উপহার, এবং বিশেষত এটির ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা
মারসেল মস্
[মারসেল মস্ (Marcel Mauss) প্রখ্যাত ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক। ১৯২৫ সনে তাঁর বিখ্যাত Essai sur le don. Forme et raison de l'échange dans les sociétés archaïques ("An essay on the gift: the form and reason of exchange in archaic societies") প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪, ১৯৯০ ও ২০১৬ সনে তিন দফায় ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। ফরাসি দার্শনিক জর্জ বাতাইয়ের মারফতে দেরিদা, বদ্রিয়ার প্রভৃতি উত্তর-আধুনিক ভাবুকদের যেমন এটি প্রভাবিত করেছে, তেমনি ডেভিড গ্রেয়বার সহ প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানীদের উপরেও এর প্রভাব বিস্তর। ছোট্ট অথচ তীব্রভাবে প্রভাববিস্তারী এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু নিয়ে বোধিচিত্তে ইতিপূর্বে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ডব্লিও. ডি. হাল্স (W. D. Halls) অনূদিত নব্বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ থেকে মস্-এর এই গ্রন্থটির ভূমিকার অংশটুকু যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন কাজী রবিউল আলম ও রাদিয়া আউয়াল তৃষা। অনুবাদকদ্বয় উভয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ান।]
সূচনালিপি/এপিগ্রাফ
স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়ান এড্ডার পুরনো কবিতার একটি থেকে কিছু স্তবক নীচে তুলে ধরছি।[i] এগুলো এই অধ্যয়নের সূচনালিপি হিসেবে কাজ করতে পারে, আমরা এখানে যা বলতে চাচ্ছি এগুলো সে সম্পর্কিত চিন্তা ও বিষয়বস্তুর আবহে পাঠককে দৃঢ়ভাবে নিমজ্জিত করে।[ii]
(৩৯) আমি কখনো এত উদার মানুষ দেখিনি
এবং তিনি তাঁর অতিথিদের আপ্যায়নে এত উদার
যেন ‘প্রতিদান গৃহীত হবে না’,
কোন মানুষই তাই… [বিশেষণটি এখানে অনুপস্থিত]
তাঁর দ্রব্যের
বিনিময়ে কোন কিছু গ্রহণ করা অসম্মানের ছিল তাঁর
কাছে[iii]
(৪১) অস্ত্র ও পোশাকসহ
বন্ধুরা অবশ্যই একে অপরকে আনন্দ দেয়;
প্রত্যেকেই এটি নিজে থেকেই জানে [তাঁর নিজ অভিজ্ঞতা থেকে]
যারা একে অপরের সাথে উপহার আদান প্রদান করে তাঁরা
দীর্ঘতম সময়ের জন্য বন্ধু থাকেন
যদি সবকিছু সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
(৪২) একজন অবশ্যই বন্ধু হবে
আরেকজন বন্ধুর,
এবং উপহারের বদলে উপহার দিবে;
একজনের অবশ্যই থাকবে
হাসির বদলে হাসি
মিথ্যার বদলে দুঃখ
(৪৪) দেখুন, আপনার যদি একজন বন্ধু থাকে
যার প্রতি আপনার আত্মবিশ্বাস আছে
এবং আপনি যদি ভালো ফলাফল পেতে চান
আপনার আত্মা অবশ্যই তাঁরটার সাথে বিলীন হতে হবে
এবং আপনাকে অবশ্যই উপহার বিনিময় করতে হবে
এবং প্রায়শই তাঁকে দেখতে যেতে হবে।
(৪৪) কিন্তু আপনার অন্যকেউ যদি থাকে
(হুবুহু উদ্ধৃত) যাকে আপনি অবিশ্বাস করেন
এবং আপনি যদি ভালো ফলাফল পেতে চান,
আপনাকে অবশ্যই তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে
কিন্তু আপনার চিন্তা অবশ্যই ভুল হতে হবে
আপনি অবশ্যই মিথ্যা বিলাপ করবেন।
(৪৬) এটিই তাঁর সঙ্গে চলার পথ
যার প্রতি তোমার কোন আস্থা নেই
এবং যার অনুভূতিকে আপনি সন্দেহ করেন,
আপনি অবশ্যই তাঁকে দেখে হাসবেন
এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা বলুনঃ
বিনিময়ে প্রদত্ত উপহারগুলো অবশ্যই সেরকমই হতে
যেমনটা গ্রহণ করা হয়েছিল।
(৪৭) মহৎ ও সাহসী মানুষেরা
সর্বোৎকৃষ্ট জীবন পায়;
তাদের কোন ভয়ই থাকে না
কিন্তু একজন কাপুরুষ সবকিছুতেই ভয় পায়ঃ
একজন কৃপণ সবসময় উপহারকে ভয় পায়।
ক্যাহেন (Cahen) ১৪৫ নম্বর স্তবকের দিকেও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনঃ
(১৪৫)’ ভিক্ষা না চাওয়াই ভালো [কোন কিছু না চাওয়া]
অতিরিক্ত কিছু ত্যাগ করার চেয়ে [ঈশ্বরের প্রতি]:
একটি প্রদত্ত উপহার সবসময় বিনিময়ে আরেকটি প্রত্যাশা করে।
কোন নৈবেদ্য না আনাই ভাল
