শীত মানেই কুয়াশাঘেরা প্রকৃতির ছবি। সামান্য দূরের কোনও কিছুও তখন দেখা যায় না। দেখা যায় শীতের সকালে গুটিসুটি মেরে আগুন পোহাবার দৃশ্য।বাংলাদেশ ঋতুবৈচিত্রের দেশ। এ দেশে যেমন আছে ঠা ঠা গরম আর রোদের তেজ তেমনি আছে ঘন কুয়াশা আর কনকনে ঠাণ্ডার আবেশ। বাংলাদেশের ক্যালেন্ডারে পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস হলো শীত কাল। এসময় কুয়াশার চাদর গায়ে পুরো বাংলাদেশ সাজে নতুন সাজে। বিশেষকরে উত্তরাঞ্চলে যেন শীতের প্রকোপ একটু বেশিই। কারণ হিমালয় পর্বতের কাছাকাছি অঞ্চলগুলোতে শীত পড়ে একটু বেশি। হিমালয়কে চেনে না এমন কেউ নেই। হিমালয় হচ্ছে অসংখ্য পর্বতের সমন্বিত রূপ। ভারত, পাকিস্তান, ভুটান ও চীন এই পাঁচটি দেশে এটি বিস্তৃত। প্লেট টেকটোনিক তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতীয় প্লেট ও এশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষে হিমালয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এশিয়ারও বিভিন্ন দেশের প্রকৃতিতে এর প্রভাব পড়ে। হিমালয় সারাবছর বরফে ঢাকা থাকে তাই এর আশপাশের অঞ্চলে ঠাণ্ডা পড়ে বেশি। শীতকালে হিমালয়ে বরফের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ছোট ছোট ছড়ায় রূপ নেয়, পরে এগুলো মিলিত হয়ে নদীর আকার ধারন করে। সিন্ধু, শতদ্রু, ব্রক্ষ্মপুত্র ও গঙ্গার উৎপত্তি এখান থেকেই।বাংলাদেশে শীত কালে শীতপ্রধান দেশের মতো বরফ পড়ে না বরং এখানে তীব্র শীত আসে শৈত্যপ্রবাহের মাধ্যমে। হিমালয়ের বরফ চূড়া ছুঁয়ে আসা প্রবাহ শৈত্যপ্রবাহ দৈত্য হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে হানা দেয় এবং প্রচণ্ড শীতে কাঁপুনী ধরিয়ে দেয়।
ভালো লাগে ভোরের কুয়াশা:
শীত বাংলাদেশের ঋতৃতে এক অপরুপ পরিবর্তন নিয়ে হাজির হয়। হেমন্তেই হালকা শীতের আবহ বিরাজ করলেও শীত ঋতুতে নতুন এক চিত্র ফুটে ওঠে বাংলাদেশের মাঠে ঘাটে গ্রামে গঞ্জে। শীতকালে সবচেয়ে ভালো লাগার দৃশ্য হলো ভোরের কুয়াশা। কয়েক হাত দূরের মানুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও কুয়াশা ভেদ করে তাদের দেখা যায় না। গ্রামাঞ্চলে এসময় মানুষ জটলা করে আগুন পোহায়। কিছুদিন আগের হেমন্তের কাটা ধানের নাড়া—কুটা দিয়ে আগুন ধরিয়ে চারদিক গোল হয়ে বসে আগুন পোহাবার মজাটাই অন্যরকম। সন্ধ্যায় যদিবা কখনও এমন আসর বসে তখন সাথে থাকে গ্রাম্য লোককথার গান আর করুণ বাঁশির সুর। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে মোটা কাপড় আর চাদর পড়ে মোয়া বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়ে হকাররা। কাকা/ মামা ডেকে তাদের থেকে মোয়া কিনে খেতে এত্তো মজা লাগে। আরও পাওয়া যায় সদ্য বানানো পাউরুটি। মধু দিয়ে মাখিয়ে গরম পাউরুটি খেতেও কিন্তু দারুণ মজা।