scribbling

প্রেম, হালিম, এবং পেঁপে

রোজার পবিত্র মাস রমজান । বছরের এই সময়টা আসতেই কেমন যেন প্রাণটা খাই-খাই করতে থাকে । আর কর্মসূত্রে হায়দ্রাবাদে থাকার দরুণ এই অভ্যেসটা একেবারে বাতিকের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল । আর হবে নাই বা কেন ? বাড়ির দরজার ঠিক সামনে একটি অনবদ্য বিরিয়ানির দোকান, "সুইটহার্ট রেস্তোরাঁ"। আর সে কি শুধু বিরিয়ানি ? সকাল ন'টায় অফিস বেরোনোর সময় দেখতাম মুরগি গায়ে হরেকরকম মশলা মেখে রোদ পোয়াচ্ছে, পাঁঠা ঘপাঘপ কিমা হয়ে যাচ্ছে, রুমালি রুটি আর পরোটার ময়দার সাথে কুস্তি চলছে জোরকদমে । আর সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফেরার সময় নাকে ভেসে আসত চিকেন আলফাহাম, কলমি কাবাব, কিমা মশলা, বিরিয়ানির স্বর্গীয় সুবাস । স্কুটি থেকে নামতে নামতেই হাঁক পাড়তাম, " চাচাজি, মেরে লিয়ে এক গরমাগরম বিরিয়ানি অউর আলফাহাম রখ দেনা । ম্যায় রাত কো নৌ বজে আকে লে জাউঙ্গা ।" এই ভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল আলফাহাম আর কলমিদের নিয়ে ।

 

চিত্তিরটা বাধল রমজানের সময়টা আসতেই । রমজানের প্রথমদিন সকালবেলা অফিসে বেরোচ্ছি, দরজাটা খুলতে বাইরে বেরোতেই নাকে এসে ধাক্কা দিল এক অপার্থিব সুবাস । আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য হকচকিয়ে গিয়ে ইতিউতি চাইছি, কিন্তু গন্ধের উৎসটা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলাম না । শেষে স্কুটিটা পার্ক করে সটান রেস্তোরাঁর মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, "চাচাজি, ইয়ে খুশবু কাহাঁ সে আ রহি হ্যায় ?" চাচাজি আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন, "বেটা, ইয়ে হালিম কি খুশবু হ্যায় ।"

"হালিম ? ইয়ে কেয়া হোতা হ্যায় চাচাজি ?" কৌতূহলের বশে জিজ্ঞেস করলাম ।

"ইয়ে হায়দ্রাবাদ কা শান অউর পেহচান হ্যায় বেটা ।" চাচাজি গর্বের সাথে বললেন ।

অনেকটা কৌতূহল আর জিবের গোড়ায় জল নিয়ে অফিসের দিকে পাড়ি দিলাম । স্কুটি নিয়ে রাস্তায় নামতেই আমার একেবারে অবাক জলপান দশা । বাড়ি থেকে অফিস অব্দি গোটা রাস্তাটা জুড়ে চারিদিকে শুধু হালিমের গন্ধ । জাগতিক ভাষায় সে গন্ধের বর্ণনা দেওয়া আমার সাধ্যাতীত । একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে অফিস পৌঁছলাম । একবার ভাবলাম, কাউকে জিজ্ঞেস করি এই হালিম জিনিসটা কি বস্তু । কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, নাহ থাক । ব্যাপারটা নিজেই উদ্ধার করব ।

 

অফিস থেকে সন্ধ্যেবেলা বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই মাথাটা ঘুরে গেল । রাস্তা জুড়ে গন্ধটা যেন মাত্রা ছাড়িয়েছে । অলিতে গলিতে গন্ধে যেন ভারী হয়ে গিয়েছে হায়দ্রাবাদের রমজান সন্ধ্যার বাতাস । আমি তো ভাবের ঘোরে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতেই বাড়ি পৌঁছে গেলাম । বাড়ি ঢুকতেই স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, "হ্যাঁগো, আজ সামনে কি বানাচ্ছে বলো তো ? মাথা খারাপ করে দেওয়া গন্ধ তো ।"

"ওরা তো বলল হালিম বলে একটা কিছু বানাচ্ছে ।"

"সেটা কি ?"

"তা তো জানি না ।" একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলাম, "তাহলে কি বল, একটা নিয়ে আসি ?"

