Explore my thoughts and writings on various topics by visiting my Pratilipi account.
Explore my thoughts and writings on various topics by visiting my Pratilipi account.
জানালার ওপারে
একটি সরু গলি। দুই পাশে রংবেরঙের দুই-তিনতলা বাড়ির সারি। ছোটো ছোটো দরজা-জানালাগুলি যেন জমকালো পেরিস্কোপের রঙিন লেন্স, কেউ যেন লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখছে পথচলা মানুষদের উপর। ছাদের কার্নিশে, রেলিংয়ে ঝুলছে গতদিনের ভিজে জামাকাপড়। দুই পাশের উঁচু বাড়ি গুলির মাঝে, মাথার উপর দেখা যাচ্ছে মেঘমুক্ত নীল আকাশ। সকালের কোমল উজ্জ্বল সূর্যরশ্মি রাস্তার এদিক ওদিক লুকোচুরি খেলছে। একটু এগিয়ে গেলে, অন্য একটি অপেক্ষাকৃত সরু গলিপথ এসে মিশেছে এই গলিতে। সেখানে সকালবেলায় একটি ছোট্ট সবজি বাজার বসেছে। পথচলা মানুষের কলহ, সাইকেলের বেলের ক্রিং ক্রিং শব্দে ভরে উঠেছে জায়গাটা। একটি অতি পুরনো দোতলা বাড়ি, ওই গলির বাঁকটায়, বাজারের উপর উদাসীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কোনো বয়স্ক মানুষকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে কেউ বাজারে কেনাবেচা দেখাতে নিয়ে এসেছে; এখন সে নিজের ইচ্ছায় ফিরে যেতেও পারছে না তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চুপটি করে বসে আছে। চারিদিকে এত রঙচঙে বাড়িগুলির মাঝে এই জরাজীর্ণ প্রাচীন বাড়িটি বড্ড বেমানান। বাড়িটিকে নাগপাশের মত জড়িয়ে আছে লতানো ফুলের গাছ। ইটের দেওয়াল ঢাকা পড়ে গেছে সবুজ পাতায়, রঙিন ফুলে...লতানো গাছ গোটা বাড়িটিকে গ্রাস করে ফেললেও দোতলার একটি জানলা তখনও অনাবৃত। জানালার কাঠের ফ্রেমে লোহার রড দিয়ে আটকানো। ঘরের ভিতরে আলো প্রবেশ করে না বললেই চলে; শুধু অন্ধকারের মধ্যে কুঞ্চিত ত্বকে আবৃত একটি মুখ দেখা যায়। দুটি জীর্ণ হাত জানালার রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। দুটি নিষ্প্রভ চোখ নিচের বাজারের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ততা অনুভব করার চেষ্টা করে। ক্ষীণ হয়ে আসা দৃষ্টি যেন কিছু খুঁজে নিতে চায়, অতগুলি মানুষের ভিড়ে।
৯ মে ২০২৪
রাতের বেলায় এই এক সুবিধা, নিজের শরীরটাকে জানলায় বসিয়ে রেখে মনকে নিয়ে দিব্যি ঘুরে আসা যায় । ঠিক যেনো কেউ জানলায় বসে বাইরের আকাশে ড্রোন ওড়াচ্ছে । মাঝে মাঝে কোনো রাতে, একটা-দুটো বেজে যায় কিন্তু দুচোখে ঘুম আসে না । জানালায় বসে বাইরে তাকাই । এই অজ পাড়াগাঁয়ে রাত দশটার পর থেকেই কোনো এক ঘুমের অপদেবতা গোটা গ্রামকে গ্রাস করতে শুরু করে । যত রাত বাড়তে থাকে ততই বাইরের জগতটা পরিবর্তিত হতে শুরু করে...এক মায়াজালের চাদরে ক্লোরোফর্ম মাখিয়ে কেউ যেনো চেপে ধরে প্রতিটা বাড়ির উপর । সেই সময় ভুল করে কারো ঘুম ভেঙে গেলেও যেন সেটা কাউকে জানতে দিতে নেই... দরজা খুলে রাতের জোৎস্না মেখে উদ্মুক্ত উঠানে পায়চারি করতে নেই... জানালা খুলে দিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ বা জনশূন্য রাস্তার দিকে চেয়ে থেকে কোনো অপার্থিব জীবের আসার অপেক্ষা করা মানা । রাতের সেই সৌন্দর্য্যের মধ্যে কোথায় যেন একটা ভয় মিশে থাকে । গ্রামের বুড়োবুড়িরা বাচ্চাদের পোষ মানানোর জন্য অনেক গল্প বলে ভয় দেখাত, কিন্তু সন্তান বড়ো হওয়ার পরেও তারা যেন সেই ভয় গুলো কাটিয়ে দিতে ভুলে গেছে ।
তবে দীর্ঘদিন শহরে কাটানোর পর গ্রামে এসে আমার সেই ভয়টা অনেকটা কেটে গেছে । এখন জানালা খুললে দেখা যায়, ফাঁকা মাঠের উপর হালকা কুয়াশা পড়েছে, ধানের পাতার উপর শিশিরের উপর চাঁদের আলো পড়ে চিক চিক করছে । পুকুরের দিক থেকে জলে টুপটাপ মাছ নড়ার শব্দ শোনা যায় । দূরে...অনেক দূরে কয়েকটা কুকুর ডাকছে । রাতের বেলায় এই আবছা কুকুর ডাক শুনলে আমার যেন কিছু একটা মনে পড়তে চায়... কোনো একটা সময়ের কথা...বা কোনো এক অনুভূতির কথা । এই কুকুরের ডাক শোনার মধ্যেও যেন কিছু একটা উপভোগ করার ব্যাপার আছে, কিন্তু সেই পুরোনো সময়ে আমি যেন ব্যস্ত ছিলাম, বা আমার মনে তখন অন্য কোনো অনুভূতি চেপে বসে ছিল । আমার মন বলে কুকুর গুলো এমনি এমনি ডাকে না । রাতের অন্ধকারে গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর, সরু আবছায়া পথে যারা হেঁটে যায়, রাতের আকাশে যারা উড়ে বেড়ায়, ওই কুকুর গুলোর সাথে তাদের বহুদিনের পরিচয় । ওই কুকুর গুলো ডেকে ডেকে যেনো সারাদিনের গল্প শোনায় ওই ভিনজগতের অধিবাসীদের । পাশের পাড়া থেকে শোনা যায় মোরগের ডাক...অবাক হই... ছোটো বেলায় জানতাম মোরগ কেবল ভোর বেলায় ডাকে । এত রাতে ডাকবে আসা করিনি । আর মাঝে মাঝে কয়েকটা নিশাচর পাখি কর্কশ শব্দে কি যেন বার্তা দিয়ে যায় । দিগন্ত রেখার ওপারে বড় রাস্তা...চোখে দেখা যায় না....অনেক রাতে মাঝে মাঝে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ আসে সেদিক থেকে । বুক টা কেঁপে ওঠে ।
ভিন জগতের প্রাণীরা আসে বলেই হয়তো রাতের বাতাসটা একটু বেশি ঠান্ডা । দূরে কোনো রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের আলো জোনাকির মত মিটি মিটি জ্বলতে থাকে । কান পাতলেই শোনা যায় দূরে কোথায় শেয়াল ডাকছে । ছোটো বেলায় এই ডাক শুনলে খুব ভয় পেতাম । মনে হত শেয়াল ডাকলেই বোধ হয় কোনো অশুভ শক্তি হানা দেবে । বড়ো হওয়ার পর যখন বুঝতে শিখেছি, ওই শেয়ালদের জন্য দুঃখ হয়, যত দিন যাচ্ছে গ্রাম থেকে ওরা বিলুপ্ত হচ্ছে, একসময় হয়ত ছোটো বেলার বাকি স্মৃতিগুলোর মতোই ওরাও হারিয়ে যাবে...চিরতরে...
