মোশাররফ হোসেন খান (১৯৫৭)। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্রে জীবন্ত কিংবদন্তী। তার একেকটি গল্পে একেকটি চরিত্র বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়। যা দেখে যে কারও গায়ের রোম কাঁটা দিয়ে উঠতে পারে। এতোটা জীবন্ত চরিত্র খুব কম কথাসাহিত্যিকের লেখনীতে দেখা যায়। চরিত্র সৃষ্টিতে তার এই দক্ষতা তার জীবনবোধ, দৈনিন্দিন জীবনযাপনের প্রতি গভীর নিরীক্ষণের ফলেই তৈরি হয়েছে। বলাইবাহুল্য জীবনের ঘাতপ্রতিঘাতগুলো তিনি যেভাবে মোকাবেলা করেছেন তারই নিদাঘ দাগ কেটে কেটে তৈরি হয়েছে একেকটি চরিত্র।‘সাগর ভাঙার দিন’ গল্পের পরিব্যাপ্তি উপন্যাসের সমান। যদিও জীবনের পূর্ণ বিকাশ বা পরিপূর্ণতা নেই তবুও ব্যাপ্তির দিক থেকে এটি উপন্যাসের কাছাকাছি। বরং এটি কিশোর উপন্যাস। আর যেহেতু কিশোর উপন্যাস সেহেতু কৈশোরের মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকেছে এর গল্প। এটি ৫টি পর্বে বিভাজিত। পর্বগুলোর আলাদা শিরোনামও রয়েছে। যাকে উপ শিরোনাম বা সাবটাইটেল বলা যায়। ১. বৃষ্টিভেজা পাখির কান্না, ২. ওই যে নদী আমার নদী, ৩.মাঠের পরে মাঠ চলেছে, ৪. আঁধার ফুঁড়ে আলোর গোলক, ৫. এই রাত শেষ হবে। এই মোট ৫টি শিরোনামে মালা গেথে তৈরি হয়েছে ‘সাগর ভাঙার দিন’। মজার ব্যপার হলো গল্পের নাম ‘সাগর ভাঙার দিন’ হলেও এই নামে কোনও গল্প নেই, গল্পের প্রত্যক্ষ কোনও অভিব্যক্তি বা এক্সপ্রেশনও নেই। তাহলে বইটির নাম কেন সাগর ভাঙার দিন হলো? আসলে নামটি রূপক। এই সাগর বঙ্গোপসাগর নয়, আটলান্টিক মহাসাগর বা ভারত মহাসাগর কিংবা ভূমধ্যসাগরও নয়, এই সাগর কষ্টের সাগর। এই সাগর আনোয়ারের ছোট্ট জীবনে নিঃসীম কষ্টের মহাসাগর।উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বারবার চোখ অশ্রসজল হয়ে ওঠে। আনোয়ার-সানোয়ার দুই ভায়ের কষ্টের সাথে একাকার হয়ে যে কারও হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে পারে অগত্যাই। উপন্যাসেরএকটি দৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত করে বারবার। দৃশ্যটা হলো ছোট্ট একটা শিশু খালি পায়ে পাড়ি দেয় মাইলের পর মাইল মেঠো পথ!...কে এই শিশুটি? সে উপন্যাসের নায়ক। কিন্তু সেই শিশুটির মাঝে যদি নিজের সমবয়সী সন্তানের ছবি ভেসে ওঠে? কিংবা নিজের হারানো ছোটবেলার দৃশ্যটি মনে পড়ে? তাহলে সমানুভূতির প্রতিগাতে নিমিষেই চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠবে এতে কোনও সন্দেহ নেই। শিশুটির বাবা রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার। নৈতিক কারণে তিনি ঘুষ দিতে পারেন না তাই তার পেনশনের টাকাটাও তার পাওয়া হয় না। অথচ পেনশনের স্বপ্ন দেখে দেখে কাটে আনোয়ারের কষ্টের দিনগুলো।...শুরুতে উপশিরোনামে যে গল্পটি রয়েছে; ‘বৃষ্টিভেজা পাখির কান্না’। কষ্টের শুরু এখান থেকেই। একটি পাখির গল্প। যে প্রকৃতির কাছে হেরে গেছে। বৃষ্টিতে আশ্রয়হীন পাখিটির জন্য আনোয়ারের দুঃখবোধ, পাখিটির সাথে আনোয়ারের বন্ধুত্ব, পাখিটির হৃদয়সংবেদন উপলব্ধি এতোটাই নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন লেখক, যে গল্পের বা সাবপ্লটের শেষে যখন পাখিটি মারা যায় তখন পাঠক হিসেবে নিজেকেও কষ্টের সমুদ্রে আবিষ্কার করতে হয়। বুকের ভেতর চাপা কষ্টটা দীর্ঘশ্বাসে বেরিয়ে এসে বলে ‘পাখিটা কেন মরলো?’সেই কষ্টে আনোয়ার আর্তনাদ করে উঠলো। আর আনোয়ারের মা ভাবেন ওটা শালিখ নয় তার হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট শিশু আইয়ুব হোসেন।আগেই বলেছি গল্পটি কষ্টের সাগর পাড়ি দেয়ার গল্প। কষ্ট! আর কষ্ট! কিন্তু সামান্যতম আরোপিত কষ্ট মনে হয় না। এই কষ্ট জীবনের সত্যিকারের সচিত্র রূপ। এই কষ্ট গ্রামবাংলার শত-সহস্র-কোটি আনোয়ারের জীবনের কষ্ট।সাগর ভাঙার দিন প্রথম প্রকাশ পায় বই আকারে ২০০২ সালে। কিন্তু গল্পের পটভূমি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে অভাব অনটন, অনিয়ম দুর্নীতি গেঁড়ে বসেছিল তারই সময়কার। লেখকের জন্ম যেহেতু ১৯৫৭ সালে এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে তিনি একজন কিশোর । সেহেতু ধরে নেয়া যায় এটি তার নিজের দেখা কৈশোরের প্রতিচ্ছবি। একজন কবি ও গবেষক মন্তব্য করেছেন “উপন্যাসের শব্দের খেল, কাহিনীর বিন্যাস, দেখার দৃষ্টি আর উপস্থাপনশৈলি দেখে মনে হয়েছে লেখকের ব্যক্তিজীবন অনেকটা জড়িত এর সঙ্গে। ব্যক্তিজীবন না হলে অনুভূতির এমন ভাষান্তর খুব কষ্টকর ব্যাপার।” গল্পপাঠের পর আমারও ঠিক তাইই মনে হয়েছে। আনু আর সানুর মাঝে লেখক মোশাররফ হোসেন খান এবং তার বড় ভাই অধ্যক্ষ আবু সাঈদ সাহেবের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছি বারবার। প্রথম সাবপ্লট বা উপকাহিনীতে তিনটি চরিত্র সমান্তরালে তিনটি বিন্দু দখল করে ত্রিভূজ গল্প তৈরি করেছে। তিনটি চরিত্রের মাঝেই কমন ব্যাপার ছিল কষ্ট। গল্পের নায়ক আনোয়ার ক্ষুধায় কাতর। সে কষ্ট পাচ্ছে খেতে না পেয়ে।