ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ-ই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
-মামুন মাহফুজ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস আমাদের জন্য সবচেয়ে গৌরবোজ্জল ইতিহাস। কারণ সামরিক শক্তির অপ্রতুলতা সত্ত্বেও বেসামরিক জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এতো অল্পসময়ে এমন বিজয় ইতিহাসে বিরল। তোমরা নিশ্চই জানো বাংলাদেশের সমসাময়ীক আরও দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হলো বাহরাইন ও আরব আমিরাত। দুটো দেশই কিন্তু বিনাযুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ করে, এবং দুটো দেশেরই অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত সুদৃঢ়। বাহরাইন স্বাধীন হয় যুক্তরাজ্য থেকে। ১৫ ই আগস্ট ১৯৭১ সাল। যুক্তরাজ্যের আগে সৌদি আরবের অধীনে এবং তারও আগে ইরানের অধীনে ছিল বাহরাইন। বাহরাইন আরবি শব্দ। এর অর্থ দুটি সমুদ্র। এর চারপাশে কিন্তু সাগর বেষ্টিত। অর্থাৎ এটি একটি দ্বীপরাষ্ট্র। প্রায় একই সময়ে স্বাধীন হওয়া আরেকটি রাষ্ট্র হলো আরব আমিরাত।সংযুক্ত আরব আমিরাত স্বাধীন হয় ২ ডিসেম্বর ১৯৭১। আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ, আজমান, উম্মুল কুয়াইন, ফুজিরা ও রাস-আল-খাইমা, মোট ৭টি ইমারত নিয়ে গঠিত সংযুক্ত আরব আমিরাত।তেলরপ্তানীকারক দেশ হিসেবে এর অর্থনীতি অত্যন্ত শক্তিশালী। এই আরব আমিরাতকেও কোনও যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়নি। ১৯৬৮ সালে ব্রিটিশরা সিদ্ধান্ত নেয় চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর উপর থেকে তাদের আধিপত্য সরিয়ে নেবে। আর তারই আলোকে ১৯৭১ এ সাতটি যুক্ত রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন রাষ্ট্র আরব আমিরাত। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসটা অন্যরকম।বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এর রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। অন্তত ২শ বছরের ইতিহাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তোমরা নিশ্চই জেনে থাকবে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজ উদদৌলার কথা। ১৭৫৭ সালে পলাশির আম্রকাননে স্বাধীন নবাব সিরাজ উদদৌলাকে পরাজিত করে ব্রিটিশ বেনিয়ারা দখল করে নেয় বাংলা। অস্তমিত হয় বাংলার শেষ স্বাধীনতার সূর্য! আসলে এই যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে নয় বরং নিজ দেশের বিশ্বাসঘাতকদের হাতেই নবাব সিরাজ উদদৌলা পরাজিত হন। এটি ছিল বিশ্বাসঘাতকতার যুদ্ধ। এই পরাজয় ছিল বিশ্বাসঘাতকদের কাছে পরাজয়। এই পরাজয়ের মাধ্যমে যেমন স্বাধীনতার শেষ সূর্য অস্তমিত হলো, তেমনি গোলামির জিঞ্জির পরতে হলো স্বাধীন জনগণের। ইংরেজরা জানতো এ জাতি ঐক্যবদ্ধ হবার সুযোগ পেলে আবার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করবে, তারা যাতে আর ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে, তাই তারা ভারতবর্ষের জনগণকে বিভক্ত করে একের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দিয়ে পরষ্পরবিরোধী দু’টি গোষ্ঠী তৈরি করলো। ৬শ বছর যারা একে অপরের সাথে মিলে মিশে কাটালো ইংরেজ কূটকৌশলের কারণে, ইংরেজদের ডিভাইড এন্ড রুল থিওরি প্রয়োগের কারণে তারা একে অপরকে শত্রু ভাবতে শুরু করলো। ভারতবর্ষের হিন্দু জনগোষ্ঠী ইংরেজদের প্রতি মৌন সমর্থন জানিয়ে, ইংরেজি ভাষাশিক্ষা করে অফিস আদালতে চাকরির সুযোগ নিলো, আর মুসলমানরা অভিমান করে ইংরেজি শিক্ষাকে হারাম মনে করে সে সুযোগ থেকে দূরে থাকলো। ফলে ১০০ বছর মুসলমানরা ক্রমাগত গোলামে পরিণত হতে থাকলো। শুধু ইংরেজদের গোলামি নয় বরং স্বজাতি স্বদেশি হিন্দুদের কাজের লোকে পরিণত হলো।