কান পেতে থাকি...সৌভাগ্যক্রমে যদি এমন কিছু শুনতে পেয়ে যাই, যা এই ঘুমন্ত গ্রাম কোনদিন শুনতে পায়নি বা দেখতে পায়নি....দাদুদিদার রূপকথার গল্পের কোনো সাদা পক্ষিরাজ ঘোড়া যদি নামে ওই মাঠের উপর বা সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা লোক, যে প্রতিটা বাড়ির সামনে গিয়ে বাচ্চাদের নাম ধরে তিন বার করে ডাকতে ডাকতে চলে যায়...
৪ নভেম্বর ২০২৩
আমি কোনো বাস্তব ঘটনা লেখার সময় সবার আগে সময় উল্লেখ করি; আমার মনে হয় সঠিক সময়টা জানতে পারলে পরিস্থিতি বুঝতে সুবিধা হয় ৷
তো....সময় এখন রাত দুটো বেজে চল্লিশ মিনিট । আমি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ক্যাম্পাসে। সন্ধ্যে থেকেই বসে আছি । সরকারি হাসপাতালে সারাদিন সাধারণ মানুষের হয়রানি আর হাহাকারের ছবি, সবার মোটামুটি চেনা । সন্ধ্যার অন্ধকার একটু গাঢ় হতেই দেখলাম চারিদিকে কেমন এক "জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা" শুরু হল । গাছের নীচে, ফাঁকা চাতালে, খবরের কাগজ-প্লাস্টিক পেতে একে একে জীবন্ত শরীরগুলো সারি দিয়ে শুয়ে পড়তে থাকল, যেন তাদের গায়ের উপর দিয়ে কালী প্রতিমা বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে । আর একদল মানুষ পিঁপড়ের মত চঞ্চল, শুধুই ছুটে চলেছে । তারা বড্ড প্রশ্ন করে; "রক্ত লাগবে, আর্জেন্ট! ব্লাড ব্যাঙ্ক কোনদিকে?", "ওষুধটা পেলে ?", "টয়লেটটা কোন দিকে?", "খাওয়ার জল কোথায় পাওয়া যাবে?" ইত্যাদি ইত্যাদি । একে একে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে আর বেরুচ্ছে । কুকুর গুলোও দেখি গোষ্ঠীদন্দ্ব বাঁধিয়েছে । যাইহোক.... এখনের সময়ে ফিরে আসা যাক! আমি আবার অতীত-বর্তমান বড্ড গুলিয়ে ফেলি । একটু আগে আমার কাজ মিটতেই, ক্যাম্পাসের ভিতরেই ফুটপাতের উপর একটা প্লাস্টিক পেতে বসেছি । বড়ো বড়ো মশা দেখে ডেঙ্গুর ভয়েতে মশারিটা গায়ের উপর চাপিয়ে নিলাম, টাঙানোর উপায় নেই । মাঝে মাঝে গাড়ির শব্দ আর দু-চারটে কুকুরের ডাক ছাড়া চারিদিক প্রায় নিস্তব্ধ । সারাদিন তেমন কিছু খাওয়া হয়নি বললেই চলে, ব্যাগ থেকে একমাত্র বিস্কুটের প্যাকেটটা বের করলাম ৷ সবে একটা বিস্কুট বের করে মুখে পুরেছি অমন কোথা থেকে যেন এক মহিলা কন্ঠে আর্তনাদ শোনা গেল, "ও বাবা তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেলে গো ! আমার এ কি সর্বনাশ হল গো !....." বুঝলাম ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ তার বাবাকে হারালো ৷ কেমন একটা অজানা শোক আমাকে ঘিরে ধরল ৷ এদিকে আমার মুখে তখনও অর্ধেকটা বিস্কুট, গলা দিয়ে পেটে যাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই তার, আবার ফেলে দিতেও পারছি না ৷ কিছুক্ষণ এই দন্দ্ব চলল ৷ শেষমেশ গিলে নিয়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিলাম, এখন দোকান সব বন্ধ, কিচ্ছু খাবার পাওয়া যাবে না ৷ পাশ থেকে একজন বলল, "এ তো নিত্যদিনের ঘটনা, প্রতিদিন কত মানুষ মরছে..." সেই কান্নার শব্দটা ভূমিকম্পের আফটার শকের মতো ফিরে ফিরে আসতে লাগল ৷ সামনের রাস্তা দিয়ে একজন ফোনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে...শুনতে পেলাম, "মা! তোমার নাতনি হয়েছে! হ্যাঁ...হ্যাঁ! ভালো আছে দুজনেই...." সত্যি অবাক লাগে ৷ এই হাসপাতাল...এখানেই জীবনের শুরু....এখানেই শেষ...এখানেই জন্ম... আবার এখানেই মৃত্যু...