শীতের ভোরে লেপ—কাথা ছেঁড়ে বাবার হাত ধরে ফজর নামাজ পড়তে যাবার স্মৃতি এখনও মনে আছে। লেপ—কাথা ছাড়তে কিন্তু খুব কষ্ট হতো। কিন্তু তারপর একবার শয়তানকে থাক্কা দিয়ে উঠে গেলে কিন্তু আর কষ্ট নেই।মজার ব্যাপার হচ্ছে শীতকালে একবার ঘুম ভাঙলে কিন্তু আর ঘুমাতে হয় না। সবাই বলে শীতের রাত বড়। তাই ঘুম হয় পরিপূর্ণ। সত্যিতো ৫টা সোয়া ৫টায় দেয় মাগরিবের আযান। তারপর ভোর হয় আবার ৫টা সোয়া ৫টায়। রাততো অনেক বড়!...এরপরও যারা ঘুমের আলস্যে শুয়ে থাকে, তারা যেমন মিষ্টি ভোরের কুয়াশা মিস করবে তেমনি বঞ্চিত হবে আলাহর অনেক বড় নিয়ামত ও রহমত থেকেও। হাদিসে আছে যে ফজর নামাজ ছেড়ে দেয় তার রিজিক কমে যায়। ছোটবেলা আমরা শীতের ভোরে ফজর নামাজ পড়ে নদীর পাড়ে ঘুরতে বের হতাম। দেখতাম ভোর থেকেই মানুষ ভীষণ কর্মব্যস্ত। কেউ গরুকে খাওয়াচ্ছে, কেউ হাঁস মুরগীকে খাবার দিচ্ছে। কেউ ধরছে মাছ। আমার বাবা প্রায়ই নদীর পাড় থেকে টাটকা মাছ কিনে ফিরতেন। সেই মাছের স্বাদ কিন্তু ফ্রিজে রাখা মাছের চেয়ে অনেক আলাদা।
শীতের সবজি:শীতের সকালে কুয়াশায় আচ্ছন্ন দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে লাঙল কাঁধে মাঠে চলে যায় কৃষক। ক্ষেত থেকে তুলে আনে নানান জাতের সবজি। সবজি যাদের খুব প্রিয় তাদের কাছে নিশ্চই শীতকালটাও খুব প্রিয়। কারণ এমন অনেক সবজি আছে যা কেবল এই শীতেই পাওয়া যায়। যেমন ফুলকপি, বাধা কপি—ওল কপি, পাতা কপি, সিম, টমেটো, পিয়াঁজের ফুলকি, বরবটি,ঢেঁড়স ইত্যাদি নানা জাতের নানা স্বাদের সবজিতে ভরে যায় বাজার। শীতকালে প্রচুর সবজি উৎপাদন হয় ফলে দামটাও কমে। এতে দারুণ স্বস্তির দেখা মেলে ভোজনরসিক মানুষের মনে। শীতকালে অনেক শাক পাওয়া যায়। পালং শাক, লাল শাক, মূলা শাক ইত্যাদি। ছোটবেলায় আমার প্রিয় শাক ছিল লাল শাক। তখন লাল শাক ভাজলে তার রং হতো রক্তের মতো লাল। হয়তো সার বা অন্যান্য কেমিকেল বা রাসায়নিক উপাদান মেশানো হতো না তাই।শীতে সবজি বাগান করা অনেকরই হবি। বাড়ির আঙিনায় হালকা নিরানী দিয়ে লাল শাক, পালং শাক, ধনে পাতার বীজ ছিটিয়ে দিলে দিন কয়েক বাদে দেখা যায় পড়ে থাকা পতিত জমিতেও কী সুন্দর শাক সবজিতে ভরে গেছে। তা কি এমনি এমনি হচ্ছে? না মহান আলাহ বলছেন; তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা থেকে উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্নকারী? ইচ্ছা করলে, আমি উহা খরকুটা করে দিতে পারি। অতঃপর তোমরা হয়ে যাবে হতভম্ব (সূরা ওয়াক্বিয়া: আয়াত—৬৩—৬৫)। কোরআন মজিদের অন্যত্রে বলা হয়েছে, নামাজ শেষ হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আলাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অন্বেষণ কর এবং আলাহকে অধিক স্মরণ কর— যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা জুমায়াহ : আয়াত—১০)। কোরআন মজিদের নির্দেশনার পাশাপাশি হাদিসেও বলা হয়েছে—হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুলাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা জমিনের প্রচ্ছন্ন লুকায়িত ভাণ্ডারে খাদ্য অন্বেষণ কর। (তিরমিযী)।