এরপর প্রায় ১শ’ বছর পর মুসলমানরা ইংরেজদের চক্রান্ত এবং নিজেদের জাত্যাভিমানের কারণে সবরকমের সুযোগ সুবিধা হারিয়ে, শোষণ বঞ্চনা সহ্য করে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কারের প্রেরণা পেলেন। সৈয়দ আহমদ বেরেলভির নেতৃত্বে মুসলমানরা আবার রাজনীতিতে, শিক্ষায়, অর্থনীতিতে নিজেদের মেলে ধরার প্রেরণা পেলেন। সেই প্রেরণায় ১৮৩১ সালে বেরেলভির নেতৃত্বে মুসলমানরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু তাতেও পরাস্ত হলেন। এরপর ১৮৫৭ সালে ইংরেজ বাহিনীতে থাকা মুসলিম সিপাহীরা বিদ্রোহ করলে তাদের দমন করে, হত্যা করে, নির্যাতন করে মাত্র ১০ বছরে স্বাধীনতাকামীদের পুনরায় গোলমি করতে বাধ্য করা হলো। ৫০ বছরের মধ্যে মুসলমানরা দাসে পরিণত হলো।এরপর ১৯৩৫ সালে মুসলমানরা পৃথক নির্বাচনের থিওরি উত্থাপন করে নিজেদের জন্য আলাদা নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হলেন। সেসময় ইংরেজ শাসকরা ‘ভারত শাসন আইন’ করে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের ঘোষণা দেয়। এতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কিছুটা শাসনক্ষমতা ফিরে পায়। আর এই আইনের অধীনে ১৯৩৬ সালে পৃথক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে গোটা ভারতবর্ষে হিন্দু কংগ্রেস ৭টি প্রদেশে এবং মুসলমানরা ৪টি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে স্বায়ত্তশাসন অর্জন করে। আমাদের মনে রাখতে হবে ১৭৫৭ সালে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর এটাই প্রথম স্বাধীনতা পুনরুদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ১৯৩৬ সালের পৃথক নির্বাচন স্বাধীনতার প্রথম পদক্ষেপ। তারপর ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারত থেকে পৃথক রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে এই প্রস্তাব উত্থাপিত হলে সেখানে দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রপুঞ্জ গঠনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হয়। ১৯৪৫ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভা ও ১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক আইন সভা সমূহের নির্বাচনে মুসলিমরা নিরংকুশ বিজয় অর্জন করে। ফলে ইংরেজ শাসকও দাবি মেনে নিয়ে ১৯৪৭ এ প্রথমে পাকিস্তান নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং পরে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য স্বাধীন ভারতকে স্বীকৃতি দেয়। যে কারণে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ই আগস্ট এবং ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ই আগস্ট। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল অংশ এটি। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হলেও যে স্বপ্ন নিয়ে এই স্বাধীনতার জন্য ১০লাখ মানুষ জীবন দিল সেই স্বাধীনতার সাধ অপূর্ণই থেকে গেলো। শাসকেরা যে ধর্মের ভিত্তিতে দু’টি পৃথক রাষ্ট্র হলো সে ধর্মের ব্যাপারে আগ্রহী না হয়ে নিজেদের ভোগবিলাস ও শাসনকার্যকে বেশি গুরুত্ব দিল। ফলে জনগণ আশাহত হলো। অল্পদিনেই দ্বিজাতিতত্ত্বের নায়কেরা বা পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা জনপ্রিয়তা হারালেন। এই সুযোগে ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখল করে নিলেন সামরিক-জান্তা জেনারেল আইয়ুব খান। আইয়ুব খানের ১০ বছরের শাসনে পুরো পাকিস্তানের জনগণ অতীষ্ঠ হয়ে উঠলো। সিন্ধু, পাঞ্জাব এবং পূর্বপাকিস্তানে অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করলো। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৯৬৯ সালে পদত্যাগ করে আইয়ুব খান। শুরু হয় ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন। কিন্তু গণ আন্দোলন তখন বিস্ফোরণ্মূখ। তাই ইয়াহিয়া খান অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। আর এটাই সেই ঐতিহাসিক সত্তুরের নির্বাচন। যে নির্বাচনে বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান নিরংকুশভাবে বিজয়ী হন। সিন্ধু ও পাঞ্জাবে ভুট্রো জয়ী হন। কিন্তু সামরিক শাসক বিজয়ী প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নানান টালবাহানা করতে থাকেন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের তীব্রতায় ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের সাথে আলোচনায় বসেন । ১৯৭১ এর ২৩ মার্চ পর্যন্ত আলোচনা চলতে থাকে। কিন্তু আলোচনার টেবিলে কোনও সমাধান না হওয়ায় ২৫শে মার্চ রাতে টিক্কা খানের নেতৃত্বে ঢাকায় ক্রাকডাউন চালানো হয়। এসময় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ঢাকা পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায়। ঢাকা পরিণত হয় মৃত নগরীতে। ৭০ এর নির্বাচনে নিরংকুশভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। কার্যত বাংলাদেশ তখন নেতৃত্বশূন্য। ঠিক সে সময় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা আসে। ১১টি সেক্টরে বিভক্ত হয়ে সারাদেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের নয়মাস ছিল বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময়। এসময় যুবকেরা নিজের বাড়িঘরে থাকার সুযোগ পাচ্ছিল না। হাজার হাজার মানুষ ভিটে বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমায় পাশের দেশে। কলকাতায় গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। সেখান থেকেই পরিচালিত হতে থাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ৯মাস প্রাণপণ মুক্তি সংগ্রামের পর ১৬ ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। বিজয়ের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। কিন্তু এই ইতিহাস কোনওভাবেই স্বস্তির ইতিহাস নয়। স্বাধীন ভূখণ্ডে আজ আমরা কারও গোলামি করছি না ঠিকই, কিন্তু যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লক্ষ লক্ষ মানুষকে হারিয়েছি, আমাদের প্রিয়জনেরা হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছেন সেই স্বপ্ন কি আজও বাস্তবায়িত হয়েছে?এই সুদীর্ঘ ইতিহাস থেকে যে শিক্ষা আমরা পেলাম, তা হলো শোষণবঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইর শিক্ষা। অধিকার আদায়ের শিক্ষা। গোলামির জিঞ্জির ভেঙে ফেলার শিক্ষা। কিন্তু তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে ১৭৫৭ সালে কেন আমাদের স্বাধীনতা পরাধীনতার শেকলে বন্দী হলো? মাত্র কয়েকজন ইংরেজ সেনা কীভাবে গোটা বাংলা, তারপর গোটা ভারতবর্ষ দখল করে ফেললো? তৎকালিন ইংরেজ শাসকদের বিভিন্ন বক্তব্যে ও লেখায় বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে, আর তা হলো বিশ্বাসঘাতকতা। ইংরেজরা যখন স্বাধীন নবাবের দিকে এগিয়ে আসছিল সিরাজউদদৌলার অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তাই তখন হাতগুটিয়ে বসেছিল। ইতিহাসে আমরা একটি নাম জানি মীর জাফর আলী খান। তিনি ছিলেন নবাব সিরাজ উদদৌলার প্রধান সেনাপতি। তিনি ইংরেজদের সাথে চক্রান্ত করে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকেন। এর প্রধান কারণ কী ছিল? মীর জাফর ছিলেন ক্ষমতালোভী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কেন তিনি ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা করতেন? কারণ তিনি বীরত্বের সাথে একের পর এক যুদ্ধ ও অভিযানে বিজয়ী হয়ে নবাব আলীবর্দী খানের নিকট স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন। বিজয় তাকে অহঙ্কারী করে তোলে, আর আলীবর্দী খানের স্নেহ তাকে ক্ষমতালোভী করে তোলে। আর আজও আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখি। কাছের মানুষের বিশ্বাসঘতকতা, সফল মানুষদের অহঙ্কার ও পদস্খলন এবং পরবর্তীতে লোভের কারণে সাজানো বাগান ধংস করা। পরবর্তীতে আমরা কী দেখলাম?