বর্ষা বাংলাদেশের বর্ণাঢ্য এক ঋতু । গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহ শেষে বর্ষা আসে প্রকৃতির সেরা দান হয়ে । থেকে থেকে একটানা বর্ষণের পর ধরায় জাগে নতুন প্রাণের স্পন্দন । বৃষ্টির মিষ্টি পানির ছোঁয়ায় গ্রীষ্মের বিবর্ণ প্রকৃতি হয়ে ওঠে কোমল আর সজীব ।এ সময় আকাশজুড়ে থাকে ঘনকালো মেঘের গম্ভীর নিনাদ । হঠাৎ মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সকল কাজ থেকে। না পড়তে ভালো লাগে, আর না কোনও কাজ ভালো লাগে। ভালো লাগে কেবল জানালার পাশটা।কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিন্তু এই বরষা ঋতুকে ভীষণ ভালোবাসতেন। এই বরষায় তিনি তার বজরা নিয়ে নদীতে ঘুরে বেড়াতেন, আর লিখতেন কতো কতো কবিতা! ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে জল সিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে ঘন—গৌরবে নব যৌবনা বরষা শ্যামা—গম্ভীর সরসা ।ঋতুচক্রের হিসেবে আষাঢ়— শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। কিন্তু বর্ষার বৃষ্টি শুরু হয় বৈশাখ থেকে, চলে ভাদ্র–আশ্বিন মাস পর্যন্ত । সেই হিসাবে বর্ষা বাংলাদেশের দীর্ঘতম ঋতু । অনেক সময় দেখা যায় শরৎকালকে স্পর্শ করেও বৃষ্টি থামার কোনও নাম নেই। বর্ষার অপরূপ সৌন্দর্য হলো এসময় নদী নালা খাল বিল যেন নতুন যৌবন ফিরে পায়। বর্ষার প্রবল বর্ষণে জীবজন্তু গাছপালা যেন নতুন করে সজীবতা পায় । নানাধরনের ফুল ফোটে পত্রপল্লবে সুশোভিত হয় গাছপালা। কদম কেয়ার সৌন্দর্যে ভরে যায় রাস্তার দু’পাশ। আনন্দে ভরে ওঠে পথিকের মন। সবচেয়ে বড় কথা হলো এসময় উর্বর হয়ে ওঠে ফসলের ক্ষেত। কৃষকের মুখে ফোটে হাসি আর গান। ছোটছোট বাচ্চাদের ঘরে বেঁধে রাখা হয় দায়। তারা কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দেয়। ভাঙা ছাতি মাথায় দিয়ে, অথবা কচুপাতা, কলাগাছের পাতার ছাতি মাথায় দিয়ে খালি পায়ে বেরিয়ে পড়ে এখানে সেখানে।একটা গান নিশ্চই সবার জানা ‘মুক্তো মালার ছাতি মাথায় বর্ষা এলোরেসারা গাঁ এ গোলাপ পানি ছিটিয়ে দিলরেসারা গাঁ এ গোলাপ পানি ছিটিয়ে দিলরে’ এরকম কতো গান যে তখন তৈরি হয়। গৃহবন্দী মানুষ মনের অজান্তেই কবি হয়ে ওঠে। কলমের আঁচড়ে গাঁথে মনের প্রশান্তি। আর তা থেকে হয় মজার মজার গান। বর্ষাকাল কিন্তু সব কবিদেরই প্রিয় ঋতু। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি ফররুখ আহমদ সবার কাছেই এই ঋতু প্রিয়। তাইতো তারা বর্ষাকে নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা ও গান।বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শনগুলোতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগের কবি চন্ডীদাশ লিখেছেন‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটাকেমনে আইলো বাটে,আঙিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছেদেখিয়া পরাণ ফাটে।’ বর্ষায় যেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভেতরের প্রেম আরও বেশি করে জেগে উঠতো। তিনি লিখেছেন ‘বাদল রাতের পাখি।উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল,নাহিক ফুলের ফাঁকি।’(চক্রবাক; বাদল রাতের পাখি) মানবতার কবি, জাতীয় জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ লিখেছেন—‘বৃষ্টি নামে রিমঝিমিয়ে রিমঝিমিয়েগাছের ডালে টিনের চালেবৃষ্টি নামে হাওয়ার তালেবাদলা দিনের একটানা সুরবৃষ্টি নামে ঝুমুর ঝুমুর।’ কবিতার কথাতো গেলো এবার আসি ফলের কথায়। কতো ফলই না পাওয়া যায় এই বর্ষায়! আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, ডেউয়া, চালতা, লটকন, তাল ইত্যাদি জনপ্রিয়ফলগুলো কিন্তু গ্রীষ্মকালের ফল। যা বৃষ্টির পানিতে রসে টসটসে হয়। তার তা খেয়ে প্রাণ জুড়াই আমরা। কিন্তু কিছু বিপত্তিতো আছেই, এই বর্ষাকালে। যেমন রাস্তাঘাট কাদায় ভরে যায়, হাটতে গিয়ে মানুষ আছাড় খায়, অথচ আছাড়া কোনও খাওয়ার জিনিস না। খুবই বেদনার জিনিস। এছাড়া রাস্তাঘাটে খোড়াখুড়ি, খানা খন্দ ভরে গিয়ে এক মরণঘাতী রূপ নেয়। ভালো হতো যদি এসময় রাস্তা খোড়াখুড়ি বন্ধ থাকতো। কিন্তু আমরা দেখেছি বর্ষাকালেই বরং খোড়াখুড়ি বেশি হয়।বর্ষাঋতু সাধারণত দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের জন্য খুবই দু:খের।কারণ,অনেক সময় টানা বর্ষণে খেটে খাওয়া মানুষ কাজে যেতে পারে না।তাদের আয়—রোজগার বন্ধ থাকে,ঘরবাড়ি বৃষ্টির পানিতে ভেসে যায়।ফলে তাদের দুখ—কষ্টের সীমা থাকে না । অতিবৃষ্টির ফলে নদীভাঙনে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।কৃষেকের ফসলের জমি ভেসে যায়, খেতের ফসল নষ্ট হয় । বানবাসি মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখলে মনে হয় ,বর্ষা এসব মানুষের জীবনে দুর্যোগ ও দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে।কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন –‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরেওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাইরে। কিন্তু বাইরে না গেলে কি চলে? খেটে খাওয়া মানুষকেতো তবে না খেয়ে কাটাতে হবে। কবি যদিও বলেছেন এই বরষায় ঘরের বাইরে যেতে না। কিন্তু দরিদ্র মানুষের সমস্যা সৃষ্টির জন্য কিন্তু বর্ষা নয়। এই বৃষ্টির পানি হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালার অন্যতম নেয়ামত। তিনি বলেছেন এই যে বৃষ্টি, কে তা বর্ষণ করে? আমি আল্লাহ তা নাযিল করি। যাতে এর দ্বারা গাছপালা, শস্যাদি, লতাগুল্ম চাষ হয়, আর তা খেয়ে মানুষ ও পশু খেয়েপড়ে বাঁচে।‘তিনি (আল্লাহ) পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তা দ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফল—মূল উৎপাদন করেন। সুতরাং জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিও না।’ (সূরা বাকারা : ২২)।তাইতো আমরা দেখি বর্ষাকালে আমাদের দেশে কেয়া,কামিনী,কদম, জুঁই,টগর,বেলি,চাঁপা প্রভৃতি ফুলের সুগন্ধে চারপাশ সুরভিত হয়ে ওঠে। অর্থকরী ফসল পাট তখন কৃষকের ঘরে আসে। আউশ ধানের মৌসুম তখন। পেয়ারা,কলা,চালকুমড়া,ঝিঙা,করলা,ঢ়েঁড়শ বরবটি ইত্যাদি ফল ও তরকারি বর্ষাকালেই জন্মায়।এসময় নদীতে, পুকুরে, ডোবা নালায় আমরা প্রচুর মাছ পেয়ে থাকি । এমনকি চরাঞ্চলে যাদের আত্মীয় স্বজন থাকে সেখানে বেড়াতে যেতেও দারুণ সুবিধা হয়। কারণ নদী—খাল—বিল সব থাকে পানিতে টইটুম্বুর। নৌকাযোগে ব্যবসা—বাণিজ্যও বেশ ভালো হয়। তবে সতর্ক থাকতে হয় বাচ্চাদের নিয়ে। কারণ তারা পানি পেলেই দৌড়ে যায়। কিন্তু সাঁতার না জানার ফলে ডেকে আনে অনাকাঙি্ক্ষত বিপদ। আর সতর্ক থাকতে হয় সাপ—গোপ নিয়ে। কেননা এসময় সাপের গর্তগুলোও পানিতে ভরাট হয়ে যায়, ফলে সাপ উঠে আসে মানুষের কাছাকাছি। যদিও তারা এমনিতে কাউকে ছোবল দেয় না, তবু সাবধানে থাকতে হয়। কারণ কখন যে উৎপীড়নের শিকার হয়ে কামড়ে দেবে তারতো ঠিক নেই। সবচেয়ে ভালো হয়, কার্বোলিক এসিড ঘরের চারপাশে বোতলে ভরে রাখলে। কার্বোলিক এসিডের গন্ধ সাপ অনেক দূর থেকে পায় তখন আর ঘরে বাড়িতে সাপ আসে না। এছাড়াও আরেকটি কাজ করতে হবে, তাহলো বাড়ির আশপাশের জঙ্গল কেটে সাফ করতে হবে। ও হ্যাঁ সাবধান! কার্বোলিক এসিড কিন্তু খুবই বিপদজনক। বাচ্চাদের দূরে থাকতে হবে। আর এই এসিড কােঁচের বোতলে নিয়ে ঘর থেকে বেশ খানিকটা দূরে রেখে আসতে হবে। বোতলের মুখ খোলা রাখলেই চলবে। কোথাও ঢেলে দিতে হবে না। বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্যের অন্যতম সৌন্দর্য বর্ষাকাল হয়ে উঠুক সবার জন্য আনন্দময়।