রাসুল সঃ বলেছেন, ফজরের নামাজের পর তোমরা জীবিকা অর্জনের কাজে অমনোযোগী হয়ে আবার ঘুমিয়ে যেও না,(কানযুল উম্মাল)।এখন দেখা যায় শহরের বাজারে যে শাক সবজি পাওয়া যায় তাতে সেই আগের স্বাদও নেই পুষ্টিও নেই।এর জন্য কিন্তু আমরা নিজেরাও কম দায়ী নই। আমরা ভালো জিনিস খেতে চাই কিন্তু পরিশ্রম করতে চাই না। “যে ব্যক্তি রিজিকের ব্যবস্থায় নিজের শ্রম ও জ্ঞানকে সঠিকভাবে কাজে লাগায় না সে নাফরমান ও গুনাহগার।”
শীতের পীঠাঃশীতকালে শীতের পীঠা হচ্ছে আরেক মজার উপকরণ। পীঠা খাওয়ার ধূম পড়ে যেন এই শীতকালেই। শীতের চিতল পীঠা খেলে কার না প্রাণ জুড়ায়? এছাড়াও অনেক ধরনের পীঠা পাওয়া যায় গ্রামে। যেমন চই পীঠা,পুলি পিঠা,ভাপা পিঠা,ছাঁচ পিঠা, কলা পিঠা, সেমাই পিঠা, কুলশি পিঠা,চিড়ার মোয়া ইত্যাদি।
এসব পিঠা কেন বারোমাস পাওয়া যায় না? এরও কিন্তু কারণ আছে। শীতের পিঠার যেসব উপকরণ তা কিন্তু শীতেই সহজলভ্য। যেমন চালেরগুড়া,খেজুরের গুড় ইত্যাদি। আবার কিছু কিছু পিঠা আছে যা শীত ছাড়া বানানো যায় না। নবান্নের নতুন ধান ঘরে ওঠার পর ধান ভানিয়ে চালের গুড়া করে বানানো হয় ভাপা পিঠা। এই চালের গুড়ার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে গরমকালে চালের গুড়া ভালো থাকে না। গরমে গুড়ি নষ্ট হয়ে যায়। আর গুড় কোত্থেকে আসে?শীতকালে খেজুর গাছ কাটা হয়। সেখান থেকে রস নামে, রস থেকে হয় গুড় আর গুড় দিয়ে হয় পিঠা।শীতকালে এই খেজুর রসের প্রাপ্তিও যেন মহান আলাহর অনেক বড় অনুগ্রহ। শুষ্ক গাছও তখন রসে ভরপুর হয়ে ওঠে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সামান্য অথের্র বিনিময়ে গাছ কেটে দেয় গাছীরা। তারপর মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে সেখান থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। এই রসের স্বাদ কিন্তু আর অন্য ঋতুতে পাবে না। সকালে উঠে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে একগাস খেজুরের রস খাওয়ার আনন্দ কিন্তু কম নয়। রস দিয়ে বানানো যায় মাজাদার পায়েস এবং অনেক ধরনের পিঠা। শহরের মানুষ যে চিতল পিঠা কিনে খায় রাস্তার মোড় থেকে সেই চিতল পিঠাকে রসে ভিজিয়ে অনন্য স্বাদের এক পিঠা বানায় গ্রামের মানুষ। কেউবা হাড়ি ভর্তি পায়েস রান্না করে বিলায় পাড়া পড়শির ঘরে ঘরে। শীতকালের এই মনোরম দৃশ্যগুলো চিরায়ত বাংলার এক অবিস্মরণীয় সম্পদ। খেজুরের রসঃমিষ্টি কিন্তু সবার পছন্দ। বিশেষকরে বাচ্চাদের যেন