প্রফুল্ল মামার দোকানে নানাবয়সের লোকেদের হাট বসত গল্পের; ফাঁকতালে গোটাকতক দুধেল কুলফি বাগিয়ে নিতে পারাই ছিল সে আমলের নির্মল বিনোদন। হুটহাট করে বয়াম থেকে এক আধুলির লজেন্স তখন উধাও হত বিনে পয়সায়। এলোমেলো আর রঙিন সব পিং পং বলের বিবর্ণ পাতা হুক থেকে ঝুলে থেকে সাক্ষী হত সেসব অর্থহীন রসালাপের। অবশ্য অর্থহীন গালগল্পই যে কেবল হত এমনটি ভাবা ভুল। আসর জমত দেশ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, অমুক-তমুক সংঘ নিয়ে। হরমাহিনা নিয়ম করে প্রফুল্ল মামার ফিরিজটা যেমন নষ্ট হয়ে যেত, তেমনি নিয়ম করে তে’তলার ঘরটায় আনাগোনা লেগেই রইত জ্যাঠামশায়ের।
জ্যাঠামশায় রাঙাদাদুর দিকে সবছোটর বড় জন। নির্ভেজাল আমিষভোজী তাঁর জন্য হাওড়ের টাটকা মাছ পরিবেশিত না হলে সে বেলা তিনি মৌন ব্রতে নিমগ্ন হতেন খ্যাপা শিবের মতন। সুন্দর সুঠাম দেহ, সফেন গোঁফ আর তার ওপরে ভোঁতা মতন নাক নিয়ে রাশভারি চলন ছিল তাঁর। ধোঁয়া ওঠা চায়ের বাষ্পে ‘প্যাসনেই’ চশমার ভারি কাঁচে এঁকে দিতাম হাসিমুখ দু’টো করে। সেই জ্যাঠামশায় গুড়ুকে গুড়গুড় আওয়াজ না তোলা পর্যন্ত এ বাড়িতে রাত নেমে আসত না কারো জন্য।
সে-বার তিনি মিস্তিরিপাড়া থেকে পৃথ্বীষ খুড়োর সংগ্রহে থাকা আঠেরো শতকের সুন্দর এক ল্যান্টার্ন খরিদ করে প্যাঁটরাসমেত বাড়িতে উঠলেন। সে এক দেখবার মতন ল্যান্টার্ন ছিল। অদ্ভুত নাম না জানা পাঁচটি রঙের এক চমৎকার মিশেল আর শরীরময় অসাধারণ কারুকার্যের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকলে সম্মোহনে বন্দী হতেন দর্শক। কেলসের বনে-বাঁদাড়ে এমন চিত্রকরদের খোঁজ মিলত কালেভদ্রে। অবশ্য চাঁদের পাহাড়েও যে এমন চিত্রকরের দেখা পাওয়া যায় না এমনটি বলা মুশকিল। কিছু বিষয়ে জ্যাঠামশায়ের কুসংস্কার ছিল তাঁর তরুণ বয়স থেকেই। এসবের কোনোটি আমাদের রাঙা ঠাম্মার কাছ থেকে, কোনোটি বা বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে গিয়ে শুনে আসা সংস্কার। অমঙ্গল আশঙ্কায় ঠাম্মা আমাদের ইষ্টদেবতাদের আসনের পাশে কোনো প্রকার আসবাবপত্র পছন্দ করতেন না। এই একটি ক্ষেত্রে জ্যাঠামশায় তাঁর নিয়ম ভাঙলেন। আসন থেকে একটুখানি দূরে দেয়াল ঘেঁষে রাখা হল সেই সুদৃশ্য বিদেশী ল্যান্টার্ন। তার মিহি রোশনাই ছড়িয়ে পড়ত ঘরজুড়ে, খাটের পায়ার ফাঁকে-ফোঁকড়ে, সুদূর ভেনিস থেকে বৌমণির আনা চৈনিক সেনাদের মুখচ্ছবি আঁকা সিরামিকের ফুলদানী পর্যন্ত।
প্রফুল্ল মামার সাথে তাঁর সখ্যতা গড়েই উঠেছিল এই অত্যাশ্চর্য ল্যান্টার্নকে কেন্দ্র করে। জ্যাঠামশায়ের শরীর তেমন ভাল যাচ্ছিল না বিধায় কিছুদিন পরপরই মামা এসে দেখে যেতেন তাঁকে। আর দেখতেন সেই সুদৃশ্য ল্যান্টার্ন। মামা মন থেকে সৌখিন ছিলেন বেশ; এ অঞ্চলে তাঁর পরিবার শিল্প সংস্কৃতিতে ভালই নামকরা ছিল বলতে গেলে। তবু পারিবারিক অর্থসংকটের কারণে বিলাসিতা বিষয়টিকে কখনো বাড়াবাড়ি করতে দেননি নিজেদের জীবনে। জ্যাঠামশায়ের সাথে গল্প করতেন বিভিন্ন সভ্যতায় গড়ে ওঠা শিল্প নিয়ে; বিভিন্ন বিহারে খুঁজে পাওয়া ভাস্কর্য নিয়ে। জ্যাঠামশায়ের এসব বিষয়ে ছিল অগাধ পান্ডিত্য। কারণ আর কিছুই নয়। তিনি পড়েছেন যেমন প্রচুর, ঘুরেছেনও ঢের। মামার সাথে তাঁর আসর জমতও বেশ। কাউচের প্রান্ত ধরে আমি দাঁড়িয়ে রইতাম; শুনতাম সুপ্রাচীন উপকূলবর্তী এলাকায় ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য গল্প-সব। ডালা ভর্তি পান আসত, চুন আসত, জদ্দা আর কাশ্মিরি সুপুরি পাঠাতেও ভুল হত না জ্যাঠিমার। নিজ হাতে সে ডালা সাজিয়ে পাঠাতেন এ ঘরে বীরেন কাকার মাধ্যমে। জ্যাঠিমা সম্বন্ধে যাই বলা হোক না কেন, তা প্রয়োজনের চেয়ে কমই হবে। নিখাদ এই ভাল মানুষটি আমার ফিরে দেখা শৈশবের এক অতি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জুড়ে ভেসে বেড়িয়েছেন। জ্যাঠামশায়-জ্যাঠিমার ভেতর যে অলিখিত দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল তা এ বাড়ির সকলেই অনুভব করতে পারতেন, অনুভব করতেন বাইরের লোক প্রফুল্ল মামাও। মুখ ফুটে কেউ এ বিষয় নিয়ে কথা বলেননি কখনো। মনে হত এই দূরত্ব, এই সবাক নিস্তব্ধতাই তো স্বাভাবিক। অবশ্য মাঝেমধ্যে তিনি স্বয়ং আসতেন জ্যাঠামশায়ের কাছে। শীতল সেই সাংসারিক আলাপ শেষ হলে পরে জ্যাঠিমা আমাকে নিয়ে ফেরত যেতেন এক তলায়, তাঁর নিজ ঘরে। ফেরার সময় তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে কুলকুল করে নেমে যেত নীল যমুনার নরম দুঃখ। বাঁ দিকে একটু হেলে নিয়ে আবার হাঁটা দিতেন ঘর বরাবর।
গতানুগতিক কাব্যের মতন করে এ বাড়ির নৈমিত্তিক কর্ম সম্পন্ন হত সতর্ক পাহারায়। পোষা ময়নাটা যেমন উড়ে যেত কার্নিশ থেকে কার্নিশে, তেমনি এক আবদ্ধ হাওয়া যেন এ বাড়ির সিলিং থেকে সিলিং এ আঘাত পেয়ে ফিরে আসত জ্যাঠিমার নরম দুঃখ সাঙ্গ করে। এইসব গল্প আমি জানতাম; আমি দেখতাম; আমি শুনতাম। যা ছিল অজানা তা নিতান্তই এক আয়নামানুষের গল্প। সবার ভেতরেই থাকে যে আয়নামানুষ, তাঁকে না যায় দেখা, না যায় ছোঁয়া। জনারণ্যে সে বেমালুম ছু মন্তর, কিন্তু নিভৃতে? জ্যাঠামশায়ের ভেতরকার আয়নামানুষ ত্রিসন্ধ্যে হলেই ঘরে বাহারি ল্যান্টার্ন জ্বেলে উঠে আসত অন্ধকার চিলেকোঠায় ভীরু পদক্ষেপে তাঁর শরীরে ভর দিয়ে; ধুনো জানলায় ঝুপ করে নেমে আসা রাতের পরিচিত সঙ্গী হিসেবে। কিসের যেন সংকোচ তাঁর! লোহার দরজার ওপাশটায় পা বাড়ালেই এদ্দিনকার জমে থাকা আবেগ দু’পাশে দু’ভাগ হয়ে যেত ঝলকানি দিয়ে। শরীরের একেকটা অংশ যেন ছিটকে পড়ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কোনোটা পুবে, কোনোটা নৈর্ঋতে, কোনোটা অন্য কোথাও। দিক সম্বন্ধে তাঁর সচেতন জ্ঞান না থাকায় বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে ভেঙে গড়ে জ্যাঠামশায় আর জ্যাঠামশায় হয়ে উঠতে পারতেন না সেসব রাতে। অস্পষ্ট গোঙানি চিলেকোঠায় প্রতিফলিত হত এবসার্ডভাবে, “time is fleeting! time is…!” অথচ দরজার ওপাশ তাকে চুম্বকের মতন আকর্ষণ করত প্রতিনিয়ত; কাছে টেনে নেবার ব্যাকুলতায় জ্ঞানশূন্য হয়ে চক্রাকারে ঘুরপাক খেত স্বচ্ছতোয়া আকাশটায়। ফাল্গুনের রি-রি করা হাওয়ার বিষাদের মতন সুতীব্র সুন্দর আকাশটা আর দেখা হত না তাঁর। অস্তিত্বহীনতায় ভোগা বাগানবাড়ির সদস্যরা একে অপরকে গাল-মন্দ করত পালাক্রমে কিংবা যুগপৎ। আশ্চর্যজনক হলেও এই কথোপকথন আয়নামানুষ বাদে এ তল্লাটের কেউ শুনতে পেত না। ভোর হলে পরে তিনি ফিরে আসতেন ঘরে; ততক্ষণে মায়াবী রোশনাই সারারাত্তির অপেক্ষমান দেবতাদের দিকে ভ্রান্ত কৌতূহল ছুঁড়ে দিয়ে নিবু নিবু; বেলি ফুলের খুশবুদার আতরের মেয়াদ উত্তীর্ণ হত এক গুচ্ছ ব্যক্তিগত প্রশ্ন নিয়ে। সকাল পেরোলে প্রফুল্ল মামার দোকানে হাট বসত গল্পের, যেমনটা আগেরদিন কিংবা তারও আগেরদিনে বসত; স্বাভাবিক আর সুনির্দিষ্ট।
ল্যান্টার্ন চুরি গেছে। আজ বহুদিন পর ক্লান্ত অরণ্যে জ্যাঠাবাবুর আকাশ দেখার পালা।
(Dhaka 2017)