"একদম ।  তবে জিনিসটা শুকনো হলে সাথে পরোটা এনো, আর ঝোল-ঝোল হলে বিরিয়ানি এনো," স্ত্রী হেসে বললেন ।

আমি আর কালবিলম্ব না করে সটান গিয়ে হাজির রেস্তোরাঁতে । "চাচাজি, এক হালিম দিজিয়ে ।"

"বেটা, চিকেন মে লোগে, ইয়া মাটন মে ?"

বাঙালি বলে কথা, পাঁঠার প্রতি প্রেমটা একটু বেশি তো হবেই । "মাটন মে হি দে দিজিয়ে চাচাজি ।"

"সাথ মে কেয়া লোগে বেটা ?"

এবারে আমি বিপদে । জিনিসটার চেহারাই তো কোনদিন দেখিনি । একটু আমতা আমতা করে বললাম, "চাচাজি, ইয়ে হালিম দিখতা ক্যায়সা হ্যায় ?"

চাচাজি একটু হেসে আমাকে একটা বড় ড্রামের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে নির্দেশ করলেন । ড্রামটার উচ্চতা আনুমানিক পাঁচ ফুট, পাশাপাশি চারটে রাখা আছে । একটু থতমত খেয়ে ড্রামটার দিকে এগোতেই পিছন থেকে চাচাজির বজ্রনির্ঘোষ ভেসে আসল, "স্যারকো হালিম চখা দো ।" সাথে সাথেই আমার হাতে ছোট্ট একবাটি হালিম ধরিয়ে দিল চাচাজির শাকরেদ । আমি কিছুক্ষণ জিনিসটাকে পর্যবেক্ষণ করলাম । এ তো না শুকনো, না ঝোল-ঝোল, ব্যাপারটা বেশ মাখোমাখো । আর সুবাস ? আহা । একটা চামচ তুলে মুখে দিতেই আবেশে চোখটা বুজে আসল । এ কি খেলাম ! এই স্বাদ থেকে এতদিন দূরে ছিলাম কি ভাবে ? এই সুরের সাথে সঙ্গত দিতে পরোটা বা বিরিয়ানি নয়, ভিন্নমার্গের বাদক লাগবে । পুরো বাটিটা চেটেপুটে শেষ করে চাচাজির দিকে ফিরে বললাম, "চাচাজি, চার রুমালি রোটি ।" সেই সুবাসিত অমোঘ পুণ্যলগ্নেই হালিমের সাথে আমার প্রেমকাহিনীর সূত্রপাত ।

 

তো রুমালি রুটিতে জড়াজড়ি করে আমার এবং হালিমের দিনগুলো বেশ কাটছিল । ইতিমধ্যে চাচাজির শাকরেদকে বিড়ি খাইয়ে তার কাছে হালিম বানানোর তালিমটাও নিয়ে ফেলেছি । এইভাবে হালিম এবং আমার প্রেমকাহিনী আস্তে আস্তে হয়ে চলেছিল গভীর থেকে গভীরতর, একেবারে মাখোমাখো ব্যাপার আর কি । কিন্তু প্রেমকাহিনীতে ভিলেনের আবির্ভাব তো অবশ্যম্ভাবী, না'হলে কি আর ক্লাইম্যাক্স জমে? অবশেষে একদিন আমার প্রেমকাহিনীতেও আবির্ভাব হ'ল এক ভিলেনের । রমজানের পরের মাসের মাঝের দিক থেকে পেটের ডানদিকে একটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হল । কোনদিন ব্যথাটা একটু বেশি, আর কোনদিন একটু কম । এইভাবে ৫-৭ দিন চলার পরে ভাবলাম এইভাবে ফেলে রাখলে কেস গ্যামাক্সিন হয়ে হতে পারে । তখন কলকাতায় বাড়ি এসেছিলাম একটা কাজে, ভাবলাম এই সুযোগে কোন এক ডাক্তারকে দেখিয়ে নিই । যেমন ভাবা, তেমন কাজ । ফোন করে নির্ধারিত সময়ে বাড়ির কাছেই এক প্রখ্যাত ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে হাজির হ'লাম । ডাক্তারবাবু পেট টিপেটুপে দেখে একটু গম্ভীরমুখে বললেন, " হমম, আল্ট্রাসাউন্ড করতে হবে ।" আমিও একটু ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "সিরিয়াস কিছু, ডাক্তারবাবু ?" "সেটা তো রিপোর্ট না দেখে বোঝা যাবে না । এই পাশের ক্লিনিকটা থেকে একটা আল্ট্রাসাউন্ড করিয়ে নিন । খালি পেটে এসেছেন তো ?" আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম । ডাক্তার মাথা নিচু করে প্যাডে লিখতে লিখতে বললেন, "বেশ । আমি লিখে দিচ্ছি, এখনই গিয়ে করিয়ে নিন ।" আমি প্রেস্ক্রিপশনটা নিয়ে ক্লিনিকে যেতেই আমাকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে পেটের উপরে আঁশটে গন্ধমার্কা জেলিটা মাখিয়ে ক্যামেরা ঘোরানো শুরু হ'ল । মিনিট পনেরো পরে হাতে রিপোর্টটা আসতেই "জয় কালী" বলে দৌড় মারলাম ডাক্তারবাবুর চেম্বারে ।

 

ডাক্তারবাবু হাতে রিপোর্টটা নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে দেখছেন আর চিন্তিত মুখে কিছু একটা ভাবছেন । তারপরে হাত থেকে রিপোর্টটা নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, "দিনে ক' বোতল মদ গেলেন ?"

এই অতর্কিত এবং অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে একটু হকচকিয়ে গেলাম । বিস্ময়ের সাথেই বললাম, "আমি তো খুব বেশি হ'লে ৬-৭ মাসে একবার ড্রিংক করি, তাও খুব বেশি না । অম্বল হয়ে যায় বলে একটু এড়িয়ে চলি । কেন বলুন তো ?"

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ডাক্তারবাবু গম্ভীরমুখে রিপোর্টটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পরের প্রশ্নটা করলেন, " থাকা হয় কোথায় ?"

"হায়দ্রাবাদে ।"

এবারে ডাক্তারবাবু একটু নড়েচড়ে বসলেন । " খাওয়ার রুটিনটা একটু বলুন তো ।"

"আজ্ঞে ?" ব্যাপারটা আমার ঠিক বোধগম্য হ'ল না ।

"আমি জানতে চাইছি আপনি গতমাসে কি কি খেয়েছেন । বিরিয়ানি, কাবাব, অথবা ওই জাতীয় কিছু খেয়েছেন কিনা, আর খেয়ে থাকলে কতবার খেয়েছেন একটু বিস্তারিত বলুন ।"

"গতমাসে হালিমটাই একটু খেয়েছি । অন্যকিছু তেমন খাইনি ।"

ডাক্তারবাবু আবার প্যাডে কিছু লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করলেন, "কতবার ?"

"এই ৫-৬ দিন ।"

"মাসে মোটে ৫-৬ দিন । তাহলে তো একটু –"  আমি ডাক্তারবাবুকে শেষ করতে না দিয়েই বললাম, "আজ্ঞে ওটা সপ্তাহে ৫-৬ দিন ।"

আমার উত্তরে ডাক্তারবাবু রীতিমত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, "সপ্তাহে ৫-৬ দিন করে হালিম খেয়েছেন ?"

একটু নির্লিপ্তভাবেই বললাম, "আজ্ঞে হ্যাঁ, দুপুরে আর রাতে ।"

"দিনে দু'বার করে ?" এবারে ডাক্তারবাবুর কথাগুলো অনেকটা আর্তনাদের মত শোনাল । আমি কিছু বলার আগেই উনি বলতে শুরু করলেন, "মশাই, আপনি কি মানুষ না ডাইনোসর ? একটু নোলাটা কমান, নাহ'লে মারা পড়বেন যে ।"

এবারে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম, "কেন ডাক্তারবাবু, কি হয়েছে ?"

ডাক্তারবাবু উত্তেজিতস্বরে বললেন, "কি হয়েছে ? নন-এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার বাধিয়ে বসে আছেন যে । এ তো সহজে সারবার জিনিস নয় । পাঁঠার চর্বি চোরের মত আপনার লিভারে বাসা বেঁধেছে, লিভ করার কোন লক্ষণ তো দেখছি না । বুঝেছেন ব্যাপারটা ?"

ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "তাহলে কি করব বলুন ?"