১২ নভেম্বর ২০২২
The sky is the biggest canvas! কবে, কখন, তার কোন কোনায় কোন ছবি ফুটে উঠবে কেউ জানে না।
সারাদিনের দাবদাহ সহ্য করার পর, কোনো গ্রীষ্মের বিকেলে সূর্যাস্তের পর দুই বন্ধু নদীর পাড়ে, পুলের উপর বসে পা দোলাচ্ছে ৷ নদীর উপর থেকে ভেসে আসা শীতল বাতাস তখন উত্তাপে সৃষ্টি হওয়া ক্ষতে মলম লাগাচ্ছে ৷ কতকগুলি কাক ও বক দল বেঁধে বোধহয় কোনো খেলা খেলছে আর মাঝে মাঝে ছেলে দুটির মাথার উপর চক্কর কাটছে ৷ নদী বেশি চওড়া নয়, ওপারের দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যায় ৷ একটা ডিঙি নৌকা ওপারে বাঁধা, সারাদিন নদীর বুকে দৌড়দৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে এখন বিশ্রাম নিচ্ছে; অবাধ্য ঢেউ গুলি বারবার তাকে নাচিয়ে তুলছে, যেন দমকা বাতাসে বারবার আগোছালো চুলগুলি কোনো মেয়ের মুখের উপর এসে পড়ছে ৷ এদিকে কাকগুলি খেলা ছেড়ে নদীর পাড়ে একটা গাছের ডালে ঝগড়া শুরু করেছে; বড্ড ঝগড়ুটে ওরা ৷ বকগুলি জলের পাশে কাদার উপর জড়ো হয়ে কোনো জরুরি বিষয়ে আলোচনা করছে ৷ পাশেই একটা পরিত্যক্ত শশ্মান, খুব নির্জন ৷ নদীর ওপারের পাড়ে নতুন রাস্তা হয়েছে ৷ সেই রাস্তা দিয়ে লোকজন বাজার থেকে বাড়ি ফিরছে ৷ রাস্তার পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ল্যাম্পপোষ্ট গুলি যেন একদল সৈনিক, অন্ধকার নামলেই জীবন্ত হয়ে উঠবে, পাহারা দেবে সারারাত ৷ বিক্ষিপ্ত মেঘগুলি নিজেদের অবসর যাপনে ব্যস্ত; ছোট্টো শিশুর মতো ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক ৷ এদিকে দুই বন্ধু মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, পশ্চিম আকাশের ওই মেঘটি রাজহাঁসের মতো লাগছে নাকি চাইনিজ সিনেমার উড়ন্ত ড্রাগন ! একজন বলছে উত্তর আকাশের একটা মেঘ নাকি কাঁকড়ার মতো লাগছে, অন্যজন বলছে কুঠার কাঁধে কোনো মানুষ ! এইভাবেই একের পর এক মেঘ নিয়ে তাদের কল্পনার খেলা শুরু হয়েছে ৷ দুজনের কল্পনার রথ তখন ভূমি ছাড়িয়ে আকাশে উড়ছে ৷ এদিকে আকাশের আলো ধীরে ধীরে কমে আসে ৷ মেঘগুলিও ধীরে ধীরে উবে যায় ৷ ওপারের রাস্তায় সাদা ল্যাম্পপোষ্ট গুলি চকচকে তরোয়ালের মতো জ্বলে ওঠে ৷ এপারে অন্ধকার ৷ কয়েকটা জোনাকি ঘুরতে বেরিয়েছে, যেন একদল কিশোর-কিশোরী সন্ধ্যের পর লন্ঠন নিয়ে মাস্টারমশায়ের বাড়িতে টিউশন পড়তে যাচ্ছে ৷ ছেলেদুটিও বসার জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ে; এই শশ্মানের সম্পর্কে অনেক ভুতুড়ে গল্প বলে গ্রামের লোকে ৷
১৬ এপ্রিল ২০২২
মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের সাথে প্রতারণা হয়েছে...বড় হওয়ার লোভ দেখিয়ে আমাদের ছোটোবেলা কেড়ে নেওয়া হয়েছে ৷ একে একে সবকিছুই হারিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে ৷ এই বছর-দশের আগের ঘটনাগুলিও আজ পূর্বজন্মে ঘটেছে মনে হয় ৷ মাঝে মধ্যে গুলিয়ে ফেলি কোনটা গল্পের বইতে পড়েছি আর কোনটা নিজের চোখে দেখেছি ৷ আজ বুঝতে পারি দাদু-দিদারা নিজের ছোটোবেলা নিয়ে কেন এত গল্প করত...ছোটোবেলা হারিয়ে যাওয়ায় তাদের কেন এত দূঃখ...আমাদের এই বয়সে যদি এমন মনে হয় তবে আরও বয়স বাড়লে এত স্মৃতির বোঝা বয়ে বেড়াব কেমন করে ?
কি হবে এত সভ্যতার বিস্তার করে, আধুনিক জীবনযাপন করে ? যখন জীবনের সেই সৌন্দর্যটাই হারিয়ে যাচ্ছে ৷ প্রতিদিনের যান্ত্রিক জীবনে বহুতলের ছোট্টো খাঁচায় স্ক্রিনের সামনে বসে রোবটের মত জীবন কাটানোর থেকে ছোটোবেলায় গ্রামে কাটানো সেই দিনগুলো ঢের ভালো ছিল ৷ এসি/ফ্যানের হাওয়ার থেকে মায়ের হাতের তালপাতার পাখার হাওয়ায় তাড়াতাড়ি ঘুম আসত...সুখ ছিল সেই হাওয়ায় ৷ যেখানে মাটির ঘরের খড়ের চালের নিচে মা গ্রীষ্মের দুপুরে কাঁথা সেলাই করত, সেখানে আজ মাটি ফুঁড়ে কংক্রিটের দেওয়াল উঠেছে; বাড়ির সামনে যে বড় বাগান ছিল, যেখানে গাছের ছায়ায় বসে বিকেলে দাদু-নাতিতে লুডু খেলা জমে উঠত আজ যেন সেখানে মরুভূমি হয়েছে ৷ সরস্বতী পুজোর আগে মা যখন একবস্তা মুড়ি নিয়ে ঢেঁকিতে যেত ছাতু বানাতে এবং তার বদলে দিনের শেষে এককৌট ছাতু নিয়ে বাড়ি ফিরত, সে যেন এক ম্যাজিক ৷ কোনো কোনো দিন দুপুরে মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলত বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো; মেহেগিনি গাছের ফল ফেটে বীজগুলি হেলিকপ্টারের মতো নেমে আসত নিচে...সে এক অদ্ভুত জিনিস ! গরমকালে একধরনের ফুল ফুটত রাস্তার পাশে, তার পুংকেশর গুলি ছিঁড়ে জলে ভাসিয়ে দিলে চরকির মতো ঘুরত ৷ মায়ের বানানো আমের আঁচারের কৌটগুলি উঠানের উপর সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে রৌদ্র পোহাত ৷ আবার কোনোদিন বিকেলে বেশ কয়েকজন মিলে লুকিয়ে গাছ থেকে কাঁচা তেঁতুল পেড়ে, লবন দিয়ে খেতে খেতে পুকুরপাড়ে বসে গল্পগুজব চলত ৷ অসুস্থতা ও মায়ের বকাঝকাকে উপেক্ষা করেই প্রতি বিকেলে মন ছুটে যেত খেলার মাঠে ৷ বর্ষাকাল এলেই দাদুর কাছ থেকে ছিপ বানিয়ে গোটা শরৎকাল জুড়ে চলত সেই ছিপ নিয়ে মাঠ-ঘাট-পুকুর-খালে ঘুরে মাছধরা খেলা ৷
শরতের উজ্জ্বল রৌদ্র যখন রাস্তার পাশে রাখা সাদা পাটকাঠির উপর পড়ে জ্বলজ্বল করে উঠত তখন সেই বাঁকা বাঁকা পাটকাঠিকে তরোয়াল করে নিয়ে চলত যুদ্ধযুদ্ধ খেলা ৷ অনেক বড় হয়েও আমি নারকেল পাতার ডাল নিয়ে গাড়ি চালিয়েছি...সেই গাড়ির মধ্যে আভিজাত্য ছিল ৷ সুপুরির চওড়া পাতায় বোনকে বসিয়ে সারা উঠান-বাড়ি টেনে টেনে বেড়িয়েছি, উঠানে দাগ হয়ে যাওয়ায় মায়ের কাছে বকা খেয়েছি ৷ বাঁশবন গুলি ছিল সবথেকে রহস্যময় জায়গা...যেখানে ভয়ও ছিল আবার অ্যাডভেঞ্চারও ছিল ৷
এইভাবে বলতে থাকলে হয়ত শেষই হবে না ৷ তবু মনে হয় আমরা ছেলেবেলাটা উপভোগ করার মতো যথেষ্ট সময় পেলাম না, কোনো অতল সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ছেলেবেলার সেই সব সাক্ষী ৷ যেন তাড়াহুড়ো করেই আমাদের দূরপাল্লার ট্রেনে তুলে দেওয়া হল ৷ আমাদের ছেলেবেলা ধীরে ধীরে আমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে....অনেক দূরে...আর কখনও ফিরবে না...ভোরের স্বপ্নের মতো আবছা হয়ে যাচ্ছে ৷ তাই রূপঙ্কর বাগচীর মতো বলতে ইচ্ছে করে, "ছেলেবেলাটা....ছেলেবেলাটা ফিরিয়ে দাও না গো...প্লিজ..!"
১২ মার্চ ২০২২
কে যেন বলেছিল, "আমি বেশি উঁচুতে উঠতে চাই না ৷ যারা উঁচুতে উঠে তারা নাকি বড্ড একা হয়ে পড়ে ৷" আমার মেস বাড়িটির অবস্থাও তেমন ৷ তিনতলা বাড়িটির পড়শি বাড়িগুলি একতলা বা দোতলা ৷ তিনতলা জুড়ে বেশ কয়েকটি ঘর ৷ উজ্জ্বল রং, হলুদ দেওয়ালে গোলাপি ফুল আঁকা ৷ সেই ঘরগুলিতে যারা থাকে, তারা রোজ দুবেলা প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বোনে ৷ নিজের বাবা-মা পরিবার ছেড়ে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে তারা স্বপ্নের চাবি খুঁজে বেড়ায় ৷ এই বাড়িটি যেন এক অলিখিত দায়িত্ব পালন করে চলেছে ; তাদের বাবা মায়ের অনুপস্থিতে ছেলেগুলির খেয়াল রাখে ৷ সারাদিন চলে মানুষ জনের যাতায়াত, হই-হুল্লোড়, পড়াশোনা ৷ রাত বাড়লে একে একে ছেলেদের চোখে ঘুম আসে, সারাদিনের ক্লান্তির পর তারা জানালা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে ৷ অনেক রাত পর্যন্ত পড়ে যে ছেলেটি সে যখন খোলা বইয়ের উপর মাথা রেখে ঝিমোতে থাকে তখন হয়ত বাড়িটির মনে হয়, ছেলেটির চশমাটি খুলে রাখি, পাছে চাপ পেয়ে ভেঙে যায় ! ঠিক যেন একজন মা তার ছেলেদের লালনপালন করছে ৷
তারপর রাত যখন আরও গভীর হয়, সন্ধ্যা থেকে ডাকাডাকি করে রাস্তার কুকুর গুলো যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, একে একে ঘরের আলো গুলি বন্ধ হয়ে যায়, দূরের আলোগুলো জোনাকির মতো নিভে যায় ; বাড়িটি তখন অন্ধকারে নিজেকে হারিয়ে ফেলে ৷ খোলা আকাশের নীচে নিঃসঙ্গতার জালে বন্দি হয় সে ৷ সারাদিনের জনকোলাহল তখন উধাও; তাকে তখন একটা শীতল নিস্তব্ধতা গ্রাস করে ৷ অনেকদূর থেকে অস্পষ্ট ট্রেনের হুইসেল শোনা যায় ৷ বড়ো রাস্তার পাশে গাড়ি চাপা পড়ে মরে যাওয়া কুকুরের মায়ের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে ৷ হয়তো তখন বাড়িটির মনে হয় এই ইট-কাঠ-বালির জড় শরীর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে, মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঘুমন্ত শহরে ঘুরে বেড়াতে, ল্যাম্পপোষ্টের নিচে নীল-হলুদ আলো মেখে নির্জন রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে ৷
একটু এগিয়ে যেতেই হয়তো দেখবে মশার কামড় খেতে খেতে টুলের উপর বসে ঘুমে ঢুলছে এক পাহারাদার ৷ আরও একটু এগিয়ে গেলে যেখানে গলি পথ বড় রাস্তায় মিশেছে, রাস্তার উপর হয়তো তখনও রক্তের দাগ লেগে আছে ; যা দুপুরের এক দুর্ঘটনার চিহ্ন রেখে গেছে ৷ তারপর সামনে বাসস্ট্যান্ড; একটি বাস দাঁড়িয়ে, খুব ভোরে সেটি রওনা দেবে ৷ তার ড্রাইভার ও কন্ডাক্টর কম্বল পেতে বাসের মেঝেতে ঘুমোচ্ছে ৷ রাস্তার দুপাশে সারি সারি দোকান, ঠান্ডার মধ্যে কুকুরের মতো মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছে ৷ হয়তো একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে ঢুকল হাসপাতালের গেট দিয়ে ৷ হাসপাতালের বারান্দায় সারি দিয়ে কয়েকটি জীবন্ত শরীর কাঁথা মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে, তাদের চোখে ঘুম নেই, তাদের প্রিয়জন হয়তো তখন মৃত্যুর সাথে লড়ছে ৷ হাসপাতালের পাঁচিল যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে স্টেশনের পাঁচিল শুরু হয়েছে ৷ পাঁচিলের গায়ে একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ, হালকা কুয়াশায় তার সৌরভ ভেসে বেড়াচ্ছে ৷ স্টেশন চত্বরটা একদম ফাঁকা, এককোণে এক বয়স্ক ভিখারি তার রুগ্ন শরীর নিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে ৷ ধীরে ধীরে রাত পেরিয়ে ভোর হয় ৷ সে হয়তো তখন তার ফেলে আসা তিনতলা জড় শরীরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ৷ তখনই হয়তো স্টেশনের পাশের চায়ের দোকানদারের ঘুম ভাঙে ৷ একটু পরে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয় ৷ আরও একটি দিনের সূচনা হয় ৷ আরও একটি রাতের অপেক্ষা...
১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২২
১৯ই ডিসেম্বর, বিকেল চারটে ৷ বোলপুর শান্তিনিকেতন ৷
ট্রেন থেকে নামলাম এক নম্বর প্লাটফর্মে ৷ স্টেশনে অপেক্ষা করতে হবে বেশকিছুটা সময় ৷ প্লাটফর্মে ছড়িয়ে-ছিড়িয়ে বসে আছে লোকজন ৷ তখন কারোই তাড়া নেই বাড়ি ফেরার, তাড়া নেই অফিস যাওয়ার, তাড়া নেই ট্রেন ধরার, তাড়া নেই ক্লাসে জয়েন করার; যেন একদল ক্লান্ত প্রাণ কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা থেকে পালিয়ে এসেছে, ক্ষুধার্ত শরীরে প্লাটফর্মের চাতালে বসে একটু জিরিয়ে নিতে চায়, দিনের শেষ আলোটুকু গায়ে মেখে রূপকথার দেশের হারিয়ে যেতে চায় ৷ সূর্যরশ্মি তার উত্তাপ হারিয়ে ছড়িয়ে ছিড়িয়ে পড়ছে গাছের ডালের ফাঁকফোকর দিয়ে ৷ প্লাটফর্মের রেলিং লম্বা ছায়া ফেলেছে যাত্রীদের চলার পথে, ফাটল দিয়ে বেরিয়ে থাকা সবুজ ঘাসগুলো শীতল হাওয়ায় কাঁপছে ৷ গাছের ডাল থেকে পাখিদের কিচিরমিচির ভেসে আসছে ৷ মাঝে মধ্যে দুটো-একটা ট্রেন থামছে, যাত্রীরা নামছে, কেউ স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে কেউ আবার বিশ্রামরত যাত্রীদের দলে যোগ দিচ্ছে ৷ অফিস ফেরত লোকজন দলে দলে জমা হচ্ছে বাড়ি ফেরার ট্রেনের অপেক্ষায় ৷ স্টেশনের বাইরের গাড়ির শব্দ আর টোটোচালকদের হট্টগোল শোনা যাচ্ছে ৷ এই স্টেশনটা যেন স্থির, পুকুরের জলের মতো শান্ত; আর এর ঠিক বাইরে যেন একটা খরস্রোতা পাহাড়ি নদী দূর্দান্ত গতিতে বয়ে চলেছে ৷ এই শান্ত জগৎ থেকে বাইরে বেরিয়ে স্রোতের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য সবাই মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে, যেন হেলমেট-গ্লাভস পরে ব্যাট হাতে প্রস্তুত কোনো ব্যাটার অপেক্ষা করছে ৷
ধীরে ধীরে দূরের দৃশ্য ঝাপসা করে দেয় কুয়াশা ৷ শীতের থেকে নিজেকে বাঁচাতে সূর্য লুকিয়ে পড়ে আগেভাগে ৷ স্টেশনের আলো গুলো একে একে জ্বলে ওঠে ৷ সেই আলোর পাশে ছোটো ছোটো পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে, যেন সমুদ্রের জলে একঝাঁক মাছ বিশৃঙ্খল ভাবে সাঁতার কাটছে ৷ বাইরে গাড়ির হর্নের শব্দ আগের তুলনায় বেড়েছে ৷ বড়ো ভারি ব্যাগ নিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করে একদল যাত্রী, গভীর রাতে তাদের ট্রেন আসবে অর্থাৎ এখনও কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা ৷ আমাকেও এবার উঠতে হবে, প্রচণ্ড ঠান্ডা জ্যাকেটের ভেতরে থাকা শরীরটা কাঁপিয়ে দিচ্ছে ৷ আজ এই পর্যন্ত রইল ৷
১৯ ডিসেম্বর ২০২১
প্রিয় ডায়েরি,
আজ আবার কয়েক মুহূর্তের জন্য আলো আঁধারির স্মৃতির স্থুপে হারিয়ে গিয়েছিলাম ৷ তখন আমি অনেক ছোটো, স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি ৷ আমরা তখন পুরোনো বাড়িতে থাকতাম ৷ টালির ছাউনি অনেক নীচ পর্যন্ত বাড়ানো ছিল, ছোটো ছোটো জানালা দিয়ে খুব কম আলো ঘরের ভিতর প্রবেশ করত ৷ দিনের বেলাতেও ঘরের বেশিরভাগ অংশ অন্ধকারের দখলে থাকত ৷ আমার তখন বাকি সুস্থ ছেলেমেয়েদের মত বাইরে খেলাধুলা, হুড়োহুড়ি নিষেধ; সারাদিন গৃহবন্দী ৷ খেলনার সংখ্যা ছিল খুবই কম, কিম্তু সবগুলিই খুব মূল্যবান ৷ একটা ভেসলিনের খালি চৌকো কৌটো, তার সোনালি রঙের ঢাকনা, কয়েকটা প্লাস্টিকের গুটি, ঘড়ির ও রেডিওর পুরোনো ব্যাটারি আর ঘরে ব্যবহার করার আয়না ৷ বিভিন্ন জায়গায় টালির ছাউনির ফাঁক-ফোকর দিয়ে সূর্য উঁকি দিত আমার ঘরে ৷ গোবর দেওয়ার পর শুকনো মাটির মেঝেতে সরু সূর্যরশ্মি এসে উজ্জ্বল হয়ে পড়ত ৷ ওটি ছিল আমার কাছে বড় পবিত্র জিনিস ৷ মনে হত যেন ওই সূর্য রশ্মি স্বর্গ থেকে পাতালে নেমে এসেছে...আমার জন্য, আমার ঘরের মধ্যে ৷ ঝর্ণার মতো অনুভব করতে পারতাম সেই আলো, হাতের উপর জল পড়ে যেমন ছিটকে যায়, সেই আলোও তেমন ছিটকে পড়ে চারিদিকের অন্ধকারে হারিয়ে যেত ৷ সারাদিন ধরে সেই আলো ঘরের মেঝের উপর এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়াত, সূর্যের সাথে কোণ করে ৷ শীতল ঘরের মধ্যে সেই আলোর নিচে দাঁড়িয়ে সূর্যের উত্তাপ অনুভব করতে পারতাম, মনে হত সূর্য আশীর্বাদ করছে ৷ আয়নার উপর সূর্যের আলো ফেলে ঘরের ভেতর তাকে প্রতিফলিত করার মত বৈজ্ঞানিক গবেষণা বোধ হয় আর ছিল না তখন ৷ সেই প্রতিফলিত আলো দিয়ে ঘরের প্রতিটি কোণ আবিস্কার করতাম, যেন কোনো গুহাতে প্রাচীন যুগে খোদাই করে আঁকা কোনো ছবি খুঁজে পেয়েছি ৷ কাঠের জানালার চৌকাঠের উপর পোকা কত জায়গায় ছিদ্র করেছে অথবা দেওয়ালের কোথায় পায়ের ধাক্কা লেগে মাটি খসে যাওয়ার জন্য মায়ের কাছে বকা খেয়েছি সব যেন মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ৷ ঘরের মধ্যে পুরোনো চটের বস্তা একটু নাড়া দিলেই তার মধ্যে থাকা ছোটো ছোটো ধূলিকণা সেই সূর্যরশ্মির স্তম্ভের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু করত; পরে যখন বড়ো হয়ে মহাকাশ, মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝের গ্রহাণুপুঞ্জ সম্পর্কে পড়লাম, তখন সেই ধূলিকণা ভেসে বেড়ানোর দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠত ৷ ছোটোবেলায় সব থেকে বড় প্রশ্ন ছিল, টালির যে ফাঁক দিয়ে আমি তিনকোণা আকাশ দেখতে পাই, সেখান থেকে সূর্যের আলো এসে মেঝেতে গোল হয়ে পড়ে কেন ??