একটু বেশিই প্রিয়। কিন্তু কেউ কি জানো মিষ্টির উৎস কী? অনেকেই জানে মিষ্টি হয় চিনি থেকে। কিন্তু চিনি ছাড়াও মিষ্টির আরেকটি উৎস হচ্ছে গুড়। মজার ব্যাপার হচ্ছে। চিনি বা গুড় এ দুটিকে আমরা প্রায় একসাথেই বলি বা দেখি অথচ এদের জন্ম সম্পূর্ণ ভিন্ন। চিনি হয় আখ থেকে। আখ থেকে চিনি করতে হলে চিনির কল বা মিলে যেতে হয়। যে কারও পক্ষে চিনি বানানো সম্ভব নয়। আর গুড় হয় খেজুরের রস থেকে। প্রথমে খেজুর গাছ কেটে তা থেকে রস সংগ্রহ করতে হয় তারপর বড় তাওয়াতে করে রাতভর সেই রস জাল দিয়ে বা গরম করে করে করা হয় গুড়। এই গুড়কে বলা হয় খেজুরের ঝোলা গুড়। যেহেতু গুড়টা দেখতে ঝোলের মতো পাতলা তাই।খেজুরের রস দিয়ে কিন্তু শুধু পাতলা বা ঝোলা গুড়ই নয় শক্ত পাটার মতো গুড়ও বানানো হয়। পাটার মতো দেখতে সেই গুড়ের নাম পাটারী গুড়। পাটারী গুড়ের জন্য বিখ্যাত কিছু অঞ্চল আছে। তবে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগে যশোরের পাটারী গুড়। নারকেল মেশানো এই পাটারী গুড়ের চাহিদা কিন্তু ব্যাপক। খেজুরের ঝোলা গুড় দিয়ে যেমন মুড়ির মোয়া বানানো যায় কিংবা মুড়ি মাখিয়ে অথবা চিতই পিঠার সাথে মাখিয়ে খেতে খুব মজা তেমনি, পাটারী গুড় সারাবছর সংরক্ষণ করে রাখা সহজ এবং এই গুড় দিয়ে ভাপা পিঠাসহ নানান জাতের পিঠা বানানো যায়।
শীতের বেড়ানোঃবেড়ানোর জন্য শীতকালটাই ভালো। এসময় আকাশ এবং প্রকৃতি শান্ত থাকে। এছাড়া বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুলগুলোতেও বন্ধ পাওয়া যায়। শিশুকিশোররা বছরের এ সময়টার অপেক্ষায় থাকে অধীর হয়ে। কবে শীত আসবে,কবে পরীক্ষা শেষ হবে তারপর অনেক বড় ছুটি পাওয়া যাবে, তারপর মনের স্বাদ মিটিয়ে নানা বাড়ি দাদা বাড়ি বেড়ানোর ধূম পড়ে যাবে। যারা বর্ষার কাদায় গ্রামে গিয়ে বিরক্ত হয় তারা শীতকালে গ্রামে গিয়ে খুব মজা পায়। একদিকে নতুন গরম কাপড়ের মজা, অন্যদিকে অনেকদিন পর দাদা—দাদু—চাচা—চাচী, নানা নানু খালা মামাসহ অসংখ্য আত্মীয় স্বজনের দেখা সাক্ষাত আদর ভালোবাসা তারউপর নতুন নতুন শীতের পিঠার অভাবনীয় স্বাদ। সবমিলে শীতকালটা যেন শুধুই মজা আর মজা। আনন্দ আর আনন্দ।
তবে কষ্টও কিন্তু আছে। বিশেষকরে উত্তারাঞ্চলে প্রচণ্ড শীত পড়লে সেখানকার মানুষদের ভীষণ কষ্ট হয়। দরিদ্র মানুষ শীতের জন্য গরম কাপড় কিনতে না পেরে নিদারুণ কষ্টে ভোগে। শীতকালটা বয়স্কদের জন্য একটু ঝুঁকির ব্যাপার। শীত বেশি হলে তারা সামাল দিতে না পেরে মারা যায়। আমাদের উচিৎ যাদের সামর্থ্য আছে তারা দরিদ্রদের মাঝে শীতের পোষাক বিলি করবো, অন্তত নিজের ছোট হয়ে যাওয়া বা পুরনো শীতের কাপড়টি দিয়ে হলেও যেন আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি।তবেই শীতকাল হয়ে উঠবে আমাদের প্রিয় ঋতু, আমাদের আনন্দের উৎসব।