scribbling

কেস-মেস

রোজকার মতো আজও দুপুরের দিকটায় এক কাপ চা নিয়ে লাউঞ্জে বসে আছি, পাশে আরও ২-৩ জন অধ্যাপক আছেন । এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে আমাদের এক অধ্যাপকের আবির্ভাব । আমার পাশের চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়ে বলতে শুরু করলেন, "আর বলো না, আজকের ক্লাসে যেতে গিয়ে সে কি অবস্থা ।" আমি চায়ের কাপটা পাশে নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, "কেন কি হয়েছে ?"

"আরে সবে ক্লাসে ঢুকতে যাচ্ছি, এক মক্কেল পিছন থেকে কাঁধে হাত রেখে বলে 'কি গুরু, কেমন আছো বাওয়া' । আমি তার দিকে ঘুরে তাকাতেই সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে 'ও স্যার আপনি ! পিছন থেকে ঠিক ঠাহর করতে পারিনি ।' কি যাচ্ছেতাই অবস্থা মাইরি । শালা একটু হাইটটা কম বলে পাবলিক পিছন থেকে তাদের প্রফেসর বলে চিনতেই পারল না ।"

এই শুনে আমরা অনেকেই হো-হো করে হেসে উঠলাম । সত্যিই যাচ্ছেতাই অবস্থা । হাসতে হাসতে আমি চায়ের কাপটা আবার তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, "আপনাকে তো তবুও নিজেদের ব্যাচমেট বলে ভেবেছে । আমাকে তো একেবারে মেসের চাকর বানিয়ে দিয়েছিল ।"

"আরে বলো কি । কবে হল ?"

"এইতো গেলবার পুজোর সময় বাড়ি গেলাম, তখনই হল কেসটা ।"

"তাহলে আর কি, বলে ফেল দিকি কেসটা হালকা করে ।"

চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে শুরু করলাম ।


ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পরে তখন কলকাতায় চাকরি খুঁজছি, থাকতাম লেকটাউনে । আমাদের কলকাতার ফ্ল্যাটটা তখন প্রায় বন্ধই পড়ে থাকত বলে সেখানে আস্তানা গেড়েছি । আর আমার কিছু বন্ধু থাকত আমার ফ্ল্যাটের গলির ঠিক পাশের গলিতে একটা মেসবাড়িতে । তাদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরি খুঁজছে, আর কেউবা সদ্য চাকরি পেয়েছে । তো ফি সন্ধ্যেবেলায় আমি সেখানেই যেতাম আড্ডা মারতে । চা-সিগারেট মারতাম, সুখ-দুঃখের কথা হত । রাতের খাওয়াটাও প্রায়শয়ই সেখানেই সেরে ফিরতাম । প্রায় একবছর যাবৎ ওটাই ছিল আমার "সেকেন্ড হোম" । তারপরে তো পড়তে মুম্বাই বেরিয়ে গেলাম, সেখান থেকে চাকরি, বিয়ে, পিএইচডি, আবার চাকরি - এইসবের চক্করে কলকাতায় যাওয়াটাও কমে গেল । আর সেই মেসবাড়ির স্মৃতিগুলোও আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে আসছিল ।


তো বহু কাঠখড় পুড়িয়ে গেলবার পুজোতে বাড়ি গেলাম । তাও প্রায় পাক্কা ছ'বছর পরে, একেবারে ছেলেকে কোলে নিয়ে । তো বলাই বাহুল্য, মা-বাবা নাতিকে কাছে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন । তো ৪-৫ দিন পরে ছেলেকে নিয়ে বাড়ির কাছে একটা পার্কে ঘুরতে গেছি । সন্ধ্যে হয়ে আসছে দেখে ছেলেকে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরছি, হঠাৎ সেই মেসবাড়ির গলিটার সামনে এসে একবার দাঁড়ালাম । মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন আসল, 'এখনও কি কেউ ওখানে থাকে ?', 'পুরোনো আড্ডার ঠেকটা কি আগের মত আছে ?' এইসব ভাবতে ভাবতে গুটিগুটি পায়ে মেসবাড়িটার দিকে এগোলাম । এতবছরে বাড়িটার বহিরঙ্গে কিছু পরিবর্তন এসেছে বটে, তবে চিনতে কোন অসুবিধে হয়নি । সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে আমাদের সেই চেনা পুরোনো ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম । একটা ১০-১২ বছরের বাচ্চা মেয়ে এসে দরজা খুলে আমাকে আপাদমস্তক দেখে বেশ সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, "কাকে চাই ?"

আমি বুঝলাম যে এই মেসের পুরোনো বাসিন্দারা এখন আর কেউ নেই । কি ভেবে ওই মেসের সবচেয়ে পুরোনো বোর্ডারের নামটা উল্লেখ করেই জিজ্ঞেস করলাম, "আচ্ছা, এখানে আগে একটা মেসবাড়ি ছিল । সেখানে বাপ্পাদা বলে একজন থাকতেন । আপনি জানেন উনি এখন কোথায় থাকেন ?"

"না, জানি না । আপনি ওনাকে খুঁজছেন কেন ?"

"আমি তো কলকাতায় থাকি না । তাছাড়া ওনার সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি । উনি আগে যেহেতু এখানেই থাকতেন, তাই ভাবলাম যে আপনাদের কাছে ওনার নতুন ঠিকানাটা থাকতে পারে ।"


এটা শোনার পরে মেয়েটা যে কান্ডটা করল, সেটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না । মেয়েটা বাড়ির ভিতর দিকে মুখ করে চেঁচিয়ে বলল, "দাদু, একটা দাড়িওয়ালা লোক এসেছে বারমুডা পরে, কোলে বাচ্চা নিয়ে । আগে এখানে মেসে কাজ করত, এখন আবার কাজ খুঁজতে এসেছে ।"


আমি হাঁ, মানে একেবারে বেবাক লুডোর ছক্কার মত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি । একবার "আমি অর্থনীতির অধ্যাপক" কথাটা মাথায় আসলেও বুঝলাম যে এই পোশাকে এই কথাগুলো বললে খিল্লির চূড়ান্ত হয়ে যেতে পারে । তারচেয়ে মেসবাড়ির পুরাতন ভৃত্য হয়ে থাকাটাই আপাতত সম্মানজনক । আমি আড়চোখে একবার কোলে ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখি, সে ধুলোকাদা মাখা নিষ্পাপ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে ফোকলা হাসি হাসছে, কি যে বুঝেছে সেই জানে । হয়ত মনে মনে বলছিল, "কেমন আছো বাওয়া ?" আমি আর দাদুর অপেক্ষা না করে সেখান থেকে সটান হাওয়া, আর ওই চত্বর মাড়াইনি ।


প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, "এবারে বলুন তো, আপনার কি আমার থেকেও যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়েছে ?" 



প্রকাশিত: সববাংলায় [Link]