বনলতা
কথা ছিল—
একদিন বনলতা হবে
তার ছোঁয়ায় হিতাহিত লোপ পাবে আমার…
গোধূলি বা উষায়
অথবা
সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি
ঝিলমের স্রোতে
জলের পোশাকে
খাপখোলা ক্ষুরধার তরবারি হবে
আরও আরও অন্ধকারে
বিদর্ভ নগরে
বন্য বিছানায়
বাকল-বিহীন চিরহরিৎ
সারা গায়ে সবুজ ধূসরতা
সব পরিচয় মিথ্যে মনে হয়
তখন
পৃথিবীর গোপন গহনে
শুধু বনলতা তুমি
বনলতা বনলতা
আমার বনলতা তুমি…
প্রকাশ : 'এবং সায়ক', ২০২৩
অলংকরণ : অরিজিৎ মান্না
১৮-০৭-২০২১-এ সাহিত্য সৃজনীর আসরে পঠিত কবিতা
(১)
পায়রা-যাপন
তবে তাই হোক
চলো পায়রা জীবন শুরু করি
করোনা-মরসুমে
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে
শুষে নিই বন্য মাদকতা
বাহারি মাস্কের গহনে
অনর্গল বকবকম
শান্তির অভিজ্ঞান
দুধ-সাদা পায়রা-যাপনে
চলো নিস্তব্ধ লকডাউন লগ্নে
খড়কুটোয় সাজাই
আমাদের ঘুলঘুলি-বাসর
মাসভর লুটোপুটি…
খসে যাবে এক একটা পালক
নির্ভার হবো…
আরও হাল্কা…
ডানার আড়ালে
গোপন চিঠি
একদিন উড়ে যাবো ঠিক
চলো পায়রা জীবন শুরু করি
চলো একদিন ঘুরে আসি পায়রা ডাঙা…
(২)
প্রতীক্ষা
সমুদ্রে বৃষ্টি নামুক
হাতের মুঠো ভরে যাক বিন্দুবিন্দু ঘামে
দুচোখ জুড়ে ভাসানের স্বপ্ন জেগে থাক
কুসুম ফুটবে আগামী মরশুমে
(৩)
বনলতা
হাজার বছর ধরে
পিঁড়ি পেতে বসে আছি
দারুচিনি দ্বীপে
সে কথা ভেবেছো তুমি ?
কখনও জেনেছো কবি
ক্লান্তিহীন অপেক্ষার মানে ?
কেশবতী কন্যারা নক্ষত্রের আয়ু নিয়ে
কী আশায় বেঁচে থাকে
ব্যথিত আঘ্রাণে
হে আমার সংসার-সখা
বুঝিবেনা কোনোদিন
বুঝিবেনা—
তোমার অ্যানড্রয়েড যাপনে...
(১১-০৭-২০২১)
(৪)
কাক
গ্যালারিতে ঢুকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। বুকের ধড়ফড়ানি কমতে আরও কিছুক্ষণ। ক্যনভাস থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়াতে হয়। নাহলে জ্বলে ওঠার ভয় থাকে। জ্বলাপোড়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, সতর্ক দূরত্ব থেকে ছবির দিকে তাকাতে হয়। তা সত্ত্বেও রং-রেখার রহস্যময় উৎসার সারা শরীর আন্দোলিত করে।
তুমি বলেছিলে একটা ছবির হাজার রকম ব্যাখ্যা হয়। কোনও ব্যাখ্যাই এল না আমার মাথায়। নিজেই নিজে শুধু ছটফট, রক্তের ভিতর তোলপাড়, উথালপাথাল সব। পিছোতে পিছোতে দেওয়ালে ঠেকেছে পীঠ।
শুভাদা, তোমার কাক যে আমার চোখ দুটোকেও গিলতে চায়।
(৫)
বোধ-ই বৃক্ষ
বৃক্ষেরও একটা সরল ভালোবাসা থাকে
সময় হারিয়ে গেলে সব ছবি স্মৃতি হয়ে ভাসে
আয়ুর অন্তিমে এসে চুপিসারে তুলে ধরে কীর্তিছাপ
স্মৃতির ঘনিষ্ট উত্তাপ জেগে থাকে সারাক্ষণ শাখায় শাখায়
বৃক্ষেরও একটা স্মরণশক্তি থাকে
হে অশত্থ,
কার স্পর্শ তোমায় মহৎ করেছে ?
