সকালবেলা বেশ তাড়াহুড়ো করে উঠে সবাই তৈরী হয়ে নিলাম । গন্তব্যটা অনেকখানি । সত্যি বলতে কি এই রাস্তাটা ট্রেনে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো । কারণ গোটা রাস্তার নৈসর্গিক দৃশ্য অপরূপ আর গোটা রেল পথে অজস্র টানেল এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে । কিন্তু বিধি বাম । এই রেল পথের টিকিট ঢের আগেই বিক্রী হয়ে যায় । ফলে আমাদের ভরসা সেই কুমারজী ।
আজ কিন্তু কুমারজী বেশ একটু লেট । অবশ্য তাতে আমাদের শাপে বর হলো । কুমারজীর জন্যে অপেক্ষা করতে করতেই দেখি ব্রেকফাস্ট রেডি । পেট ভরিয়ে নিতে নিতেই কুমারজী হাজির । গাড়ী চললো আপন মনে । পথে আমাদের ইচ্ছে হলো এক পাত্র কফি পানের । কারণ আমার কেমন জানি ধারণা ছিল দক্ষিণ ভারত মানেই ফার্স্ট ক্লাস ফিলটার কফি । কিন্তু কফির দোকান আর খুঁজে পাওয়া যায় না । দু’এক জায়গায় যা পাচ্ছি - তা প্যাকেট করা শহুরে কফি । তাতে আমাদের আকর্ষণ নেই । শেষকালে কুমারজীই রহস্যটা ফাঁস করলেন । অন্ধ্রের লোক কফি নয়, চা টাই বেশী পছন্দ করে । এমনি একসময় কুমারজী হঠাৎ অনেক দূরের পাহাড় দেখিয়ে বললেন - ওই পাহাড়টা পেরোলেই আরাকু ভ্যালি । একটু পরেই টের পেলাম আমরা উঠতে শুরু করেছি পাহাড়ী পথে । এঁকে বেঁকে চলা রাস্তা । চারপাশে পাহাড়ী গাছ । দূরে দূরে নানান পাহাড় । হঠাৎই রাস্তার ধারে গজিয়ে ওঠা একটা দোকানের কাছে গাড়ী থামিয়ে কুমারজী বললেন - কফি খাবেন বলছিলেন, ওই নিন কফি ।
রাস্তার ধারে ছোট্ট একটা কাঠের টেবিল সাজিয়ে বসা ছোট্ট দোকান । খুব কাঁচা বয়সী এক তরুণ দোকানদার । তার কাছে খাসা কফি পাওয়া গেল । শুনলাম - এই পাহাড়গুলোর এখানে সেখানে অল্প বিস্তর কফির চাষ হয় । আর আদিবাসী মানুষ সেই গাছের বীজ থেকে কফি বানায় । দোকানদারের কাছে সামান্য দামে কফির গুঁড়ো বিক্রী হচ্ছে । আর তার সাথে নানান জড়ি বুটি । কোনটা চুল গজানোর, কোনটা বা অন্য কিছু । চুলের ওষুধ আমার দরকার নেই । কারণ আমার মাথার চুল আজও বিনা কলপেই কালো । কম বয়েসের তুলনায় পাতলা হলেও আজও যথেষ্ট ঘন । কারণটা হয়তো বংশগত । কিন্তু ইস্কুল জীবনে এক স্যার যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তা নিদারুণ । বন্ধুরা স্যারকে বলেছিল - স্যার, নির্মাল্যর চুল এতো তাড়াতাড়ি বেড়ে যায় কি করে ? স্যার বলেছিলেন, জানিস না ? গোবর সারে গাছ ভালো হয় ! ওর চুলের নিচে নির্ঘাত গোবর সার আছে । যাকগে সে কথা ।
হঠাৎ নজর পড়লো - দোকানদারের টেবিলের এক কোণে কিছু লেখাপড়ার বই । প্রশ্ন করতে তরুণ দোকানদার ভারী লাজিয়ে গিয়ে জানালো - তার ক্লাসের বই ।
কোন ক্লাস ?
উত্তর এলো - বি কম - সেকেন্ড ইয়ার ।
তবে নাকি শুধু পাশ্চাত্যের লোকেরাই ভোরে কাগজ বেচে দুপুরে কলেজ যায় ? আমার দেশেও কলেজ ছাত্র পথ-পাশের ছোট্ট দোকানে বসে চা কফি বেচার ফাঁকে কলেজের বই পড়ে !
কফির দাম মিটিয়ে এগোলাম । এবার সোজা গিয়ে থামবো আরাকু উপত্যকায় । কুমারজী কিন্তু ঘন ঘন গাড়ী দাঁড় করায় আর আমাকে নির্দেশ দেয় - ইঁহাসে ফটো লে লো, আচ্চা ফোটো আয়েগা ।
আমি বুঝলাম ফটোগ্রাফির কোর্স করে, বই পড়ে আর ইন্টারনেট ঘেঁটে অ্যাঙ্গেল অব ভিসান ইত্যাদি সম্পর্কে যা জেনেছি, দীর্ঘকাল হরেক রকম ট্যুরিস্ট নিয়ে ঘোরার সুবাদে লোকটা তার অনেকটাই বুঝে নিয়েছে (ছবি - ১৬) ।
একটু পরেই পাহাড় আর জঙ্গল পার করে ধু ধু করা প্রান্তর । এই আরাকু উপত্যকার রূপ (ছবি - ১৭) ।
একটু এগোতেই পথে আর এক চমক । পথের পাশে পাশে পশরা সাজিয়ে ডাক দিচ্ছে স্থানীয় মানুষ । আকর্ষণের বস্তু - ব্যাম্বু চিকেন । বাঁশের ভেতর মশলা মেশানো মুরগীর মাংসের ছোট ছোট টুকরো ভরে সব শুদ্ধু রোস্ট । এ জিনিস অসমে পাওয়া যায় বলে শুনেছি । বিশেষত বুদ্ধদেব গুহর লেখায় । ফলে আমরা বেশ একটু আকৃষ্ট হয়েছিলাম বটে । কিন্তু কুমারজীর অভিজ্ঞতা প্রচূর । আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন - বোরা গুহালুতে গিয়ে খাবেন । এখন খেতে গেলে অনেকখানি সময় নষ্ট হবে ।
কাজেই নোলা সামলাতে হলো । এক সময় একটা বাজার গোছের জায়গায় পৌঁছে কুমারজী ঘোষণা করলেন - এই হলো আরাকু উপত্যকা । আমার মনে তখন ভাসছে - (মাফ করো বাবা ওয়ার্ডসোয়ার্থ সাহেব) - And is this—Yarrow ? এ যে নেহাৎ একটা বাজার ! কুমারজী আরও একটু এগিয়ে দেখালেন সেখানে একটা “বোটানিক্যাল গার্ডেন”। টিকিট কেটে ভেতরে গেলাম । সাজানো গোছানো একখানা বাগান (ছবি - ১৮) । নানান রঙের ফুল, পাতা আর গাছ । আর তার সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে বাটু ! বাটুদের সেলফি তোলার ভিড় ঠেলে এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখা সম্রাট স্পাইডার দ্যা গ্রেট এর সাথে । প্রস্তুতি ছিল না এনার ছবি তোলার । এমন কি গাছপালাদেরও । তবু এনার দেখা পেতেই ব্যাগ থেকে অন্য লেন্স বার করে বদলে নিয়ে আমার ডি এস এল আর ক্যামেরা বাগিয়ে ধরলাম (ছবি‑১৯) । দু’পা এগোতেই আর একজন । ইনি আবার অনেকটা ওপরে এমন সূক্ষ ভাবে জাল বিছিয়েছেন - যে মনে হচ্ছে তিনি আকাশে ভাসছেন ! তাঁর নামকরণ করলুম সম্রাট স্পাইডার দ্যা সেকেন্ড (ছবি - ২০) !
ঘোরা ঘুরির মাঝে হঠাৎ দেখা এক প্রতিবেশী বন্ধুর পরিবারের সাথে । কুশল বিনিময় এবং বিজয়ার কোলাকুলি সারার পরেই আবার এক অনুজপ্রতিম বন্ধুর সাথে দেখা । আমার অফিসের । তার ছোট ছেলেটা ভারী মিষ্টি । আলাপ হতেই তার একটা ছবি তুলতে গেলুম । সে বলল, জেঠু তুমি আমার ছবি তুলছো ? দাঁড়াও, আমিও তোমার একটা ছবি তুলে দিই । এই বলেই সে তার ক্যামেরা বার করে আমার ছবি তুলতে লেগে গেল । চোখে পড়ল তার পিছনের গাছের কেয়ারী করা রাস্তাটা ভারী সুন্দর (ছবি - ২১) । দুই ফটোগ্রাফার পরষ্পরের ছবি তুলে আর একটু এগোতেই আর এক বন্ধুর দেখা পেলাম । ইনি আবার দেখা হতেই একগাল হেসে বললেন, আরে ব্যানার্জ্জীদা ! আপনি এখানে ? আরাকু ঘুরতে এয়েচেন ?
জিভের ডগায় উত্তরটা এসে গিয়েছিল - না না, ঘুরতে নয়, এই একটু সবজী কিনতে এসেছিলুম । এখানের সবজীগুলো বড়ো ফ্রেশ !
কিন্তু ইনি আবার আমার শ্বশুরবাড়ীর তরফের চেনাশোনা । তাই উত্তরটা সটান গিলে নিয়ে তাঁর সাথে কিছুক্ষণ হেঁ হেঁ করে সোজা গেটের দিকে রওনা দিলুম । পাছে এইরকম আর কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ! গেটের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ ইচ্ছে হল সামনের সবুজ ঘেরা গাছগাছালির একটা ছবি তোলার । আমার ছোট মেয়ে কোত্থেকে দৌড়ে এসে ফ্রেমের মাঝে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো । যদিও আমার মেয়েরা জানে ট্যুরিস্ট স্পটে আমি বাড়ীর লোকের ছবি তোলা খুব একটা পছন্দ করি না । কিন্তু ওরা আবদার করতে ছাড়েনা । আগে খেয়াল করিনি । হঠাৎ আবিষ্কার করলুম, মেয়েটা কি ভেবে আজ একেবারে সবুজে সবুজ হয়ে সেজে এসেছে । আমার আর আপত্তি করার জো রইল না (ছবি - ২২) । কিন্তু তার ছবি তোলা হতেই অন্য জনের মুখ ভার ! কে বলবে দুজনেই কলেজে পড়ে । অগত্যা একটা রফা হলো । তিনজনেরই একটা ছবি তোলা হবে - কিন্তু কেমন ছবি সেটা আমি ঠিক করবো । গাছপালায় ঢাকা একটা রাস্তার মাঝে ছবি তোলা হলো (ছবি - ২৩)
ওখান থেকে বেরিয়ে গাড়ীতে উঠতে যেতেই হঠাৎ আবার চমক । গাড়ীর ছাতে বেশ রাজকীয় চালে বসে আছেন এক গঙ্গাফড়িং বাবু । “সবুজে সবুজ” ছবি তোলার পরেই যেন আমাকে চ্যালেঞ্জ - কই, এবার তোল দেখি আরও সবুজ । তবে এবার বেশী অসুবিধে হয়নি । কারণ দুই সম্রাটের ছবি তোলার পর লেন্সটা আর ব্যাগে ঢোকাইনি । আমার ফটোগ্রাফার’স জ্যাকেট এর একটা ঢাউস পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলুম । কিন্তু সমস্যা ছিল তাঁকে ঠিক ঠাক ফোকাসে আনা - কারণ চার পাশের সবুজ ব্যাকগ্রাউন্ডে তিনি হয়তো হারিয়েই যাবেন ! যাই হোক, কোনরকমে তাঁকে ক্যামেরাবন্দী করতে পারলুম (ছবি - ২৪) ।
আবার গাড়ী চলতে লাগলো । কুমারজী হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করলেন - “গানা গাইয়েগা ” ?
আমি একটু অন্যমনস্ক থাকায় খেয়াল করিনি । একটু চমকেই গেলাম । ভর দুপুরে বেমক্কা গান গাইতে যাবো কেন ? পরক্ষণেই খেয়াল হলো - আমি তো এখন দক্ষিণ ভারতে । মনে পড়ল - চেন্নাইয়ে আমার মেরুদন্ডের হাড়ের অপারেশনের আগের রাতে আমাকে বলা হয়েছিল খুব ভালো করে বিশেষ ধরণের শ্যাম্পু এবং সাবান মেখে চান করতে । আমি তাই বলেছিলাম, একেবারে চান করে রাতের খাবার খাবো । তাতে দক্ষিণী নার্স আমাকে এইরকম ভাবেই সাবধান করেছিল - রাত এগারোটার পর - গানা নেহি গানেকা । আভি গানা গা লো ।
হাসপাতালে রাত্তিরবেলা গানা কেন গাইবো বুঝতে সময় লেগেছিল । তখন তো জানতুমনা দক্ষিণী উচ্চারণে খ কে গ বলা হয় ! এবারে কিন্তু চট করে বুঝে গেলুম । কুমারজী প্রস্তাব করলেন - অন্ধ্রপ্রদেশ ট্যুরিজ্মের গেস্ট হাউসে গিয়ে “গানা গাওয়ার” । কিন্তু আমরা অতীত অভিজ্ঞতায় জানতাম - ওই সব জায়গায় খাবার তৈরী থাকে না । গরম গরম বানিয়ে দেওয়া হয় । ফলে অনেকটা সময় লাগে । তাহলেও এটা দেখে ভালো লাগলো - কুমারজী অন্য অনেক জায়গার ড্রাইভারের থেকে আলাদা । তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেছে বেছে অতি জঘন্য হোটেলে খেতে নিয়ে যায় - যেখানে তার সাথে কমিশনের বন্দোবস্ত আছে ।
আমি তাই বললাম - না, এমন জায়গায় চলুন যেখানে খাবার রেডি পাওয়া যাবে । দরকার হয় হালকা কিছু হলেও চলবে ।
কুমারজী বললেন, সাদা হোটেল চলেগা ?
সাদা হোটেল আবার কি বস্তু রে বাবা ? কিন্তু তখন আমাদের মাথায় তাড়া - দেরী করলে বোরা গুহালু পৌঁছতেও দেরী হবে । তাই হ্যাঁ বলে দিলাম । মনে ভাবলাম, সাদা, লাল, নীল, হলদে - যে কোন হোটেলই চলবে ! কারণ আমাদের দলের সবাই বেড়াতে বেরোলে একেবারে বর্ণপরিচয়ের গোপালের মতো সুবোধ বালক - যাহা পাই তাহাই খাই ! কোন প্রকার বায়নাক্কা নাই ।
কুমারজী যেখানে নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন - তা হলো পথের পাশের চালু হোটেল । খাদ্য তালিকায় একটিই জিনিস আছে - অন্ড্রা মিল । তবে বেশ সাফ-সুতরো । গরম গরম ভাত আর যথারীতি নানা রকম তরকারী । অবশ্য দশপাল্লার মতো অত পদ নেই । কিন্তু অবাক হলাম - ডাল বা সম্বর জাতীয় কিছু দিল না তো ! ওমা, ভাবতে না ভাবতেই সম্বর আর একটা তরকারী হাজির । বাটিতে নয় । টেবিল পিছু দুটো করে বালতি বসিয়ে দিয়ে গেল । পরিমাণ যা ছিল তা স্নানের জন্য ব্যবহার করলে একটু কমই বলতে হবে - কিন্তু খাওয়ার জন্যে ? থাকগে সে কথা । বেশ তৃপ্তি সহযোগেই খাওয়া শেষ করলাম । দাম পড়লো মিল পিছু সত্তর টাকা ! আহা, আমাদের মতো লোকের জন্যেই ড্যাঞ্চিবাবু শব্দটা তৈরী হয়েছিল ।
খাওয়া দাওয়ার পরে এবার গন্তব্য - বোরা গুহালু । কিন্তু কুমারজী বারবার বলতে লাগলেন - কফি মিউজিয়াম দেখার জন্যে । অগত্যা গেলাম সেখানে । মাথা পিছু দশ টাকা টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম । কফি সম্পর্কে কিছু কথা বার্তা, ছবি আর বেশ গুটি কতক প্রমাণ সাইজের পুতুল । আর হ্যাঁ, একটা মস্ত সেলস্ কাউন্টার । তাতে কলকাতার ওই “কাপে কফি দে” বা “ব্যারিস্টারের” কফির মতো বিচিত্র সব কফি পাওয়া যায় । সাকুল্যে আমরা সময় নিলুম বড়জোর আড়াই মিনিট । পরে বুঝেছিলুম আমাদের কফি খাওয়ার আগ্রহ দেখে কুমারজী ভেবেছিল ওই নানান ধরণের কফি আমাদের খুব পছন্দ হবে ।
বেরিয়ে পড়লাম বোরা গুহালুর পথে । পার্কিং লটে গাড়ী রাখা হলো । কুমারজী বললেন - এই বেলা যে কোন দোকানে ব্যাম্বু চিকেনের অর্ডারটা দিয়ে গুহায় ঢুকুন । যখন বেরিয়ে আসবেন ততক্ষণে রেডি হয়ে যাবে । তাই করা হলো । দাম বিরাট কিছু নয় । পাঁচশো গ্রাম তিনশো টাকা আর এক কেজি হলে পাঁচশো টাকা । অবশ্য আরো নানান হোটেল আছে । রীতিমতো বাংলায় বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে - বাঙালী ভাত আর মাছের ঝোল পাওয়া যায় !
