অমৃত:১

ভূপেন বসু এভিনিউ 

...ঐ মন্ত্র বা ধ্বনি বয়ে যায় স্মরণের পথে, তাই মনে মনে মন্ত্র বা জপ সদা-সর্বদা স্মরণে দৈহিক, মানসিক সর্বদিকে যে ফল হয়, ঐ সমস্ত যোগাভ্যাসে যা না হয় তা হয় এই মন্ত্র জপ ও স্মরণে। 

এক রবিবার ক্লাসে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন― তোমাদের যার যা জিজ্ঞাসা আছে, জিজ্ঞাসা করে নাও।

ভক্তদের মধ্যে একজন বললেন— প্রভু, তোমার প্রদত্ত মন্ত্র যারা পেয়েছে, তাদের দর্শন তো নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু মনের মধ্যে পাপবুদ্ধি তো সব সময় থাকছে। কিভাবে এসব ক্লেদ থেকে মুক্তি পেয়ে তোমার বা ভগবৎ কৃপা লাভ করা যায়?

উত্তরঃ শ্রীশ্রী ঠাকুর— মুক্তির মন্ত্র মুক্তি হওয়ার জন্যই। মুক্ত পুরুষের প্রদত্ত মন্ত্রেই মুক্তির পথ সহজ হয়। তার কাছে ক্লেদ, পঙ্কিলতা ও পাপ অতি নগণ্য। তাই, তোমাদের ওগুলো ভাববার নয়, যদিও সংস্কারবদ্ধ মনে ওগুলো আসা স্বাভাবিক। তোমাদের উপর এমন কোন নির্দেশ দেওয়া নেই যার জন্য এগুলো ভাবতে হবে। তোমাদের উপর শুধু এই নির্দেশ যে, মেঘে আচ্ছন্ন সূর্য থেকে মেঘকে পরিষ্কার করার জন্য তোমাদের ব্যবস্থা অনাবশ্যক। সূর্যের তেজেই মেঘ অপসারিত হয়। তোমাদের ভিতরের অজ্ঞানতারূপ কেদাচ্ছন্ন ভাবগুলো ভিতরের শক্তি হতেই তৈরী তোমাদের দেওয়া গুরু প্রদত্ত মন্ত্রশক্তি হতেই ঐ ক্লেদগুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে। তেজ থেকে জীবলোক সৃষ্টি, সেই তেজই হল মন্ত্র। সেই মন্ত্রবলেই ভিতরকার অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেলে, তোমার চলার পথ অতি সহজ হয়ে যাবে। তোমরা তারই পথিক ও যাত্রী। মুক্তাকাশে তেজদীপ্ত সূর্যদেব সেইভাবে সব ক্লেদ পরিষ্কার করে জীবলোক ও পৃথিবীকে আলো দান করে থাকে। এই আলোই হল জীবের জীবন ও প্রাণ। তোমরা তারই তৈরী বস্তু। তারই তৈরী যে মন্ত্র, মন্ত্রের অর্থে রয়েছে সমস্ত বিশ্বের ইচ্ছাশক্তি ও কল্যাণশক্তি। তোমাদের সাধারণ ইচ্ছা ও বুদ্ধিতেই এই মহামন্ত্র জেগে উঠবে। ইচ্ছাশক্তির ইচ্ছাতেই জগৎ সৃষ্টি। আবার জীবলোকের ইচ্ছাতেই ইচ্ছাশক্তির সাথে এক শক্তি হয়। তোমাদের ভিতর যত অনিচ্ছার ভাবই আসুক না কেন, তোমাদের শুধু কর্তব্য তোমাদের সাধারণ ইচ্ছাটা জপ করার কাজে ও স্মরণে যাতে লাগাতে পার তারই প্রচেষ্টা। সফলতা নিয়েই এই জীবলোক সৃষ্টি হয়েছে, তাই সফল না হওয়ার কোন কারণ নেই। মাঝে মাঝে যে অসফলতার ধাক্কায় পড়তে হয়, সেটা হল আমাদের চলার পথের সঙ্কেত মাত্র। তালে তাল না মিললে যেমন তাল মেলাবার চেষ্টা থাকে, এই চেষ্টা হল মেলে নি বলে মেলানোর চেষ্টা। তেমনি জীবনের অসফলতা হল সফলতার দিকে অগ্রসর হওয়া। যদিও মাঝে মাঝে অসফলতা ও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের চাপে বিব্রত হয়ে, হতাশ-নিরাশের মাঝে পড়তে হয়। তখন পথিক ক্লান্ত হয় ঠিকই, তার পৃথিবীতে এক মুহূর্ত থাকবার বাসনাটাও চলে যায়, কিন্তু হে পথিক! সবই তোমার কথা মানি, তুমি যে একদিন একেবারেই চলে যাবে তার চেয়ে বেশী ক্লান্ত তো হও নি। তবে তোমার যেগুলো আসছে সেগুলো হল মৃত্যুর পথের বন্দনা। তিল তিল করেই তো শেষ হতে হবে, হতাশ-নিরাশ, ঘাত-প্রতিঘাত, রোগ-শোক তারই তো একটা ইঙ্গিত।