আর এক দৃশ্য
সন্ধেবেলা ঘরে ঢুকে দেখি দাদুর ছবির সামনে
ঠাকুমা বিড়বিড় করছেন
পিঠে হাত রেখে বলি—“ঠাকুমা”
—“শিবনাথের মৃত্যুর পর নীলিমা আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে
কিষাণভোগ গাছের সবকটা মুকুল এবারও কুয়াশায় ঝরে গেছে...”
টাট্কা ফুল আর ধুনোর গন্ধ ঘর জুড়ে
জানলা দিয়ে সাদা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে ঠাকুমার উপর
পিঠে হাত রেখে বলি—“ঠাকুমা”
—“কাল সুনীলের বাড়ি গেছিলাম। শরীরটা আরও
খারাপ। ছেলে শহরে চলে যাওয়ার পর
বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
জানো কালো গাইর বাছুরটা এবারও দু-ঘন্টা বই বাঁচল না...”
ঠাকুমা মগ্ন তাঁর জগতে। আনন্দ বিষাদের কোনও চিহ্ন নেই মুখে
আমি ছবির দিকে তাকাই
দাদুর চন্দনলেপা এক চোখে গভীর নিঃসঙ্গতা
অন্য চোখে পরম নির্ভরতা
মুখমণ্ডলে পবিত্র নীরবতা
ঠাকুমা মাটিতে মাথা ঠুকে প্রণাম করলেন
—“ও নরকেষু সমস্তেষু যাতানাসু চ যে স্থিতাঃ”
তাঁর উচ্চারিত মন্ত্রে আরও গম্ভীর হল ঘরের স্তব্ধতা...
কারো কারো সঙ্গ
কারো কারো সঙ্গ অদ্ভুত ভালো লাগে
হৃদয়ে কাঁপন শুরু হয়
স্ববিরুদ্ধ প্রশ্নগুলো চারিয়ে যায় শরীরে
নিজেকে খুঁজতে ভালো লাগে
কারো কারো কথার ভিতর
মুখ লুকিয়ে ঘুমোতে ভালো লাগে
অনেকেরই সামনে এলে শ্বেতপাথরের মতো
ঠাণ্ডা ও পবিত্র হয়ে ওঠে সকল সত্তা
সকলের নয়, কারো কারো সঙ্গটাই সঙ্গীত হয়ে যায়
বোধ অথবা উৎস সন্ধানে
স্থির অথবা আরও স্থিরতায়—
চেয়ে দেখো
লুম্বিনী বন, নৈরঞ্জনা নম্রতায় জঙ্গলের গাছ
বটের সানু ও শিখর, পরিযায়ী প্রেম
মহালের ওপার থেকে ভেসে আসছে
জন্ম-জন্মান্তর— বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি...
জীবনের সকল পরাজয় থেকে দূরে
বৃক্ষই বোধ, প্রচ্ছন্ন প্রতীকে
চন্দনকাঠের কলম
চন্দনগন্ধ ঢেউ ছুঁয়েছে হৃদয়
ক্রমশ পবিত্র হচ্ছি
ক্রমশ শিল্পিত হচ্ছি
পাতায় পাতায় নীলাভ অক্ষর
কাঁপাকাঁপা আঁকিবুঁকি ভাঙাচোরা রেখা
অবিকল কবিতার মতো
অবিকল শিল্পের মতো
এ কলমে সমুদ্র জেগে আছে
এর কালি কখনও ফুরোবে না
‘পুরী’-আঁকা চন্দনকাঠের কলম
কে তোমাকে শিল্প করেছে ?
স্বরলিপিহীন গান
ফুটপাথ ধরে হাঁটছি অস্পষ্ট আলোয়
এখনও সুস্থ হইনি জানাচ্ছে চিনচিনে ব্যথা
কোনও শব্দ না করে সংকেত দিয়েছে মৃত্যু আসন্ন
ধীরে ধীরে বদলে গেছে মুখের আদল
আমার সামনের রাস্তা রোধ করেছে—
অকালবৃদ্ধ গাছ-ডাল-লতা-পাতা
কিছু স্বরলিপিহীন গান নিষ্প্রভ ছিল মুখে!
একটিই কবিতা
১
গতরাতের খুন-রক্ত
কালো পিচে এখনও সতেজ
২
শীতরাতে কালভার্টে সদ্যজাত
কুকুরছানা মানুষের চেয়ে ঢের স্বাস্থ্যবান
৩
ঘরদোর সব লণ্ডভণ্ড
বোমা ও খাবার একসাথে উড়্ছে হাওয়ায়
এ বড় মজার কাণ্ড
৪
নধর ছাগলটা মাথা মুড়োচ্ছে আকাশমণির
বিশ্বপরিবেশ দিবসে মন্ত্রীর হাতে পোঁতা
৫
প্রকৃতি কোথায়
পলিব্যাগ চারপাশে
৬
প্রতিটি বিমান এক একটা উড়ন্ত কফিন
যার ভিতর জীবন্ত লাশ খেলা করে
বিড়াল
একটা বিড়ালকে নিয়ে বড় সমস্যায় পড়েছি
রান্নাঘর থেকে পড়ার টেবিল—স্বচ্ছন্দ গতিবিধি তার।
আমার কালির শিশি উল্টে দেয়
কলম চিবোয়
বইখাতায় আঁচড় দেয়
লাঠি নিয়ে ভয় দেখালে বাঘের মতো চোখমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসে।
অগত্যা সমার্থ শব্দকোষ খুলে স্তবপাঠ করি—
বেড়াল বিড়াল বিল্লি মার্জার মেকুর পয়স্য অকরোটি ব্যাঘ্রস্য বাঘের মাসি মা ষষ্ঠীর বাহন...
তার ম্যাওম্যাও মিউমিউ বাড়ে। বুঝি অন্য মন্ত্র চাই।
ফার্দিনান্দ দ্য স্যসুর তো নেই; ভাবছি নোয়াম চমস্কির কাছে যাব—
অগত্যা পবিত্র সরকার
উত্তর-আধুনিক এই বিড়াল পাণিনিকে গ্রাহিই করে না!
একটি চারাগাছ এবং
ক্রমশ বড় হয়ে ওঠে তোতন, আমার সন্তান
এত নিষেধ সত্ত্বেও সে খেলতে থাকে— ছুটতে থাকে
আর, এই খেলতে খেলতে— ছুটতে ছুটতে বড় হয়ে ওঠে তোতন
আমার সন্তান।
ঠিকঠাক খাওয়াই শোওয়াই
যত্ন-আত্তি সব
হোঁচট খেলে ব্যান্ডেজ বাঁধা তাও আমায় করতে হয়
সময়ের বৃত্ত ভেঙে তার সব ভালো— সব মন্দ
আমার অস্তিত্বে মিশে যায়
যতই দূরে থাক ও পা ফেললেই স্পন্দিত হই আমি।
এত সতর্কতার মধ্যে আক কানামাছি খেলতে গিয়ে
আমার পাঁচ বছরের তোতনের মাথা ঠোকে গাছে।
ওর প্রথম জন্মদিনে বাবার হাতে পোঁতা চারাগাছ
যত্ন নেই আত্তি নেই অবাঞ্ছিত গাছ
এতদিন তার কথা মনেও পড়েনি
আজ দেখি—
সে গাছ তোতনের থেকে বড়
আমার থেকে বড়
আমার বাবার থেকেও...