পৌঁছলাম বোরা গুহালুতে ঢোকার গেট এর সামনে (ছবি - ২৫) । গেটের চার পাশে অজস্র বাঁদর সর্বপ্রথম আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো । টিকিট কাটতে হবে প্রত্যেকের । ক্যামেরার জন্যে আলাদা টিকিট, দাম ১০০ টাকা । আর মোবাইল মাত্র ২৫ টাকা । হাঁটতে থাকলাম । পরপর সিঁড়ি বেয়ে নামা (ছবি - ২৫) । নামতে হবে ৮০ মিটার মানে ২৬০ ফুট । মোট ৪৪০ টি সিঁড়ি । বস্তুত এটি ভারতের সবচেয়ে গভীর গুহা । শুরু হল অবতরণ । বেশ কিছুটা নেমে গুহার মুখ । ওড়িয়ায় বোরা মানে গর্ত আর তেলেগু ভাষায় গুহালু মানে গুহা । এই অঞ্চলে বিভিন্ন উপজাতী সম্প্রদায়ের বাস । শোনা যায় অনেক আগে গুহা মুখের একটি গর্ত দিয়ে তাদের একটি গরু গুহার মধ্যে পড়ে যায় । তার খোঁজ করতে গিয়ে রাখাল খোঁজ পায় এই গুহার (ছবি - ২৫) । ভেতরে ঢুকেই একটি শিবলিঙ্গের সন্ধান পাওয়া যায় (ছবি - ২৫) । সেখানে একটি ছোট মন্দিরও তৈরী হয় । পরে ১৮০৭ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার উইলিয়াম কিং জর্জ এটিকে আবার করে আবিষ্কার করেন ।
এই ধরণের গুহায় চূণাপাথরে জল পড়ে তার থেকে ধুয়ে বেরিয়ে যায় বিভিন্ন খনিজ আর লবণ । এগুলো যেখানে পড়ে সেখানে আস্তে আস্তে জমে যায় । এই জমে যাওয়া বস্তুটির নাম স্ট্যালাগমাইট । আর চূণাপাথরের যে অংশটা গুহার ছাতে বা দেয়ালে আটকে থাকে তাকে বলে স্ট্যালাকটাইট । বছরের পর বছর ধরে এই দুই রকম পদার্থ জমে প্রকৃতির খেয়ালে তৈরী হয় নানান আকৃতি । কত বছর ধরে জমে জমে তৈরী হয়েছে এই বোরা গুহালুর নানান আকৃতি ? বেশী নয় - এই ধরুন পনেরো কোটি বছর !
গুহার ভেতর থেকে বেরিয়েছে একটি ছোট্ট নদী । তার নাম গোস্তনী নদী । একটু পরেই সিঁড়ি বেশ ভিজে । খুব সাবধানে নামতে হয় । যষ্ঠিধারী আমাকে দেখে অনেকেই উপযাচক হয়ে উপদেশ দিচ্ছিলেন -আপনি আর নামবেন না । উঠতে ভীষণ কষ্ট হবে ইত্যাদি । কি করে এদের বোঝাই - আমার মতো প্রতিবন্ধী অনেক মানুষ এভারেস্ট জয় করতে পেরেছেন । সর্ব প্রথম টম হুইটেকার থেকে শুরু করে আমাদের দেশের মেয়ে অরুণিমা সিংহ, এমনি আরও কত কে ! এর মধ্যে মার্ক ইংলেশ ছিলেন এমন মানুষ যাঁর দুটি পা-ই ছিল অ্যামপুট করা । এঁদের শারীরিক সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশী যে জিনিষটা ছিল তা হলো হিম্মত !