তোমার হয়ত মনে হচ্ছে একটুকরো সূর্যের আলো নিয়ে কেন এত মাতামাতি ! আসলে ওই সামান্য সূর্যরশ্মিই ছিল আমার ছোটোবেলার খেলার সঙ্গী, যেন কোনো অশরীরী বন্ধু যাদুর শহর থেকে এসেছে ৷ ছোট থেকে বড় হলাম, টালির ছাউনির পরিবর্তে অ্যাসবেস্টস এসেছে, ভবিষ্যতে হয়ত কখনও কংক্রিটের ছাদও আসতে পারে কিন্তু আমার নতুন ঘরে এখন আর সূর্য উঁকি দিয়ে দেখে না, তার সাথে আর লুকোচুরি খেলা হয় না ৷ আমাদের ছোটোবেলার সাথেই সেই সব ছোটো ছোটো খুশি গুলি সমাধিস্থ হয়েছে ৷
ইতি,
তন্ময় গিরি
২১ অক্টোবর ২০২১
অনেকদিন পর স্কুল-টিউশনের বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেয়ে, পরিবারের সাথে ছুটি কাটাতে যাওয়া এক শিশু, উৎফুল্ল মনে জানালা দিয়ে দেখছে ঘরবাড়ি, গাছপালা, মাঠ-পাহাড়। দশবছর আগের নিত্যযাত্রী দুই ছাত্র-ছাত্রী আজ স্বামী-স্ত্রী...আজও তারা একই সাথে বাড়ি ফেরে একই ট্রেনে। গত চারমাস ধরে এক বয়স্ক ভদ্রলোক প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার করে শহরে যাতায়াত করছেন, তার চারবছরের নাতির হার্টের সমস্যা, হাসপাতালে ভর্তি। মিঃ ঘোষ রোজ জানালার পাশের সিটে বসে অফিস থেকে বাড়ি ফেরেন, আগে গোটা বেঞ্চ জুড়ে তার বন্ধুরা বসে থাকতো, এখন তিনি বাদে সকলে অবসর নিয়েছেন। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছিঁটে আসছে, সেই জলে ভিজছে একটি ছেলে, তার মাথায় তখন হাজার চিন্তা, বাড়িতে গিয়ে কি জবাব দেবে! একের পর এক চাকরির পরীক্ষা দিয়ে বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। বাল্যবিবাহের শিকার একটি মেয়ে শশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। একটি পকেটমার ওৎ পেতে বসে আছে এক মহিলার ব্যাগের দিকে চেয়ে। এককোণে ট্রেনের মেঝেতে বসে এক ভিখারি সারাদিনে পাওয়া টাকার হিসেব করছে। খেলনা বিক্রেতা একজন হকার, সেই সাতসকালে বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছিলো, সারাদিন হেঁটে পা অবশ হয়ে আসছে কিন্তু তাকে থামলে হবে না, এখনও সামনের দুটো কম্পাটমেন্টে যাওয়া বাকি। ---- এইরকম হাজার হাজার গল্প জমে আছে ট্রেনের প্রতিটি জানালায়, প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি রন্ধ্রে।
প্রতিটি স্টেশনে কিছু গল্পের সমাপ্তি ঘটে...আবার কিছু নতুন গল্পের সূচনা হয়। প্রতিটি গল্প সযত্নে তুলে রাখে ট্রেন। এইভাবে দিনের পর দিন গল্পের পাহাড় বহন করে এগিয়ে চলে 'চলমান মিউজিয়াম'।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ আগে ৷ যেন কোনো জাদুমন্ত্রের ইশারায় চারিদিক থেকে সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা বেরিয়ে এসে একে একে সবকিছুকে গ্রাস করছে ৷ প্রথমে পূর্বদিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে মাঠ, ধানক্ষেত, পুকুর, ডোবা খাল ; তারপর একে একে রাস্তাঘাট, গরু-ছাগল, ঘরবাড়ি...এইভাবে সমস্ত গ্রামকে গ্রাস করে ফেললো ৷ খেলা শেষ হলে একে একে ছেলেরা বাড়ি ফিরে গেছে কিন্তু একটি ছোটো ছেলে তখনও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তার পরিবারের জন্য অপেক্ষা করছে ৷ তার পরিবারের সবাই মাঠে গেছে ধান কাটতে, তখনও ফেরেনি ৷ কুয়াশাচ্ছন্ন মাঠে তাদের দেখা যাচ্ছে না ৷ এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে, সাথে সোয়েটার নিয়ে আসেনি, ঠান্ডা পড়েছে খুব ৷ রাস্তার উপর তাদের গরুটি বাঁধা, ঠান্ডা হাওয়ায় সেও কাঁপছে ৷ মাঠের দিকে কয়েকবার চিৎকার করে ডাকতে গিয়ে ফল হল না, খেলার সময় এত চেঁচামেচি করেছে যে গলা থেকে জোরে শব্দ বেরোচ্ছে না ৷ এদিকে গরুটিকে একা রাস্তায় ফেলে সেও বাড়িতে যেতে পারছে না, তাছাড়া বাড়িতে একা একা বড্ড ভয় করে তার ৷ নিরুপায় হয়ে গরুর পাশে দাঁড়িয়ে মশা তাড়াতে থাকে ৷ পাশেই একটা গাছের ডালে বসে একটা ছোট্ট পাখিও ডেকে চলেছে অনেকক্ষণ থেকে; হয়তো তার মা-ও ফেরেনি ৷
বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যায়
"ডুবছে না তো হৃদয় শুধু একলা থাকার সুখে..."
