ভাইজ্যাগের তৃতীয় সকাল । একটু দেরি করেই উঠলাম । ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোলাম সীমাচলম্ মন্দির দেখতে । শুরু হল পাহাড়ী পথ । গাড়ী কিছুটা ওঠার পর সুন্দর লাগছিল উঁচু থেকে দেখা ভাইজ্যাগ শহর । সমস্যা একটাই, এখানে গাড়ী দাঁড় করানো যাবে না । ফলে ছবি তোলার ইচ্ছে পূরণ হওয়ার জো নেই । বেশ কিছুটা ওঠার পর শুরু হলো মন্দিরের চৌহদ্দি । কিন্তু সেখানে পৌঁছেই ঠেক । জুতো, ক্যামেরা, মোবাইল – মন্দিরের ভেতরে কোন কিছুই নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই । অগত্যা সব কিছু কুমারজীর জিম্মায় রেখে আমরা এগোলাম মন্দিরের দিকে । এই মন্দিরে বেশ কিছুটা সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে হয় । কিন্তু আমার জন্যে সুখবর – প্রতিবন্ধি ও বয়স্কদের জন্যে লিফটের ব্যবস্থা আছে । আমার সাথে একজন সঙ্গীও থাকতে পারবে । কাজেই আমার ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম লিফটের দিকে । ওপরে উঠে দেখি বিশাল লাইন । আমি খুঁজে দেখতে চাইলাম কোন আলাদা লাইন আছে কি না । খুঁজে না পেয়ে শেষে দেখি একটা গেট – সেখানে ১০০/- টাকার টিকিট কেটে ঢোকা যায় । সেখানেও বেশ দুচারজন লাইনে । আমি একজন পূজারি গোছের লোককে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেশ করতে গেলুম – প্রতিবন্ধিদের কোন আলাদা লাইন আছে কি না । ও মা । লোকটা তক্ষুণি রেলিং সরিয়ে আমাদের দুজনকে স্পেশাল ভিআইপি গেট দিয়ে ভেতরে নিয়ে চলে গেল । একটু দূর থেকে দর্শনের ব্যবস্থা – নৃসিংহ দেবের মুর্তি । যদিও অনেকখানি দূর থেকে খুব ভালো বুঝতে পারলুম না । ঘুরে ঘুরে আরো কিছু বিগ্রহ দর্শন করে বেরোনোর মুখে ছোট শালপাতার বাটি করে খাসা ঘী-ভাত প্রসাদ দেওয়া হলো । আমরা বাপ-বেটিতে নততল বেয়ে নেমে এলুম নিচে । ও মা ! এসে দেখি আমাদের দলের বাকি পাঁচজন আমাদের জন্যে অপেক্ষারত ।
এখানে বলে রাখা ভালো – আমরা যদিও একান্তই পৌত্তলিক হিন্দু পরিবারের লোক, বাড়ীতে ঠাকুরঘরে নিয়মিত পুজো করি এবং সন্ধ্যেয় বাতি জ্বালি, কিন্তু আমাদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা নেই । আমরা নিয়মিত তারাপীঠ যাই । এক এক বারে চার পাঁচ দিনও কাটিয়ে আসি । কিন্তু ভিড় থাকলে সেদিন মন্দিরমুখো হই না । আমাদের বাকিরাও সেই নিয়ম পালন করে মন্দিরের বাইরে থেকেই প্রণাম করে চলে এসেছে । অবশ্য তারা ওই অসাধারণ ঘী-ভাত প্রসাদটা পায়নি । কিন্তু আমি আর আমার মেয়ে লোক ভালো । আমরা একবারও বলিনি – এ স্বাদের ভাগ হবে না ! সাত জনে প্রসাদ মুখে দিয়ে ফিরে এলাম গাড়িতে । এবার অবতরণ । দুঃখের বিষয় – ছবি তোলার মত কিছু পেলাম না ।
সে দুঃখ ঘুচে গেল পরের গন্তব্যটিতে গিয়ে । জায়গাটির নাম টেনেটি পার্ক । কৈলাসগিরির উল্টোদিকে সমুদ্রের ধারে গাছপালায় ঢাকা একটি অসাধারণ পার্ক । কনিষ্ঠ তিন সদস্য সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল জল ছুঁয়ে আসতে । আমরা চারজন ওপরে রইলাম । আমি নেমে পড়লাম ছবি তুলতে । প্রথমে ওপরে । তারপর কিছুটা নেমে । কিছুক্ষণ পরে বেশ কয়েক ডজন সেলফি তুলে আমাদের ছেলে মেয়েরা উঠে আসার পথে আমার সাথে দেখা । এবং – বায়না – আমাদের একটা ছবি তুলে দাও । দিলুম । (ছবি ৩০ থেকে ৩৩)
এরপর গাড়িতে উঠে প্ল্যান হলো লাঞ্চ খাওয়ার । আজ কোজাগরি লক্ষ্মী পুজো । আমার শ্যালিকা এদিন নিরামিষ খায় এবং ভাত খায় না । আমরা তাই সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিলাম – আজ আমরা আবার দশপাল্লায় সেই অন্ড্রা মিল খাবো । শুনে কুমারজীও খুব খুশি । যদিও আজ রবিবার, তাঁর আমিষ খাওয়ার দিন । কিন্তু তাতে কি ? পৌঁছতেই আগের দিনের স্টুয়ার্ড এগিয়ে এলো । তার মুখে এক গাল হাসি । এদিন আবার বেজায় ভিড় । রবিবার বলেই বোধহয় । আমাদের সযত্নে নিয়ে গিয়ে ভেতরের একটা ঘরে বসালো । অর্ডার হলো আট খানা অন্ড্রা মিলের । আমার শ্যালিকা অনুরোধ করলো – ভাতের বদলে তাকে যদি কচুরি দেওয়া যায় । তার অনুরোধটাই আগে রক্ষিত হলো । যে পরিমাণ কচুরি এলো তাতে রীতিমতো একটা পল্টন পোষা যায় । আগের দিনের মতোই থালা ভর্তি ছোট ছোট বাটি । অল্প স্বল্প এদিক সেদিক । আগের দিনের নিরামিষ পোলাও এর বদলে - ভেজ বিরিয়ানি । আগের দিনের দুটো ছোট ছোট পান্তুয়ার বদলে অন্য একটা মিষ্টি আর প্রত্যেকের জন্যে একটা করে পাকা কলা । বাকি সব খাওয়ার পরে আমাদের মধ্যে কয়েকজনের পেটে আর কলা খাওয়ার আর জায়গা ছিল না । আমি তাই দিব্যি সেগুলোকে প্যাক করে নিলুম । আগের দিনের মতোই অসাধারণ মিঠা পান এলো । আমি হাসিমুখে স্টুয়ার্ডকে বললুম - আপনাদের পানগুলো কিন্তু দারুণ । ও মা, সাথে সাথে একজন বেয়ারাকে কি নির্দেশ দিল । সাথে সাথে সে গোছাভরা পান নিয়ে এসে হাজির হলো ! আমরা রীতিমতো অপ্রস্তুত ! যদিও লজ্জ্বার মাথা খেয়ে মুঠো ভরে পান তুলে নিতে ছাড়িনি ।
কুমারজী আমাদের এরপরে আরও কি সব মিউজিয়াম হেন তেন নিয়ে যাবেন বললেন । কিন্তু গোটা পরিবার তখন একমত - এবারের মতো আমরা ক্ষান্ত দিই । হোটেলে গিয়ে একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক । ভাগ্যিস সকালে দুটো ঘর ছেড়ে দিলেও একটা গোটা দিনের ভাড়া গুনে একটা ঘর রেখে দিয়েছিলুম ! ঘরে গিয়ে সবাই সটান মাটির সাথে সমান্তরাল হয়ে গেল । কেউ বিছানায়, কেউ সোফাতে পা গুটিয়ে । এই রকম অবস্থার কথা ভেবেই আমার ব্যাগে একটা বড়োসড়ো প্লাস্টিকের চাদর থাকে । আমিই সবচেয়ে আরামে শুলাম - ঠ্যাং ছড়িয়ে ।
ঘন্টাখানেক পরে আমি উঠে পড়লুম । মনে পড়লো, সব ছবি তোলা হলেও হোটেলের সামনের রামকৃষ্ণ বিচের ছবি তোলা হয় নি । অবশ্য তোলা হয়নি হোটেলের সুইমিং পুলের ছবিও । কিন্তু সুইমিং পুলের ছবি তোলার খুব একটা আগ্রহ হয় নি । কারণ সেটাকে পুল না বলে একটা বড় চৌবাচ্চা বললেই ঠিক হয় । তবুও যে হোটেলে সুইমিং পুল আছে, এসি ঘর, ২৪ ঘন্টা গীজার, কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট ইত্যাদি সব আছে তার ভাড়া কত হবে ভেবে গোড়াতে একটু চিন্তায় ছিলুম, কিন্তু হোটেলে ঢুকেই যখন জেনেছিলাম তার ভাড়া মোটে ১৫০০/- নিজেকে আর একবার ড্যাঞ্চিবাবু মনে হয়েছিল । কারণ এর চেয়ে ঢের খারাপ ঘরে থেকে পুরীতে দু’হাজারের বেশী ভাড়া গুনতে হয়েছে ।
থাক সেকথা । নিচে নেমে বিচের ধারে পৌঁছে বেশ কয়েকটা ছবি নিলুম । একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে ভাইজ্যাগ বন্দর । দূরে দূরে দাঁড়িয়ে অনেক জাহাজ । আর সমুদ্রে মুখ ডুবিয়ে রয়েছে বিখ্যাত ডলফিন নোজ্ ! (ছবি ৩৪ থেকে ৩৬)
হোটেলে ফিরে চেক আউট করে ভাইজ্যাগ স্টেশন । সবাই যখন কুমারজীকে বিদায় জানালো, ছোটরা এবং আমরা হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলাম, কুমারজীর চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো । আমাদেরও । মাত্র তিন দিনে এমন ঘনিষ্ঠতা হয় ? আমাদের হয় । মনে আছে রাজস্থান বেড়ানো শেষ করে আমাদের ড্রাইভার ভাঁওরলালজী আমাদের তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিলেন । আর বলেছিলেন - তাঁর ছাব্বিশ বছরের ট্যুরিস্ট গাড়ী চালানোর অভিজ্ঞতায় - এটা মাত্র দ্বিতীয় ঘটনা - যে কাস্টমারদের তিনি বাড়ীতে ডেকেছেন । মালপত্র নিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে রওনা হলাম । যতক্ষণ দেখা যায় - কুমারজী হাত নাড়তে থাকলেন । পরের গন্তব্য হায়দরাবাদ । বিদায় কুমারজী ! বিদায় ভাইজ্যাগ !
শেষ । তবে পরের অংশ আছে - এবার হায়দরাবাদ ।