"এখন চিকেন-মাটন ভুলে যান । ক'টা দিন একটু পেঁপের ঝোল খান ।"

"পেঁপে ?" প্রায় ককিয়ে উঠলাম ।

"হ্যাঁ, পেঁপে । লোভে পাপ, পাপে পেঁপে । নাহ'লে এই লিভার নিয়ে বিপদে পড়বেন যে । ক'টা ওষুধ লিখে দিচ্ছি, সামনেই পেয়ে যাবেন । আর পেঁপের ঝোলটা আজ থেকেই শুরু করুন । মনে থাকবে তো ?"

মাথা নেড়ে নীরবে সম্মতি জানিয়ে ভিজিটটা দিয়ে ওনার চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসলাম । অনেক চিন্তা একসাথে ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার মধ্যে । মাটন ছেড়ে পেঁপে ? মানে লাল ছেড়ে সবুজ ? উত্তমকুমারকে ছেড়ে মহানায়ক দেব ? ক্রিস্টোফার নোলানকে ছেড়ে সিজিদ্দা ? মাইরি, এই পোড়া জীবনের আর সার্থকতা রইল কোথায় ?

 

চেম্বার থেকে একটু এগিয়েই বাজার । খানিক দরদাম করে দু'টো কাঁচা পেঁপে বগলদাবা করে হাঁটা লাগলাম বাড়ির দিকে । বাড়ি পৌঁছে দরজা খুলতেই স্ত্রী উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করলেন, "কি হয়েছে গো ? ডাক্তারবাবু কি বললেন ? আর হাতে পেঁপে কেন ?"

"সব বলছি," আমি একটু ধাতস্থ হ'তে হ'তে বললাম, "একটু জল দাও তো, গলাটা একেবারে শুকিয়ে উল্টোডাঙ্গা হয়ে গেছে ।"

স্ত্রী এক গেলাস জল হাতে দিয়ে বললেন, "এই শোনো, তুমি তো সকালে বেরোনোর আগে বললে যে আজ হালিম বানাবে । আমি ডাল, গম, আর মাটন ধুয়ে রেখেছি । তুমি মুখ-হাত ধুয়ে পেঁয়াজ-রসুনগুলো কাটাকুটি করে নিয়ে চাপাবে তো ?"

এই কেলো করেছে । সক্কালসক্কাল ডাক্তার, আল্ট্রাসাউন্ড, ফ্যাটি লিভার - সব মিলিয়ে হালিমের কথাটা মাথা থেকে বেমালুম হাওয়া হয়ে গিয়েছিল । আজ নিজেই তো বাড়িতে হালিম বানানোর তাল করেছি । এখন তো শিয়রে সংক্রান্তি, কি করি ? আকাশপাতাল ভাবছি, এমন সময় স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, "হ্যাঁ গো, ডাক্তারবাবু কি বলেছেন বললে না তো ?"

আমি একটু মাথা চুলকে বললাম, "ডাক্তারবাবু পেঁপে সেদ্ধ খেতে বলেছেন ।"

"ওমা কেন ?"

"লিভারে শ্যাওলা জমেছে ।" বলে টেবিলে রাখা পেঁপে দুটোর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে স্ত্রীকে পুরো ঘটনাটা বললাম । তিনি চোখ কপালে তুলে বললেন, "সব্বোনাশ । এখন কি করবে  ?"

মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, আমি ট্রেনের দরজায় হাত বাড়িয়ে ঝুলছি, আর প্ল্যাটফর্মে আমার হালিমের হাত শক্ত করে ধরে রয়েছে একটা দামড়া পেঁপে সেদ্ধ । অশ্রুসজল চোখে হালিম চিৎকার করছে, "বাবুজি, মুঝে জানে দো ।" ব্যাকগ্রাউন্ডে করুণ সুরে ম্যান্ডোলিন বাজছে, ট্রেন হুইসল দিচ্ছে । আমি আকুতিভরা চোখে আমার হাতটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছি । স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি মান্না দে গাইছেন, "এই কূলে আমি, আর ওই কূলে তুমি, মাঝখানে পেঁপে ওই কাঠি করে যায় ।" আর পারছি না ।

আমি আলগোছে মাথাটা সোফার উপরে রেখে বললাম, "পেঁপেদুটো হালিমেই দিয়ে দেব, সেদ্ধ হয়ে যাবে ।"

 

সিদ্ধ প্রেমকে কি কোনদিন সেদ্ধ পেঁপে আটকাতে পারে ? আপনারাই বলুন ।



প্রকাশিত: সববাংলায় [Link]