আমাদের জীবনটা চলে যেন সেই বিজ্ঞানের বইতে পড়া বৃত্তাকার গতি পথে । একদিকে কেন্দ্রাভিমুখি বল টানছে জীবনের কেন্দ্রে থাকা জীবিকা, বাসভূমির দিকে আর কেন্দ্রাতিগ বল টানছে - এই সব থেকে দূরে - “অন্য কোথা, অন্য কোনখানে” । সেই টান যখন প্রবল হয়ে ওঠে - এক ছুটে বেরোতে ইচ্ছে হয় - শহর ছেড়ে দূরে । এমনই টানে এবছর আমাদের হঠাৎই ঠিক হলো বেড়িয়ে আসি - ভাইজ্যাগ । দুটি পরিবারের আমরা সাতজন । অন্য পরিবারটির সদস্য আমার এক শ্যালীকা, ভায়রাভাই এবং শ্যালিকাপুত্র । বেড়াতে গেলে অবশ্য আমরা একটা পরিবার হয়ে যাই । কিন্তু যখন আমরা বেড়ানোর কথা ঠিক করলাম, তার ঢের আগেই রেলের টিকিট অমিল । শুরু হলো নানান খোঁজ । আছে, আছে, পথ আছে । কলকাতা থেকে বাসে একরাত কাটিয়ে ভুবনেশ্বর - আর সেখান থেকে ট্রেনে বিশাখাপত্তনম্ । কিন্তু ফেরার টিকিট নেই । ফলে অন্য রাস্তা খোঁজা । তাও পাওয়া গেল - তিনরাত ভাইজ্যাগ, একরাত ট্রেনে থেকে হায়দ্রাবাদ । সেখানে তিন রাত । সেখান থেকে ফেরার টিকিট আছে । যদিও এই ট্রেনটা চলে বড় ধীরে, থেমে থেমে । ফলে অন্য ট্রেন যখন চব্বিশ ঘন্টায় পৌঁছে দেয়, এ নেয় আরো ঘন্টা আষ্টেক বেশী । তা হোক, টপাটপ টিকিট কাটা হয়ে গেল । মা দুর্গা চলে যাবেন বিজয়া দশমীতে আর একাদশীর সন্ধ্যেবেলা আমাদের যাত্রা শুরু ।
দিনটা ঘনিয়ে এলো । পুজোর চারটে দিন তো রকেটের গতিতে চলে গেলো । সন্ধ্যেবেলা যাত্রা শুরু । আজ আবার সব ঠাকুরের ভাসানের দিন । তাই প্রচূর যান-জটের সম্ভবনা । আমরা তাই এস্প্ল্যানেড নাকচ করে সল্টলেক করুণাময়ী থেকে বাস ধরার বুদ্ধি করলাম । কিন্তু দুপুর থেকেই ক্রমাগত বৃষ্টি । বাড়ীর সামনে এক গোছ জল । যা হোক করে পৌঁছে গেলাম সল্ট লেক । আমাদের সাতজনের তিনজন উঠবে ধর্মতলা থেকে । বাস হলেও, এ বড় আরামের বাস - ঠান্ডা মেশিন লাগানো ভলভো বাস । হেলানো সিট, তার সাথে ফ্রী-তে হাফ লিটার জল, একটা বিস্কুট আর একখানা কম্বল । ধর্মতলা পার করে বাস সাঁই সাঁই করে দৌড় দিল । মাঝে বাবুঘাটে দাঁড়ানোর কথা ছিল - কিন্তু সবাই উঠে পড়ায় সেদিকে আর গেল না । প্রথম থামলো মাঝ পথে এক খানা ধাবায় । যদিও এর সাথে নেতাজীর বাহিনীর নাম জড়ানো, কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা জানতাম - এদের খাবার অতি অখাদ্য আর দামটা অনেক বেশী । আমরা তাই আগে থেকে রুটি আর ডিমের ভুজিয়া প্যাক করে এনেছিলাম । তাই দিয়ে তোফা ডিনার হয়ে গেল । অবশ্য এটা স্বীকার না করলে পাপ হবে - যে এ বিষয়ে কৃতিত্ব সম্পূর্ণ ভাবেই অন্য পরিবারটির । আমাদের পরিবার শুধু গৌরবে বহুবচন । তবে আগেই বলেছি, বেড়াতে গেলে আমরা দুটো পরিবার মিলে মিশে একটাই পরিবার ।
এবার শোবার পালা । সিট আধ শোয়া করে দেওয়া হলো । বাসের ভিডিওতে চালানো অতি অখাদ্য সিনেমাটিও শেষ হলো । এ বাসে ঝাঁকুনি নেই বললেই চলে । তাই বেশ আধ ঘুমেই রাত কেটে গেল । ভোররাতে বাস নামিয়ে দিল - ভূবনেশ্বর স্টেশনের কাছাকাছি বানিবিহার নামে একটা জায়গায় । সামনে সার সার অটো । তাই ধরে লটবহর নিয়ে পৌঁছলাম স্টেশনে । তখন ভোরবেলা । সূজ্যিমামা আড়মোড়া ভাঙছেন, তখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেননি । আমাদের ট্রেন সেই দুপুর বারোটা । কিন্তু ওয়েটিং রুমে ঢুকতে গিয়েই ঠেক । ট্রেন ছাড়ার তিনঘন্টার আগে ওয়েটিং রুমে প্রবেশ নিষেধ । অবশ্য কর্তব্যরত
রেলকর্মী মহিলাদের অনুমতি দিল মহিলা ওয়েটিং রুমে বসতে । আর আমরা একেবারে ওয়েতে মানে পথে বসে টিং টিং করতে লাগলুম । যা হোক, লোকটা এদিকে ভালো, আমাদের বাথরুম ব্যবহারের অনুমতি দিল ।
ঘন্টাখানেক পরে আবার একবার যেতেই বলল - আচ্ছা, আচ্ছা - যান, ভেতরে বসুন । আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ! খাবার দাবার সংগ্রহ শুরু হলো । যদিও খাবার দোকানের গায়ের মেনু কার্ডের সাথে ওদের বলা দাম মিলছে না, কিন্তু বিল দেওয়া হয় না । আপত্তি করলে - সোজা পথ দেখো । অভিযোগ করে ফল হয় না - কারণ আমাদের হাতে কোন প্রমাণ নেই । আর উর্ধতন কর্তৃপক্ষ চোখে ভালো দেখতে পান না । তার কারণটা মুজতবা আলি সাহেব ঢের আগে শিখিয়ে গেছেন - রৌপ্যমুদ্রা অস্বচ্ছ !
যা হোক - একসময় উঠলাম ট্রেনে । ঠিক ঠাক ছেড়েও দিল । একসময় পৌনে সাত ঘন্টার পথকে সাড়ে ন ঘন্টা করে ট্রেণ পৌঁছল ভাইজ্যাগ । ওখানে থাকা আমার কিছু বন্ধুর সহায়তায় ভাগ্যিস আগে থেকে গাড়ী হোটেল ইত্যাদি সব ঠিক করা ছিল ! পৌঁছে স্নান খাওয়া সেরে তোফা একখানা ঘুম ।
সকালে উঠে তৈরী হয়ে বেরোলাম সাড়ে আটটায় । গাড়ীতে উঠেই ড্রাইভারকে বললাম - আগে কোথাও জলখাবার খাবো । ড্রাইভার বললেন - সে কি, হোটেলে খাননি ? আপনাদের ব্রেকফাস্ট তো কম্প্লিমেন্টারি !
তাড়াতাড়ি ছুট দিলাম - ডাইনিং হলে । গিয়ে জানলাম - হ্যাঁ, এক্কেবারে তাই ! আর আমাদের পায় কে । আর সবার মতো আমরাও কম্প্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট পেলে এমন খাই যে ডিনারের আগে আর ক্ষিধে পায় না ! গপা গপ পেট ভরিয়ে ফেললাম ।
বেরোলাম গাড়ী করে । প্রথম পৌঁছলাম - নাইডু ফিল্ম সিটিতে । আহা, জায়গাটা ছবির মতোই সুন্দর । একটা পাহাড়ের ওপর ।,অপূর্ব একটা বারান্দা বানানো । তার থেকে দেখা যাচ্ছে - দূরে নীল সমুদ্র, আর একদিকে পাহাড় । তার মাঝে সবুজ জায়গাটা । নানান বাগান, কিছু জন্তু-জানোয়ারের মুর্তি বানানো (ছবি - ১) । মাঝে মাঝে নানান সেট তৈরী - যেখানে শুটিং হয় । তাতে ওষুধের দোকান, হসপিটাল - কি নেই ! আশে পাশে নানান জায়গা এমন ভাবে বানানো যাতে নায়ক-নায়িকা দিব্যি এক আধ পাক “লাচ ভি লেচে নিতে পারে” (ছবি - ২)।
আছে একটা মন্দির, একটা বিরাট বাড়ী - যাকে দিব্যি পুরোন রাজার বাড়ী, এমন কি ভূতের বাড়ী হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায় (ছবি - ৩) ।
এর মাঝে আর এক কেলেঙ্কারী । আশে পাশে ঘুরতে এসেছে এক দল রূপকুমারী । ছবি তুলতে গিয়ে আমি একটু দলছুট হয়ে পড়েছিলাম । যদিও আমার স্ত্রী এবং শ্যালীকার নজরের আড়ালে যেতে পারিনি । এমন সময় এক রূপকুমারী আমার দিকে নিজের মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে সলজ্জ্ব হেসে বললেন - আমার একটা ছবি তুলে দেবেন ? দিলাম । একটা কেন, বেশ দু চারটেই তুলে দিলাম । বেশ ভালো ফটোগ্রাফার ভেবে রূপকুমারীও নানান পোজ দিতে লাগলেন । একটু পরে দলে ফিরতেই আমার গিন্নীর মুখ ভার । শ্যালীকা আর ভায়রা ভাইয়ের মুখে হাসি আর বিশুদ্ধ বাংলায় যাকে বলে - বেদম আওয়াজ !
উহ্ - এই সব কেস খাওয়া কেবল আমার কপালেই কেন যে হয় ! মনে আছে, একবার ধরমশালা বেড়াতে গিয়ে সরু পাহাড়ের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে - বেমক্কা এক বিদেশিনীর পাণিগ্রহন করতে হয়েছিল । সেই নীলনয়না বিধুমুখী সরু রাস্তায় একটা উঁচু পাথর ডিঙোতে গিয়ে সাহায্য চেয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন । তারপর পাক্কা তিনদিন গিয়েছিল - গিন্নীকে বোঝাতে - যে এ বিষয়ে আমার কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না !
তাও তো আমার গিন্নী জানেন না যে একবার কোনারকের মন্দির গাত্রের ইরোটিকার ইতিহাস সম্পর্কে বেছে বেছে আমাকেই প্রশ্ন শুরু করেছিল - দুই বিদেশিনী । কারণ গাইডের ইংরিজী কেন কে জানে তাদের মোটে বোধগম্য হচ্ছিল না । শেষটায় আমাকে গাইড আর তাদের মাঝে দোভাষীর কাজ করতে হয়েছিল । ভাগ্যিস সেবার বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলাম ! অবশ্য, আমার বন্ধুরা আওয়াজ দিতে ছাড়েনি ।
যাকগে সে কথা । ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম থোটলাকোন্ডা । একটা পাহাড়ের ওপর । ওখানে এক প্রাচীন বৌদ্ধ স্তুপের ধ্বংশাবশেষ আছে । যদিও চেহারা দেখে আর ক্যামেরা বার করতে ইচ্ছে হয় নি । কিন্তু একটু এগোতেই দূর থেকে সমুদ্রের এক অপূর্ব চেহারা দেখতে পেলাম । আর ঠিক সেই সময় আকাশে একখন্ড মেঘ এমন ভাবে হাজির হয়েছে যেন - ওপরওয়ালার বানানো একখানা কম্পিউটারের ডেস্কটপ ব্যাকগ্রাউন্ড । (ছবি - ৪)
আমার হঠাৎ কেন যেন বড় আক্ষেপ হচ্ছিল । সমুদ্র আর তার তট তো আমাদের দীঘা পুরীতেও আছে । সেখানের সমুদ্র এতো নীল নয় কেন ? আর কেনই বা ওই সব জায়গায় গোটা সমুদ্রতট ঘিরে শুধু বাজার বসে যায় ? কেন নষ্ট করে দেওয়া হয় তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য ?
থাকগে সে কথা । থোটলাকোন্ডায় ঢোকার মুখে আরেকটা জিনিস বড় ভালো লাগলো । নানান গাছ আর ফুলে ভরা একটি বুদ্ধমুর্তি । ধ্যানমগ্ন । ভারী শান্ত সুন্দর এই জায়গাটি (ছবি - ৫)।
ও’খান থেকে অল্প দূরেই বিখ্যাত ঋষিকোন্ডা সমুদ্র সৈকত । নিঃসন্দেহে সুন্দর । এসে তাকে দেখে মনে হলো পাহাড়ের ওপর থেকে একেই দেখছিলাম । বিচের একটা পাশ অশ্বক্ষুরাকৃতি (ছবি-৬) । সমুদ্র তট থেকেই উঠেছে ছোট্ট একটা পাহাড় (ছবি-৭) । তার মাথায় একটা রিসর্টও আছে (ছবি-৮) । তবে এইখানে এসে মনে হল জায়গাটা অনেকটা আমাদের দীঘা কিংবা পুরীর মতো । এখানের এই একটামাত্র জায়গাতেই দেখলাম সমুদ্রস্নানের সুযোগ আছে । তার সাথে বসে গেছে রথের মেলা । কোথাও ডাব, কোথাও টুপি, কোথাও খেলনা, ঝিনুকের মালা ইত্যাদি । একপাশে ব্যাটারি চালিত ছোট্ট চারচাকার গাড়ী চড়ার ভিড় । আর তার চারপাশে তারস্বরে ক্যাচর ম্যাচর লাগিয়েছে - একগাদা বাটু - মানে সেই বিশ্ববিখ্যাত বাঙালী ট্যুরিস্ট ! বাটু শব্দটা আমার এক অনুজপ্রতিম বন্ধু শিখিয়েছিল । বাটু হচ্ছে সেই টিপিক্যাল বাঙালী ট্যুরিস্ট যারা কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা যেখানেই যায় -আগে খোঁজ করে - মাছের ঝোল ভাত পাওয়া যাবে কি না । যেখানে আমীষ খাওয়া নিষিদ্ধ সেখানে যেন তেন প্রকারেণ দশগুণ দাম দিয়ে একটা ডিম সেদ্ধ বা এক পিস মাছ ভাজা খেয়ে গৌরবের সঙ্গে সেই কৃতিত্ব সবাইকে গল্প করে । যে কোন জায়গায় পৌঁছে জানতে চায় জামাকাপড় কাচার সুবন্দোবস্ত আছে কি না । যে কোন জায়গায় গিয়ে দেড়গুণ বা দ্বিগুণ দামে একরাশ অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনে । এমনকি দীঘায় গিয়ে কলকাতা থেকে সাপ্লাই হওয়া ঝিনুক আর শাঁখের জিনিষপত্র ভক্তি ভরে কেনে । যখন যেখানে যায় ক্রমাগত অঢেল অপ্রয়োজনে কথা বলে । আর সবচেয়ে গৌণ থাকে কোন কিছু দেখার চেষ্টা । আমার মনে আছে ধরমশালায় ভাগসু ঝরনা দেখতে আমরা পাহাড়ী পথে প্রায় দু’তিন কিলোমিটার হেঁটে তার উৎস অবধি পৌঁছেছিলাম । আর অঢেল বাটু ওই দু কিলোমিটার দূর থেকে তাকে দর্শন করে ফিরে এসেছিল ।
যাই হোক, সেই বাটুর ভিড় ঠেলে কিছুক্ষণ আমরা ঋষিকোন্ডা সৈকত দর্শন করলাম । ফিরে এলাম গাড়ীতে । এবার কিছু খাওয়ার দরকার । নিজেদের যতটা না, তারচেয়ে বেশী আমাদের সারথির । যথেষ্ট বেগ পেতে হলো তাঁকে বোঝাতে যে আমাদের “বেঙ্গলী থালী”-র কোন দরকার নেই । অনেক পরে তিনি কি বুঝলেন জানি না, নিয়ে গেলেন দশপাল্লা নামে একটা রেস্তোরাঁ কমপ্লেক্সে । এর মধ্যে অনেকগুলি রেস্তোরাঁ । তার কোনটা ভেজ, কোনটা নন-ভেজ । অনেক কষ্টে আমরা তাঁকে বোঝাতে পারলাম, আমাদের নিরামিষ খেতে কোন আপত্তি নেই । এবং তিনিও আমাদের সাথেই খাবেন । ঢুকলাম ভেতরে । চেহারা ছবি দেখে মনে হল - বেশ হাইফাই রেস্তোরাঁ । যদিও স্থানীয় লোকই বেশী । আমাদের সারথি আলাদা বসতে চাইছিলেন । তাঁকে যখন আমরা একসাথে টেবিলে নিয়ে বসলাম তাঁর মুখে যে হাসিটা দেখলাম তা বড় আনন্দদায়ক । এর আগে আমরা ডাব খেয়ে যখন তাঁর জন্য একটা ডাব গাড়ীতে পৌঁছে দেই, তখনও তাঁর মুখে এই হাসিটা দেখেছিলাম । আগেই জেনে নিয়েছি, তাঁর নাম কুমার । আমি বললাম, কুমারজী, আপনি কি খাবেন ? একগাল হেসে বললেন - অন্ড্রা মিল ।
আমাদের দলের অধিকাংশের পছন্দ ডাল ফ্রাই, পনীরের তরকারী আর রুটি । আমি অবশ্য অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, রুটি না খেয়ে ভাত খাও, অথবা বাটার নান খাও । কারণ আমি মেনু কার্ডে এক ফাঁকে দেখে নিয়েছি - রুটি প্রতিটা ৪৫ টাকা । আর বাটার নান আশি টাকা । আমি সব শেষে ঘোষণা করলাম - আমিও অন্ড্রা মিল খাবো । সবাই একটু আশ্চর্য ! কারণ বেড়াতে গেলে আমি পারতপক্ষে ভাত খাই না । কারণ একটাই - বড্ড ঘুম পায় । কিন্তু এখানে স্থানীয় খাবার চেখে দেখার লোভ সামলাতে পারলুম না । আমার অর্ডার শুনে কুমারজী একেবারে আপ্লুত ! দুটো পাত্রে অজস্র ছোট ছোট পাঁপড় দিয়ে গেল । পাঁপড়গুলো অনেকটা চিপস্ এর মত খেতে । ফলে দলের ছোটরা খুব খুশী । আগে আমাদের খাবার এলো । থালার ভেতর সার দিয়ে ছোট ছোট বাটি । মাঝে দুটো কচুরী । এবার আমাদের দেখাদেখি - দলের দুজন কনিষ্ঠ সদস্য ঘোষণা করলো আমরাও মিল খাবো । তাই হলো । এবার খাওয়ার পালা ।
আমি আড়চোখে দেখলাম - কুমারজী কিভাবে খাচ্ছেন । আগে তরকারী সহযোগে কচুরী । তারপর বাটিতে রাখা অল্প একটু পোলাও জাতীয় কিছু । এবার দিয়ে গেল একটা বাটিতে সম্বর । একটায় আর একটা কি তরল । তার সাথে ভাত । আর একটা পাত্রে গরম গরম ঘী । আমি এবার কুমারজীর সাহায্য চাইলাম । কুমারজী দেখিয়ে দিলেন ভাত দিয়ে ডাল সহ ঘী । তার সাথে টেবিলে রাখা কৌটোয় একটা হলুদ গুঁড়ো । কুমারজী বুঝিয়ে দিলেন - এটা হলো গুঁড়ো করা ডালভাজা । সবটা মিশিয়ে খেতে সত্যিই বেশ লাগলো । একের পর এক তরকারী খাই আর সাথে সাথে বেয়ারা সেটা ভরে দিয়ে যায় । কুমারজী দু-একবার আপত্তি করতে গিয়েও সামলে নিলেন । বুঝলাম আমি বারংবার শুক্তোর আগে পায়েস খেয়ে ফেলছি । শুধু আলাদা করে দেওয়া পাত্রের সেই তরলটাতে চুমুক দিতে যেতেই কুমারজী আপত্তি করলেন - উঁহুহু, ওটা এখন খাবেন না - ওটা যে রসম্ । একটা পাত্রে ছিল রায়তা । যদিও তাতে পিঁয়াজের বড়ই আধিক্য । সব শেষে দই ভাত । কুমারজীর নির্দেশে তাতে আবার একটু আচার মেখে নিলাম । তোফা লাগলো ! আমি তো একবার ভাত নিয়েই ক্ষান্ত দিয়েছি । কুমারজী দেখি অল্প অল্প করে ভাত নিয়েই চলেছেন । পরে জানলাম এটাই এখানের দস্তুর । তরকারী বেশী নয়, ভাতই লোকে বেশী খায় । কুমারজী শুধু রায়তাটা খেলেন না । জিজ্ঞেশ করলাম, কেন ? জানা গেল - উনি সপ্তার মধ্যে শুধু রবিবার ছাড়া বাকি সব দিন নিরামিষ খান । এবং ওনাদের কাছে পিঁয়াজ আমিষের মধ্যে পড়ে । সব শেষে এলো অসাধারণ এক রাশ মিঠা পান । দেখলাম শুধু কুমারজী নন, আমাদের অন্ড্রা মিল খাওয়া দেখে হোটেলের স্টুয়ার্ডও এগিয়ে এলো । খোঁজ নিল - আমাদের কেমন লাগলো । আমি হেসে জানালাম, খুব ভালো । লোকটা দারুণ খুশী । আমাকে অভিনন্দন জানালো । বাকিদের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে একটু করুণ হাসলো । কাউকে ভাত, ইলিশ মাছের ঝোল আর চিংড়ির মালাইকারী ফেলে রুটি আর আলু চচ্চড়ি খেতে দেখলে আমরা যেমন করুণার দৃষ্টিতে তাকাই - তার ভাবখানা অনেকটা সেই রকম ।
বিল এলো । ওই অস্টাদশ পর্ব মহাভারত মার্কা অন্ড্রা মিলের দাম ২০৫ টাকা । তাও এটা তারকা খচিত রেস্তোঁরা । নিজেকে মনে হলো ড্যাঞ্চি বাবু । কিন্তু বাকিরা যখন রুটির দাম জানলো তখন তাদের মুখের অবস্থাখানা কিন্তু দেখবার মতো হয়েছিল । আমার ভেতর থেকে হাসি গুড়গুড়িয়ে উঠছে । হাসতে পারছি না কারণ গিন্নী রীতিমত খাপ্পা ! “আমাদের একবার বলতে কি হয়েছিল ? তুমি ইচ্ছে করে আমাদের অপদস্থ করার জন্যে কিচ্ছুটি বলো নি । কি ধড়িবাজ লোক রে বাবা !” ইত্যাদি ।
যাক সে কথা ! ওখান থেকে চললাম টিইউ ১৪২ - এরোপ্লেন মিউজিয়ামে (ছবি-৯) । নৌসেনার একটি পরিত্যক্ত বিমান, তার ভেতরের যন্ত্রপাতি, অস্ত্র শস্ত্র, অন্যান্য জিনিস আর রকমারি মডেল নিয়ে এই মিউজিয়ামটি বানানো হয়েছে । ঢোকা মাত্র বলা হলো আমরা ইচ্ছে করলে বিনা পয়সায় একটা অডিও গাইড মোবাইল ফোন নিতে পারি । তার জন্য পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে ।
অপেক্ষা করলাম । সবাইকে হেডফোন সমেত একটা করে মোবাইল দেওয়া হলো । জামায় লাগিয়ে দেওয়া হলো একটা করে যান্ত্রিক ট্যাগ - মোবাইল ফেরত না দিয়ে কেউ বেরোতে পারবে না । মোবাইলে চালু একটি মাত্র অ্যাপ । তিনটে ভাষা পাওয়া যাবে, ইংরেজী, হিন্দী আর তেলেগু । অ্যাপ চালু করলে তাতে পরপর নম্বর ফুটে উঠছে । দ্রষ্টব্য বিষয়ের গায়েও নম্বর লাগানো আছে । মোবাইলে সেই নম্বরটা চাপলেই শোনা যাবে তার সম্পর্কে সমস্ত তথ্য । চোখের সামনে একে একে নানান যন্ত্র । জানা গেল নৌসেনার বিভিন্ন আধিকারিকের পোশাকের খুঁটিনাটি, ব্ল্যাক বক্স, অক্সিজেনের ব্যবস্থা, তার এঞ্জিন, তার ডানা, প্রপেলার, নৌসেনার বিমানে থাকা নানান অস্ত্র, যদি ওই বিমান থেকে নৌসেনাকে প্যারাশ্যুটে করে সমুদ্রে নামতে হয় তাহলে তার বাঁচার উপায়, বেঁচে থাকার রসদ - এমনি আরো কত কি ! সব শেষে মোবাইল ফেরৎ দিয়ে বেরোনোর পর ঢোকা হলো সেই পরিত্যক্ত বিমানে (ছবি-১০) । তার অজস্র কলকব্জা দেখলে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড় । একটা বিমানে কতজন সেনা থাকে, তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কাজের ধরণ ইত্যাদি দেখা হলো । ভালো লাগল এই সংগ্রহশালাটি । সবচেয়ে বড় কথা, এই রকমের একটা যুদ্ধবিমান, হোক না সে পুরোন বা পরিত্যক্ত, তার ভেতরে ঢুকে, তার কলকব্জা দেখা, এ এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা ।
ওখান থেকে বেরিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে সমুদ্রের ধারে আর এক সংগ্রহশালা । ভারতীয় নৌসেনারই । এর নাম কুরসুরা ন্যাভাল সাবমেরিন মিউজিয়াম । (ছবি - ১১) এটি আসলে নৌসেনারই একটি সাবমেরিন । ভারতের নৌসেনার ইতিহাসে এটি চতুর্থ সাবমেরিন । ডিজেল এবং ইলেকট্রিক এ চলা সোভিয়েট রাশিয়ায় তৈরী এই সাবমেরিনটি ১৯৬৯ এর ১৮ই ডিসেম্বর ভারতীয় নৌসেনার নৌবহরে সংযোজিত হয় । প্রায় একতিরিশ বছর এটি ভারতীয় নৌবহরের অন্যতম খ্যাতনামা অংশীদার ছিল । এই কুরসুরা সাবমেরিনটি তার গোটা কর্মজীবনে জলের ওপর সর্বোচ্চ ঘন্টায় ৩০ কিলোমিটার, জলের নিচে সর্বোচ্চ ঘন্টায় ২৮ কিলোমিটার আর অর্ধনিমজ্জ্বিত অবস্থায় সর্বোচ্চ ঘন্টায় ১৭ কিলোমিটার গতিবেগে ১,৩৬,১০০ কিলোমিটার পথ চলার পরে, ২৭শে ফেব্রুয়ারী ২০০১ এটি নৌবহর থেকে ডি-কমিশনড হয় । যাকে সোজা ভাষায় সাবমেরিনের রিটায়ারমেন্ট বলা যায় । তখন মূলত অ্যাডমিরাল ভি প্যারিশ্চার উদ্যোগে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারকে মিউজিয়াম বানানোর জন্য এটিকে দান করা হয় । প্রায় আঠারো মাসের প্রচেষ্টায় এবং সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে এটিকে তার বর্তমান জায়গায় স্থাপন করা হয় । ২০০২ সালের ৯ই অগস্ট এটিকে মিউজিয়াম হিসেবে উদ্বোধন করেন অন্ধ্রপ্রদেশের তৎকালিন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী চন্দ্র বাবু নাইডু । ২৪ শে অগস্ট এটিকে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় । বছরে টিকিট বিক্রী বাবদ এর আয় এক কোটি টাকার ওপর । এখন এটি বিশাখাপত্তনম এর অবশ্য দ্রষ্টব্য জায়গা গুলির মধ্যে অন্যতম ।
টিকিট কেটে লম্বা লাইন পার করে ভেতরে ঢুকলাম । সবার আগে টর্পেডো প্রকোষ্ঠ । তারপর একের পর এক আরো ছ’টি ঘর । অধিকাংশ ঘরেই নানান কলকব্জা (ছবি-১২ - এর নিচের বাঁদিকে) । রেডিও ট্রান্সমিটার ব্যাবস্থা । ক্যাপ্টেন এবং অন্যান্য আধিকারিক এবং নৌসেনাদের শোয়ার জায়গা । তাদের রান্নাঘর এবং খাবার ঘর । এ সবগুলির সাইজ এত ছোট যে আমাদের ওখানে থাকতে হলে আমরা নির্ঘাত বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসতাম (ছবি - ১২-এর ওপরের দুটি ) । আমাদের জল-সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা হওয়ার জন্য বোধহয় এই তথ্যগুলোই যথেষ্ট হবে যে, ৬৭ জন নাবিক-সেনা আর ৮ জন অফিসারের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র দুটি বেসিন এবং দুটি শৌচাগার । পঁচাত্তর জনের খাবার বানানোর দায়ীত্ব ছিল দু’জন নাবিকের ওপর । আর রান্নাঘরটির সাইজ - ৪ ফুট X ৬ ফুট । সবটা দেখে শুনে আমাদের দেশের বীর - সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল । প্রতিটা ঘরের বিভিন্ন বিষয় বোঝানোর জন্য উপস্থিত আছেন একজন করে রিটায়ার্ড নৌসেনা । সবটা দেখেশুনে অপূর্ব লাগলো । বেরোনোর ব্যবস্থা সামনের দরজা দিয়ে । বাইরে বেরোতেই চোখে পড়ল বঙ্গোপসাগরের ঘন নীল জলরাশি ! আবারও একবার মুগ্ধ হলুম তার রূপ দেখে (ছবি-১২ -এর নিচের ডানদিকে) ।
ওখান থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে গাড়ীতে উঠে চললাম আবার । এবার গন্তব্য কৈলাসগিরি । একটি পাহাড়ের ওপর তৈরী একটি মনোরম পার্ক । তার ওপরে আছে শিব-পার্বতির একটি বিশাল মুর্তি । আছে একটি ভিউ পয়েন্ট যেখান থেকে সমুদ্র এবং শহরের দৃশ্য অতি মনোরম । আছে সুন্দর বাগান, টয় ট্রেন আর কিছু দোকান । স্থানীয় আবহাওয়া অফিসটিও এইখানেই আছে ।
ওপরে ওঠার জন্য রোপওয়েও আছে । কিন্তু তাতে চড়তে গেলে যে পরিমাণ সিঁড়ি ভাঙতে হবে, সারা দিনের শেষে সেই সামর্থ্য আর ছিল না । তাই গাড়ী করেই পৌঁছলাম ওপরে । আমি গোড়াতেই গেলাম ভিউ পয়েন্টটিতে । এখানে ঠিক টাইটানিকের পোজে চবি তোলা যায় । তাই এর নামই টাইটানিক স্পট । আর তার ফলে দলে দলে লোকের নিজেদের ছবি তোলার আদেখলাপনা দেখতে দেখতে বিরক্তি ধরে যাচ্ছিল । যা হোক, অনেক কষ্টে কিছু ছবি তোলা গেল (ছবি - ১৩) । যদিও আলো তখন কমে এসেছে । দলের কনিষ্ঠ তিন সদস্য ছুটলো টয়ট্রেন চড়তে ।
ওপরে চড়লাম । শিব-পার্বতীর বিরাট একটি সাদা মুর্তি । সেখানে গিয়ে ছবি তুলবো কি ! ৪০/- টাকায় ছবি তুলে হাতে হাতে ডেলিভারি দেওয়ার জন্যে একগাদা ফটোগ্রাফার ভর্তি । সবচেয়ে ভালো ভিউ - বাগান সহ হর-পার্বতীর ছবি (ছবি-১৪) । আমি ক্যামেরা বাগিয়ে যেই না সে ছবি তুলতে গেছি, তারা এসে অনুরোধ করলো - একটু সরবেন দাদা ? একটা কাষ্টমার পাওয়া গেছে । বুঝলাম, ওই ভিউটা ওদেরও পছন্দের । সরলুম । আবার তুলতে গেলুম । আবার বাধা । বার তিনেক এমন হতে দুত্তোর বলে তাদের একটু রাগই দেখালুম । পরে মনে হলো - তাইতো ! আমি তো নেহাৎই একজন শখের ছবি তুলিয়ে । আর এই ছেলেগুলো ? সারা দিনে বেশ দশ বিশটা ছবি না তুলতে পারলে এ বেচারীদের ভাত জুটবে না । কিন্তু একটাই বিরক্তি যে শেষের দিকের ছবিগুলো তুলতে হলো কৃত্রিম আলোর ফোকাসের মধ্যে (ছবি-১৫) ।
পাহাড়ের ওপর থেকে ঝিকিমিকি আলো জ্বলে ওঠা ভাইজ্যাগ শহরটা এক ঝলক দেখে নিয়ে হোটেলে ফেরা । রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া দরকার । কারণ কাল সক্কাল সক্কাল বেরোতে হবে - গন্তব্য আরাকু উপত্যকা আর বোরা গুহা ।