তুমি যাবে একথা তুমি যখন ভালভাবেই জান, তখন তোমার সঙ্কীর্ণতার বেড়াজালে বসে থাকা কি উচিত? জাহাজ এখনই ডুববে, সময় আর নেই, যাত্রীরা তখন ধন সামলাবে না প্রাণ সামলাবে? প্রাণের কাছে ধন অতি তুচ্ছ হয়ে যায়। তখন উদার মনোবৃত্তি হওয়ার জন্য নির্দেশ দেবার প্রয়োজন হয় না, প্রাণের টানে আপনি উদার হয়ে যায়। তেমনি জাহাজ না হয় তখনই ডুববে জানলে। তোমার আজ হোক, কাল হোক যেতে হবে অনিবার্য, এর উপর তোমার কোন হাত নেই। এখন তোমার কি করা কর্তব্য? হতাশ নিরাশ হয়ে সব নষ্ট করে তো কোন লাভ নেই। পথিকের দরকার কিছু পাথেয়। স্রষ্টা তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, পাথেয় দিয়েছেন হাতে নাও, তারপর তুমি চল। ঐ পাথেয় বা সম্বলই তোমার চলার পথ সহজ করে দেবে। আমাদের জীবনের সব জটিলতার হাত থেকে ঐ পাথেয় মুক্ত করে দেবে। কারণ, এর আগেই বলেছি, তোমরা মুক্তজীব, মুক্ত হতেই জীবলোকে তোমরা এসেছ। পাথেয় যখন আছে, যাত্রীরা যাত্রা শুরু কর। সব অন্তরায় মেঘের মত কেটে যাবে তোমারই মুক্ত মন্ত্রের প্রভাবে। প্রতিদিন আজ্ঞাচক্রে ত্রিনয়নে উদয় এবং অস্তে সূর্যকে দেখতে পাচ্ছ। জীবনের উদয়াস্ত এই ভাবেই হয়ে যাচ্ছে। নির্ভীকভাবে নির্ভর করে শরণাগত হয়ে মনে-প্রাণে গুরু প্রদত্ত বীজ দেহবীণাযন্ত্রের সুরে সুর মিলিয়ে গেলে তখন বীণাযন্ত্রে সেই মন্ত্র ধ্বনিত হবে। তোমার যন্ত্র তোমার মন্ত্রের সুর দিয়ে যাবে। তোমাদের দেহ-মন সেই সুরেতেই গড়া। তাই তোমাদের দেহ-মনে যত যা কিছু আবিলতা আসবে ওগুলো সুরেরই ঝঙ্কার মাত্র। তুমি যখন সুরেই প্রতিষ্ঠিত, সুরেতেই প্রতিষ্ঠালাভ করবে, এটাই তো নিয়ম।

প্রশ্নঃ  প্রভু, আমাদের জপ করবার নির্দিষ্ট সময় কোন্‌টা?

উত্তরঃ শ্রীশ্রী ঠাকুর— দেহে যতক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস আছে, ততক্ষণ পর্যন্তই সময়। তার উপর শেষ রাত্রে বসে জপ করার অভ্যাস করবে। ঘুমোবার সময় জপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়বে। এমনি যখনই সময় পাবে, তখনই একটু জপ করবে। হাঁটা-চলার পথেও জপ করবে। একবার শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে চালু করে ফেলতে পারলে, তখন শ্বাস-প্রশ্বাস নিজেই সে জপ করে নেবে। শ্বাস প্রশ্বাস যেমন স্মরণ করে টেনে ফেলতে হয় না বা নিতে হয় না, দৈহিক প্রক্রিয়ায় আপনিই সেই কাজ হয়ে যাচ্ছে, জপকেও সে সেই প্রক্রিয়ায় করে নেবে। শুধু প্রথম প্রথম অভ্যাসটা চালু রাখতে হবে। তারপর আর তত চেষ্টার প্রয়োজন হবে না।

প্রশ্নঃ  জপ করবার জন্য কোন আসনের প্রয়োজন আছে কি?

উত্তরঃ শ্রীশ্রী ঠাকুর— ব্যায়াম অভ্যাস করার সময় যেমন যন্ত্রের সাহায্য নিলে একটু তাড়াতাড়ি হয় এবং কাজ করার স্পৃহাও একটু হয়। এটাকে বলে স্থান মাহাত্ম্য, যে ব্যায়ামাগারে গিয়ে ব্যায়াম করব, যেখানে আমার ব্যায়াম করবার সর্বপ্রকার যন্ত্রপাতি রয়েছে। আসনও সেইরূপ তারই আর একটি অঙ্গ। একাধারে ব্যায়ামের কাজ হয়, আবার মনের একাগ্রতার জন্য আগ্রহ জন্মে। যন্ত্র সুরের সাহায্যকারী। সুরে পাকা হয়ে গেলে আর যন্ত্র লাগে না। মন্ত্রের বেলায়ও তাই। সময় সময় অনুষ্ঠানের সমূহ প্রয়োজন হয়, তারপর আর লাগে না। আসন শুধু বসে সুখাসন বা পদ্মাসন করে বসাটাই যে আসন তা নয়। দাঁড়িয়ে কাজ করাটাও একটা আসন। দেহ যখন যেভাবে থাকতে চায় বা থাকে সেটাই আসন তূল্য হয় এবং সেইভাবে আবার জপ-ধ্যান প্রযোজ্য। নির্দিষ্ট সময় করে নিয়ে বসা খুবই ভাল আবার বসে কাজ করার সময় পাওয়া গেল না বলে যে হবে না তা ঠিক নয়। তার আসন বা যোগ হবে পথে-ঘাটে সর্বত্র, ওগুলো সবই আসনের মত।

প্রশ্নঃ  অনেকে হঠযোগ, প্রাণায়াম, কুম্ভক ইত্যাদি নানা যোগ অভ্যাস করেন, কেন করেন আর করেই বা কি লাভ হয়?

উত্তরঃ শ্রীশ্রী ঠাকুর— সব কিছুর মুলে শরীরকে সুস্থ রাখাই হল প্রধান কথা। শরীর সুস্থ থাকলে তার দ্বারা সব কিছুই সম্ভব। শরীর সতেজ রাখার অনেক নিয়মাবলী আছে, যেমনি করে গাছ-গাছড়াকে সতেজ রাখা হয়। আলো, বাতাস, জল ও উপযুক্ত সার দিলে সেই বীজের গাছ সবল হয়ে ওঠে, তারপর হল রক্ষা করা। এই দেহকেও অতি দীর্ঘায়ু করা যায়। আমাদের ভেতর এমন কতকগুলো জিনিস আছে যেগুলো কোনদিনই ফুটবার অবকাশ পায় না। সেগুলো নানা প্রক্রিয়ায় ফুটিয়ে তুলতে পারলে, দেহ তখন মনে হবে অমরত্ব লাভ করল। ঐ যোগাভ্যাসগুলো ওর জন্যই। শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া নিয়ম মত করতে পারলে খুবই ভাল, তা না হলে আবার বিপদও হয়। আমাদের শরীরের ভিতর ক্যামেরার লেন্সের মত ছবি তুলে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। ওগুলো প্রস্ফুটিত হলে অনেক কিছু জটিল সমস্যার অতি অল্পতেই সমাধান হয়ে যায়। এই সমস্ত যোগাভ্যাস করতে হলে আমাদের সংসারের অনেক কাজের পক্ষে সমূহ অসুবিধা হতে পারে, আর আমাদের এখানে এটার চর্চ্চা নেই বলে সবার পক্ষে এ কাজগুলো করার সুবিধা হয়ে ওঠে না। তাই অতি অল্পতে সবটা যাতে আবার পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে হয়, সেটাই হল ধ্বনি। ঐ ধ্বনির পথই হল মন্ত্র। ঐ মন্ত্র বা ধ্বনি বয়ে যায় স্মরণের পথে, তাই মনে মনে মন্ত্র বা জপ সদা-সর্বদা স্মরণে দৈহিক, মানসিক সর্বদিকে যে ফল হয়, ঐ সমস্ত যোগাভ্যাসে যা না হয় তা হয় এই মন্ত্র জপ ও স্মরণে। যোগ, প্রাণায়াম ইত্যাদিতে রক্ত ও শরীরের উপর কাজ করে থাকে। মনে মনে স্মরণে তাতে যে গর্জন অন্তর্নিহিতে থেকে যায় সেটা হল মেঘ গর্জনের মত। শূন্য আকাশে ধুম্রাকারে জলকণায় ভরা যে মেঘ তাতে রয়েছে বিদ্যুৎ ও গর্জন। শূন্যে কণাগুলোর মিলনশক্তিতেই হয় গর্জন, আলো ও বর্ষণ। মনও সেইভাবে শূন্য ও ফাঁকাকে আশ্রয় করে অবাধ গতিতে বহু কণাশক্তিকে একত্রিত করে, আমাদের ভিতরকার ইচ্ছা সেই মনের ধারাতে ধারা অনুযায়ী সমস্ত অণুগুলোতে ইচ্ছার প্রভাবে প্রভাবান্বিত করে মহাশূন্যের পথে স্পুটনিকের মত চলতে থাকে। অত দ্রুত গতিতে যায় বলেই এক সুর দেহের ভিতর থেকে আকাশ অবধি বয়ে যায়। ফলে সবটাই আবার ভাব, কল্পনা ও মন গড়ার উপরেই চলছে। চোখে দেখা যায় না, দেখানো যায় না, কল্পনায় এনে ভাবা যায়, সেটা বুঝে নেওয়ার মত অনুভূতি-সাপেক্ষ। এই অবগতির পথে যে যত দ্রুত গতিতে স্মরণ করে এই ধ্বনি বা মন্ত্র বা জপ করে নিতে পারবে তার দেহের সমস্ত কণাগুলো তত দ্রুত ঐ পথের পথিক হতে থাকবে। সাগরের জল চোখের আড়ালে আকাশে উবে যায়। তেমনি জীবলোক অণিমা, লঘিমা হয়ে সেই পথে চলে যায়। তাই ভিতরে জেগে ওঠে যোগ-ব্যায়ামের, প্রাণায়াম ইত্যাদি শক্তি। অনুষ্ঠানে যা না হয় তার চেয়ে শতাধিক বেশী হয়। অজগর সাপেরা বেশীর ভাগ ছয় মাস শিকার করে খায় আর ছয় মাস নিজ সাধনায় আহার যোগায়। সেটা যোগ প্রক্রিয়া দ্বারা। ওটা ওদের জন্মগত। ওদের জিহ্বা এমন এক জায়গায় রেখে দেয়, সেই জিহ্বা থেকে এমন একটা রসের সৃষ্টি হয় যা বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট। তাকে ত্রাটক যোগ বলে। সবার ভিতরেই আছে, অবস্থার উপর নির্ভর করছে সেগুলোকে জাগিয়ে তোলা। অতি সহজেই যদি খাবার মিলে যায় অত পরিশ্রম করে ওটুকু যোগানোর প্রয়োজন হয় না, শুধু সময় নষ্ট করা ছাড়া। শুনতে আশ্চর্য লাগে, এই রকম অনেক আশ্চর্য আছে। যদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দ্বারা বিভিন্ন কাজ করা হয় তাতে কম্বলের এক-একটি লোম বাছতে বাছতে কম্বল আর গায়ে দেওয়া যাবে না। তাই, আমাদের একটি পথ বেছে নিতে হবে, যে পথে সব কিছুকে পাওয়া যায়। পৃথিবীকে নিজের আলোকে আলোকিত করা সম্ভব নয়, সূর্যের প্রকাশেই আলোকিত হয়। পাত্র দিয়ে জল ঢেলে পৃথিবী ভাসিয়ে দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, যেটা আকাশের বারি বর্ষণে সম্ভব হয়।

*******

  ֎