পাশের বাড়ির রেডিও থেকে হালকা শব্দে গানটা ভেসে আসছে। কাত্ হয়ে শুয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে অনিন্দ্য। সূর্য যেন ফাঁকি দিয়ে একটু আগেই ডুবে গেছে আজ। পশ্চিম আকাশের লাল আভাটাও প্রদ্বীপের শেষ নিঃশ্বাসের মতো নিভে আসছে। আকাশের মনটাও আজ খারাপ, মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে মাঝে মাঝে নিঃশব্দে বৃষ্টিধারায় কাঁদছে। জানালার সামনেই মেহগনি গাছের একটা সরু ডাল, তার কয়েকটা পাতা কনে কনে ঠান্ডা হাওয়ায় ঠকঠক করে কাঁপছে। হু হু করে ভেজা হাওয়া ঘরে ঢুকছে, সাথে বৃষ্টির জলের ছিটে। ভিজিয়ে দিচ্ছে সব কিছু: হ্যাঁ সবকিছু! অনিন্দ্যের চোখ দিয়ে জলেরধারা গড়িয়ে পড়ছে বিছানায়।
দিনের শেষে, শেষ পাখিটা যখন বাসায় ফিরছে তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকের নানা ফুলের গন্ধে ভরে গেছে, বসন্তের বাতাস। মেঘমুক্ত আকাশ তারায় ঝকমক করছে। দক্ষিণা বাতাস উষ্ণ পরিবেশকে শীতল করছে, দূরে পুব আকাশে চতুর্দশীর চাঁদ উঠেছে। বাসায় ফেরার সময় এইসব দৃশ্য সে রোজ দেখে, নতুনত্ব কিছুই নেই, কেবল একটা ব্যাপার ছাড়া ; রাস্তার পাশে একটা পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে মাঠের ওপারে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। কয়েকমাস বাড়িতে শয্যাশায়ী তারপর হাসপাতাল, ডাক্তার, অপারেশন, বিশ্রাম এইসবের জন্য কেটে গেছে প্রায় একবছর। আজ এতদিন পর সে ছাড়া পেয়েছে।
ঝমঝম করে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো। মাঝে মাঝে জল জমা রাস্তায় শহরের আলো পড়ে ঝলসে দিচ্ছে ট্রেনের জানালাটা। একটু পরে আলোগুলো ট্রেন থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। তারপর একদম জোনাকির মতো।
সেই জোনাকি মতো আলোগুলো এই বর্ষার সন্ধ্যায় এক আলোকসজ্জা তৈরি করছে, একই ছন্দে চলছে। স্থির আলোগুলো বাড়ি থেকে আসছে আর চলমান আলো গুলো গাড়ির সারি। তারপর আলোর সংখ্যাও কমতে লাগলো। মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়া জোর করে ট্রেনে ঢোকার চেষ্টা করছে। সাথে একটা খুব পরিচিত গন্ধ, প্রিয় গন্ধ, বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ!
রাতের আকাশের দিকে তাকালে আজও অনেক স্মৃতি জড়িয়ে ধরে। ওই তারাদের সাথে বন্ধুত্বটা সেই ছোটোবেলা থেকে।
গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে পড়তে, ঘেমে ভিজে যেতাম, মা হয়তো পেছনে বসে তালপাতার হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছে। বেশি গরম লাগলে, ছুটি পেতাম একটু তাড়াতাড়ি, তারপর মাঠের পাশে গাছ তলায় বসে স্নিগ্ধ বাতাসের শীতল স্পর্শের আরাম উপভোেগ। রমরমিয়ে চলতো বড়দের সাংসারিক গল্প আর ছোটোদের মাদুরে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সদ্য পরিচিত ধ্রুবতারা, শুকতারা, সপ্তর্ষিমন্ডল, কালপুরুষকে আরও একবার চিনে নেওয়ার খেলা।
ও মাঝি রে...
শরৎকাল ৷ সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে এসেছে ৷ জোয়ার উঠছে ৷ মাঝি পান্তা খেয়ে নৌকার পাটাতনের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে ৷ বুকের উপর দিয়ে একদল মেঘ পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে উড়ে যাচ্ছে ৷ মেঘের আড়ালে কয়েকটা গাংচিল সূর্যের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এগিয়ে চলেছে ৷ এই নদীই মাঝির পৃথিবী আর নৌকা তার মা ৷ জল থেকে মাছকে তুলে নিলে যেমন মাছ মরে যায়, মাঝি ভাবে এই নদী আর নৌকার বাইরে তারও কোনো অস্তিত্ব নেই ৷
প্রতি ঝড়-জলের রাতে প্রকৃতি তার পরীক্ষা নেয়, সত্যিই সে দক্ষ মাঝি হয়ে উঠতে পেরেছে কি? শক্ত হাতে সে দাঁড় ধরে বসে থাকে, বর্ষার তীরের ফলা তাকে বিদ্ধ করলেও পরাস্ত করতে পারে না ৷ এই পরীক্ষায় পাশ করলে তার জন্য তাকে পূর্নিমার রাত, বড়োলোক বাবুরা যেমন পার্টি করে কোনোকিছু উৎযাপন করে, এটাও ঠিক তেমনি ৷ আকাশ জুড়ে ঝিকিমিকি তারার আলো ৷ কোমল জোৎস্না মাঝির সেই পুরনো জখমে মলম লাগিয়ে দেয় ৷ কয়েকটা রাত জাগা পাখি এসে জানিয়ে যায় রাত হয়েছে অনেক ৷ আলো আঁধারি আকাশে মেঘের দৌড়ঝাপ দেখতে দেখতে মাঝির চোখ বন্ধ হয়ে আসে ৷ ঘুমের ঘোরে মাঝির মনে হয় সে যেন মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ৷ ভাগ্যবান মাঝি জগতের যত লোকজন-কোলাহল, মারামারি-দাঙ্গা, রাজনৈতিক কলহ থেকে মুক্ত ৷ তার জন্য আছে অথৈ জল আর অসীম আকাশ ; যা বহু মানুষের কল্পনার জগৎ ৷
৮ অক্টোবর ২০২০
«« গৃহবন্দীর গান »»
দেশজুড়ে চলছে এখন
চতুর্থ দশার গৃহবন্দী;
সবাই এখন বুঝতে পেরেছে
প্রকৃতির এই দারুন ফন্দি৷
বন্ধ সব কলকারখানা
পরিবেশদূষণ কমেছে আজ;
নিত্যদিনের শ্রমিকদের
কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ৷
সন্মান বাঁচাতে মধ্যবিত্ত
পারে না তো নিতে অনুদান;
পেটের মধ্যে ক্ষিদের আগুন
নেভানোর উপায় খুঁজতে হয়রান৷
ভাইরাস এলো পৃথিবীতে
নিয়ে মানুষ নিধনের দীক্ষা,
যেতে যেতে শিখিয়ে গেলো
মানুষকে দারুন এক শিক্ষা৷
ভিন্ন ভিন্ন মর্যাদা সবার
দাবার বোর্ডে সাজানো তারা,
খেলার শেষে কাঠের বাক্সে
মন্ত্রী-পেয়াদাও ক্ষমতা হারা৷
খাঁচা বন্দী মানুষ এখন
বন্যপ্রাণীরা সবাই স্বাধীন,
মন্দির মসজিদ গীর্জা বন্ধ
সবাই এখন ডাক্তারের অধীন৷
বাকি সকল দেশবাসীর মতো
আমিও এখন গৃহবন্দী আছি৷
এই কিছুদিনে আসতে পেরেছি
প্রকৃতির আরও একটু কাছাকাছি৷
ছোটোবেলায় দেখা গ্রামটাকে
এখন যেন নতুন লাগে আবার,
মাঠের মাঝে, গাছের ছায়ায়
স্মৃতিরা জীবন্ত হচ্ছে বারবার৷
জন্ম আমার অজ পাড়া গাঁয়ে
ছোট্টো গ্রামের নাম পূবেরঘেরী৷
ছোটো থেকেই এখানে আছি
তবুও কেন চিনতে হল দেরি?
নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়
জন্ম যে আমার এই গ্রামেই,
কবির বর্ণনা নিশ্চয়ই দেখতাম
বছর পঞ্চাশ আগে জন্মালেই৷
তবুও জসীমউদ্দীন পড়ে
কোণে কোণে খুঁজে ফিরি,
আমার ছোট্টো গাঁয়ের সাথে
পল্লিকবির গাঁয়ের তুলনা করি৷
গাছের শীতল ছায়ায় বসে
ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি,
প্রতি জন্মে বারবার যেন
এই ছোট্ট সবুজ গ্রামে ফিরি৷
১৮ মে ২০২০
করোনার আতঙ্ক নয়, বসন্তের রঙিন গল্প
করোনা জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্ব ৷ তার তান্ডবে তোলপাড় উন্নত দেশগুলির চিকিৎসা ব্যবস্থা ৷ স্কুল-কলেজ-কর্মক্ষেত্র সব বন্ধ ৷ অন্যসময়ের জনবহুল রাস্তা গুলো এখন শশ্মানের মতো জনশূন্য হয়ে গেছে ৷ থেমে গেছে সমস্ত ব্যস্ততা-সভ্যতা ৷ প্রায় দুশো কোটি মানুষ ঘরবন্দী ৷ এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নাজেহাল এই পৃথিবী ৷
এদিকে একটি বসন্ত নিঃশব্দে বিদায় জানাচ্ছে, সেদিকে লক্ষ্য করার সময়ই নেই ৷ কোকিলের ডাক নয়, টেলিভিশনের খবরে সবার কান আটকে গেছে ৷ বসন্তের প্রেম নয়, সবার চোখে করোনার আতঙ্ক ৷
এই মহামারির কবলের বাইরে একটা ছোট্টো পৃথিবীর বসন্তের গল্প:
সেখানে লকডাউন আর নিত্যদিনের জীবন যাত্রার মধ্যে পার্থক্য খুবই কম ৷ বসন্তের শেষের দিক, গ্রীষ্মের দাবদাহ তখনও শুরু হয়নি ৷ সূর্য সবেমাত্র অস্ত গেছে কিন্তু পশ্চিম আকাশ তখনও রক্তিম ৷ বামদিকে সারি সারি গাছের মাঝে একটা পুকুর আর ডানদিকে নরম সবুজ ঘাসে ঢাকা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ ৷ আশেপাশে জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই ৷ পুকুর পাড়ের পুরু ঘাসের আস্তরণের উপর আয়েশ করে বসা যায় ৷ পুকুরের উপর থেকে আসা শীতল হাওয়ার স্পর্শে শান্তির আশ্বাস ৷ কোকিলের ডাক শোনা যায় মাঝে মাঝে ৷ দমকা হাওয়া, দীর্ঘ নারকেল গাছগুলোর মাথা দুলিয়ে দেয় ৷ মাথার উপর খোলা আকাশে, ঘরে ফেরা পাখির আনাগোনা ৷ পুবের আকাশে উজ্বল তারাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে ৷ পশ্চিম আকাশের বাতিও ধীরে ধীরে নিভে আসে ৷ দূরে দিগন্ত রেখা কালো হয়ে আসে আর তার বুক চিরে জোনাকির মতো বেরিয়ে আসে বিভিন্ন বাড়ি, রাস্তার আলো ৷ ইতিমধ্যে ঝিঁ ঝিঁ ডাকতে শুরু করে ৷ দেখতে দেখতে সমস্ত আকাশ জুড়ে তারা ফুটে উঠে, যেন এক অস্পষ্ট ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ৷ দূরে কোথায় যেন কয়েকটা শিয়ালও ডেকে উঠে ৷ হাওয়ার মধ্যে তখন শীতলতার স্পর্শ ৷ পুর্বদিকের মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ উঁকি দেয় ৷ পুকুরের ওপারে অনেকগুলো গাছ পাশাপাশি দাড়িঁয়ে একটা জঙ্গল তৈরি করেছে, তার মধ্যে থেকে ভেসে আসে নিশাচর পাখির ডাক ৷
চাইলে পুকুর পাড়ে পায়চারি করা যায় কিছুক্ষণ ৷ তারপর মাটির বাড়িটার উঠানে মাদুর পেতে বসে দেখা যায় এক অপরূপ দৃশ্য ; মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে চাঁদ তখন সমহীমায় আকাশে বিরাজ করছে আর সামনের ধূ ধূ প্রান্তর, জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে ৷ মাঠের মাঝে ইলেকট্রিকের খুঁটি গুলি যেন সারি দিয়ে এগিয়ে চলেছে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ৷ পাশেই একটা পেঁচা ডেকে ওঠে ৷
যে প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে পারে, তার একাকিত্ব অনুভূত হয় না ৷
২৬ মার্চ ২০২০