scribbling

প্রশ্নের রকমফেরে

এ কি আর আজকের কথা মশাই। বেশ পুরোনো। সেই হাতেখড়ির পর থেকেই তো হয়েছিল এর সূত্রপাত। আজব রকমের সাধারণ সমস্যা জানেন তো। প্রথমে বাচ্চা জন্মানোর পরে কথা না বললে সমস্যা। আর কথা বলা শেখার পরে প্রশ্ন করলে সমস্যা। "এটা কি ? ওটা কি ? এটা কেন হয় ? ওটা কেন হয় ?" শুরুর দিকে একটু ঠিকঠাক উত্তর পেতে থাকলেও পরের দিকে "ওটা ঐরকমই হয়"-মার্কা উত্তরগুলোই আসতে শুরু করল। শেষে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবার হাত থেকে মুক্তি পেতে ভরে দেওয়া হল ইস্কুলে।


"যাক, বাঁচা গেল। এবারে টিচার বুঝবে আর নিজে বুঝবে। উফফ, জ্বালিয়ে খেয়ে নিয়েছিল একেবারে।" কথাগুলো খুব একটা অচেনা লাগছে কি ? না লাগাটাই স্বাভাবিক।


তবে বিপদটা বাড়ল ইস্কুলে যাওয়ার পর থেকেই। প্রথমেই শেখানো হল, শিক্ষক হল গুরু। তাঁর কথার উপরে কথা বলা যাবে না। তা তিনি গল্পের গরুকে গাছেই চরান, অথবা ল্যাম্পপোস্টে, নাহলে মনুমেন্টে। গুরু বলে কথা। তো, তেনাদের কথা, থুড়ি "বেদবাক্য" শুনতে শুনতে সবে বড় হ'ব-হ'ব করছি, দুম করে একদিন শুনে ফেললাম নচিকেতা-সুমন-অঞ্জন-শিলাজিৎ-দের গান। জীবনের গতানুগতিক প্রাত্যহিকতার মুখে সপাটে একটা বিরাশি সিক্কার চড় কষিয়ে তারা আমাকে ফেলে দিল অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি। বুঝলাম, হয়ত একেই বলে বড় হওয়া। জানতাম না, ব্যাপারটা ভুল ভেবে ফেলেছি। বড় হওয়ার আরও অনেক বাকি ছিল।


ঢুকলাম কলেজে। ক্লাসের শুরুতেই একটা বড় ধরণের বিপত্তি ঘটিয়ে ফেললাম। প্রশ্ন করে ফেললাম। সেই একটি প্রশ্নের জেরে আমার কলেজ জীবনটা জেরবার করে দিলেন আমার সেই প্রফেসর, এবং আমার বিভাগের অন্যান্য প্রফেসররা। যাই হোক, জানতে পারলাম যে কাউকে প্রশ্ন করলে তাকে ছোট করাও হ'তে পারে। পরিচয় হ'ল ডিপ্লোমেসির সাথে, যাকে সহজ বাংলায় বলা যায় "কূটনীতি"। আরেকটু বড় হ'লাম।


এবারে স্নাতকোত্তর পড়াশুনোর পালা। এখানে দেখলাম ব্যাপারটা একটু আলাদা। যেহেতু এই পড়াশুনোটা ছিল একেবারেই চাকরিভিত্তিক, তাই এখানে সমস্ত জিনিসকে প্রশ্ন করাটা ছিল আবশ্যক। তো পুরোনো আদল ভেঙে নিজেকে নতুন করে তৈরী করতে একটু সময় লাগলেও বিশেষ অসুবিধা হয়নি। বিভিন্ন পরিস্হিতিকে বিভিন্ন দিক থেকে পরীক্ষা করে দেখার বিষয়টাও এখান থেকেই শেখা। এই ব্যাপারটা চাকরির ক্ষেত্রেও পুরোদমেই বহাল ছিল। এমনকি ডক্টরেট করার সময় গবেষণার কাজেও তাই। তবে এই সময়টায় প্রশ্ন করবার কিছু উপায় শিখলাম। যতক্ষণ না প্রশ্নটা ব্যক্তিগত, অথবা অপ্রীতিকর, ততক্ষণ কিন্তু বিপদের কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যে মুহূর্তে প্রশ্নটা সেই সীমারেখার কাছাকাছি বিচরণ করতে শুরু করবে, তখনই প্রতি পদক্ষেপে বিপদের সম্ভাবনাও বাড়তে থাকবে। প্রাসঙ্গিকতা মাথায় থাক, যদি প্রশ্নটা সামনের ব্যক্তির বিশ্বাসকে আঘাত করে, তাহলে বিপদের পারদটা আরেকটু চড়বে। এবারে সামনের ব্যক্তির বিশ্বাসের ভিত্তিটাই যদি না জানি, তবে আমায় বাঁচায় কে? অতএব, প্রশ্নটা করতে হবে আরও চিন্তা করে, সবদিক ভেবে, আর সম্ভাব্য একটা প্রীতিজনক উত্তরের কথা ভেবে। আরেকটু বড় হ'লাম।


ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে গিয়েছে। এবং তার সাথে বাকস্বাধীনতার স্থানটুকুও আরও সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। কেউ সত্যি কথা বললে বিপদ, কার্টুন আঁকলে বিপদ, ফেসবুকে পোস্ট করলে বিপদ। এই রকম শ্বাপদসঙ্কুলতার মাঝে নিজের প্রাণ বাঁচাব, না প্রশ্ন করব? মাইরি যেদিকে যাই, সেই দিকেই অন্ধকার। অতএব, প্রকাশ্যে প্রশ্ন নিষেধ। বুঝলাম, বড় হয়ে গিয়েছি।


এখন তো বয়সটা আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়েছে, তাই আস্তে আস্তে বুঝতে পারি, অধিকাংশ বিচক্ষণ মানুষেরা চুপ করে থাকেন কি জন্য। যদিও আমি তাঁদের আর জিজ্ঞাসা করতে যাইনি। এই কয়েক বছর জীবনকালে এইটুকুই বুঝলাম যে প্রশ্নটা থাকে শুধু কাগজে-কলমে। কারণ, যখন সত্য আপনার সামনে আস্তে আস্তে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তখন দেখা যায়, "ঠিক-ভুল" "ন্যায়-অন্যায়" "বিচার-অবিচার" এই ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণ নির্ভর করে পরিপ্রেক্ষির উপর। সেটা আমার কাছে একরকম, অন্যজনের কাছে অন্যরকম। জীবনটা তো কেশবচন্দ্র নাগের কোন সাধারণ পাটীগণিতের অঙ্ক নয়, যেখানে প্রশ্ন করলে একটাই সঠিক উত্তর মেলে। এখানে প্রশ্নের উত্তর স্থান-কাল-পাত্র হিসেবে বদলায়, এবং সেই সবকটা উত্তরই সঠিক।


তাহলে মোদ্দা ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? মানুষের বয়সের সাথে প্রশ্নের তাগিদটা ক্রমশঃ কমে আসে। কারণ উত্তরটা না জানা থাকলেও প্রশ্নের ফলটা মোটামুটি আন্দাজ করে নেওয়া যায়। সুতরাং, ছোটবেলা হোক অথবা বড়বেলা, প্রশ্ন করলেই বাঁশ।


এই দাঁড়ান একটু, বস ফোনে প্রশ্ন করছে, "কাজটা কি আর এগোবে, নাকি অফিসে বসে ঘুমিয়েই কাটাবে? আর ছুটি নেবে কিসের জন্য? মাইনেটা কি এমনি এমনি দেওয়া হয়?"


বাপরে, একসাথে এতগুলো প্রশ্ন। কি বলি বলুন তো?

(Image Source: http://suitelife.com/wp-content/uploads/2015/05/No-Questions-400.png)