ইংরেজরা যখন একে একে গোটা ভারতবর্ষ দখল করে নিল তখন মুসলমানদের অবস্থা খুবই শোচনীয় হলেও হিন্দুদের অবস্থা কিন্তু মুসলমানদের মতো অতো নাজুক হয়নি। কারণ মুসলমানরা ইংরেজ শাসনের সাথে নিজেদের খাপখাইয়ে নিতে না পারলেও হিন্দুরা তা করতে পেরেছে স্বচ্ছন্দে। মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষা তথা শিক্ষা-দীক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকলো, তাই পিছিয়ে পড়লো সরকারি উচ্চপদস্ত চাকরি বাকরি থেকেও। এই অভিমান বা জাত্যাভিমান ছিল ভুল। বরং যেভাবেই হোক যখন কেউ শাসনব্যবস্থায় গেঁড়ে বসেছে তখন যতক্ষণ না লড়াইর মতো শক্তি অর্জিত হয় ততক্ষণ কৌশলে ধৈর্য ধারণ করাই ছিল অপেক্ষাকৃত উত্তম। হিন্দুরা ইংরেজ শাসন মেনে নিলেও যখন তারা ইংরেজদের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন হওয়ার সুযোগ পেলো তখন কিন্তু তারা স্বাধীনতার জন্য সরব হয়ে উঠলো। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলো। তাদের সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলালো মুসলমানরাও। অর্থাৎ ইংরেজ শাসকদের সাথে মিলে মিশে কাজ করলেও হিন্দুরা হৃত গৌরবের কথা ভুলে যায়নি। নিজেদের অধিকারের কথা ভুলে যায়নি। অন্যদিকে পিছিয়েপড়া মুসলিম জনগোষ্ঠী ইংরেজ শাসনামলে দাসশ্রেণিতে নেমে আসায় হিন্দুরাও কিন্তু অবহেলা করতে শুরু করে। একদিকে ইংরেজ বিদ্বেষ, অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ। সবকিছু মিলিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের অবস্থা হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। স্বজাতির অবহেলা অপমান তাচ্ছিল্য মুসলমানদের আরও বেশি ক্ষুব্ধ আরও বেশি অভিমানী করে তোলে। তারই ফলশ্রুতি ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব, তারই ফলশ্রুতি হলো ভারত-পাকিস্তান আলাদা দু’টি রাষ্ট্র। কিন্তু তাতেও কি থেমে গেছে বিভাজন? থেমে গেছে শোষণ, অবহেলা বঞ্চনা নির্যাতন? না থামেনি। এবার বিশ্বাসঘতকতা করলো স্বধর্মী স্বজাতিরা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও আমরা আমাদের প্রত্যাশিত স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে পারিনি। শোষণ বঞ্চনার ধারাবাহিকতা অবিরতই থাকলো। আর তারই পরিণতি হলো ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পর শুরু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে দেখা দিল চরম দুর্ভিক্ষ। সেই দুর্ভিক্ষে কতো হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারালো! কতো মানুষ খেতে না পেয়ে রাস্তার ধারে মরে থাকলো!... সেই দিনের কথা ভাবলে আজকের দিনটাকে বড় উজ্জল মনে হয়। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছে। উন্নয়নের মহাসড়কে পা ফেলতে শুরু করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পরও আমরা সেই স্বপ্নকেই খুঁজে ফিরি। কীসের বাধায় আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে পারিনি? কেন এখনও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে পারিনি? কেন রাস্তার পাশে এখনও ভিটেমাটিহীন মানুষেরা, ছিন্নমূল শিশুরা পড়ে থাকে? সামগ্রিম উন্নয়নের পথে কী সেই বাধা? একমাত্র বাধা বিভাজন। বিভাজন যতদিন থাকবে ততদিন স্বাধীনতার সুফল সবাই পাবে না। বর্তমানের বিভাজনটি হলো স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এই বিভাজন আর মেনে নেয়া যায় না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী তখনই সাফল্যমণ্ডিত হবে যখন এই বিভাজন-রেখা মুছে গিয়ে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে একসারিতে দাঁড়াতে পারবো। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী তখনই সফল হবে যখন প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণাটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে। “২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন “বাংলাদেশ ২০২১ সালে স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছে। এই মহান উৎসব উদযাপনের লক্ষ্যে, আমরা বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত এবং একটি মর্যাদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, যাতে কেউ আমাদেরকে দরিদ্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করে অবহেলা করতে না পারে।”“আমরা যুদ্ধ জয়ী জাতি, আমরা ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতেই দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই। আমি মনে করি, সে শক্তি আমাদের রয়েছে।” তিনি বলেন, “আমাদের দেশের জনগণ ও বিজ্ঞানীরা অনেক বেশি মেধা সম্পন্ন।”এসময় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে বেশকিছু পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেন, তিনি দেশের যুব সমাজকে চাকরীর পেছনে না ছুটে সরকারী সহযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে আত্মকর্মসংস্থানমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলে দেশের উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার আহবান জানান।প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে, দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি না থাকে। যেখানে জমি পাবে তাতে আবাদ করতে হবে। এ কাজে দেশের যুব সমাজতে এগিয়ে আসতে হবে।”তিনি বলেন, “তাদের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে তারা যেন উদ্যাক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে। কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে বিনা জামানতে ঋণ নিয়ে বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিলে তারা কর্মসংস্থান ব্যবস্থা গড়ে তুলে নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।” এই ঘোষণার আলোকে দলমত নির্বিশেষে সকলকে সমান সুযোগ সুবিধা দিয়ে এগিয়ে নিতে পারলে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণ অবশ্যম্ভাবী। স্বাধীনতার এই পঞ্চাশ বছরে বিশ্বের কাছে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি অনেকটা। কিন্তু ভৌগোলিক মুক্তির মতো করে অর্থনৈতিক মুক্তি সেভাবে অর্জিত হয়নি। এখনও বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত। বিদেশী অনুদান বা ঋণ ছাড়া সম্পন্ন হয় না আমাদের বাজেট পরিকল্পনা। এখনও আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায়। স্বাধীনতার সুফল পেতে হলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি জরুরি। আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক উন্নয়ন। প্রতিটি সেক্টরে উন্নয়নের গতি সঞ্চরণ। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গঠন। এর জন্য দরকার বেকারত্বের অভিশাপ থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করা। ঘরে ঘরে জনে জনে চাকরির ব্যবস্থা করা। প্রবাসে যারা আছেন তারা যেন যে কোনও সময়ে ফিরে আসতে পারেন তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। দুর্নীতি প্রতিরোধ করা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। সুশাসন ও দারিদ্র-বিমোচনের ব্যবস্থা করা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ছোট বড় সকলের কাছে নিবেদন থাকবে আসুন আমরা সম্মিলিতিভাবে এগিয়ে যাই স্বাধীনতার স্বপ্নচূড়ায়। সকল ভেদাভেদ ভুলে, বিভাজন ভুলে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আমরা হারিয়েছি তাদের রক্তের ঋণ শোধ করতে এই দেশটাকে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলি।