইউরিন ইনফেকশন হলে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।
মেনোপজের কারণে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হলে মাসিকের রাস্তায় ইস্ট্রোজেন ক্রিম ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।
ইউরিনের ইনফেকশনের চিকিৎসা না করা হলে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ইনফেকশন কিডনিতে পৌঁছে গেলে কিডনির স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।
এ ছাড়া ইনফেকশন রক্তে ছড়িয়ে পড়লে ‘সেপসিস’ নামক মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এমনকি রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে।
পুরুষদের ক্ষেত্রে বারবার সংক্ৰমণ হলে মূত্রনালি সরু হয়ে যেতে পারে। এতে মূত্রতন্ত্রের জটিলতার পাশাপাশি যৌন ও প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে।
গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে কিডনির ইনফেকশনসহ নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন: জন্মের সময়ে শিশুর ওজন কম হওয়া ও নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই বাচ্চা প্রসব (প্রিম্যাচুর বেবি) হয়ে যাওয়া।
প্রস্রাবের ইনফেকশন সবসময় প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও কিছু নিয়ম মেনে চললে ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে আনা যায়।
টয়লেটে টিস্যু ব্যবহারের সময়ে সামনে থেকে পেছনে পরিষ্কার করুন।
যৌনাঙ্গ শুকনো ও পরিষ্কার রাখুন।
প্রচুর পানি পান করুন। দৈনিক কমপক্ষে ছয় থেকে আট গ্লাস পানি পান করা উচিত।
বাথটাব বা পুকুরে গোসল করার পরিবর্তে শাওয়ার কিংবা বালতির সাহায্যে গোসল করুন।
প্রস্রাব করার সময়ে মূত্রথলি সম্পূর্ণ খালি করার চেষ্টা করুন।
সহবাসের আগে ও পরে যৌনাঙ্গ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
সহবাসের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রস্রাব করুন।
সুতি কাপড়ের ঢিলেঢালা অন্তর্বাস ব্যবহার করুন।
এক থেকে তিন বছর বয়সী বাচ্চার ডায়পার বা কাপড়ের ন্যাপি নিয়মিত পরিবর্তন করুন।
প্রস্রাবের বেগ আসলে তা ধরে রাখবেন না।
প্রস্রাব করার সময়ে তাড়াহুড়ো করবেন না।
যৌনাঙ্গে সুগন্ধি সাবান অথবা ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করবেন না।
সিনথেটিক কাপড় (যেমন: নাইলন) এর তৈরি আঁটসাঁট অন্তর্বাস ব্যবহার করবেন না।
আঁটসাঁট পায়জামা পরবেন না।
চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় খাবেন না। এগুলো জীবাণু বেড়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে।
যেসব কনডম অথবা ডায়াফ্রামে শুক্রাণু ধ্বংস করার পিচ্ছিলকারক থাকে সেগুলো ব্যবহার করবেন না। এর পরিবর্তে ভিন্ন ধরনের কনডম ও লুব্রিকেন্ট কিংবা জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করুন।
লিখেছেন ডা. নুসরাত জাহান
মেডিকেল রিভিউ করেছেন ডা. ইমা ইসলাম