অবশ্য আমার সে সার্টিফিকেটও পাওয়া হয়ে গেছে । দেওঘরের কাছে তপোবনে সাড়ে চারশো সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠা আর পাহাড়ের পেছন দিয়ে পাথুরে পথে কসরৎ করে নেমে আসার পর আমাদের গাইড আমাকে সার্টিফিকেট দিয়েছিল - আপকা বহোৎ হিম্মত হ্যায় ! পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের তিনশো সিঁড়ি ভাঙতেও কষ্ট হয় নি । কষ্ট হয় অফিস ফেরৎ বাগুইহাটি সাবওয়ের বাহান্নটা সিঁড়ি ভাঙ্গতে ! যাকগে সে কথা ।
কিছুটা নামার পর গাইড পাওয়া গেল । হাতে বড় ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে তিনি আমাদের এগিয়ে নিয়ে চললেন । প্রকৃতির খেয়ালে যে সব আকৃতি তৈরী হয়েছে তার সাথে পরিচয় করাতে লাগলেন । যদিও আমার মনে হয়েছিল - এই আকৃতিগুলোর আট আনা সাদৃশ্য আর বাকি আট আনা কিন্তু দর্শকের কল্পনাশক্তি । কিন্তু ক্যামেরা না আনলেই ভালো হতো । একে তো এখানে ওখানে যেরকম ঝরঝরিয়ে জল পড়ছে তাতে ক্যামেরা বার করাই সমস্যা । তারওপর আবার কর্তৃপক্ষ চন্দননগরের এস্টাইলে এমন এক রকম লাইট লাগিয়েছেন যা ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় । কখনও বেগুনী, কখনও হলুদ, কখনও পিঙ্ক । ফলে আকৃতিগুলোর রং একেবারে কিম্ভুত কিমাকার লাগছে । অনেক কষ্টে এক আধটা ছবি নিলাম - কিছু রঙ্গিন, কিছু সাদা কালোয় (ছবি - ২৬ ও ২৭) । শেষ প্রান্তে পাহাড়ের ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসছে হলুদ রং এর তরল । গাইড জানালেন - কথিত আছে এখানে সীতা হলুদ মেখে স্নান করেছিলেন । সেই থেকেই এখানে হলুদ রং বেরিয়ে আসে । তারপর জানাতে ভুললেন না - বিজ্ঞানের মতে এ হলো সালফার । খুব কম আলোয় ছবি নিলাম (ছবি - ২৬) । আর একটি অদ্ভুত তথ্য পেলাম । এই গুহার অনেকখানি ওপর দিয়ে গেছে রেল লাইন ।
গাইড জানালেন এই গুহা বহুদূর বিস্তৃত । একটা পথে যাওয়া যায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার । আর একটা পথে সাত কিলোমিটার । তবে সে পথ বড়ই সমস্যার । অনেকটা অংশ প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয় । দীর্ঘ সময় লাগে । যায় কেউ ? উত্তরে গাইড জানালেন, হ্যাঁ, আজকেই সকালে একটি ছোট্ট দল গেছে গাইড নিয়ে ।
ধীরে ধীরে একসময় বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে । পাশেই একটি ভিউ পয়েন্ট থেকে গোস্তনী নদী আর তার চারপাশের অপরূপ দৃশ্য (ছবি - ২৮) । চোখের দেখা শেষ । এবার চেখে দেখার পালা । তার মধ্যে হঠাৎ নজরে আনলো আমার শ্যালিকাপুত্র । প্রায় অন্ধকার পাহাড় আর জঙ্গলের একখানা অপূর্ব সিল্যুট (ছবি - ২৯) ।
চেখে দেখলাম ব্যাম্বু চিকেন (ছবি - ২৯) । খুব একটা আহামরি লাগলো না । পরে জানতে পারলাম এখানের রন্ধন পদ্ধতি নাকি অসমের থেকে একেবারেই আলাদা । এখানে রান্নার বেশীর ভাগটা বাইরে করে শেষ কালে বাঁশের ভেতর পোরা হয় । অর্থাৎ অসমের জিনিসটাই হচ্ছে আসলি ঘী আর এখানেরটা নেহাতই বনস্পতি ! তাহলেও এক কেজি চিকেন নিমেষে উড়ে গেল । আর আপনাদের অনুরোধ, ওখানে গেলে ব্যাম্বু চিকেন চেখে দেখতে ভুলবেন না । কারণ ওই চিকেন ওখানের অনেকগুলো আদিবাসী গরিব মানুষকে দুবেলা ভাত জোগায় ।
যাই হোক, এবার ফেরার পালা । হোটেল ফিরতে পাক্কা তিন ঘন্টা । কাল একটাই আনন্দ - সকাল সকাল ওঠার দরকার নেই । আর বিষাদের সুর, ভাইজ্যাগে অদ্যই শেষ রজনী । কাল সারা দিন আরো কিছু জায়গা দেখে সন্ধ্যায় ট্রেন ।