“তিনদিন ধরে বৃষ্টি।তিনদিনের ভেতর মাত্র একদিন হাঁড়ি চড়েছিল উনুনে। তাও বহু কষ্টে। প্রায় না খেয়ে কাটাতে হচ্ছে দিনগুলো। খিদেয় এখন পেটটা চোঁ চোঁ করছে।...” এই হচ্ছে আনোয়ারের অবস্থা।দ্বিতীয় চরিত্র আনোয়ারের মা। তিনি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাইরে গেছেন খাবার যোগাড় করতে। কিন্তু ফিরে এলেন শূন্য হাতে। আনোয়ার যখন নারিকেল গাছের শালিখ পাখিটাকে নিয়ে আনমনে ভাবছে, পাখিটার কষ্ট নিজের মতো করে অনুভব করছে, ঠিক তখন তার মায়ের কথায় তার ভাবনায় ছেদ ঘটে।মাকে দেখে আনু খশি হয়। কিন্তু মা বলে“ বাবা! আরেকটু কষ্ট করো। মাত্র সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যায় খাবারের যোগাড় হয়ে যাবে। ...ততক্ষণে আমি কিছু ডালপালা সংগ্রহ করে আনি। তা না হলে আবার রান্না করবো কী দিয়ে!”এ যেন ছোটবেলায় আমাদের পড়া সেই গল্পের প্রতিরূপ। ক্ষুধার্ত সন্তানকে সান্ত্বনা দিতে মা হাঁড়িতে পাথর জাল দিচ্ছেন। আসলে অভাবের দৃশ্যগুলো এমনই চিরায়ত রূপ লাভ করে আছে যে যুগ যুগ আগের গল্পের সাথে আজকের অভাবের গল্পের চেহারা হুবহু মিলে যায়। বাংলাভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদেও একই দারিদ্র্যচিত্র ফুটে উঠেছে। “টালত মোর ঘর, নাহি পড়বেশি, হাড়িত ভাত নাই, নিতি আবেশী।” তখনও হাঁড়িত ভাত ছিল না। আজও বাংলার ঘরে ঘরে কারও কারও ভাতের হাঁড়ি শুন্য।চর্যাপদের সহজিয়া পদকর্তাদের কবিতার পর আধুনিক যুগের কবিরাও এই অভাবকে চোখে দেখেছেন, কবিতা লিখেছেন---“তিনদিন হতে খাইতে না পাই, নাই কিছু মোর ঘরে, দ্বারা পরিবার বাড়িতে আমার উপোস করিয়া মরে..”.কবি শেখ হাবিবুর রহমানের লেখা ‘নবীর শিক্ষা’ কবিতার এই লাইনগুলো দারিদ্রের চিরায়ত রূপ। একই অভাব দেখা মেলে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালিতে। দারিদ্রের সেই চিত্র আরও প্রকট হয়ে ওঠে স্বাধীনতাউত্তর যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে। তারই সামান্য ছিটেফোঁটা উঠে এসেছে ‘সাগর ভাঙার দিন’ গল্পে।‘মায়ের কথা শুনে আনুর চোখের কোনা ছলছল করে উঠল।মা বললেন, কাঁদছিস কেন? খিদের কষ্ট বড় কষ্ট। তবু তো সবুর করতে হবে বাপ!’বিচক্ষণ কিশোর। মাকে উল্টো সান্ত্বনা দিতে নিজের কষ্টটা আড়াল করে সুকৌশলে। এই কিশোর যে কত বিচক্ষণ তা গল্পের অনেক অংশেই স্বীকার করেছেন লেখক। তার ভাবনা কৈশোর ছাপিয়ে গেছে, তার উপলব্ধি নিজের বয়সটাকে টপকে গেছে। সে বলে- শুধু খিদের জন্য কাঁদছিনে মা!-তবে?-তবে? দেখো, আমাদের উঠোনের নারিকেল গাছে একটা শালিখ বসে আছে। ওর ডানা দুটো ভাঙা। ভাবছি, ওর আর আমাদের মধ্যে কি কোনও পার্থক্য নেই?’লালনের গানে খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়... যেমন পাখি আত্মার রূপক হয়ে উঠেছে তেমনি এই গল্পে পাখির ডানা ভাঙা অসহায়ত্ব মানুষের অসহায়ত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে।আর এই অসহায়ত্বের একটি কারণ প্রকৃতি। একটানা বৃষ্টি। বৃষ্টি আনন্দের হলেও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য যে কতোটা কষ্টও বয়ে আনে তা বলাইবাহুল্য। বাংলা সাহিত্যে বৃষ্টির আধিপত্য নতুন নয়। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে মধ্যযুগে এবং মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগের সাহিত্যেও বৃষ্টি অন্যতম উপাদান। তবে বেশিরভাগ কবি সাহিত্যিকের কলমে-কল্পনায় বৃষ্টি বিরহের প্রতীক, কষ্টের সারথী। কারও কারও কাছে বৃষ্টি প্রেমের প্রতীক হলেও সর্বনাশা হিসেবেও এর উল্লেখ কম নয়। বর্ষা নিয়ে মহাকবি কালিদাস রচনা করেছেন বিখ্যাত মহাকাব্য ‘মেঘদূত’। মেঘকে সেখানে যক্ষের বন্ধু বলা হয়েছে। যক্ষ তার প্রিয়ার কাছে মেঘকে দূত করে খবর পাঠাতেন। কী করে একখণ্ড মেঘ কবির কল্পনায় হয়ে উঠছে বিরহীর বার্তাবাহক প্রাণবন্ত-জীবন্ত দূত!মেঘদূত ছাড়াও বৈষ্ণব পদাবলীতেও বিরহের সঙ্গে বর্ষার একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেছেন পদকর্তারা। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায় বর্ষা এসেছে বারবার। তাদের বিরহের কবিতায় ও গানে বর্ষা ও বিরহ একাকার হয়ে গেছে। যা নতুনরূপ নিয়েছে মধ্যযুগের বাংলা কবিতা ও গানে। ‘এ ভরা বাদর মাহভাদর শুন্য মন্দির মোর।’ পঞ্চদশ শতকের মৈথিলি কবি বিদ্যাপতির ব্রজবুলি ভাষায় বৃষ্টির মাঝে একাকীত্ব, প্রিয়জনের বিরহ যে কষ্টের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় সেই একইভাবে বৃষ্টিতে একাকী ঘরে বসে মায়ের জন্য বাবার জন্য শালিখের জন্য কষ্ট পায়, বিরহে কাতর হয় ‘সাগর ভাঙার দিন’ উপন্যাসের আনোয়ার। বাংলা সাহিত্যের আরেক কালজয়ী সম্পদ কালকেতু উপাখ্যান। কালকেতু উপাখ্যানে বর্ষা এসেছে উপার্জনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। স্বভাবতই গ্রামাঞ্চলে বর্ষা এলে কাজ-কর্ম কমে যায়। চারিদিকে অথৈ পানি থাকায় উপার্জনের তেমন কোনো পথ থাকে না। এই গল্পে আমরা কালকেতু উপাখ্যানের সেই দারিদ্রের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করি।কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ বর্ণনা করতে গিয়ে বর্ষাকাল সম্পর্কে বলেছেন:‘আষাঢ়ে পুরিল মহী নবমেঘে জল।বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বর॥মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে।কিছু খুদকুঁড়া মিলে উদর না পুরে ॥শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী।সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি ॥’কিছু খুদকুঁড়া মিলে উদর না পুরে ॥ এই লাইনটির সাথে ‘সাগর ভাঙার দিন’ এর বিবরণ ‘পেটে হাত দিয়ে আনু দেখল তার নাড়িগুলো যেন পিঠের সাথে লেগে যেতে চাইছে।’ লাইনটির কোনও অমিল নেই। বাংলা সাহিত্যে কবি মোশাররফ হোসেন খান অনেকটা ‘অন্ধকারের কালোঘোড়া’ হলেও কিন্তু তিনি যে বাংলার মানুষের প্রকৃত অবস্থা প্রকৃত চিত্র, প্রকৃত মনের কথাই তার কবিতা ও গল্পে নিরাবরণভাবে ঠাঁই করে দিয়েছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর একইভাবে তিনিও নীরবে ঠাঁই করে নিয়েছেন গ্রামবাংলার মানুষের হৃদয়ে। হয়তো গ্রামবাংলার এই কবি এই কিশোর ঔপন্যাসিক শহুরে মানুষের ভিড়ে প্রভাবে সেভাবে জায়গা করে বা আধিপত্য বিস্তার করতে পারেননি এখনও। কিন্তু একবার যে তার কথাসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হবে তাঁকে খুঁজে ফিরতে হবে আবহমান বাংলার সঙ্গে তার অপূর্ব মেলবন্ধন। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের সাথে তার কী অপরূপ শেকড়-সম্পর্ক!এই গল্পের প্রথম সাবপ্লটে বা উপকাহিনীতে আরেকটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় আর তা হলো সমকাল। রচনাকালের ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেয়া। আগেই উল্লেখ করেছি, গল্পটি মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সময়কাল ও সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে। এই গল্পে তাই অত্যন্ত প্রচ্ছন্নভাবে সূক্ষ্ম প্রতীকাশ্রয়ী শব্দের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের নিষ্ঠুর চিত্রটি ফুটে ওঠে। শিশুতোষ কিংবা কিশোরগল্পে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার দৃশ্যগুলো নগ্নভাবে তুলে ধরা হলে শিশু মনে মারাত্মকভাবে আঘাত করতে পারে। কিন্তু কোনও কবি বা কথাসাহিত্যিক তার সময়কালকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। ঐতিহাসিক সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতির প্রবক্তাফরাসী দার্শনিক তেইন বলেন, ‘সাহিত্য শুধুমাত্র একজন বা কতগুলো ব্যক্তির জীবনচিত্র নয়, এর সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছে সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি বিষয়াদি’। ‘সাগর ভাঙার দিন’ উপন্যাসের লেখকও এড়াননি সমকালীন প্রেক্ষাপটকে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার জীবন্ত চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি প্রতীকাশ্রয়ের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের নিষ্ঠুরতম ইতিহাসকেও একঝলক স্মরিয়ে দিয়েছেন পাঠককে। প্রথম উপকাহিনীর তৃতীয় প্রধান চরিত্র শালিখ। গল্পের প্রধান চরিত্র আনোয়ার নামের কিশোরটি শালিখ পাখির মাঝে নিজের এবং মানুষের জীবনের আয়না প্রতিস্থাপিত করেছে। পাখিটির সঙ্গে সে আনমনে কথা বলে।পাখির সঙ্গে শিশুদের এই কথাবলার ঢঙ রূপকথা নয় বরং শিশু সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যেমনটি আমরা ছোটবেলায় পড়েছি রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি। এখানে বাবুই আর চড়ুই পাখি একে অপরের সাথে কথা বলছে।‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই/ কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই/ আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে/তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে...’ একইভাবে শিশুমন পাখির কথা বা মনের অভিব্যক্তি বুঝতে পারে ‘সাগর ভাঙার দিনে’। এই গল্পেবৃষ্টিতে ভেজা আশ্রয়হীন পাখিটার সঙ্গে নিজের দুঃখ কষ্ট ভাগাভাগি করে আনোয়ার নামের ছোট্ট শিশুটি। পাখির বেদনা অসহায়ত্বকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে নিজের কষ্টের সাথে empathy বা সমানুভূতির মাধ্যমে। আনোয়ার পাখিটার কাছে জানতে চায় তার প্রিয়জনেরা কোথায়? বাবা মা কোথায়?- বলো কী? তোমার মা বাবাকে মেরেছে!-তোমার বোনকেও!-কিন্তু কীভাবে?-প্রতারণা করে?- সে আবার কেমন?-ও তাই বলো। ফাঁদ পেতে। ইস! কী আফসোসের কথা। সত্যিই দুঃখিত আমি। এটা মোটেও উচিৎ হয়নি। আমার মা এখনো তো সেই হারিয়ে যাওয়া ছোট্টভাই আইয়ুবের জন্য কান্নাকাটি করেন। করবেন না! হাজার হোক মায়ের মন! এসব কষ্টের কথা কি কখনও ভোলা যায়?- তোমার কষ্ট তার চেয়েও বেশি?সে তো ঠিকই। তোমার চোখের সামনেই তোমার বাবা মা, বোনকে ধরে নিয়ে গেছে! তুমি কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছো। কিন্তু করার কিছুই নেই। এত বড় অসহায় তোমরা!”এখানে লেখক একটা ইংগীত দিয়ে গেছেন।মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করা লেখক যুদ্ধের সময় যে একটি শিশুর মনে কী ধরনের ‘ইমেজ’ তৈরি হতে পারে এতে তারই ইঙ্গীত দিয়েছেন। যুদ্ধের সময় কতো নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। একজন শিশুর মনে যখন সেই দৃশ্যটি গেথে থাকে তখনতো সে পাখিটার কষ্টের কারণও ভাববে নিষ্ঠুরভাবে বাবা মা ভাই বোন তথা সপরিবারে হত্যার কথা! এমনকি সে যদি জানে অমুকের বাবা মা নেই, সে তৎক্ষণাৎ ধরে নেবে তার বাবা মাও মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। ‘সপরিবারে হত্যা’র এই দৃশ্য মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কোন কারণে হতে পারে? ২.‘সাগর ভাঙার দিন’ গল্পের প্রধান বিষয় দারিদ্রপীড়িত পরিবারের দুঃখকষ্ট। আর এই দুঃখের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে আবহমান বাংলার প্রকৃতিকে। তবে পুরো গল্পে বৃষ্টি বা প্রকৃতির সাথে সাথে আর্থসামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রটিও প্রাধান্য পেয়েছে। আনোয়ারদের দারিদ্রের অন্যতম কারণ তার বাবার রিটায়ারমেন্ট। কিন্তু যদি সামাজিক ব্যাধি দুর্নীতির কারণে, ঘুষের কারণে রিটায়ার্ড বাবার পেনশন আটকে না থাকতো তাহলে এত সব কষ্ট সইতে হতো না আনোয়ারদের পরিবারকে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ নৈতিকবোধের কারণে ঘুষ দেয়া থেকে বিরত থাকতো। অন্যদিকে মোটা অংকের ঘুষের দাবিতে বছরের পর বছর পেনশন আটকে রাখা হতো। এমন অনেকের জীবনে ঘটেছে যারা জীবদ্দশায় পেনশনের টাকা উত্তোলন করে যেতে পারেননি। ঘুষ নামক অপদেবতার কারণে কতো শত পরিবার যে এভাবে ধুকে ধুকে দারিদ্রের সাথে লড়াই করে একসময় ধমকে দাঁড়িয়েছে তার হিসেব নেই। লেখক কেবল একটি পরিবারের জীবনে ট্রাজিক হিস্ট্রি তুলে ধরে তৎকালিন ঘুষপ্রথার নির্মমতাকে তুলে ধরেছেন।দ্বিতীয় সাবপ্লটে উপশিরোনাম হচ্ছে ‘ওই যে নদী, আমার নদী’ এই উপকাহিনীতে বাবা ফিরে এসেছে। এছাড়া মা তো আছেনই। আরও আছেন নতুন একটি চরিত্র। বড় ভাই সানোয়ার। প্রথম সাবপ্লটে যার কোনও অস্তিত্বই ছিল না। কোনও ইঙ্গীতও ছিল না। তবে দ্বিতীয় সাবপ্লট থেকে শেষপর্যন্ত আনোয়ারের বড় ভাই সানোয়ার অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবেই রোল করেছে। বরং শুরুর শালিখ-মা-বাবা চরিত্রগুলোকে ছাপিয়ে ভাই সানোয়ার চরিত্রটি অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হয়েছে।এই প্লটে বারবারই মনে হয়েছে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালির অপু দুর্গার কথা। অপু-দুর্গার মধ্যে যে ভালোবাসার বন্ধন আনোয়ার-সানোয়ার দুই ভাইয়ের মাঝেও একইরকম বন্ধনের ঘ্রাণ পাবে পাঠক। আর পাবে প্রায় একইরকম দারিদ্রের সাথে লড়াই’র অনুভূতি।এখানে লেখক হয়তো নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবিও কিছুটা এঁকেছেন। কবি মোশাররফ হোসেন খানের বড় ভাই ছিল। ভাইয়ের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক ছিল, সম্পর্কের মাঝে যে মধুরতা ছিল লেখক হয়তো এই গল্পে সেই সম্পর্কের ছায়াপাত করেছেন। আর একারণেই হয়তো চরিত্রদুটো এতো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে কবি তার বড় ভাইকে যে সম্বোধন করতেন এই গল্পেও ছোটভাই বড়ভাইকে সেই সম্বোধনই করেছে।কিন্তু এতো জীবন্তু চরিত্র ও প্রাণবন্ত গল্প-বুননের মাঝেও গল্পের চরিত্রের ভেতরকার কথোপকথনে থমকে গিয়েছিলাম। লেখক ডায়লগের ভাষা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার না করে লেখ্যভাষা বা অফিসিয়াল ভাষা ব্যবহার করেছেন। আনোয়ারের বাবা মা কথা বলছেন---“আব্বা বললেন, কিছু জরুরি কথা ছিল-বলুন-একটু না বসলে কীভাবে বলবো?-চুলোয় ভাত ফুটছে। শেষের পথে। তাহলে নামিয়ে আসি।-এসো। তার আগে আমাকে একটা পান বানিয়ে দিয়ে যাও।”এই যে স্বামী স্ত্রীর মাঝে কথোপকথন এখানে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা অফিসিয়াল ভাষা হওয়ায় কিছুটা দ্বিধায় পড়তে হয়। হতে পারে লেখক চেয়েছেন যেহেতু এটি শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা তাই এতে এমন ভাষাই ব্যবহার করা হোক যাতে শিশু-কিশোররা আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে পরিশিলীত সুন্দর ভাষা শিখতে পারে। একসময় অন্যান্য লেখকরাও শিশুকিশোরদের বইয়ে চেষ্টা করেছেন উপদেশাত্মক, শিক্ষণীয়, নীতিকথা, ফুটিয়ে তুলতে। এবং সেসব বইয়ে কথোপকথনে আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে শুদ্ধভাষা এমনকি সাধুভাষা ব্যবহার করা হতো। উপেন্দ্র কিশোর রায়ের ‘গল্পমালার’ কথাই যদি উল্লেখ করি; সেখানে দেখতে পাই একইরকম শুদ্ধ ও সাধুভাষার কথোপকথন। “ সেই বাড়ির কর্তা আমাদের অবস্থা দেখিয়া বড় দুঃখিত হইলেন। .... বলিলেন ‘কাল আমি একজন লোক দিয়া তোমাদের দু’জনকে বাড়ি পাঠাইয়া দিব।’ এই যে ডায়লগটি, এটি ইনভার্টেড কমার মধ্যেই উল্লেখিত। অর্থাৎ এটি ডাইরেক্ট স্পিচ। একই গল্পে আরও কিছু কথোপকথন এরকম...তিনি আমার নাম ধরিয়া বলিলেন, ‘গিরিশ এখানে তোমার কেমন লাগে?’‘দিব্যি’‘বটে?, তা এখান থেকে তোমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছা হয় না?’‘কোথায় যাব? এখানেই থাকব’যাই হোক একসময় গল্পের পাত্রপাত্রীদের মধ্যেকার কথাবার্তার ধরন এমনই ছিল। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছেও দেখা যায় চরিত্রের মধ্যে যে কথাবার্তা বা ডায়লাগ তা বইয়ের ভাষাই থেকে গেছে।“বাবু জি আমি কয়দিন ধরে এখানে এসে দু’বেলা তোমাকে দেখছি। আমার তাজ্জব লেগে গেছে।”নন্দকিশোর হেসে বললেন “ কেন, এখানে তোমাদের চিড়িয়াখানা নেই নাকি?” রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘ল্যাবরেটরির’ ভাষা এটা।অর্থাৎ গল্পের পাত্রপাত্রীদের মাঝে অফিসিয়াল ভাষা ব্যবহার দোষের নয়, তবে আঞ্চলিক বা প্রকৃত কথ্যভাষাই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। যে কারণে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শেষদিকে কথোপকথনের ভাষায় স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষা ফিরে এসেছে। বলাইবাহুল্য তা গল্পের ‘মেইকবিলিভ’ অনেকগুন বাড়িয়ে তুলেছে। এখান থেকে গল্প যেমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে তেমনি গল্পের গভীরেও ঢুকে যেতে পারে পাঠক। তৃতীয় সাবপ্লট আর প্রকৃতঅর্থে সাবপ্লট নয় বরং গল্পের মূল প্লটের দিকে এগিয়ে গেছে দুরন্ত ও সাবলিল গতিতে। দ্বিতীয় সাবপ্লট বা এটাকে এখন থেকে পরিচ্ছেদ-বিভাজনও বলা যায়। কারণ শালিখের গল্পটা একটা উপকাহিনী ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় শিরোনাম আর উপকাহিনী হিসেবে আলাদা স্থান তৈরি করেনি বরং গল্পের ধারাবাহিক গতি লাভ করেছে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শেষে ডায়লগ ছিল এরকম...“তুত্তুর করে কাঁপছে দুইভাই। কাঁধে ধানের ঝুঁড়ি। দৌড়াচ্ছে তারা। পিঠের সাথে লেগে গেছে অভূক্ত কচি পেট। আনু বললো, ম্যাভাই, আরতো পাত্তিছিনে।-এইতো দাদু আর এট্টু। আমরা তো বাড়িই যাচ্ছি।-কিন্তুক শীতে যে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!-আমারও। নে ধর, আমরা গান গাতি গাতি দৌড়াই। তালি গাডা গরম হয়ে উঠবানে।...”দুই গ্রাম্যকিশোরের এই দৌড় কিন্তু আমরা আরও দেখেছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যে দৃশ্যটা চোখে ভাসে সেটি অপু-দুর্গার দৌড়। বিভূতিভূষণের সেই অপু-দুর্গা ফিরে এলো আনোয়ার-সানোয়ার হয়ে। বাংলাভাষী দুই কথাসাহিত্যিকের এই সামঞ্জস্যপূর্ণ দৃশ্যায়ন মনে করিয়ে দেয় এপার বাংলা ওপার বাংলা দুই বাংলার সাহিত্যভূবন এক। সাহিত্য চিন্তা, সমাজচিত্র এক। ভৌগোলিকভাবে দুই বাংলা আলাদা হলেও সাহিত্যে মননে চরিত্রে সংস্কৃতিতে দুই বাংলা আলাদা হয়নি।৩.সাগর ভাঙার দিন উপন্যাসের তৃতীয় পরিচ্ছেদের উপশিরোনাম হচ্ছে ‘মাঠের পরে মাঠ চলেছে।’এখান থেকে চরিত্র হিসেবে খুবই অনালোকিত থাকা ‘বাবা’ চরিত্রটি বিকশিত হতে শুরু করে।আনোয়ার সানোয়ারের বাবা দরাজ গলায় আবৃত্তি করতে পারেন। ‘তার কবিতা আবৃত্তির ঢংটা খুবই চমৎকার।’এই বর্ণনা লেখকের অন্তর্যামি দৃষ্টিকোণের। আনোয়ার বা সানোয়ার কিন্তু এই পাকামু করেনি। বরং তৃতীয় কেউ বলে দিচ্ছে আনোয়ার-সানোয়ারের বাবা আবৃত্তি করতে পারেন। এখানে কবিতাকে ইলিমেন্ট বা উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে যশোর অঞ্চলের (লেখকের নিজের এলাকার) ঐতিহ্যকে তুলে আনা হয়েছে। উঠে এসেছে বাংলা কাব্য সাহিত্যে আধুনিকতার প্রবর্তক মাইকলে মধূসূদনের কথা ও কৃতিত্ব। কবিতাটি ঐতিহ্যবাহী কপোতাক্ষকে নিয়ে। লেখকের এই জাতীয়তাবোধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখে পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে বইটি শিশু-কিশোরদের পাঠ্যবই হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। এই গল্পের মধ্যে অত্যন্ত প্রচ্ছন্নভাবে, পরোক্ষভাবে এমন এমন সব উপদেশ বা শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যা শিশু-কিশোরদের জীবনের জন্য খুবই উপযোগী।যেমন ভাইয়ে ভাইয়ে যে অসাধারণ সম্পর্কের চিত্র লেখক তুলে ধরেছেন; এমন দৃশ্য সমবয়সী শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া নয়, বিবাদ নয়, একে অপরকে ভীষণভাবে মিস করা, ফিল করা, একে অপরের জন্য কষ্ট পাওয়া, অভাব অনুভব করা...সবমিলে অসাধারণ এক সম্পর্ক ঠাঁই পেয়েছে এই উপন্যাসে। আমার তো মনে হয়েছে আমাদের কবি ভাইর সঙ্গে তার সাবেক সংসদ সদস্য ভাইয়ের এমনই মধুর সম্পর্ক ছিল! যে কারণে এই দু’টি চরিত্রের মধ্যে এমনই ভালোবাসার উষ্ণতা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন; যাতে পাঠকের হৃদয় বারবার অশ্রুকাতর হয়ে পড়তে বাধ্য।একটি বর্ণনা এমন---“লজিং এর কথা মনে পড়লে বড় ভাইয়ের জন্য তার(আনোয়ারের) মনটা কেঁদে ওঠে। আহ! না জানি সেখানে তার কত কষ্ট! কত শূন্যতা!”এরপর আমরা জানতে পারি কাহিনীর অন্যতম প্রধান চরিত্র সানোয়ার লজিং থাকে। জায়গাটির নাম কলারোয়া (বর্তমান সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত, যদিও এটি সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত কিন্তু যশোর থেকেই বেশি কাছে)। আনোয়ারদের বাড়ি থেকে মাত্র দশ মাইল দূরে। দুরত্ব বেশি নয় কিন্তু যানবাহন না থাকায় এই দুরত্ব অনেক গভীর বিরহের জন্ম দেয়। হাঁটা আর সাইকেল ছাড়া উপায় নেই। ভাই লজিংএ থাকে। পড়ালেখায় এতোই ব্যস্ত যে আজকাল ছুটির দিনেও বাড়ি আসতে পারে না। এই ভাইটাই আনোয়ারের একমাত্র বন্ধু সাথী সবকিছু। ভাইয়ের বিরহে আনু বিষণ্ণবোধ করে। অনেক স্মৃতি মনে পড়ে।...স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতেই পরিচ্ছেদ শেষ হয়।৪.তৃতীয় পরিচ্ছেদে আনু-সানু দুইভাইর অনেক দুরন্তপনার অনেক ঘটনা উঠে আসে স্মৃতিচারণের ‘টেকনিক’ ব্যবহার করে। চলচ্চিত্রের ভাষায় যাকে বলে ফ্লাশব্যাক। ফ্লাশব্যাকে দেখা যায়, গ্রামের দুই কিশোর শুধু পড়ালেখা বা বাবার উপদেশমূলক গল্পই শোনে না বরং মাঠে ঘাটে দৌড়ে বেড়ায়, খালেবিলে ডোবানালায় মাছ ধরে, কাদায় মাখামাখি করে সাঁতরে পাড় হয় নদী। আর এসবের মাঝেও বৃষ্টি আছেই।...বৃষ্টি যে গল্পের প্রধান উপাদান! ‘বর্ষার কারণে কপোতাক্ষ ফুলে ফেঁপে বিশাল হয়ে পড়েছে। দুকূল প্লাবিত। থই থই পানি। তেমনি আবার স্রোত।’নদীর এমন বিবরণ পেলে বাঙালি মনও আনন্দে ফুলে ওঠে।শিশু-কিশোররা সাধারণত বীরত্বের কাজ খুব পছন্দ করে। এই গল্পের চরিত্রদ্বয়ও তাই বিভিন্ন বীরত্বব্যঞ্জক কাজের মধ্য দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করে । একটানা বৃষ্টি। ঘর থেকে কেউ বের হচ্ছে না। এদিকে কপোতাক্ষের ওপারে আটকে পড়েছে দু’ভাই। গিয়েছিল এক আত্মীয়বাড়ি দাওয়াত খেতে। এবার নদী কীভাবে পাড় হবে? নৌকাতো ওই পাড়ে!... বড় ভাই সানোয়ার বলে তুই এই পাড়ে থাক আমি সাঁতড়ে গিয়ে নৌকা নিয়ে আসি। কিন্তু ছোটভাই বড় ভাইকে কষ্ট করতে দিতে চায় না। বলে-না ম্যাভাই (‘মিয়া ভাই’ এর কথ্যরূপ)। তুই এপার থাক। আমি যাই।-পাগল! তুই না ছোট্ট মানুষ। আমি তো বড়। আমি যাই।- না ম্যভাই, আমি যাব। তুই যদি সৌতের মদ্যি পানিতে ডুবি যাস!-আর তুই? তুই তো আমার চেয়েও ছোট। তুই ডুববিনে?”এবার বুঝা গেল নদীটা পাড় হওয়া সাধারণ কোনও ব্যাপার না! মৃত্যুর ঝুঁকিও আছে! আর তারপর যখন দুই ভাইই কেউ কারও বারণ না শুনে নদী সাঁতরে পাড় হয় তখন কিন্তু গায়ের রোম কাঁটা দিয়ে ওঠে। সারাদিন বৃষ্টি! চারিদিকে মানুষ জন নাই! নীরব সুনসান! আর সেই সময় নদী পাড় হচ্ছে দুই কিশোর! সাঁতার কেটে!...আসলে তাদেরও হয়তো ভয় হচ্ছিল। কিন্তু একে অপরের প্রতি ভালোবাসার টানে সেই ভয়কে তারা জয় করে ফেলেছে।...গল্পের ঠিক এই স্থানটিতে এসে আমার ফুপাতো বোনের দুই ছেলের একসাথে পানিতে ডুবে মরার ঘটনাটি মনে পড়ে গেলো। প্রথমে ছোটভাই পুকুরে পড়ে যায়, তাকে বাঁচাতে বড় ভাইও পুকুরে ঝাঁপ দেয়। সেও সাঁতার জানে না। ৭ আর দশ বছরের দুই ভাই। এভাবেই পুকুরে ডুবে মারা যায়। সাঁতার না জানা সত্ত্বেও ভাই ভাইকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দেয়। ভালোবাসা এমনই। মৃত্যুর ভয়ও সেখানে মূল্যহীন।...গল্পে সানু নদী পার হতে গিয়ে পেছনে ফিরে দেখে ছোটভাইও নদীতে নেমে গেছে। ভাইকে সে নদীতে একা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। যা হোক সানু আর আনু দুজনেই হাঁপাতে হাঁপাতে নদী পার হয়। তারপর বাড়ি ফেরে। ফিরতে সন্ধ্যা হয়। এতটা সময় পর ছেলেদের ফিরে পেয়ে মায়ের মনের কী অবস্থা? - মা আমরা আইচি।মা চোখ মুছে অবাক দষ্টিতে তাকালেন, সে কি? এলি কীভাবে?(ওদের মা বোধয় বরবরই এভাবে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন। কারণ তার সমস্ত ডায়লগই শুদ্ধ ভাষায় বর্ণিত)।মা বলেন এতো কহর মাথায় না এলে কি হতো না? ছেলে জবাব দেয়-তুমারে থুয়ে কি আমি কোনো জাগায় থাকতি পারি?মা একটা ধমক দিলেন, খুব দরদের ধমক। মায়ের সেই ধমকের মধ্যে আদর আবেগ আর অনুভূতি ছিল খুব গাঢ়।...একটি পরিবারের এরকম মিষ্টি গল্প দিয়েই সাজানো ‘সাগর ভাঙার দিন’ বইটি।কিন্তু এসব আনন্দের মাঝেও কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকে অভাব এবং নিদারুণ দারিদ্রের কষাঘাত। তারপরও এই পরিবারটি নৈতিকভাবে ভেঙে পড়ে না, ঘুষ দিয়ে নিজের হকের পেনশনের টাকা তোলার চেষ্টা করে না, অপেক্ষা করে কবে মানুষের বিবেক হবে, কবে মানুষ অন্যায় থেকে রক্ষা পাবে। এমনকি পরিবারের দুই কিশোরও অত্যন্ত নৈতিকতাবোধসম্পন্ন। তারা দুরন্ত, তারা সাহসী, তারা একে অপরের প্রতি ভালোবাসায় ভীষণভাবে আবদ্ধ, কিন্তু কিছুতেই মিথ্যে তারা বলে না। তারা চেয়েছিল বাবা যেন কিছুতেই টের না পায় সাঁতরে নদী পাড় হওয়ার কথা। কিন্তু বাবা সেই প্রশ্নটাই করলেন যখন, তখন উত্তর দেয়ার আগেই মা খাওয়ার কথা বলে বাচ্চাদের সরিয়ে নিলেন। এই যে পারিবারিক আদর্শ, নৈতিক ভিত। এতেও প্রমাণিত হয় এই বইটি সত্যিই পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার যোগ্য।৫.চতৃর্থ পরিচ্ছেদে জানা গেলো সানুর লজিং বাড়ির কথা। জানা গেলো বাবার প্রতি সানুর ভালোবাসা-দায়বদ্ধতার কথাও। জানা গেলো ছোট্ট আনুর বিবেকবোধের কথা। ব্যক্তিত্ববোধের কথা। সাধারণত শিশুদের ব্যক্তিত্ববোধকে অধিকাংশ মানুষ গুরুত্ব দেন না। কিন্তু ব্যক্তিত্ববোধ যেমন শিশুকাল থেকেই গড়ে ওঠে তেমনি এর গুরুত্বটাও শিশুকাল থেকেই দেওয়া উচিৎ। অর্থাৎ শিশুদের ব্যক্তিত্ববোধকেও সম্মান করা উচিৎ। আমরা ছোটবেলায় হিলফুল ফুজুল গল্পে, রাসুল সঃ এর ছোটবেলার গল্পে জেনেছি তাঁকে শিশুকালে একবার কাপড় খুলে মাথায় বেঁধে দিয়েছিল বলে তিনি শৈশবেও লজ্জায় অজ্ঞান হয়ে যান।এ থেকে প্রমাণ হয় ব্যক্তিত্ববোধ, সম্মানবোধ শৈশবেই তৈরি হয়। যে কারণে শিশুদেরও কারও সামনে বকাঝকা করা উচিৎ নয়। শিশুদের সামনেও ব্যক্তিত্বহীন কাজ করা উচিৎ নয়।আনোয়ার বড়ভাই সানোয়ারের লজিং বাড়িতে যায়। ভাইকে অনেকদিন না দেখে শীত গ্রীষ্মের নানান স্মৃতি মনে করে আনু আর ভাইকে না দেখে থাকতে পারে না। দশমাইল পথ হেঁটে সে ভাইর কাছে যায়। যাদের পীঠাপীঠি ভাই আছে তারাই বুঝবে ভাইয়ে ভাইয়ে এই টান মোটেও আরোপিত নয় বরং অতীব বাস্তব। কথায় বলে না, ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন।দশমাইল হেঁটে ছোট ভাই গেছে বড়ভাইর কাছে। ভাই তো তাকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু একই সাথে লজিং বাড়িতে ভাইকে সাদর অভ্যর্থনা করতে সে কিছুটা লজ্জাবোধ বা সংকোচও করছে! কী দারুণ এক মনস্ত্ত্ব লেখক তুলে ধরেছেন এখানে। ছোটভাইটাও ভাইয়ের সংকোচটা বুঝতে পারে। ভাই যখন বলে কী ব্যাপার! হঠাৎ যে চলে এলি? ভাইয়ের এমন প্রশ্নে আনুর খুব কষ্ট লাগে। তার কান্না পায়।...আসলে এটাও একধরনের অসহায়ত্ব। আমি নিজেও এই অসহায়ত্ব ভোগ করেছি। আমি যখন সানুর মতো ইন্টারমিডিয়েটের শিক্ষার্থী তখন আমি এক আন্টির বাসায় পেইংগেস্ট ছিলাম। তখন আমার কাছে কেউ এলে আমি খুব অসহায় বোধ করতাম। যদিও আন্টি অত্যন্ত সমাদর করেই আমার গেস্টকে আপ্যায়ন করতেন, কিন্তু আমি কিছু বলতে পারতাম না। এমনকি গেস্টকে সাধতেও পারতাম না। লজ্জায়। লেখক আনু-সানুর মাধ্যমে আমার সেসময়ের লজ্জাবোধটাকেই কেমন করে যেন ঠাঁই করে দিলেন! এখানেই লেখকের সার্থকতা, যে একজনের সুখ, দুঃখ হয়ে ওঠে হাজার জনের সুখ-দুখ মনের অভিব্যক্তি।...লজিং বাড়িতে আনুর যথেষ্ট সমাদর হয়। কিন্তু অনাত্মীয় একজনের বাড়িতে ওর থাকতে ভালো লাগে না। বিকেলে পৌঁছায় আবার রাতেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে। বাবার শরীরটা একটু খারাপ এটা শুনে সানু আর থাকতে পারে না। অন্যদিকে লজিংবাড়ির প্রতিও যেন কারও খারাপ ধারনা না হয় তার জন্য গল্পের একস্থানে সেটারও অপনোদন করা হয়েছে। তারা মানুষ ভালো। তা না হলে কি লজিংবাড়ির ছেলেটাও আনুদের বাড়ি বেড়াতে যেত?এই উপন্যাসের অভাব অনটনের যে দৃশ্যটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে, যা আগেও বলেছি, সেই করুণ দৃশ্যটি হলো“আনুর পায়ে জুতা নেই। খালি পায়ে সে এসেছে। সানুর আছে মাত্র এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল। স্যান্ডেল জোড়াটি সে হাতে করে নিলো।” কী এক সমানুভূতি!...ছোটভাইর খালি পা বলে বড়ভাইও জুতা পায়ে না দিয়ে তা হাতে নিয়ে নিল!...লেখকের ভ্রাতৃত্ববোধের ছোট ছোট এই বর্ণনাগুলো গল্পের করুণরসকে এতোটাই বাড়িয়ে তোলে যে পাঠক বারবার অশ্রুসজল হয়ে উঠতে পারে। আমি কখনও নিজেকে সেই খালি পায়ে দেখতে পাই, কখনও আমার ছেলেকে দেখতে পাই খালি পায়ে। আমি কিছুতেই দৃশ্যটা সহ্য করতে পারি না। বারবার ভাবনায় পড়ে যাই। আনুর কষ্ট যেন আমাদেরই কষ্ট। আমার ছেলেটাই আনু। তার দরিদ্র বাবার সামর্থ্য নেই ছেলেকে জুতা কিনে দেয়ার!...৬.এতসব কষ্ট কি সারাজীবন বয়ে চলবে এরা? না, লেখক শেষ পরিচ্ছেদটির শিরোনামেই বলেছেন ‘এই রাত শেষ হবে’। এই অভাব শেষ হবে। কিন্তু পরিচ্ছেদটির শুরুই হলো হতাশা দিয়ে। হয়তো হতাশাকে স্থায়ীভাবে ঝেড়ে ফেলার জন্যই এক এক করে একত্রিত করা।“ অনেক চেষ্টার পরও আব্বা তার পেনশনের টাকাটা পেলেন না। তারা ঘুষ চায়। আব্বা কিছুতেই ঘুষ দেবেন না। অফিসের এক কেরানি আব্বাকে আশ্বাস দিয়েছিল, সামান্য কিছু টাকা দিলে সে যাবতীয় কাজ করে দেবে। আব্বা তাতেও রাজি হননি।”গল্পের মূল ম্যাসেজটা হয়তো এখানেই। গল্পের মূল ফ্যাক্টও হয়তো এটাই। ঘুষ দানবের হাতে কীভাবে একটি পরিবার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে, অসহায় হয়ে পড়েছে, তারই চিত্র এটা। একই সাথে অভাবের সাথে এতো লড়াই করেও শেষমেষ অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি, নৈতিকতাকে বিসর্জন দেননি আনু-সানুর বাবা। ন্যায়ের পথে অটল থেকেছেন। একজন শিক্ষক তার মহান পেশাকে কলঙ্কিত করেননি। নিজের চরিত্রকে কলুষিত করেননি। এমনকি আনুর মাও ঘুষ দিয়ে পেনশনের টাকা তোলার পক্ষে নন। অথচ তিনি ঝড় বাদলে ভাঙা ঘর নিয়ে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত।হঠাৎ কোনও নাটকীয়তা দিয়ে শেষ হয় না গল্পের। শেষ হয় না আনুদের অভাব। কিন্তু তাদের চোখে অবারিত স্বপ্ন। এই অভাবের দিন একদিন শেষ হবে। কিন্তু আদৌ শেষ হলো কি না, কবে শেষ হলো, তা জানা যায়নি এই গল্পে। জীবনের পূর্ণতা, ঘটনা বা গল্পের পরিসমাপ্তি না টেনে গল্পকার পাঠককে ঠেলে দিয়েছেন স্বপ্নের দিকে। কাহিনীর সমাপ্তিটা নিজেদের মতো করে ভেবে নিতে পারে পাঠক। হয়তো এমনটিই হবে… “এই রাত শেষ হবে থেমে যাবে ঝড়মেঘ ফুঁড়ে উড়ে যাবে বেদনার খড়।সাহসী জোয়ার এলে ভরে যাবে কূলনবীন তারার চোখে সাতরঙা ফুল।পাথরে পারদ জ্বলে, জলে ভাঙে ঢেউভাঙতে ভাঙতে জানি গড়ে যাবে কেউ।”এটি শুধু কাব্যকথা নয় এটি মূলত জীবনের দর্শন। সৃষ্টির আদি দর্শন। কোনও কষ্টই চিরস্থায়ী নয়। একদিন তার শেষ আছেই। তবে উদ্ধৃত শেষ দু’টি লাইন স্বপ্নাতুর মানুষের জন্য অনেক বড় মাইলস্টোন। হতাশাগ্রস্ত মানুষের জন্য বেঁচে থাকার প্রেরণা। পাথরে পারদ জ্বলে...শক্ত পাথরেও পারদ জ্বলে, পাথরে পাথরে ঘর্ষণে পাথর জ্বলে ওঠে। কষ্টই একদিন কষ্টকে আনন্দে পরিপূর্ণ করে তোলে। কষ্টসহিষ্ণু মানুষ খাঁটি হয়ে ওঠে। জল থেকে যে ঢেউয়ের সৃষ্টি, জলই সেই ঢেউকে ভেঙে দেয়। আবার ভাঙাগড়ার এই সমাজে ভাঙতে ভাঙতে ধংস হতে হতেই কেউ একদিন গড়ে যাবে। আগেই বলেছি এটি জীবনের আদি দর্শন। লক্ষ লক্ষ ভ্রুণকণা ভাঙতে ভাঙতে যেমন একজন জয়ী হয়। একজন গড়ে ওঠে, জায়গা পায় মাতৃজঠরে, হয়ে ওঠে মানুষ! ঠিক সেই দর্শনের কথাই উচ্চারিত হলো আবার। ভাঙতে ভাঙতে একদিন গড়ে যাবে কেউ।এরকম স্বপ্নবোনা চোখের আলোতেই গল্পের শেষ হয়। আনু ও সানুর মাঝে পৃথিবীর তাবৎ দুখঃ কষ্ট শুষে নেয়ার স্বপ্ন ও প্রত্যয় এবং দৃঢ়তা দিয়েই শেষ হয় গল্পের। উপন্যাসের শেষে পাঠক হিসেবে আমরা হয়তো সর্বদা পরিণতিটাই জানতে চাই কিন্তু কখনও কখনও শেষ পরিণতি না জেনেও স্বপ্নের সোপানে সঁপে দিয়ে, একদিন আমরাও এই দুখের সাগর পাড়ি দিয়ে জয়ী হবো, এমন প্রত্যয় নিয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায়। আনোয়ার-সানোয়ার দুই ভাইয়ের মাঝে বাবার সেই স্বপ্নের ছবি এঁকে দিয়ে সেই তৃপ্তি নিয়েই শেষ হয় সাগর ভাঙার দিন। যে কিশোরদ্বয় সাঁতরে পাড় হয়েছে কপোতাক্ষ নদ। সেই কিশোরেরা পাড়ি দেবে কষ্টের, অভাবের, অনটনের দীর্ঘ সাগর।