scribbling

হাম দোনো

"অভীক, জলদি ঘুম থেকে ওঠ"

ফোনের ওপার থেকে চিৎকারটা শুনেই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম । ঘুমজড়ানো চোখে বিছানার পাশে রাখা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল সাড়ে ছ'টা । এত সকালে ফোনে এইরকম একটা চিৎকার শুনে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করতে করতেই আরেকটা চিৎকার ভেসে আসল,

"আরে এই, এখনও ঘুমোচ্ছিস নাকি ? ওঠ ওঠ, এদিকে বিপদ হয়ে গিয়েছে"

কথাটা কানে যেতেই একটু সজাগ হয়ে উঠে বসলাম । ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম, "হ্যালো, কি হয়েছে রে ?"

"অতকিছু ভেঙে বলার সময় নেই । কিন্তু না এলে আর দেখতে পাবি না ।"

এবারে ঘুমটা পুরোপুরি কেটে গিয়ে একটু ভয় হল । "কি হয়েছে একটু বলবি ? কোথায় আসতে হবে ?"

"অতকিছু ভেঙে বলার সময় নেই । তবে এখনই বেরিয়ে গেলে হয়ত একবার দেখতে পাবি ।" এই বলে অন্যদিকে ফোনটা কেটে গেল । এবারে সত্যিই একটু ভয় হল । শনিবারের বাজারে এত সক্কাল সক্কাল তো কেউ নিছক মজা করার জন্য ফোন করবে না । আর যে মক্কেল ফোন করেছিল, সে তো এতটা খেজুর করার পাবলিক নয় । অর্থাৎ শনিবার সকালের ঘুম বিসর্জন দিয়ে একবার সরেজমিনে দেখে আসতেই হচ্ছে, কারণ সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার কোন উপায় তো নেই । আর জায়গাটাও তো নেহাত কাছে নয়, সেই মীরা রোড । আর আমি থাকি খারঘরে । দু'বার লোকাল ট্রেন পাল্টে যেতে হবে, একবার ওয়াডালা রোডে, একবার আন্ধেরিতে । আর মাসের শেষ চলছে, তাই মেরু ক্যাব ভাড়া করতে গেলে মাসের বাকি দিনগুলো সালোকসংশ্লেষ করেই পেট চালাতে হবে । অগত্যা দুগ্গা-দুগ্গা করে বেরিয়ে পড়লাম ।


শনিবার বলেই ট্রেনে ভিড়টা একটু কম । খারঘর স্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে একটা বড়া পাও চেবাতে চেবাতে টিকিটটা কেটে ট্রেনে উঠলাম । টুকটুক করে হারবার লাইনের লোকাল এগিয়ে চলল । হঠাৎ খেয়াল পড়ল, কোন ওষুধপত্র সঙ্গে তো নেওয়া হল না, যদি দরকার পড়ে ? কথাটা মনে পড়তেই ফোনটা করলাম সেই পাবলিককে,

"ভাই, কোন ওষুধপত্র আনতে হবে নাকি রে ?"

ওদিক থেকে যে কথাটা ভেসে আসল, সেটা শুনে পিঠ দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, "কিছু লাগবে না, শুধু তুই চলে আয় । চারজন লাগবে তো, বুঝতেই পারছিস…" আমার মুখ দিয়ে কোন কথা সরল না । কথাটার মানেটা কি ? ওখানে আমার তিনজন বন্ধু থাকে, তাহলে কি তাদের মধ্যে কেউ - আর ভাবতে পারলাম না । যা হবে দেখা যাক ।


মীরা রোডে নেমে স্টেশনের গেটের দিকে এগোচ্ছি আর হাত-পা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে । রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটছি, আর ঠিক এমন সময় পিঠের উপরে একটা জোরদার চাঁটি, "কি মামা, সক্কাল সক্কাল মীরা রোডে হাজির হয়ে গেলে ?" আমি তাকিয়ে দেখি সেই ফোনের মক্কেল । আমি একটু থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কেসটা কি বলতো মামা ? কি হয়েছে ?"

"তুমি শালা মুম্বাই ছেড়ে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছো, আর তোমাকে কোন গিফট না দিয়ে কি করে ছেড়ে দিই বলতো মামা ?"

এবারে আমার অবাক হওয়ার পালা । "মানে ? এই যে সক্কাল সক্কাল ফোন করে বললি বিপদ, চারজন লাগবে…"

মক্কেল এবারে হো-হো করে হেসে উঠে বলল, "হে হে মামা, বিপদই তো । চারটে টিকিট কেটে রেখেছি, বেশি দেরি হয়ে গেলে শো-টা মিস হয়ে যেত তো ।"

এবারে আমার মাথায় প্রায় খুন চেপে যাওয়ার জোগাড় । "চ্যাংড়ামি হচ্ছে ? শালা সারা সপ্তাহ অফিসে মারিয়ে এই দুটো দিন একটু ঘুমাই, আর তুই সকালে -"

"চোপ শালা, এই নে, দেখ" বলে আমার হাতে একটা টিকিট ধরিয়ে দিল । আমি টিকিটটার দিকে ভাল করে দেখতেই আনন্দে প্রায় চোখে জল এসে যাওয়ার জোগাড় । প্রায় ১০ দিন আগে আমি এই মক্কেলকে এই সিনেমাটার ব্যাপারে বলেছিলাম, "মুম্বাইতে থাকতে থাকতেই এই সিনেমাটা হলে গিয়ে না দেখলে জীবনটাই বৃথা", আর সেই সিনেমার টিকিট আমার হাতে । আমি হাঁ করে টিকিটটার দিকে তাকিয়ে আছি, আর আমার সেই বন্ধু আমার কাঁধে হাত রেখে কানে কানে জিজ্ঞেস করল, "কি মামা, গিফট পছন্দ হয়েছে ?" আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠলাম, "জিও মামা, তুমি সবার সেরা ।"


অতঃপর, আমরা সবাই মিলে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে নামলাম PVR-এর সামনে । হলের বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে তাকিয়েছিলাম সিনেমার পোস্টারটার দিকে । বড়দিনের সাজসজ্জাকে ছাপিয়েও সেই পোস্টারের ছবিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল । রঙীন পোস্টারটার উপরে জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা ছিল:


Hum Dono (in color)

(Image Source: https://i.pinimg.com/originals/82/a5/fb/82a5fb6cd19039966b4f02fe5869e1fc.jpg)