এটিতে নিয়ে খুব বেশী ব্যয় করার চেয়ে।
কার্যক্রম
বিষয়টি স্পষ্ট। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সভ্যতায় এবং আরো অনেক জায়গায়তেই, উপহারের মাধ্যমেই বিনিময় এবং চুক্তিগুলো সম্পন্ন হয়; তাত্ত্বিকভাবে এগুলো ঐচ্ছিক, বাস্তবে সেগুলো বাধ্যবাধকতামূলকভাবে প্রদান ও পরিশোধ করা হয়।
বর্তমান মনোগ্রাফটি আরও বিস্তৃত অধ্যয়নের একটি একটি অংশ। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল তথাকথিত আদিম এবং প্রাচীন হিসেবে চিহ্নিত সমাজগুলোর বিভিন্ন উপগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চলমান চুক্তি সম্বন্ধীয় আইনী সংগঠন ও সর্বাত্মক অর্থনৈতিক পরিসেবা ব্যবস্থা উভয়ের উপর। এটি অনেক ধরনের জটিল বিষয়বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে। এগুলো এমনিতেই অনেক দুর্বোধ্য। আমাদের পূর্ববর্তী সমাজ এমনকি আরো পিছনের ইতিহাসপূর্ব সমাজের যথাযথ সামাজিক জীবন গঠনকারী উপাদানের সবকিছুই এর মধ্যে জড়িয়ে আছে। আমরা এগুলোকে ‘সর্বাত্মক’ সামাজিক প্রপঞ্চ হিসেবে অভিহিত করতে চাচ্ছি যার মধ্য দিয়ে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান যুগপৎভাবে অভিব্যক্ত হয়। এগুলো হচ্ছে— রাজনীতি এবং পরিবার উভয়ের সাথে সম্পর্কিত ধর্মীয়, আইনগত এবং নৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ; অনুরূপভাবে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানও যা উৎপাদন ও ভোগের বিশেষ ধরন বা অন্যভাবে বললে পরিসেবা ও বিতরণের সামগ্রিক কর্মকান্ডকে সম্পাদন করে। কিন্তু এটি এই ঘটনাসমূহ থেকে উদ্ভূত নান্দনিক প্রত্যয় এবং এই প্রতিষ্ঠান প্রতিভাত প্রত্যয়ের বহিরাবয়বগুলোকে বিবেচনার মধ্যে নেয় না।
এই সব সদা পরিবর্তনশীল জটিল বিষয় এবং বহু ধরনের সামাজিক ‘জিনিস’-এর মধ্যে থেকে আলাদা করে নিবিড়ভাবে শুধু একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে অধ্যয়ন করতে চাচ্ছিঃ যথা, এইসব সর্বাত্মক পরিসেবার ঐচ্ছিক চরিত্র যা আপাতদৃষ্টিতে মুক্ত ও স্বার্থহীন মনে হলেও আদতে বাধ্যতামূলক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এই ধরনের পরিসেবাগুলো সাধারণত উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। যদিও উপহারগুলো উদারভাবে দেওয়া হয়, এমনকি বিনিময়ের আচরণের ক্ষেত্রে কাল্পনিক নম্রতা, আনুষ্ঠানিকতা এবং সামাজিক কপটতা দেখা যায়, কিন্তু আদপে সেখানে বাধ্যবাধকতা ও অর্থনৈতিক আত্ম-স্বার্থ জড়িত থাকে। যদিও আমরা এই ধরনের প্রয়োজনীয় বিনিময়ের ধরন, তথা, সমাজের শ্রম বিভাজন আবির্ভাব হওয়ার পিছনের নানাবিধ নিয়ম-নীতিগুলো বিশদভাবে উল্লেখ করবোই, তবুও এগুলোর মধ্যে আমরা কেবল একটি বিষয় নিয়ে নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করবো। আদিম বা প্রাচীন সমাজের কি ধরনের আইনগত বা স্বার্থের নিয়ম গৃহীত উপহারের আবশ্যিক পরিশোধ করাকে বাধ্য করে। প্রদত্ত বস্তুর মধ্যে এমনকি ক্ষমতা আছে যার কারণে এর গ্রহীতা এর একটি প্রতিদান দেন। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে এই সমস্যাটির প্রতিই দৃষ্টি আবদ্ধ করে এগিয়ে যাব যেখানে অন্যান্যগুলোরও কথা উল্ল্যেখ থাকবে। অনেক ধরনের বিষয়ের যাচাই-বাছাই এর মাধ্যমে আমরা আশা করি এই সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো এবং এ সম্পর্কিত প্রশ্ন নিয়ে একজন কিভাবে অধ্যয়ন শুরু করতে পারে সে পথও নির্দেশ করতে পারবো। এর মধ্য দিয়ে আমরা কোন নতুন ধরনের সমস্যার দিকে ধাবিত হচ্ছি সেটিও দেখবো। এর মধ্যে কিছু আছে চুক্তিভিত্তিক নৈতিকতার স্থায়ী ধরন সম্পর্কিত, যথা কিভাবে বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত আইন আজও ব্যক্তি সম্পর্কিত আইনের সাথে যুক্ত হয়ে আছে তা নিয়ে। অন্যান্যগুলো সেই সব কাঠামো ও চিন্তা নিয়ে কাজ করে যা অন্তত আংশিকভাবে হলেও সবসময় বিনিময়ের কাজের উপর অধিষ্ঠান করেছে এবং এমনকি এখনো পর্যন্ত আংশিকভাবে হলেও যা ব্যক্তি-স্বার্থের ধারণাকে পরিপূরক করে।