মারসেল মস্-এর “উপহার”: বাজার অর্থনীতি ধারণার প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ
কাজী রবিউল আলম
একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যপথ
মারসেল মস্(Marcel Mauss) তাঁর উপহার(The Gift) বইটিতে বিভিন্ন সমাজে বিদ্যমান উপহার-প্রদানের ধরণ, অর্থ এবং কাঠামো সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। মস্ অন্য অনেকের মতো লক্ষ্য করেন যে একটি ব্যাপক সংখ্যক সমাজে — বিশেষত আর্থিক বিনিময় এবং আইনী কাঠামো বিহীন সমাজে—উপহার আদান-প্রদান পরিচালিত হতো কঠোর প্রথা ও অলিখিত আইন অনুযায়ী। মস্ তাঁর উপহার বইটিতে কিভাবে কখন উপহার প্রদান, গ্রহণ ও বিনিময় দেওয়া হবে সেই কাঠামোটিকে বিশ্লেষণ করেছেন এই কাঠামো পরিচালনার অন্তর্নিহিত ও অব্যক্ত কারণ সম্পর্কে বুঝবার জন্য। তিনি আরো দেখতে চেয়েছেন আধুনিক, পশ্চিমা সমাজে তাঁর এই বিশ্লেষণের প্রভাব কি থাকতে পারে। মস্-এর অনুসন্ধানে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে অনেক সংস্কৃতিতে উপহার-প্রদান একটি গুরত্বপূর্ণ কাঠামোগত শক্তি যা উপহারের আইনের মধ্য দিয়ে মানুষকে একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার জালে আবদ্ধ করে (Macat 2017:5)।
লেখক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মারসেল মস্ ১৮৭২ সালে ফ্রান্সের ভস (Vosges) শহরের একটি "রক্ষণশীল" ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মামা, এমেইল ডুর্খেইমকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের স্থপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডুর্খেইমকে ঘিরে তরুণ মেধাবিদের একটি দল গড়ে উঠেছিল, তাঁর মধ্যে মস্ নিয়োজিত হয়েছিলেন ধর্ম অধ্যয়ন করতে। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের ধাক্কায় দলটি ভেঙ্গে যায়; ডুর্খেইমের সন্তানসহ অনেকে মারা যান, এবং এরই শোকে কিছুদিনের মধ্যে ডুর্খেইমও মারা যান। ফলে উল্লেখযোগ্য বলতে শুধু মস্ই বেঁচে থাকলেন দায়িত্বটি কাঁধে তুলে নেবার জন্য।
কোন বিবেচনাতেই মস্ কখনই তাঁর এই দৃশ্যমান অর্পিত দায়িত্ব গুরত্বের সঙ্গে নেননি। অসামান্য পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও (সংস্কৃত, মাওরি এবং ক্ল্যাসিকাল আরবী ভাষা সহ তিনি কমপক্ষে এক ডজনের উপর ভাষা জানতেন), তাঁর মধ্যে একজন মহিয়ান প্রফেসরের ভারত্বের অভাব ছিল। একজন প্রাক্তন সৌখিন মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সামান্য বিষয় নিয়ে হাসিঠাট্টাপূর্ণ বলিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। কোন বড় ধরনের দার্শিনিক তত্ত্ব নির্মাণের চেয়ে তিনি নানা ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত ধারণা নিয়ে ‘ভেলকি’ দেখানো পছন্দ করতেন (Graeber 2013:2)। তিনি তাঁর জীবনে অন্তত পাঁচটি ভিন্ন ধরণের বই লেখার কাজ হাতে নিয়ে ছিলেন (যেমন প্রার্থনা, জাতীয়তাবাদ, অর্থের উৎপত্তি প্রভৃতি), কিন্তু কোনটির কাজ তিনি শেষ করেন নি। তা সত্ত্বেও একদল নতুন প্রজন্মের সমাজবিজ্ঞানীদের সফলভাবে দীক্ষা দিতে সমর্থ হন এবং বলা যায় একার হাতেই ফ্রান্সে নৃবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি তিনি অনেক অসাধারণ উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন যাদের প্রত্যেকটিকে একটি নতুন ধরণের সামাজিক তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করা যায়(Graeber 2013:3)।
মস ছিলেন একজন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক। ছাত্র জীবন থেকে তিনি সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং জীবনের বেশিরভাগ সময়ে ফরাসী সমবায় আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। প্যারিসে তিনি একটি ভোক্তা সমবায় আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বহু বছর ধরে তা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি প্রায়শই তিনি অন্যান্য দেশের আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্য সেসব দেশে মিশনে যেতেন (যার উদ্দেশ্যে তিনি বিপ্লবের পরে রাশিয়ায় সময় কাটিয়েছিলেন), যদিও মস্ একজন মার্কিস্ট ছিলেন না। কমিউনিস্ট এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাট উভয়েই ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে বলে তিনি মনে করতেন। কারণ উভয়েই বিশ্বাস করতেন সমাজ মূলত সরকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়। বরং তাঁর মতে সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিৎ ছিল সমাজতন্ত্রের আইনগত ভিত্তি তৈরী করা যা মূলত তলা থেকে বিকল্প প্রতিষ্ঠান তৈরী করার মাধ্যমে সম্ভব(Graeber 2013:3)।
রাশিয়ার বিপ্লব তাঁকে গভীরভাবে দ্বিধায় ফেলে দেয়। যখন একটি প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দেখে তিনি আনন্দিত হচ্ছিলেন, একই সঙ্গে বলশেভিকদের পদ্ধিতিগত সন্ত্রাস এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর তাদের দমন দেখে তিনি একইমাত্রায় ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন(Graeber 2013:4)। এটাকে মস্ প্রকৃত পক্ষে বাজার নিয়মেরই চেতনা বর্জিত যৌক্তিক হিসেবের শুধুমাত্র একটি সামান্য রূপান্তরিত রূপ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।
মস্-এর “উপহার” বইটি, রাশিয়ার এইসব ঘটনা বিশেষত লেনিনের ১৯২১ সালের অর্থনৈতিক নীতির শুধুমাত্র একটা প্রতিক্রিয়াই ছিলনা। লেনিনের অর্থনৈতিক নীতি পূর্বকার বাণিজ্য বিলুপ্ত করবার প্রচেষ্টাকে বাতিল করে দেয়(Graeber 2013:4)। এই প্রেক্ষিতে মস্ বলেন, রাশিয়ার মতো স্থান যাকে সর্বনিম্ন আর্থিক ইউরোপীয় আর্থিক সমাজ হিসেবে বলা যায়, সেখানে যদি বাজারকে অস্বীকার বা বাতিল করা না যায়, সেখানে বিপ্লবীরা আরও বেশী গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলেন তাহলে “বাজার” আসলে প্রকৃত অর্থে কী ছিল, এটা কোথা থেকে এসেছে, এটার কার্যকর বিকল্প রূপ কী হতে পারে। এই সময়টা ছিল সেসব ঐতিহাসিক ও নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলকে সামনে নিয়ে আসার যা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে সাহায্য করতে পারে। আর এটাই ছিল মারসেল মস্-এর “উপহার” বইটি লেখার প্রেক্ষাপট যা এই প্রশ্নগুলোর একটি যথার্থ উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে।
লেখক ও বৌদ্ধিক প্রেক্ষাপট
মস্কে মূলত তাঁর মামা এমেইল ডুর্খেইমের একজন বৌদ্ধিক উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে মস্-এর কাজকে দেখার একটা সহজ পথ হচ্ছে কিভাবে ডুর্খেইমের মতো একই বৌদ্ধিক সমস্যাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ডুর্খেইমের সমস্যা মূলত উদ্ভব হয় উনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি ও ব্রিটিশ পন্ডিতদের মধ্যে চলমান সামাজিক পরিবর্তনের গতিবিধি নিয়ে বিতর্ককে ঘিরেঃ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার উত্থান, ধর্মীয় সংহতি ও ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্বের পতন, প্রধান সামাজিক সম্পর্কের ধরণ হিসেবে বাজারের উত্থান (Graeber 2001:152)। আর এরই প্রেক্ষিতে মস্-এর “উপহার” বইটিকে সামাজিক চুক্তির একটি অনুসন্ধান হিসেবে পড়া যেতে পারে।
মার্শাল সাহ্লিনস্ বলেন যে, মস্ যে সমস্যাটিকে মোকাবিলা করছেন তা শেষ পর্যন্ত থমাস হবস্-এর কাছে ফিরে যায়ঃ তুমি কিভাবে মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপন করবে যেখানে একে অপরকে হত্যা না করবার তাৎক্ষণিক কোন কারণ নেই? (Sahlins 2017: 135)। হবস্ যুক্তি দেন যে, মানুষের অন্তহীনভাবে অধিগ্রহণযোগ্য প্রবণতাটা প্রদত্ত, কাজেই তাঁর প্রকৃতি হচ্ছে "সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ"; তখনই যথাযথ সমাজ শুরু হতে পারে যখন সকলে মিলে একটি সর্বময় রাজনৈতিক ক্ষমতা সৃষ্টি করতে রাজী হবে। প্রকৃত “সামাজিক চুক্তি” ছিল মানুষের শক্তি প্রয়োগের অধিকার ত্যাগ করতে সম্মত হওয়ার বিষয়, এবং এমন একটা অবস্থা তৈরী করা যেখানে মানুষ নিজের প্রয়োজন মতো যেকোন ধরনের সামাজিক চুক্তি করতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে যে যুক্তির ধারা সেইন্ট-সিমন হাত দিয়ে শুরু হয়ে হার্বাট স্পেন্সারে এসে শেষ অংকে পৌঁছে তা প্রস্তাব করে যে রাষ্ট্রের জবরদস্তির ভূমিকা চিরন্তন ছিল না, এবং মানব ইতিহাস দেখছিল সমাজগুলোর ভিত্তি কিভাবে সামরিক থেকে অর্থনৈতিক প্রতিযোগীতা এবং সেখান থেকে ব্যক্তিদের মধ্যে মুক্ত অর্থনৈতিক চুক্তিতে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হচ্ছিল। ডুর্খেইম তাঁর বেশীরভাগ সামাজিক তত্ত্বের কাঠামো দাঁড় করান স্পেনসারের চিন্তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেঃ যেমন, তিনি উল্লেখ করছেন, ব্যক্তিগত চুক্তির বিকাশ রাষ্ট্রকে দূরে সরিয়ে দেয়নি, বরং এটি এমনভাবে নাগরিক জীবনের উপর হস্তক্ষেপ করছিল যা আগে কখনো করেনি(Sahlins 2017: 136)। এরকম একটা বৌদ্ধিক পরিবেশ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কিভাবে “চুক্তির উৎপত্তি” একটা গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে।